ফেইরিটেল পর্ব-১২

0
1625

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–12

নগরী তখন ঘুমিয়ে আছে। সারাদিনের তপ্ত, গুমোট ভাবটা ক্রমশ কমে গিয়ে আধার রজনীতে হীম শীতল বাতাসের আবির্ভাবে পরিবেশ ক্ষণে ক্ষণে ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছে। মেঘে ঢাকা পরে গেছে চাঁদখানা। তির্যকভাবে সামান্য হলেও নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে চাঁদ মামা। জানালার কিনার ঘেঁষে লোহা দিয়ে বানানো শিকে হাত রাখল ইমান। শিকের গোড়ায় জং ধরে গেছে। পুরনো জানালায় মরিচা ধরে ক্ষত প্রায়৷

দূরে কোথায় কুকুরের দল ক্ষুধায় কান্না করছে। মৃদ্যু শব্দে সেই কান্নার আওয়াজ ভুতুরে লাগছে। পাশের গাছটার পাতা মড়মড় আওয়াজ তুলে মৃদু কম্পিত হচ্ছে৷ জানালা দিয়ে নাম না জানা ফুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণও ভেসে আসছে। সে ঠাওর করতে পারছে না কোন ফুলের গন্ধ এতো মিষ্টি? কালকেই খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে আশেপাশে কোনো ফুলের গাছ আছে কীনা। সে জানালার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি নিয়ে গেল একদম অসীমে। যেখানটায় আজ তারার হাঁট বসেছে। মিটমিট কিরণ দিয়ে তারারা হাসছে, খেলছে। দূরের নক্ষত্র থেকেও খানিক আলো বিকিরণ হচ্ছে!

সে একটা দম ফেলল। ঘুম আসছে না তার। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে তিনটা বাজে দশ মিনিট । বাংলাদেশ আসার সাত দিন অব্দি তার সমস্যা ছিল জেটলকের কারণে৷ ঘুম হতো না রাতে আর সারাদিন চোখে ঘুম খেলা করত। বহু কষ্টে জেগে থাকলেও দেখা যেত সে বিকেলের মধ্যে ঘুমে মগ্ন। আপাতত এই অভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তবুও আজ বিশেষ এক কারণে ঘুম আসছে না তার। কারণটা হলো আজ সে যেই রুমটায় অবস্থান করছে সেই রুমটা তার মায়ের। কোন এককালে মা এরুমে থাকতেন। তারপর সোনালী আপুর দখলে চলে যায় রুমটা। আজ আপুও চলে গেলে দ্বিতীয়বারের জন্য। রুমটা শূন্য হয়ে গেল৷ আপুর রুমেই আজ ইমান নিজের শোয়ার ব্যবস্থা করেছে৷ খাট-পালং নাকী আগের গুলোই আছে। একথা নানী তাকে জানিয়েছে। তবে পড়ার টেবিল আর আলমারি নতুন কেনা হয়েছে৷ মা যে বিছানায় একসময় ঘুমাতেন সেই বিছানায় আজ সে ঘুমাবে। ভাবতেই হৃদয়ে এক শীতল মন খারাপ হুহু করে প্রবেশ করছে৷ অথচ তার ভালো লাগার কথা ছিল!

বিকট শব্দে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলে সে চকিত দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। “জুই” ইজ কলিং লেখা দেখামাত্র মনের মধ্যে কেমন উত্থাল-পাতাল শুরু হলো। জুই কেন কল করছে তাকে? তাও এতো রাতে! অবশ্য সেখানে এখন রাত নয়৷ ইমান ফোন হাতে নিলেও রিসিভ করল না। সাইলেন্ট করে রাখল৷ ফোন কেটে গিয়ে আবারো রিং বাজল। সে নির্বিকার চিত্তে জানালা গলে মৃদ্যু চাঁদের আলো দেখায় ব্যস্ত। কী ভীষণ সুন্দর লাগছে জং ধরা সেই লোহায় জানালাটা৷

মায়ের স্পর্শ রাখা সবকিছুই কী সন্তানের কাছে শ্রেষ্ঠ? এই শিকগুলোয় মায়ের পরশ আছে। নানী তো বলেছেন, মা নাকী রোজ শিক ধরে দাঁড়িয়ে ওই দূরের রাস্তা দেখত। কী দেখত তা কেউ জানে না৷ কিন্তু মিনিটের পর মিনিট তার অতিবাহিত হত এই জানালার ধারে৷ মা নাকী প্রকৃতিপ্রেমী খুব!

