#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
বোনাস পার্ট
সকাল-সকাল কিচিরমিচির পাখির কলকলানি আর সূর্যের তীর্যক কিরণে ইমানের ঘুম ভেঙে গেল। সে আড়মোড়া ভেঙে একটা হাই তুলে, পিটপিটিয়ে চোখ খুলে। অনেকদিন পর বেশ গাড় একটা ঘুম হলো তার৷ বেশ সতেজ লাগছে। সেই সাথে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ মন ভালো করে দিচ্ছে৷ সে উঠতে গিয়ে টের পেল তার মাথার কাছে কারো হাত। সে মাথা উচিয়ে তাকিয়ে দেখল, মিরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু তার একটা হাত ইমানের মাথায়৷ রাতে কী মিরা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল? আনমনে হেসে উঠে সে৷ কিন্তু সারাটা রাত এই পিচ্চির মেয়ে গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিল সে? মিরা তো অসুস্থ। তার ভার কীভাবে নিল? একবার ডাক দিলেই পারত৷ ইমান তো আর ঘুমাতে আসেনি এখানে৷ বরং মিরার সেবা করতে এসেছিল৷ কিন্তু হলো তো বিপরীতটা৷ মিরাই তাকে চুলে বিলি কেটে দিল। সেবা প্রদান করল৷ এবার সে বুঝলো কেন তার ঘুম এতো শান্তিময় হয়েছিল৷
ঘুমন্ত মিরার দিকে চেয়ে সে বলে উঠে, ” চুলে বিলি কেটে দেওয়ার জন্য কেউ পাশে থাকলে, জীবনটা অদ্ভুত সুন্দর লাগে।”
সে উঠে এক গ্লাস পানি খেয়ে গলা ভেজালো। বাংলাদেশের ওয়েদার খুব রুক্ষ্ম। এতো গরম লাগে। ফ্যানেও গরম ভাব যায় না। এসি দরকার সবসময়ের জন্য।
সে পানির গ্লাস টেবিলে রাখতেই মিরা জেগে যায়৷ ইমানকে দেখে সে উঠে বসে বলে, গুড মর্নিং।
ইমান মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে, “আজকের সকালটা সত্যি গুড।”
মিরা হাল্কা হেসে বলে, “আপনাকে মেয়ে পটোনার কোর্সে ফাস্ট ক্লাস দেওয়া উচিত।”
— “ইমান খান মেয়ে পটায় না। বরং মেয়েরা তার উপর ফিদা হয়।”
— “আচ্ছা তাই নাকী?”
— “জি, ম্যাডাম।”
মিরা নাক ফুলিয়ে বলে, “বিদেশি শর্ট ড্রেস পরা সুন্দরী ললনাগুলোর সঙ্গে মাখোমাখো ভাব আপনার তাই না?”
ইমান টিটকারি করে বলে, “তোমার জ্বলে নাকী?”
— “হ্যাঁ আমার অনেক জ্বলে। জ্বলে জ্বলে একদম ছাই হয়ে যাচ্ছি।”
— “এতো হিংসা ভালো না৷”
— “আপনিও হিংসা করা কমান। হুহ৷”
ইমান হতভম্ব হয়ে বলে, “আমি আবার কখন হিংসামো করলাম?”
