ফিঙের_ডানা পর্ব-৫

ফিঙের_ডানা
পর্ব-৫

বইটা না পড়ে শান্তি, না লুকিয়ে শান্তি। মাত্র একটা ঘর। কোথায় লুকাব? লুকানো অবস্থায় মা পেয়ে গেলে কী যে কান্ড করবে কে জানে! হয়তো বাড়িটাই ছেড়ে দেবে! আবার পড়াও যাচ্ছে না ঠিকঠাক। বইটা হাতে নিলেই যেন অলৌকিক মন্ত্রবলে কেউ না কেউ হাজির হয়৷ সামনে পড়তে সমস্যা নেই, কিন্তু কেউ যদি বলে দেখি বইটা তাহলেই সর্বনাশ! কাকের বাসার পুরো নামের সইটা জ্বলজ্বল করছে তার বিখ্যাত রিকশা উক্তির নিচেই।

এদিকে ৪৩২ পৃষ্ঠার মোটা বই। হুমায়ূন আহমেদের ‘বিরহগাঁথা’। চারটা উপন্যাস সংকলন৷ কষ্টেসৃষ্টে পড়ে শেষ করলাম এক সপ্তাহে। এসব না লিখলে আমি এত দ্রুত বইটা পড়তাম না। একটু একটু করে আরাম করে পড়তাম। এখন শীত কমে এসেছে। বিকেলবেলা রোদটা মরে এলে হালকা ঠান্ডার ভেতর এক কাপ চা নিয়েছে লেপের নিচে পা ঢুকিয়ে আরাম করে আধশোয়া হয় বই পড়ার যা মজা না! তার ওপর হুমায়ূনের এত ভালো চারটা গল্প! ইচ্ছে করে কাকের বাসাটার নাক ফাটিয়ে দিয়ে আসি।

এই এক সপ্তাহে সোহানের সাথে একদিনও দেখা হয়নি। ইচ্ছে করেই দেখা করিনি। ঘরেই থেকেছি বেশিরভাগ সময়। ওর বাড়িতে আসা যাওয়ার সময় ওদিকে একেবারেই যাইনি। লুকিয়ে দেখেছি, ছেলেটা প্রতিবার বাড়িতে ঢোকার সময়, বের হওয়ার সময় এদিক ওদিক তাকায়। মাঝে মাঝে অকারনে ফুলগাছের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি আড়ালে হাসি৷ সামনে যেতে লজ্জাও হয় ভীষণ। কেমন করে চোখের দিকে তাকাব?

বইটা পড়া শেষ হতেই সেটা বগলদাবা করে বিকেলবেলা রওনা হলাম লিলিদের বাড়িতে৷ ঢুকে দেখি লিলি ওর সাইলেকটা পরিষ্কার করছে৷ এই ক’দিনেই বুঝে গেছি, মানুষ নিজের শরীরেরও অত যত্ন নেয় না যত ও সাইকেলটার নেয়। লিলির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম ওদের বাড়ির পেছনে। এদিকে খানিক ঝোপঝাড়। তারপর ছোট একটা খেলার মাঠ। মাঠের পর পুকুর। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের কাছে পৌঁছে গেলাম। ঘাটটা শ্যাওলা জমে সবুজাভ হয়ে আছে। পুকুরটা নিয়ে কিছু গুজব আছে যার কারনে কেউ পানিতে নামে না। শীতের জন্য পানি কমে গেছে। কচুরিপানায় ভর্তি হয়ে আছে কালো পানি৷

ঘাটে বসে বইটা লিলিকে দিয়ে সবকিছু খুলে বললাম। লিলি প্রথমটায় হা করে সব শুনল। তারপর চোখ বড় বড় করে বইয়ের লেখাটা দেখল। এরপর হঠাৎই পেট চেপে খিলখিল করে হাসতে শুরু করে দিল। সে কী হাসি! থামতেই চায় না। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বলল, “তুই উনাকে কাকের বাসা ডাকিস, তাহলে উনি তোকে কী ডাকে?”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “আমি তো আর সামনাসামনি ডাকি না। মনে মনে ডাকি।”

“বাব্বাহ মনের কী টান!”

“এইটা মনের টান না ছাগল। আমরা স্কুলের স্যার ম্যাডামদেরও কত নাম দিতাম! তাদের সাথে কি মনের টান ছিল নাকি?”

“তাও ঠিক!”

“আর কাকের বাসা নামটা প্রথম দিনেই দিয়েছি। তখন তো এসব কিছু ছিল না।”

“কোন সব কিছু?”

“ফাজলামি করবি না একদম!”

