ফেইরিটেল পর্ব-২৯

0
1227

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–29

তখন মাত্র গোধূলিলগ্ন। ইতিমধ্যেই ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে৷ নিকষকৃষ্ণ আঁধার অতিক্রম করে আজ সূর্যের কিরণের কোন তেজ নেই। আবহাওয়া হুট করেই খারাপ হচ্ছে। বিকেলে আরেকদফায় বৃষ্টি হয়েছে৷ এখন শহর কালো করে মেঘ নেমেছে। আজ বুঝি সারারাত বর্ষণ হবে। সঙ্গে পাগলা, খেপাটে হাওয়া তো আছেই। দূরে বাজ পড়ার শব্দে বিকট আওয়াজ সৃষ্টি হচ্ছে৷ নিজের শরীরের উপর নরম তুলতুলে ব্ল্যাংকেটের উপস্থিতি টের পেল মিরা। ঘুমের মধ্যেই সে আরামবোধ করে। হাল্কা বাতাসের জন্য ঘুম আরো প্রগাঢ় হচ্ছে৷ কিন্তু অচেতন মন বারবার জেগে উঠতে চাইছে। ঘুমের মধ্যে কারো দৃষ্টির মধ্যমনি হওয়ার ইন্টিউশন পাচ্ছে সে। ব্ল্যাংকেট সরিয়ে ফেলে সে নড়াচড়া শুরু করল। আচমকা নিজের কোমড়ে শীতল এক হাতের স্পর্শ পেতেই তার নিশ্বাস গাঢ় হলো। সে চোখ বুজেই ভ্রু কুচকে ফেলে। এরপর আস্তে করে চোখ খুলল। নেত্র পল্লব মেলে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো ইমানের মুখমণ্ডল। সে সম্ভবত হাঁটু গেড়ে বসে আছে৷ নিজের কোমড়ে ওনার হাতের শীতল উপস্থিতি যেন মিরার সহ্য হলো না। সে তড়িৎ বেগে কোমড় থেকে এক ঝটকায় তার সরিয়ে দিল৷

তখনই ইমান বলে উঠে, ” পড়ে যাবে তুমি। আরো সরে ওদিকে চাপো। এটা বেড না।”

মিরা এতোক্ষণ পর নিজের অবস্থান সম্পর্কে খেয়াল হলো। সে বেমালুম ভুলে বসেছিল৷ নিজ রুমে ভাবছিল সে নিজেকে। কিন্তু সে তো ভীনদেশে পাড়ি জমিয়েছে৷ নিউইয়র্ক আসতে কম কাঠখোট্টা পেরোতে হয়নি নাকি! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে উঠে বসল। উঠে বসতেই অনুভব করল, তার মাথা ভীষণ ভারী হয়ে আছে। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। ক্লান্তি ভাব যায়নি। খোলা চুলগুলো উড়াউড়ি করছে জন্য বিরক্ত হলো সে। জানালার থাই সামান্য খোলা বিধায় বাতাস ভেতরে প্রবেশ করছে৷ খুবই আস্তে সিলিং ফ্যান ঘুরছে মাথার উপরে৷ সে চুল গোছাতে গিয়ে চমকে উঠে। তার গলা আর কপাল ভেজা৷ কিন্তু ভিজে যাওয়ার তো কারণ নেই কোন। গরম ভাব তো একদম নেই। সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে সামনের দিকে তাকালো। কিন্তু সারারুম জুড়ে ভয়াবহ অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ দু মিনিট আগেও ফোনের ফ্লাশ লাইট অন ছিল৷ ইমান সেটা অফ করে দিয়েছে৷

সে বলে উঠলো, ” লাইট বন্ধ করে রেখেছেন কেন?”

