ফিঙের_ডানা
পর্ব-৭
ঘুম ঘুম একটা সকাল। মনে হচ্ছে ঝর্নার পাশে শুয়ে আছি। পাশে বড় একটা বেড়াল ওম দিচ্ছে আমায়। মাটির ভেজা ঘ্রাণ আর মিষ্টি একটা ফুলের সুবাস নাকে দোল দিয়ে যাচ্ছে বারে বারে।
সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে গেল মায়ের ডাকে। চোখ মেলে দেখি যা দেখছিলাম সেটা বাস্তবের অন্য রূপ। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টির এমন রিমঝিম শব্দ হয় জানা ছিল না। এটাকেই ঝর্নার শব্দ মনে হচ্ছিল৷ মিষ্টি ফুলের সুবাস বলে যেটা ঠাহর হচ্ছিল সেটা টমেটো পোড়ার গন্ধ! কী অদ্ভূত!
মা চলে গেলে জানালাটা খুলে দিলাম৷ এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথমবার বৃষ্টি দেখলাম। ফেব্রুয়ারির বৃষ্টি। শীতটা ধপ করে কমে যেতে যেতেই বৃষ্টির তোড়ে আবার জানান দিয়েছে আজ। রীতিমতো হাত পা কাঁপছে। জানালার ওপাশে একটা বিষন্ন সকাল ম্লান আলো নিয়ে উঁকি দিচ্ছে। বৃষ্টির বেগ খুব বেশি নয়। টিপটিপ করে পড়ছে। ঘাসের আবরনে মাটির দেখা নেই। তবে সোদা গন্ধটা ঠিকই ভেসে আসছে৷ ইচ্ছে করছে বাইরে চলে যাই। কিন্তু লেপের উষ্ণতা টেনে ধরে রেখেছে বিছানায়।
গতকাল থেকে সোহানের কথা ভেবে মন খারাপ। রাতে শুয়ে শুয়ে ভেবে নিয়েছি ওর কথা চিন্তা করা বন্ধ করে দেব। ব্যাপারটা খারাপ দিকে মোড় নেবার আগে এখানেই সমাপ্তি টেনে দিলে আর কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। ছোটবেলা থেকেই ঝামেলা জিনিসটাকে আমি বড্ড ভয় পাই। বরাবর চেষ্টা করি এড়িয়ে যেতে।
কী মনে করে যেন সকালবেলাতেই শীতের মধ্যে ঠান্ডা কনকনে পানি দিয়ে গোসল সেরে ফেললাম। কাঁপতে কাঁপতে এক কাপ চা বানিয়ে বসে গেলাম বারান্দায় টুলে। পাশেই অন্য ভাড়াটেরা কাজকর্ম করছে। আমি কথা কম বলি এটা সবাই এতদিনে বুঝে গেছে। তাই যেচে অতটা আলাপ করতে আসে না৷
চায়ের কাপের ধোঁয়ায় চশমাটা ধোঁয়াটে হয়ে এলো। সেই ঘোলা চশমা দিয়েই হঠাৎ দেখতে পেলাম কেউ একজন ছাতা মাথায় চপচপ শব্দ করে হেঁটে আসছে। আবয়বটা খুব চেনা। সে তো এদিকটাতে কখনো আসে না!
সোজা আমার কাছেই এলো সোহান। বলল, “আজকে বিকালে ফ্রি আছ?”
আমার মুখে কথা জোগাল না। মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, আছে।
সে বলল, “তাহলে বের হবে আমার সাথে। চারটায় রেডি হয়ে বাগানে দাঁড়াবে।”
“কিন্তু বৃষ্টি তো…”
“থাকুক সমস্যা নেই।”
আমি বেকুবের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে ফেরত গেল তক্ষুনি। কথাগুলো বলার সময় অন্য কোনোদিকে তাকায়নি। যেন আমি ছাড়া আশেপাশে কেউ নেই। সেটা খেয়াল হতেই পাশে তাকিয়ে দেখি সাহিদা চাচী তীব্র সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ঢোক গিলে চায়ের কাপে মনোযোগ দিলাম। ঘটনা খারাপ হলো না ভালো বুঝতে পারলাম না। তবে এই কাহিনী কোথায় গড়াবে ভেবে খানিকটা আশঙ্কায় বুকের কোণটাতে হিম ধরে এলো। যদিও তার চেয়েও অনেক বেশি ফুর্তি লাগছে। সোহানের সাথে ঘুরতে যাওয়া যাবে! তাও এইরকম আবহাওয়ায়!
