ফেইরিটেল পর্ব-১০

0
1609

#ফেইরিটেল
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–10

তখনো ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেনি। গাড়ির ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেমন গুমোট, ভূতুড়ে ভাব। গা ছমছমে অবস্থা। ইমান খুবই সন্তপর্ণে নিশ্বাস ফেলছে৷ মিরা গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন। তার নিশ্বাসের উষ্ণতা ইমানের বুকে এসে আছড়ে পরছে৷ সে বেশ শক্ত করেই মেয়েটাকে নিজের বুকে আগলে রেখেছে।সে নাহয় সৌজন্যবশত তাকে নিজের বুকে জায়গা দিয়েছে তাই বলে কী, তাই বলে কী, তার বুকটাকে বালিশের সাবস্টিটিউট বানাতে হবে? হুহ!

আনমনে মিরার এলোমেলো চুলগুলোকে নিজের হাতের ভাঁজে গুজে নিল। ভীষণ সিল্কি চুল তার। সে গাড়ির ছোট্ট টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে দিল যেন সব পরিষ্কার দেখতে পায়। আচমকা তার মনে হলো, কোন দৃশ্যটা সে ক্লিয়ারলি দেখতে চাচ্ছে? মিরাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে চায় না তো সে? কিয়ৎক্ষণ পর পাখিদের আনাগোনা শোনা গেল। কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিত হলো চারপাশ। হালকা আলো এসে চোখে লাগলো। সম্ভবত মৃদু হাওয়াও বইছে। ইমান চুপচাপ বসে থাকলো। এরপর সোনালী আপুর নাম্বারে কল লাগায়৷ আপুও সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করে যেন তার ফোন কলের অপেক্ষায় ছিল৷

ইমান ফোন কানে নিয়ে বলে, আপু নিচে নামো ইরাকে নিয়ে৷

— মিরু কী করছে?

ইমান প্রশ্নটা শুনেই চোখ নামিয়ে একবার নিজের বুকে মাথা নত করে রাখা রমনীর দিকে তাকায়৷ রমনী তখন নিশ্চিত ঘুমে। সে যেন ঘুমরাজ্যের গ্রীনকার্ড প্রাপ্ত বাসিন্দা।

সে ছোট করে উত্তর দেয়, “আরামে ঘুমাচ্ছে৷”

— ওহ আচ্ছা৷ আমরা নামছি৷ তুই গাড়ি স্টার্ট দে৷

ইমান তড়িৎ গতিতে মিরাকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে কাত করে তাকে শুইয়ে দিয়ে।তখন সে ঘুমের মধ্যেই বিরক্তি প্রকাশ করে। যা দেখে ইমান হাল্কা হেসে ফেলে। এরপর নিজে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে। মুহুর্তের মধ্যে মনে হলো, বুকটা শূন্য হয়ে গেল। আরো কিছুক্ষণ সেভাবে থাকলে মন্দ হত না।

আপু মিনিট দশের মধ্যে ইরাকে নিয়ে নেমে আসলো। এরপর গাড়ি চলতে শুরু করে বাসার উদ্দেশ্যে।সবার মুখে-চোখে একটা চিন্তার ছাপ। যদি ধরা পড়ে যায়? যদিও তাদের ফুলপ্রুভ প্লান আছে তাও অচেতন মিরাকে নিয়ে যতো ঝামেলা৷ গাড়ি বাসার সামনে আসতেই সোনালী আপু প্রশ্ন করে, মিরু তো গভীর ঘুমে। ওকে বাসায় নিয়ে যাব কীভাবে?

ইরা অবশ্য কিছুই বুঝে পাচ্ছে না। হুট করে সোনালী আপু তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে বললো, এখন এই ভোরবেলা নাকী তারা বাসায় যাবে৷ অথচ আপুর ননদ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বলেছিল, তাদের জন্য নাকী সে সকালে ব্রেকফাস্টে কুকিজ বানাবে৷ এখন আবার মিরা আপু গাড়িতেই ঘুমাচ্ছে। ঘটনাগুলো তার কাছে সন্দেহজনক লাগছে। আপুকে জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না। সে গাড়ি থেকে নেমে গেল। ইরা আরো অবাক হলো যখন ভাইয়া নিজ থেকে মিরা আপুকে কোলে তুলে নিল। মানে আপুকে ডাক দিলেই তো পার‍ত৷ পারত না? আর আপুই বা এতো কেন ঘুমাচ্ছে যে একজন তাকে শূন্যে তুলে নিলেও ঘুম থেকে জেগে উঠবে না। সবকিছু কেমন রহস্যময় লাগছে তার কাছে৷

