#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–26
নির্ঘুম রাতেরা এমন বিচ্ছিরি হয় তা আজ হারে হারে, প্রাক্টিক্যালি টের পাচ্ছে ইমান৷ একরাত না ঘুমানোর জন্য তার চোখে ক্লান্তিভাব এবং চোখের নিচে কালি উপহার পেল৷ অপ্রিয় রজনী গুলো খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়৷ সে ভোরবেলা উঠে গোসল সেরে বসে থাকলো৷ সকাল সাতটা বাজতেই নাস্তা না করে অফিসের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায় সে। সাধারণত আটটা থেকে সোয়া আটটার মধ্যে সে অফিস যায়। আজ ব্যতিক্রম ঘটালো৷ অফিসেই যেন সব সুখ লুকিয়ে আছে৷ তার ভাবখানা এমন যেন অফিসে গেলেই সকল অবসাদ থেকে মুক্তি পাবে৷
সে যখন অফিসে পৌঁছে তখন মাত্র ওয়াচম্যান দাঁড়িয়ে ছিল। আর সম্পূর্ণ অফিস ফাঁকা। কালকের বৃষ্টির ছিটেফোঁটা চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। চারদিক সূর্যের কিরণে ঝলমলে করছে। উদাসীনতা কোথাও হারিয়ে নতুন আশার আলোময় সূর্য হাসছে৷
ওয়াচম্যান তাকে অনেকদিন পর দেখে আনন্দিত হয়ে কাছে এগিয়ে এসে বলে, ” হ্যালো স্যার। নাইস টু মিট ইউ।”
ইমান হাসিমুখ করে বলে, “কেমন আছো জনসন?”
— “ভালো স্যার, আপনি? ”
সারারাত জেগে থেকে, না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, অযথা দুশ্চিন্তা করে কোন ব্যক্তির পক্ষে পরেরদিন সকালে ভালো থাকা অসম্ভব প্রায়৷ কিন্তু তবুও সবাইকে নিজের ভালো না থাকার কথা বলা যায় না৷ গুটিকয়েক মানুষের কাছে নিজের খারাপ থাকার কথা বলা যায়৷ কাল রাত থেকে ইমান এমন কাউকে খুঁজছে যাকে অবলীলায় বলতে পারবে আমি ভালো নেই৷ কিন্তু আফসোস তাকে খুঁজে পাচ্ছে না৷ এমন কেউ তার পরিচিত নেই৷ সম্ভবত সে কারো সঙ্গে মিশতে পারেনা এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ মেবি সে খুব নিষ্ঠুর একটা মানুষ। নাহলে অন্যকে এতো কষ্ট কীভাবে দিল?
ওয়াচম্যান উত্তরের আশায় চেয়ে আছে৷ ইমান বহুকষ্টে বলে, “আমি ভালো আছি৷”
–” নিউইয়র্ক ফিরলেন কবে?”
— “দুদিন আগে এসেছি৷ জনসন আমার জন্য ব্রেকফাস্ট আনাতে পারবে?”
— ” আপনি ব্রেকফাস্ট করে আসেননি?”