ম্যাসেজের টোন কানে আসল। পুনরায় সে ফোন হাতে নিল। জ্বলজ্বল করে কৃত্রিম আলো তার চোখে এসে ধাক্কা খেল। ম্যাসেজে লেখাঃ কল মি ব্যাক এজ সুন এজ পসিবেল।

ইমান অগত্যা কল লাগায় সাত সমুদ্র তের নদী দূরের দেশ আমেরিকায়৷ মুহুর্তেই ফোন রিসিভ হলো। মিহি কণ্ঠে আমেরিকান এ্যাকসেন্ট নিয়ে সে বলে উঠে, হাই।

— হ্যালো। কোন দরকার?

মেয়েটা ফোনের ওপাশ থেকে আহ্লাদী কণ্ঠে বলে, আমার কী শুধু দরকারেই ফোন দেওয়ার অনুমতি আছে?

সে হাল্কা হেসে বলে, ঠিক তা না। কিন্তু ম্যাসেজটা এমনই ছিল যে দরকার আছে৷

— আমি বলেছিলাম দ্রুত কল দাও৷

— এর অর্থই তো জরুরি কিছু।

মেয়েটা ওপাশ থেকে চমৎকার শব্দে হাসল। এরপর বলে উঠে, ওই বাক্যের আরো অনেক মানে আছে মিস্টার খান৷

ইমান বুদ্ধি খাটিয়েও ধরতে পারল না, ওই বাক্যেটা আর কী কী অলটারনেটিভ অর্থ বহন করতে পারে। কিন্তু অসফল হলো সে।

জুই বলে উঠে, তুমি বাসায় নাকী একবারও কল দাওনি। এমন কী পৌঁছেও কল দাও নি। আংকেল জো ইজ ওরিড ফর ইউ। চিন্তায় আছেন। আজকে মিট হলো ওনার সঙ্গে। আমাকে ব্যাপারটা জানালো। সো আই কলড ইউ৷

ইমান হাল্কা হাসল। সে ভাবনাতেই আনেনি যে কাউকে জানাতে হবে সে ঠিকভাবে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে৷ তাকে নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই এটা সে খুব ভালো করেই জানে৷ তবুও বলে উঠে, আচ্ছা কল দিব। এনিওয়ে, ওদিকে সব ঠিক?

জুই রিনরিনে আওয়াজে বলে, ওনেস্টলি আই এম মিসিং ইউ।

সে যেন হোচট খেল। মিস ইউ শব্দটা তার বিরক্ত লাগে খুব। আজ অব্দি কাউকে এ”দুটো শব্দ সে উচ্চারণ করে শোনায়নি৷

ইমান নিশ্চুপ রইল। সে বলে উঠে, কাজের চাপ খুব৷ আমার মনে হয় তোমাকে দ্রুত নিউইয়র্ক ফিরে আসতে হবে। তোমাকে ছাড়া কাজ আগাচ্ছে না।

— ওখানে কোন সমস্যা হয়েছে কী?

— পাচজন ওয়াকার ছাটাই করা হয়েছে। নিউ ডিল সাইন করা হয়েছে কিন্তু প্রজেক্টের কাজ আগাচ্ছে না। আটকা পড়ে যাচ্ছে৷ আগামী আসেই প্রজেক্ট লঞ্চ করতে হবে। তোমাকে বুঝি দ্রুত ফিরে আসতে হবে৷

— দেখি৷

— তোমার কাজিনের বিয়ে কেমন হলো?

ইমান এবারে কিছু বলার মতো শব্দ খুজে পেল নিজ শব্দভাণ্ডার থেকে। সে স্নান হেসে বলে, খুব ভালো। আজকেই আপুর বিয়ে হলো।

— অনুষ্ঠান শেষ তাহলে?

— বলতে গেলে হ্যাঁ। মেইন প্রোগ্রাম শেষ। তবে ফিরানি বাকি আছে।

— ফিরানি কি জিনিস?