_________________________

মিরার যখন ঘুম ভাঙ্গল। তখন বেলা অনেক। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। অথচ সে ঘেমে-নেয়ে একাকার। ঘুমের মধ্যেই ঘেমে গেছে। উঠে বসতেই সে দারুণ আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখল। এই দৃশ্যকে হ্যালির ধূমকেতুও বলে যেতে পারে তাহলোঃ ইরা পড়তে বসেছে। তাও সোনালী আপুর বিয়ের দিন। উঠে বসার পর-পর সে অনুভব করব তার মাথা ব্যথা করছে৷ সে মনে করার চেষ্টা করল রাতে কী হয়েছিল? পার্টি থেকে বাসায় ফিরলো কীভাবে? কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলো না৷ তাই বাধ্য হয়ে ইরা ডেকে উঠে সে।

ইরা অমনোযোগী হয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। বোনের ডাক শুনেই বই বন্ধ করে দিল৷

সে চেয়ার ঘুরিয়ে বোনের দিকে ঘুম করে মুখ কালো করে বলে, কী?

— ঘটনা কী রে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ আমরা না পার্টিতে ছিলাম। বাসায় কি করে আসলাম?

ইরা ঠোঁট বাকিয়ে উত্তর দেয়, ঘুমিয়ে থাকলে জানবে কীভাবে?

মিরা ভ্রু কুচকে বলে, মানে?

ইরা বিরক্ত গলায় বলে, তুমি ঘুমাচ্ছিলে জন্য বেচে গেছো৷ বড় আব্বু জেনে গেছে আমরা ফুপুর বাসায় যাইনি৷ পরে আমাদের তিনজন কে নাস্তার টেবিলে জেরা করল। ভাগ্যিস ইমান ভাইয়া ছিল জন্য বেশি বকা খাইনি। ভাইয়া বলেছে গাড়ির ইঞ্জিন মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে জন্য সাহায্যের জন্য সোনালী আপু খুব ভালো এক ফ্রেন্ডেকে কল দিতেই জোর করে বাসায় নিয়ে গেল। ডিনার করিয়ে আর ছাড়ে না। রাতে সেখানেই থেকেছি। ওনার মা খুব রিকুয়েষ্ট করছিল থেকে যাবার জন্য। বড় আব্বু অবশ্য বকেনি৷ কিন্তু মা বকেছে। এইজন্য এখন পড়ছি।

মিরা ঠোঁট গোল করে, ও বলে। এরপর বলে কিন্তু আমি বাসায় আসলাম কীভাবে?

— ইমান ভাইয়া তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছে। এতো ঘুমাচ্ছিলে তুমি। এই পরিস্থিতিতে একটা মানুষ ঘুমায় কীভাবে? সোনালী আপু যখন ভোরে আমাকে ডাকল, ভয়ে আমার হাত জমে যাচ্ছিল।

ইরার কথায় গুরুত্ব দিল না আর সে। সে আপাতত অন্য চিন্তায় মগ্ন। ছাদের বেশিরভাগ কথাই তার মনে আসছে না। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সে কার কাছ থেকে পাবে? ইমান্ন?অসম্ভব! ওই ফাযিলকে সে কোনদিন কিছু জিজ্ঞেস করবে না৷

সে উঠে বসল। নিজের হাতের দিকে তাকায় সে।কি সুন্দর রাঙ্গা রঙ ধারণ করেছে! দেখলেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। সে দু’হাত নিজের নাকের কাছে এনে মেহেদীর ঘ্রাণ নিল। মেহেদীর গন্ধটা তার ভালো লাগে। লাল টকটকে দু’হাত ভর্তি মেহেদী দেখে তার নিজেকেই বধূ লাগছে। এতো গর্জিয়াস করে কেন আর্টিস্ট তাকে মেহেদী পড়িয়ে দিল? ইরার মেহেদী সে দেখেছে, খুবই সিম্পেল ডিজাইনে হাতের উল্টোপিঠে শুধু দেওয়া। অথচ তার হাতে একদম ব্রাইডাল ডিজাইনে মেহেদী দেওয়া। বিষয়টা অদ্ভুত।