— “এখন করব। তুমি হাল্কা কিছু এনো৷”
বলেই সে ভেতরে প্রবেশ করে লিফটের এগারো তলায় উঠে পড়ল। কাঁচ দিয়ে ঘেরাও করা লিফট বেশ তীব্র গতিতে মুহুর্তের মধ্যে এগারো তলায় পৌঁছে দিল। সম্পূর্ণ অফিস আপাতদৃষ্টিতে ফাঁকা মনে হলেও কয়েকজন এসে পড়েছে৷ ইমান আইটি সেক্টরে কাজ করে। তার ডিপার্টমেন্ট আলাদা। তবুও অন্যদের দেখামাত্র সে সৌজন্যমূলক কুশল বিনিময় করে নিজের কেবিনে চলে গেল৷ তখনই জনসন নাস্তা নিয়ে ফিরল। ব্রেড আর জেলি সঙ্গে ফ্রেশ জুস৷ সে কোনমতে পানি দিয়ে নাস্তা গিলল৷ আটটা বাজতেই অফিস জমজমাট হয়ে গেল। কাযে মনোযোগ দিতে গিয়ে বারবার কানে ভাসছে মিরার বলা কথাগুলো, ” আমি ভালো নেই।” কেন যেন এর প্রতিউত্তরে বলতে মন চাচ্ছে, “তোমাকে ভালো না রেখে, আমিও ভালো নেই।”
অফিসের অনেকেই তার সঙ্গে এসে মিট করে গেল৷ অবশেষে এই অফিসের চেয়ারম্যান পিটার স্মিথ আসলেন। তার ডাক পড়ল ওনার রুমে৷ সে নিজেকে একবার ধাতস্থ করে ওনার কেবিনের দিকে অগ্রসর হলো।
পিটার সাহেব মাত্র অফিসে এসেই জেনেছেন ওনার সবচেয়ে হার্ড ওয়ার্কিং এবং প্রিয় এমপ্লয়ি অফিসে এসেছে। সে বেশ খুশি হলো। ইমানের ছুটি আরো কয়েকদিন ছিল। সে সময়ের আগেই ফিরে এসেছে। অবশ্য পিটার সাহেবের সঙ্গে ইমানের বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে৷ এইজন্য ইমানকে সে এক্সট্রা কেয়ার দেয়৷
ইমান তার রুমে আসতেই পিটার উঠে দাড়ালো এবং তার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলে, ” মাই বয়, কেমন আছো?”
–” ভালো আছি স্যার৷ আপনি কেমন আছেন? ”
–” তোমাকে দেখে ভালো লাগছে বেশ।”
ইমান তার কথা শুনে বিমুগ্ধ হলো৷ সে জানে না সামনের দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক এবং তার কন্যা কেন তাকে এতো গুরুত্ব দেয়?
সে স্মিত হেসে বলে, “স্যার প্রজেক্টের অনেক কাজ পেন্ডিং আছে৷ আমি তাহলে যাই।”
— “ওহ ভালো কথা। দুইদিনের মধ্যে আর্জেন্ট আবারো টেক্সাস যেতে হবে তোমাকে৷”
–! যাব।”
— “লাকিলি সঙ্গে জুইও থাকবে।”
ইমানের মুখ কালো হয়ে আসলো। জুইয়ের সঙ্গ আজ-কাল অস্বস্তির সৃষ্টি করছে মনের কোণে। কিন্তু তবুও কাজ আগে প্রাধান্য পাবে। কাজের জন্য অনেককিছুই স্যাকরিফাইস করতে হয়। না চাওয়া সত্ত্বেও অনেককিছু করতে হবে৷
সে কেবিনে ফিরে এসে কাজে মনোযোগ দিল। সে হলো এ অফিসে আইটি ডিপার্টমেন্ট হেড। উন্নত এ দেশে আইটি সেক্টরের প্রয়োজন অনেক বেশি। তার অনুপস্থিতিতে অনেক কাজ পেন্ডিং। তার আন্ডারে জুই৷ তাদের অনেক কাজই গ্রুপভিত্তিক করতে হয়৷ লাঞ্চ আওয়ারের আগেই, জুই তার কেবিনে আসল।