মিরা নিজের চুলে হাত দিয়ে তা আংগুলের ফাঁকে এনে চুল আছড়ানোর ভঙ্গি করে বলে,” রাকিব আমার সঙ্গে কথা বললে আপনি মনে মনে জ্বলে কয়লা হন।”
ইমান চমকে গিয়ে তার দিকে চকিত তাকায়। তার ফেস এক্সপ্রেসন এমন যে মাত্র জুতা চুরি করতে গিয়ে জনগণের কাছে ধরা পড়েছে৷
এরপর সে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কিংবা প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বলে উঠে, “ডাক্তার মনে হয় রাউন্ডে এসেছে। উনি চেক আপ করুক একবার। এরপর রিলিজ দিলেই বাসায় যাব৷ আমি ডাক্তার সাহেবকে ডেকে আনাচ্ছি।”
মিরা হাসল শুধু। এই হাসির অর্থ হলো, ধরা পড়েছো জন্য পালাবার পায়তারা হচ্ছে৷
ইমান তাকে উপেক্ষা করে কেবিন থেকে বের হতেই, রাতের সেই নার্স আপার সঙ্গে দেখা। তাকে দেখামাত্রই নার্স আপা এমন ভঙ্গিমা করে হাসল। যে সে পুনরায় বিব্রতবোধ করে৷
নার্স বলে উঠে, “স্যার, রাত কেমন কাটলো আপনাদের? কোন অসুবিধা হইনি তো? ভাবী এখন কেমন আছেন?”
তার প্রশ্ন শুনে ইমান ভড়কে উঠে। নার্স এমন ভাবে প্রশ্ন করছে যেন সে হাসপাতাল থেকে না বরং বাসর করে বের হলো৷ কি একটা অবস্থা!
দশটার দিকে তারা দুইজনে নাস্তা সারলো। এরপর মিরার বড় আব্বু আজমল সাহেব এবং মিরার বাবা তালুকদার সাহেব হাসপাতালে আসলেন। ইমান তখন তাদের রেখে পাশ কাটিয়ে হাসপাতালের বাইরে প্রস্থান করে৷ এই প্রথম মিরার মনে হলো, ইমান কিছু একটা ইগনোর করে৷ তখন তার চেহারায় রক্তিম ভাব ফুটে উঠে৷ কিন্তু কী বা কাকে সে ইগনোর করছে ?
মিরাকে নিয়ে তার বাবা বাসায় রওনা দেয়৷ বড় আব্বু ইমানকে নিয়ে রিকশায় ফিরে৷ অথচ তাদের প্রাইভেট কারে ইজিলি চারজন বসা যায়৷ সে বাসা ফিরতেই মা আর ইরা তাকে জড়িয়ে ধরল। মা খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ালো৷
আজ শুক্রবার। এজন্য ইমান সরাসরি বড় আব্বুর সাথে নামাজ পরে বাসায় ফিরল। দুপুরে রান্না-বান্নার আয়োজন ভালোই। উৎসব-উৎসব আমেজ৷ বাসার সবার মধ্যে একটা চঞ্চল ভাব যেন। ইরা মিটমিট হাসছে। মাও বেশি উত্তেজিত। ইমানের খাতেরদারি কয়েক স্কেল বেড়ে গেছে। দাদীও আজ সবার সঙ্গে খেতে বসেছেন। সেও খুশি৷
দুপুরে খাওয়ার পর ইরা আর সে রুমে ফিরে যায় রেস্ট নেওয়ার জন্য। ওই সময় সুপ্তি বেগম তার মেয়েদের রুমে আসেন৷ মাকে আসতে দেখেই ইরা অদ্ভুত ভাবে হেসে বেরিয়ে যায়৷
সুপ্তি বেগম একটা লাল কাজ করা শাড়ি মিরার সামনে এনে বলে উঠে, শাড়িটা কেমন রে?
— খুব সুন্দর।
এবার তিনি দুটো সোনার বালা আর একটা বড় সীতাহার বের করে বলে,” এগুলো পড়লে তোকে মানাবে খুব৷”
মিরা চকিত উঠে বলে, এইসব বিয়ের শাড়ি-গহনা কেন আমি পড়ব?