আজ সকাল থেকে ব্যস্ততা যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। বিয়ের অনুষ্ঠান বিকেলে। আপু ইতিমধ্যে পার্লারে যাবে। তার সঙ্গে মিরাও যাবে। এইজন্য সে নিজের লেহেঙ্গা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে আপুর অপেক্ষা করতে লাগলো। সে জীবনে প্রথম পার্লারে গিয়ে সাজবে। এক্সাইটমেন্টে যেন সময় থমকে গেছে। ওমন সময় তার রুমের দরজায় নক হওয়ার শব্দ ভেসে এলো।

সে বলে উঠে, কে?

— এক কাপ চা বানায় দাও তো৷

আদেশকারীর কণ্ঠ শুনেই তার মেজাজ চটে গেল। সবসময়ই কী ব্যাটা তাকে দিয়েই কাজ করিয়ে নিবে? মানে কাজের সময় মিরা আর অন্যসময় ঘুরেও তাকাবে না।

মিরা দরজা খুলে দিয়ে বলে, পারব না৷

— তাহলে আমিও তোমাদের ড্রাইভারি করতে পারব না৷

— ড্রাইভার আংকেল কই?

— বড় মামার সঙ্গে বাজারে গেছে৷

মিরার মুখে কালো মেঘের আনাগোনা। সে দ্রুত যেতে ধরলে, ইমান বলে উঠে, আজকে লবণ দিলে খবর আছে কিন্তু।

মিরা ভেংচি কেটে রান্নাঘরে অগ্রসর হয়। মিনিট পনের পর সে যখন চা নিয়ে ইমানের রুমের প্রবেশ করে। তখন জনাব চুলে জেল লাগাচ্ছিল। মিরা দেখবে না দেখবে না করেও তিনবার তাকে পরখ করে নিল। এরপর চা টেবিলে রেখে চলে যেতে ধরলে সে বলে উঠে, দাড়াও৷

মিরা থেমে গিয়ে বলে উঠে, কি?

— চায়ে একটা স্লিপ দাও৷

— মানে?

— গতবার লবণ দিয়েছিলে এবার যদি বিষ দাও? কাজেই এবার তুমি আগে খাবে৷ এরপর পাচ মিনিট পর আমি খাব। চায়ে বিষ থাকলে এই পাচ মিনিটে নিজের জালে নিজে ফাসবা৷

মিরা দাতে দাত চেপে চায়ে স্লিপ দিল এবং সত্যি সে পাচ মিনিট দাড়িয়ে থাকল৷

ইমান চুল স্পাইক করে তার সামনে এসে দাড়ালো এবং চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে যেদিকটা দিয়ে মিরা চুমুক দিয়েছে সেই জায়গায় একটা স্লিপ দিয়ে বলে, একটু বেশিই মিষ্টি৷

— চিনি একদম ঠিক আছে। দু’চামচে মোটেও বেশি মিষ্টি হয় না৷

ইমান হাসলো। কিছু বললো না।

এরপর তারা সকলে অনুষ্ঠানে কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়৷ মিরা পার্লারে যায়। সেখান থেকে সোজা আপুর সঙ্গে কনভেনশন হলে সে পৌঁছে যায়৷ কনভেনশন হল তখন ফাকা৷ আপুর ফটোসেশান চলছিল। ওমন সময় একটা ফুলবিক্রেতা বাচ্চা এসে তাকে একটা গোলাপ এবং চিরকুট দিয়েই দৌড়ে যায়৷ মিরা হতভম্ব হলো তার কাজে। চিরকুট খুলতেই গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে লেখাঃ গোলাপটা কানে গুজে দিলে আরো বেশি সুন্দর লাগবে৷

মিরার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠে৷ কে হতে পারে এই ব্যক্তি! সে খোলা চুলের ভাজে গোলাপ গুজে দিল। তখনই আরেকটা বাচ্চা এসে আরেকটা চিরকুট দিয়েই ছুট লাগায়। সে পুনরায় অবাক হয়ে অতি আগ্রহ নিয়ে চিরকুটের ভাজ খুলে সেখানে বাংলা অক্ষরে লেখাঃ গলার ডান পাশের আদুরে তিল জোড়া যেন আর কেউ না দেখে। ইতি তোমার সিক্রেট লাভার৷

চলবে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here