ইমান তখন ডেস্ক ল্যাবটপের উপর চোখ রেখে কাজ করছিল। জুইয়ের প্রবেশ তার মনোনিবেশ ভঙ্গ করল।
জুই বলে উঠে, ” অনেক তো কাজ হলো মিষ্টার। এবার আসো লাঞ্চ করি৷”
ইমান মুখ তুলে তাকালো। আজকে জুই স্কার্ট পরেছে। টপস-স্কার্ট পরায় তাকে বাচ্চা লাগছে। কেশ গুলো ছেড়ে রেখেছে৷ ওর চুল বেশি বড় ন। কাঁধে গিয়ে ঠেকে। আজকে চোখে লেন্স পরেছে, জন্য অন্যরকম লাগছে৷
সে বলে উঠে, ” একটু পর। কাজ বাকি আছে৷”
“ওকে” বলেই জুই তার বিপরীতে রাখা চেয়ারে বসে তার জন্য অপেক্ষায় থাকল।
ইমান পুনরায় কাজে ব্যস্ত হলো। পড়শু যদি টেক্সাস যাওয়া লাগে তাহলে আজ আর কাল বাকি আছে কাজ শেষে করার জন্য। তার মানে এই দুইটা দিন তাকে রাত-দিন এক করে কাজে লাগাতে হবে৷
আধঘন্টা পাড় হয়ে যায় জুই বসে আছে৷ সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে মিষ্টার খানের কাজ-কর্ম গুলো। মিষ্টার খান কাজে এতোই ব্যস্ত যে তার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। আর অপেক্ষা করা যায় না৷ সে উঠে ডেস্কের সামনে ঝুকে ল্যাপটপ সুইচ অফ করে দিয়ে বলে, ” কীভাবে এতো কাজ কর তুমি? আমি তো দশ মিনিটও পারি না। ”
ইমান বেশ বিরক্ত হলো৷ কিন্তু প্রকাশ করল না। জুইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি কাজ করো না জন্যই আমাকে এতো কাজ করতে হয়।”
জুই বললো, “তুমি সব কাজ করে ফেলো জন্য আমি কিছু করি নাহ৷”
–” তাই নাকি?”
— “ইয়েস, এখন আস লাঞ্চ করি৷”
ইমান ঘড়ি দেখে বলে, “চল ”
ক্যান্টিনে এসে তারা বসল। জুই স্যান্ডউইচ নিল৷ ইমান কফি আর রাইস নেয়।
জুই খেতে খেতে বলে, ” আজকে রাতে ফ্রি আছো?
–“কেন?”
–” আমাদের এক কলিগের বাসায় পার্টি। চল এটেন্ড করি।”
–” তুমি যাও। আরেকদিন আমি যাব।”
–” এতো বোরিং কেন তুমি? ”
ইমান শব্দ করে হেসে বলল, “কী জানি! ”
জুই তার হাসি হাসি মুখের দিকে বিমুগ্ধ নয়নে তাকালো। ওকে হাসতে দেখলে তার খুব ভালো লাগে।
_____________________
আজিজ সাহেব মেজাজ গরম করে সুপ্তি বেগমকে ডাকছেন৷ সুপ্তি বেগম তড়িৎ গতিতে তার ডাকে সাড়া দিলেন।
উনি তার স্ত্রীর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে, ” ভাই কী বলেছে তুমি শুনেছো?”
সুপ্তি বেগম বলে, “হ্যাঁ।”
আজিজ সাহেব আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তারপরও এতো স্বাভাবিক কীভাবে আছো?”