লিলির আবার হাসি শুরু। বলল, “ফুচকা খাওয়া, নয়তো বই রাখব না।”

লিলিকে শেষ পর্যন্ত ফুচকা ঘুষ দিয়ে বইটা রাখতে দিলাম। পরে সুযোগমতো নিয়ে যাব। ফেরার আগে দেখলাম মিলি খালা ফোনে কথা বলছে খুব হেসে হেসে। লিলি জানাল, খালার নাকি বিয়ে ঠিকঠাক। হবু বরের সাথে দিনরাত প্রেম চলে। বাসায় ফেরার পুরোটা সময় মাথায় মাছির মতো ভনভন করতে থাকল একটা কথাই, একটা মোবাইল থাকলে আমিও কি সোহানের সাথে অনেক গল্প করতাম? কী বলতাম? ওর সাথ মিষ্টি করে প্রেমের গল্প? যাহ্ তাও হয় নাকি?

***
সকালবেলা তুসুর খোঁজ নেই৷ কোথায় গেল কুকুরটা? খু্ঁজতে খুঁজতে আমার কেঁদে ফেলার দশা, এমন সময়ে তুসুর ডাক শুনলাম বাড়ির পেছন দিক থেকে। ওদিকে দেখার কথা মনে হয়নি। তুসু গাছপালা ভরা জায়গায় সবসময় এড়িয়েই চলে। গিয়ে দেখি তুসুর গলার বেল্ট ধরে ওর পাশে বসে আছে সোহান। চুলগুলো আগের চেয়ে বড়। কপাল পুরো ঢেকে দিয়েছে। ফর্সা গায়ে কালো টিশার্ট ফুটে আছে৷ আমাকে দেখামাত্রই পূর্ন দৃষ্টিতে তাকাল সে। আমার তক্ষুনি চোখে পানি চলে এলো। লুকানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না।

সোহান অবশ্য কান্নার কারন ধরতে পারল না। বলল, “আরে আমি তো তোমার তুসুর কিছু করিনি। তুমি সামনে আসছিলে না তাই তোমার প্রিয় জিনিস কিডন্যাপিং করে তোমাকে আনতে হলো।”

“ডাকলেই হতো!”

“আসতে না তো। তাই কান টানলাম, মাথা হাজির!”

“আপনি অনেক খারাপ। দিন তুসুকে।”

“উহু, তা হবে না। মুক্তিপণ লাগবে।”

“কিসের আবার মুক্তিপণ? দিন বলছি!”

“জিম্মি করলে তাকে ছাড়াতে মুক্তিপণ দিতে হয়। সিনেমায় দেখোনি? বাচ্চাদের আটকে রেখে টাকা নেয়। জজ সাহেবের নাতনীকে জিম্মি করে রায় পাল্টে দিতে বলে….”

“উফ! আমি টাকা কোথায় পাব?”

“আমি কি টাকা চেয়েছি?”

“তাহলে?”

“চুমু খাও।”

“কিহ?” আমার গলায় কথা আটকে গেল। কান ঝাঁ ঝাঁ করতে শুরু করল। এটা কী বলল?

“চুমু খেতে বলেছি।”

“ছি!” বলে এক দৌড়ে ওর সামনে থেকে চলে এলাম। এবার আমার আরও বেশি কান্না পেল। বাড়ির কাছে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে সত্যি কেঁদে ফেললাম। এই ছেলে এত খারাপ কেন? তুসু একটু পর ছুটে এলো আমার কাছ। ঘাসের ওপর বসে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।

সোহান এলো আরেকটু পর। মুখের বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসছে। কাছাকাছি এসে বলল, “তোমাকে লজ্জা পেলে সুন্দর লাগে শিফা। তোমার লজ্জা পাওয়া একটা ছবি আঁকব বলে ওই কথাটা বলেছি। নইলে একটুও বলতাম না। বিশ্বাস করো!”

“আপনি যাবেন? অভদ্র কোথাকার!”

“এই জোরে চেঁচিও না প্লিজ। পরে বাড়ির লোক চলে আসবে। ভাববে আমি তোমাকে টিজ করছি ”

“তো আর কী করছেন আপনি?”

“আসলে তো আমরা প্রেম করছি।”

এত মেজাজ গরম হলো বলার মতো না। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “কে কার সাথে প্রেম করছে? ফাজালামি করার জায়গা পান না?”

“পেলে কি আর তোমার কাছে আসতাম?”

আমি চোখ বন্ধ করে বললাম, “আপনি যান তো!”

সোহান চলে গেল। যাওয়ার আগে খ্যাকখ্যাক করে গা জ্বালানো হাসি দিয়ে গেল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here