***
সারাটা দিন আর কাটে না। প্রতি মুহূর্ত গুনে গুনে অবশেষে বিকেল হলো। তিনটা থেকে আমি রেডি হয়ে বসে রইলাম। আমার খুব ভালো জামা নেই। লাল সুতোর কাজ করা টিয়া রঙের একটা জামা, যেটা অনেকদিন পর্যন্ত পরিনি ভালো লাগত না বলে, আজ সেটাই পরেছি৷ বাকি কয়েকটা মাত্র ভালো জামা পরে ফেলেছি সোহানের সামনে। ছেলেটা কত স্মার্ট! কত কত ডিজাইনের টিশার্টগুলো পরে! হাতে সবসময় ঘড়ি থাকে। চোখে কালো চশমা ছাড়া বের হয় না। হালকা চাপদাড়ি রেখে দিয়েছে এখন। আরও ভালো লাগে তাতে। কপালের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো কী ভীষণ আদুরে! তার আশপাশে গেলে হালকা মাদকীয় সুগন্ধি কেমন মাতাল করে দিতে চায়! সব মিলিয়ে দেখার মতো!
এদিকে আমি, যাকে নিজেরই জংলি বলতে ইচ্ছে করে। লম্বা চুলগুলো তেল দিয়ে বেনী করে রাখি সবসময়। কোনেদিম পারফিউমের বোতল আমার ঘরে ঢোকেনি। জামাকাপড়ে ডিজাইনের বালাই নেই। সাদামাটার চাইতেও বেশি কিছু। ফেয়ার এন্ড লাভলি ক্রিমের বাইরে কিছু লাগানো হয় না মুখে। মেকআপের জিনিস পর্যন্ত নেই। আগে বাড়িতে থাকতে কোনো অনুষ্ঠান হলে চলে যেতাম বড় আপুদের কাছে৷ তাদের জিনিস দিয়ে সাজিয়ে দিত। আমার আগ্রহই ছিল না কোনেদিন। তাই এখন কিনতে না পারার আফসোসও নেই। মোটা ফ্রেমের চশমা কিনেছিলাম চেহারায় একটু সিরিয়াস ভাব আনতে। এখন মনে হচ্ছে এটার জন্যই বয়স পাঁচ বছর বেশি লাগে। সোহানের সাথে হাঁটলে লোকে নিশ্চিত আমাকে তার বড় বোন বলে চালিয়ে দেবে।
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম! হুশ ফিরতেই ঘড়িতে দেখি চারটা বাজতে মিনিট দুই বাকি। শেষবারের মতো আয়না দেখে বের হয়ে গেলাম। বের হতেই দেখি সাহিদা চাচী আর রাহেলা চাচী দু’জন আমারই ঘরের দিকে ফিরে বসে ফিসফাস করছে। নিশ্চয়ই আমার অপেক্ষায় ছিল। জিজ্ঞেস করল, “সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছ?”
আমি উত্তর তৈরি রেখেছিলাম। বললাম, “লাইব্রেরি দেখতে যাচ্ছি।”
আমাদের এলাকার পাশের এলাকাতেই বড় পাবলিক লাইব্রেরি আছে। সেটার বয়স হয়তো একশোর বেশি। নামকরা বলে সবাই চেনে। আমি অনেকদিন থেকেই যেতে চাইছিলাম। চাচীদের সামনে যাওয়ার কথা বলেও ছিলাম৷ কিন্তু নিয়ে যাওয়ার হতো কাউকে পাইনি।
সাহিদা চাচী বলল, “এখন কেন?”
“সোহান ভাই নিয়ে যেতে চাইল তাই। উনার আর সময় হবে না।”
“তোমার মা জানে? উনি না থাকলে আমরাই কিন্তু তোমার গার্জিয়ান। তুমি ছোট মানুষ। ভালোমন্দ বোঝ?”