সুপ্তি বেগম বলে উঠে, “ইমানের সিদ্ধান্ত তো আমাদের মেজাজের উপর নির্ভর করছে না।”
–” ওই ছেলের সঙ্গে আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বিরাট ভুল করলা মিরার আম্মু। কী বলছিলা, মিরার সঙ্গে বিয়ে হলে ইমান শান্ত থাকবে৷ কিন্তু কী হলো? ও ওর সিদ্ধান্তে অনড়। এখন আমরা কী করব? ” ( ধমক দিয়ে বলে উঠলেন।)
সুপ্তি বেগম দ্বিগুণ ধমকে বলে উঠে, “আর কতদিন? আর কতদিন এভাবে মানুষের কাঁধের উপর ভর দিয়ে থাকবেন? আপনি নিজ থেকে কিছু করেন না কেন? সবসময় মানুষের উপর নির্ভরশীল। এতো মেরুদণ্ডহীন মানুষ কীভাবে হন? আমার তো লজ্জায় কারো সামনে মুখ দেখাতে ইচ্ছা করেনা।”
আজিজ সাহেব থমকে গেলেন।
সুপ্তি বেগম বলে, “ইমান কোন ভুল কাজ করেনি৷ ওর সম্পত্তি ও আমাদের কেন দিবে? বড় আপার ভাগের সব সম্পত্তি তো আগেই আপনি জালিয়াতি করে নিয়ে নিয়েছেন। শুধু এই বাড়িটাই আপার নামে আছে এখনো। যেটা এখন ইমানের। আমরা যেমন আমাদের সম্পত্তির এক আনাও ইমানকে দেইনি। সেই হিসেবে, ইমান কেন আমাদেরকে তার একমাত্র মায়ের সূত্রে পাওয়া জায়গা ছেড়ে দিবে?”
আজিজ সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ” এটা আপার নামে ছিল না। আমাদের দুই ভাইয়ের নামে ছিল।”
–” ছিল। কিন্তু আব্বা তো মারা যাওয়ার আগে লিখিত ভাবে আপার নামে লিখে দিয়ে গেছেন৷ আর কেন আপার নামে লিখে দিয়ে গেছে সেটা ভেঙে বলার দরকার নেই নিশ্চয়ই।”
আজিজ সাহেব অপমানে কাঁপতে লাগলো৷
সুপ্তি বেগমও রেগে আছেন৷ স্বামীর উপর সেও ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ। একবার তো ভেবেছিলেন দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার রেখে চলে যাবেন। কিন্তু সম্ভব হয়নি৷ মাটি কামড়ে বহু অপমান সহ্য করে থেকেছেন। এর সিকি ভাগও তার দুই কন্যা জানে না। ইচ্ছা করেই জানতে দেননি তিনি৷ মেয়েরা বাবার কৃতকর্ম জেনে তাকে ঘৃণা করুক সেটা সে চায় না। এক জীবনে বহু নারী তার স্বামীকে ঘৃণা করে পাড় করে দিতে পারে৷ কিন্তু যে সন্তান তার পিতাকে ঘৃণা করে, সে সবচেয়ে অভাগা।
আজিজ সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ” তিন মাসের মধ্যে নাকী এবাসা ছাড়তে হবে। ভাই তো ওনার বসুন্ধরার ফ্লাটের ভাড়াটিয়াকে বাসা ছাড়ার নোটিশ দিল। কিন্তু আমি আমার মেয়েদেরকে নিয়ে কই যাব?”
— আশেপাশেই কোথাও ভাড়া উঠব।”
আজিজ সাহেব আরেকটাবার আফসোস করে বলে, “ইমানের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঠিক করোনি৷”
সুপ্তি বেগম চুপচাপ থাকলেন৷
উনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রশ্ন করে, ” মিরা এখন কী করছে? ও কবে শ্বশুড়বাড়ি যাবে? ইমান কিছু বলেছে? ”
–” সময় লাগবে। ”
–” তাড়াতাড়ি গেলে ভালো হয় না?”
–” ভিসা হতেও তো সময় লাগবে। আরো কাগজ-পত্র তো রয়েছেই।”
— “সামনে আমাদের দুর্দিন আসছে তুমি কী বুঝতে পারছো?”
সুপ্তি বেগম মুখ চোখ শক্ত করে বলে, ” আপনি অন্যায় না করলে এমন দিন দেখতে হত না।”
চলবে৷
[ জানি অনেকের কাছে প্রিভিয়াস দু-তিনটা পর্ব বোরিং লাগছে৷ কিন্তু এই পার্ট গুলোর দরকার আছে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। নাহলে খাপছাড়া লাগত। যাইহোক সবাইকে ভালোবাসা অবিরাম। কালকে থেকে নতুন অধ্যায় শুরু হবে৷ ]