মুহূর্তে একটা হাল্কা কিরণ দেওয়া ঝাড়বাতি জ্বলে উঠে। ঝাড়বাতির আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল। মিরা অভিভূত হলো। রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো। এমন ধরনের রুম যে টিভি-সিনেমায় দেখে এসেছে। বাস্তবেও যে এধরণের রুমে মানুষ বাস করব তা আজ নিজ চোখে দেখল। চোখ ঘুরিয়ে সেন্টার টেবিলে দৃষ্টি নিবন্ধ করতেই সে বিষ্মিত হলো। টেবিলের উপর একটা মগে পানি৷ মগের উপর রুমাল পরে আছে৷

সে জিজ্ঞাসু চোখে ইমানের পানে তাকালো। ইমান বলে উঠে, “বিকেলের দিকে তোমার প্রচন্ড জ্বর আসলো। উপায় না পেয়ে জলপট্টি দিলাম৷ কিছুক্ষণ আগেই জ্বর সেরেছে তোমার।”

মিরা নাক ফুলিয়ে বলে উঠে, ” আপনি আমাকে ছুয়েছিলেন কোন সাহসে?”

ইমান সাবলীলভাবে বলে, ” যেই সাহস নিয়ে বিয়েএ পীড়িতে বসেছিলাম।”

মিরা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ইমান ভ্রু নাচালো৷ মিরার গা জ্বালা দিয়ে উঠে।

ইমান বলে, ” আমি ছুঁয়ে দিলে তো ক্ষতি নেই।”

সে উঠে দাঁড়িয়ে গায়ে ওড়না জড়ালো৷ কিচ্ছু বললো না৷

ইমান বাকা হেসে বলে,”যতোটুকু দেখার সেটা আগেই দেখে ফেলেছি৷ সুযোগের সঠিক ব্যবহার করেছি।”

মিরা বিষ্ফোরিত চোখে তাকালো একবার এরপর উঠে বাথরুমে চলে গেল। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ইমানের সামান্য মন খারাপ হলো। অন্যকোন দিন হলে, একমুহূর্তে মিরা তুলকালাম বাধাতব।এমন কী তাকে বেয়াদব বলতে এক সেকেন্ড সময় নিত না। সেই মেয়েটার আজ কী হলো? এতো শান্ত স্বভাব তার সঙ্গে যাচ্ছে না। ইচ্ছা করে রাগিয়ে দিলেও রাগছে না। বিকেলে জ্বরের ঘোরে সে কাদছিল। ইমান তখন ল্যাপটপে কাজ করছিল। কাদার শব্দে সে দৌড়ে আসে। মিরাকে জ্বরে কাহিল হতে দেখে সে বড্ড অসহায়বোধ করছিল। মেয়েটার অসুস্থতা কিভাবে দূরীকরণ করবে? সে সারাটা বিকেল জলপট্টি দিচ্ছিল মিরার কপালে। সেই যে বসেছিল মাটিতে হাটু গেড়ে, আর অন্যত্র যায়নি।তার ঘুম ভাঙ্গার পর দাঁড়িয়েছে। এখন ভীষণ পা ব্যথা করছে তার৷
সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মিরার৷ কিছুক্ষণের ব্যবধানে মিরা ফিরে আসল। চোখে মুখে তার পানির ফোঁটা লেগে আছে।

ইমান স্নান হেসে বলে, ” টেবিলের উপর খাবার রাখা আছে। তুই খাও। আমি আসছি৷ ”

সে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। যদি তার উপস্থিতিতে মিরা অস্বস্তিবোধ করে খেতে!

মিরার ক্ষুধা পেয়েছিল বেশ। প্লেনে সে তেমন কিছু খায়নি। বরং বার কয়েক বমি করেছে৷ এজন্য এতো কাহিল হয়ে পড়েছে৷ খাবারের প্যাকেট খুলতেই তার মন বিষিয়ে আসল। হটডগ আর ব্রেড। এসব খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না তার একবিন্দু৷ কিন্তু এতো খিদে পেয়েছে যে না খেয়েও উপায় নেই। অগত্যা এক বাইট মুখে পুড়তেই তার নাড়ি-ভূড়ি প্যাচিয়ে সব বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম৷ সে হড়বড় করে বমি করে ফেলে। বমি করার পর আরোও নিস্তেজ লাগা শুরু হলো। মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে সে। এই অচেনা জায়গায় তার শরীর আরো খারাপ হয়ে পড়ছে। সে আরেকদফা বমি করতেই ইমান প্রায় দৌড়ে আসলো তার নিকটে৷

মিরা একবার তার দিকে তাকালো এরপর মাথা নিচু করে বলে, সর‍্যি! আমার জন্য আপনার এতো সুন্দর রুম নোংরা হলো।”

ইমানের কথাটা শোনামাত্র মেজাজ বিগড়ে গেল। সে নিজেকে ধাতস্থ করল। একজন অসুস্থ রোগীর সঙ্গে নরম ব্যবহার করতে হয়। কাজেই সে বলে উঠে, “তুমি ঠিক আছো? ওয়াশরুমে যাবে?”