সুপ্তি বেগম তার মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলে, “আমি তো মা। সব কথা মুখে বলতে পারিনা। তোর সোনালী আপু আসুক। ও তোকে সব বুঝিয়ে বলবে।”
সুপ্তি বেগম চলে যেতেই মিরা চিন্তায় পরে যায়। কি এমন হতে চলেছে? আচমকা ফোনের রিংটোনে তার ঘোর কাটে। সে দেখল রাকিব কল দিচ্ছে৷ সে ফোন রিসিভ করে।
অপর প্রান্ত থেকে রাকিব বলে উঠে, “শুনলাম তোমার নাকি এক্সসিডেন্ট হয়েছিল। মিরা আই এম সর্যি। আমার জন্য তোমার বিপদ আসলো। ওসব কথা না বললে হয়তো তুমি আমার সঙ্গেই থাকতে৷ এমন বিপদ আসত না।”
মিরা শান্তসুরে বলে, “ইটস ওকে। তোমার দোষ নেই। দুর্ঘটনা তো বলে-কয়ে আসে না৷ আর আমি একদম ঠিক আছি৷ ফোন দিয়ে খবর নিয়েছো জন্য ভালো লাগলো।”
— “মিরা আমি তোমাকে কীভাবে বোঝাব সত্যি আই ফিল ফর ইউ……. ”
–” ওই টপিকে কথা বলতে চাইছি না। রাখছি৷”
রাকিবের ফোন রেখে সে বারান্দায় গিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকলো। বিকেল হওয়া দেখল। গুনগুনিয়ে কিছুক্ষণ গান গাইলো৷
সন্ধ্যার আগে বাসায় বেশ কয়েকজন গেস্ট আসল। ফুপু আসলেন পরিবারসহ। তাদের দুরসর্ম্পকের এক দাদা এবং এলাকার তিনজন মুরুব্বিও আসলো। মা প্রচুর ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সবাই এসে এসে মিরার খোজ নিয়ে গেল। সন্ধ্যার পর আসলো সোনালী আপু। এসেই আপু একদন্ড অপেক্ষা না করে মিরাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগে৷
সে ঘাবড়ে গিয়ে বলে, আমি শাড়ি পরব না এখন আপু৷
সোনালী আপু অবাক হয়ে বলে, “দুইদিন আগে যখন গ্যাদা বাচ্চা ছিলি প্রায় বিকেলে শাড়ি পড়ায় বউ সাজিয়ে দাও আপু– বলে বলে আমার মাথা খেতি আর আজ নিজ থেকে পরিয়ে দিতে চাইলাম এজন্য মানা করে দিলি!”
মিরা সামান্য হাসল। ছোটবেলায় তার বউ সাজতে খুব ভালো লাগত এইজন্য সোনালী আপুর কাছে বায়না ধরত। আপু এখনো এসব মনে রেখেছে। সে বলে উঠে, ” তখন বাবু ছিলাম।”
আপু হেসে বলে, আমার কাছে তুই বাবুই থাকবি সবসময়।
আপুকে আর সে বাধা দিল। আপু সুন্দর করে লাল শাড়িটা পরিয়ে দিয়ে সেভটিপিন লাগিয়ে দিল৷ মিরাকে আয়নার সামনে বসিয়ে আদুরে গলায় বলে, ” আজকে সত্যিকারের বউ সাজিয়ে দেই তোকে?”
মিরা চোখ বড় করে তাকালো আপুর দিকে যেন সে কিছুই বুঝতে পারেনি। আপু তার গলায় সেই সীতাহার পরিয়ে দিয়ে বলে, “ইমান কিন্তু খুব ভালো একটা ছেলে। নিজের ভাই জন্য গুনগান গাইছি না। তোরা সুখে থাকবি দেখিস।”
মিরা চুপ হয়ে গেল। এই দিনটা যে আসবে এটা সে জানত। কিন্তু এতো জলদি কেন এসে গেল দিনটা! সে বলে উঠে, ” উনি রাজী হয়েছেন অবশেষে?”
–” রাজী তো হয়েছিল সেইদিন-ই যেদিন আব্বু, ছোট চাচা আর দাদী মিলে বৈঠক বসালো। তবে বিয়ে করতে চাচ্ছিল না এতো জলদি৷ কাল তোর এক্সসিডেন্ট হলে, দাদী ভেঙে পড়ে একদম। জানিস তো, দাদী তোকে খুব ভালোবাসে৷”
— দাদী উনাকে দ্রুত বিয়ে করতে রাজী করিয়েছিল গতকালকে তাই না?