“জি। মা-ই আমাকে বলেছে সোহান ভাইয়ের কাছে পড়াশোনা বিষয়ে সাহায্য নিতে। কলেজে ভর্তি হচ্ছি, তাই লাইব্রেরিটা চেনা দরকার।”
“এটাই তো? নাকি আরও কিছু আছে? সত্যি করে বলো। আমরা তোমার ভালোই চাই। এই বয়সে ভুল পথে পা দিও না।”
“না চাচী। সব ঠিক আছে।”
“আচ্ছা যাও। পরের বার কোথাও যাওয়ার আগে আমার থেকে পারমিশন নিয়ে যাবে।”
“জি আচ্ছা চাচী।”
উনাদের হাত থেকে মুক্তি পেতেই দ্রুত পা ফেলে বাগানে গিয়ে দেখি সোহানও আসছে মাত্রই। কালো জ্যাকেটের কারনে আরও ফর্সা দেখাচ্ছে। চুলগুলো আজই কেটেছে৷ কেমন বোচা বোচা লাগছে সেজন্য।
বৃষ্টি থেমে গেছে দুপুরের আগেই। এখন ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। আকাশ অবশ্য পরিষ্কার হয়নি। ধূসর মেঘের আড়াল থেকে সূর্যটা অনেক কষ্টে ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। সোহানের সাথে সাথে হেঁটে বের হলাম বাড়ির সীমানা থেকে।
এই এলাকাটা শহর নয়, আবার গ্রামও নয়। মফস্বলে শহুরে হাওয়া লাগছে। বড় বড় দালান উঠে যাচ্ছে। রাস্তাজুড়ে মানুষের ভিড়। তবুও শহরের মতো ন্যাড়া নয়। গাছপালা আছে ভালোই। তবে মানুষগুলো সব ব্যস্ত। কারো অন্যের দিকে তাকানোর সময় নেই।
আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরছে। আজকে সোহান আমাকে নিয়ে কেন বের হলো?
হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
সোহান সামনের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, “যেদিকে দু’চোখ যায়।”
“দু’চোখ কোনদিকে যাচ্ছে?”
“বোধহয় নদীর দিকে।”
আমার খুশিতে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে হলো। নাদীটা আসার দিন দূর থেকে দেখেছি। কী সুন্দর টলটলে পানি! ঘাট নৌকায় ভর্তি। ব্রীজ হয়নি বলে পারাপার নৌকা দিয়েই করতে হয়।
“কিন্তু সেটা তো দূরে।”
“হুম। চলো রিকশা নেই।”
আমরা পৌঁছে দেখি বাতাসের জন্য কয়েকটা নৌকায় পাল তুলে দিয়েছে। কত রঙ বেরঙের পাল! সুন্দর সুন্দর ছইওয়ালা নৌকা! যেন ওজন নেই কোনো। পানির ওপর দিয়ে ভাসছে সব। মনটা খুব ফুরফুরে হয়ে গেল। সোহান বলল, “নৌকায় উঠবে?”
“ওপাড়ে যাব?”
“না। শুধু ঘুরব।”
“আচ্ছা।”
আমরা ছোট দেখে একটা নৌকা নিলাম। শুধু আমরা দুজন উঠলাম। আজ বৃষ্টির জন্য মানুষজন কম। নইলে একা একটা নৌকা পেতাম না। সোহান আমাকে হাত ধরে যত্ন করে তুলে দিল। বসল আমার পাশেই। নৌকা চলতে শুরু করল। নদীর পানি আজ একটু বেড়েছে বৃষ্টিতে। স্রোতও আছে ভালোই। মাঝ নদীতে যেতেই মনে হলো বাতাসে উড়ে যাব। সাথে মনটাও উড়ে চলে যাবে কোথাও৷ নৌকার সাথে কয়েকটা জড়ানো কচুরিপানাও চলছে। দূরে সবুজ গ্রাম দেখা যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে মেঘ সরে শেষ বিকেলের হালকা রোদের আভাস দেখা দিয়েছে। তার মাঝেই চার রঙের রঙধনু উঠেছে। এত স্পষ্ট রঙধনু আমি জীবনে দেখিনি। মাথার ওপর দুটো চিল পাল্লা দিয়ে চক্কর দিচ্ছে। ঠান্ডা বাতাসে আমার ঠোঁট কাঁপছে তিরতির করে৷ সোহানের দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। কেন যেন মনে হলো মরে যাই। এই কয়েকটা মুহূর্ত কি কোনোভাবে আটকে রাখা যায় না? পৃথিবীটা থামিয়ে দেয়া যায় না কয়েক শতাব্দীর জন্য? আমি সোহানের হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললাম।
সে ফিসফিস করে বলল, “এইযে দেখছ স্নিগ্ধ প্রকৃতি, এত রঙ, এত রূপ, সবকিছু শুধু তোমার মুগ্ধ দৃষ্টির জন্যই সুন্দর হয়েছে। পৃথিবীটা কেন সাজে জানো? এই মানুষকে দেখানোর জন্যই। ওরা কালে কালে এভাবে সাজছে, নতুনত্ব কিছু নেই। সব সৌন্দর্য নতুন হয়ে ধরা দেয় মানুষের চোখে। চোখভরে দেখে নাও। জানি তুমি প্রকৃতি ভালোবাসো। আমি যতটা পারি, তোমাকে দেখাব। কথা দিলাম। তোমার মুগ্ধ চোখদুটো বড় ভালো লেগে গেছে যে!”
(চলবে)