ইমান ভুলেই গিয়েছিল যে জুই বাংলাদেশী না। তার জানার কথা না, ফিরানির অর্থ৷

সে বলে উঠে, “ফিরানি বাঙ্গালী ঐতিহ্যর একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান। কন্যা কে শ্বশুড়বাড়ি পাঠানো হয়। এরপর প্রথম যেদিন বিয়ের পর মেয়ে নিজের বাবার বাড়ি আসে স্বামীসহ সেই দিনটায় ফিরানির অনুষ্ঠান করা হয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-ভাই গিয়ে মেয়েকে নিয়ে আসে বাড়ি।মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় জন্য ফিরানি৷”

— তোমাদের দেশের মেয়েরা কি বিয়ের পর আর নিজের বাবার বাসায় আসতে পারে না?

— পারে তো৷

— তাহলে ফিরানি কেন হবে? তার বাড়ি সে যখন ইচ্ছা আসবে। এখানে উৎসবের কোনো প্রয়োজন দেখছি না। সে তো আর মেহমান না৷

— অনুষ্ঠান তো অনুষ্ঠানই। এতো লজিক দেখে বাংলাদেশে কাজ হয় না। এখানে মুসলমানিতেও দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়৷

— বাংলাদেশ তোমার অনেক প্রিয় আর পছন্দের তাই না?

— হ্যাঁ।

জুই সুরেলা কণ্ঠে বলে, আর আমি?

ইমান কিছুটা ভড়কে গেল আচমকা আউট অফ টপিক কথা শুনে। সে কি বলবে ভেবে পেল না তাই প্রসঙ্গ পালটে বলে, আমি অনেক ক্লান্ত। আজ রাখছি। ঘুম পাচ্ছে প্রচুর৷

— গুডনাইট। তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি।

ইমান সত্যি সত্যি এবারে বিছানায় শুয়ে পরে ফোন কল কেটে দিয়ে। জুইয়ের সঙ্গে কথা বলার পর তার প্রচুর ক্লান্ত লাগছে। অবসাদ এসে ভর করছে শরীরে এবং মনের কোথাও যেন একটা অনুতপ্ত এবং একই সঙ্গে অপরাধবোধ কাজ করছে। জুইয়ের সঙ্গে কী সে অন্যায় করতে চলেছে? বাস্তবতা এতো বিষাক্ত কেন? সবকিছুই মুহুর্তের মধ্যে অসহ্য লাগতে শুরু করল৷ প্রচুন্ড মাথাব্যথা অনুভব করতে লাগলো সে৷ খুব করে বলতে ইচ্ছা করছিল, “আমার ফিরে আসবাব অপেক্ষা করো না” কিন্তু শব্দগুলো না বলা রয়ে গেল। সাহস সঞ্চার করে সে বলতে পারলো না৷

★★★

মিরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে। আপুর শ্বশুড়বাড়িতে তার ঘুম ভালো হয়েছে৷ এক ঘুমে রাত পার৷ সে একটা হাই তুলে বাথরুমে গেল। এরপর রুমের বাইরে পা রাখতেই দেখা মিলা রাকিবের। সে রাকিবকে দেখে সামান্য হাসল৷

রাকিবও বিনিময়ে হাসি দিল এবং বলল, তুমি যে এত কাদতে পার এটা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না৷

মিরা সামান্য লজ্জা পেল। সে আমতা করে বলে, আপুর জন্য কষ্ট লাগছিল৷

রাকিব আচমকা ছুটে গিয়ে তার জন্য এক কাপ চা এনে বলে, বেড টি!

চা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে মিরা চায়ের তরল অংশে ইমানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মাথাটাই গেছে নিজের। যেখানে সে নেই, সেই-খানেও আজ-কাল তাকে দেখা শুরু করে দিয়েছে৷

রাকিব বলে উঠে, আজকের দিনের মতো প্রতিদিন বেডটি সার্ভ করতে দিলে নিজেকে ভাগ্যবান ভাববো।

চলবে।

[ এখন থেকে রাতেই গল্প দিব। কারণ দিনে হারিকেন দিয়ে খুঁজেও আমাকে অনলাইনে পাওয়া যায় না। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here