— “হু”
— ” এইজন্য জনাব আমার খেয়াল রাখার জন্য রাতে থেকে গেল?”
— হ্যাঁ রে।
— “আজকে কী বিয়ে পড়ানো হবে? মানে আকদ হবে আমাদের? ”
— “বড়রা তাই চাচ্ছে। ইমানের আপত্তি নেই। এখন তোর অনুমতি থাকলে আজকেই কাজী ডেকে আকদ পড়িয়ে ফেলবে৷ ”
মিরা স্নান হেসে বলে,” বউ সাজানোর পর বিয়ে করব কীনা জিজ্ঞেস করছো?”
সোনালী আপু পালটা প্রশ্ন করে, আগে জিজ্ঞেস করলে মানা করতি?
মিরা দুম করে শ্বাস ছেড়ে বলে, জানি না। কিন্তু আমি প্রস্তুত নই৷”
আপু তার হাতে বালা পরিয়ে দিয়ে বলে, “পরীক্ষা আর বিয়ের জন্য কোন ক্যান্ডিডেটই প্রস্তুত থাকে না। যতোই প্রিপারেশন নিবি মনে হবে কিছুই পারবি না৷ কিন্তু একবার হলে গিয়ে প্রশ্নপত্র পড়লে একে একে সব মনে পড়ে যায়। বুঝলি? একবার কবুল বলে দেখ, সংসার-জীবন, স্বামীর জন্য মায়া পড়ে যাবে৷ আমি তো চার বছর প্রেম করেও কবুল বলার টাইমে সেই নার্ভাস হলাম। এখন কিন্তু ঠিকই তোর দুলাভাইয়ের জন্য মন কেমন করে সবসময়ই।”
মিরা ডাগর চোখ মেলে তাকিয়ে বলে,” তোমার যোগ্য পদ্মের মতো ভাইয়ের জন্য আমি হলাম গোবর।”
আপু বলে,” তুই ওর যোগ্য না হলে এই দুনিয়ায় ওর জন্য আর কোন মেয়েই যোগ্য নয়৷”
— ওর সাথে কথা বলতে চাই। এরপর সিদ্ধান্ত নিব৷
সোনালী আপু বলে,” বেশ তবে তাই হবে।”
আপু বেরিয়ে গেল। মিরা একা বসে রইল চুপচাপ। গতকাল হয়তোবা অনেককিছুই ঘটে গেছে হাসপাতালে। যা সে ঘুণাক্ষরেও জানত না। কাল রাতে কী ইমান পারত না বিয়ের কথা নিয়ে সোজাসাপটা তার সঙ্গে কনভারসন ক্লিয়ার করতে? কিন্তু নাহ উনি সব ধোয়াশায় রখল। ফাইজলামি করল আর আসল কথা না বলেই পগারপার।
সোনালী আপু পনের মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে মুখ গোমড়া করে বলে, ইমান তো বাসায় নাই এখন। বাইরে গেল কাজে। পরে কথা বলিস৷
মিরা ভারাক্রান্ত গলায় বলে, আমি অনেক কনফিউজড। কী করব জানি না৷
আপু তার পাশে বসে বলে, “এমন কনফিউশানে পড়লে ফ্যামিলির কথা শুনবি সবসময়। উনারা যা করতে বলবে করবি, যদি সফল না হোস, তাদের উপর দোষ চাপাবি। এতে তারা ঠিকই তোর সমস্যা সমাধান করে দিবে। সলিউশন না দিতে পারলেও পাশে অন্তত পাবি৷”
মিরার কপালে চিন্তার ভাজ পরে যায়।ফ্যামিলির কথা শুনলে আজকে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে। ভাবতেই তার সারা শরীর কেঁপে উঠে।
চলবে।