মিরা উঠে দাড়ালো। ইমান তাকে সাহায্য করতে চাইলে সে সাহায্য নিতে অনীহা প্রকাশ করে বাথরুমের দিকে রওনা হলো৷ বাথরুমের ভেতর প্রবেশ করা মাত্র তার মাথা ঘুরাতে লাগে। পা টলতে থাকে। সে চাপা আর্তনাদ করে ডাকে, “ইমান”

ইমান পিলে চমকে উঠে। মিরা তাকে মনে হয় অনেক দিন পর এভাবে ডাকল৷ সে ওয়াশরুমের দিকে আগালো। সে দেখতে পায় মির দেয়ালে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে আছে৷

ইমান প্রশ্ন করে, ” আমি হেল্প করি?”

মিরা এর উত্তর দেয় না৷ মৌনতা সম্মনির লক্ষণ ভেবে সে বেসিনের কল চালু করে তার হাত-মুখ ধুইয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে সোজা বেডে আনে। এরপর বালিশের নিচে মাথা রেখে তাকে শুইয়ে দিলে, মিরা উঠে বসে বলে, ” আমি বিছানায় শুব না।”

ইমান চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো। এতেও কাজ হলো না। বাধ্য হয়ে ইমান বলে, “সুস্থ হও আগে।”

মিরাকে শুইয়ে দিয়ে সে বারান্দায় গেল। হুহু বাতাসে তার ঠাণ্ডা লাগতে লাগে। বেশিক্ষণ এই বাতাসের মধ্যে থাকা যাবে না। বৃষ্টি থেমে গেছে৷ সে ডক্টর হ্যারির সঙ্গে আধঘন্টা আগে ফোনে কথা বলেছে। উনি জানিয়েছেন আবার জ্বর না আসলে মেডিসিন দেওয়ার দরকার নাই। দু-তিন দিন বেড রেস্ট এবং হেলদি ফুড খেতে হবে পেশেন্টকে। ডক্ট্র হ্যারির এই জিনিসটা খুব ভালো। উনি অযথা মেডিসিন প্রেশক্রাইব করে না৷ প্রতিকারে বেশি ফোকাস দেন। ডক্টর হ্যারি এমন একজন ডাক্তার যার সঙ্গে কথা বললে রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়৷কিন্তু মিরার আবারো জ্বর এসেছে। বাথরুমে হাত ধরার সময় সে বুঝেছে। এখন নিশ্চয়ই মিরাকে ঔষধ দিতে হবে৷

এমনই সময় রুম থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে৷ তার বুঝতে সময় লাগলো না যে কণ্ঠটা মিরার৷ সে দ্রুত বেগে বারান্দা ছেড়ে রুমে আসল এবং মিরার কাছে এসে বসে বলে, ” কাঁদছো কেন? কষ্ট হচ্ছে?”

মিরা উত্তর দিল না৷ ইমান তাকে আলতো করে ধরে উঠে বসালো। কান্না করতে করতে মিরার চোখ লাল হয়ে গেছে। জ্বরের কারণে ঠোঁট, গাল লাল হয়ে আছে৷ মনে হয় ঠোঁটে জ্বরঠোসা উঠেছে৷ মিরার গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে। সে গালে হাত রেখে সমস্ত চোখের পানি মুছে দিল৷

সে পুনরায় বলে উঠে, “তুমি খুব মানসিক চাপে আছো তাই না?”

প্রতিবারের মতো এবারও উত্তর পেল না৷

মিরা হিচকি তুলে কেঁদে বলে উঠে, ” আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে৷ আমি আম্মুর কাছে যেতে চাই।”

কথাগুলো আটকে আটকে আসছে৷ জ্বরের ঘোরে কথা বলছে সে। ইমান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে ঠায় দিল৷ কাপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে।

সে বলে উঠে, “মেডিসিন নিতে হবে। পিজ্জা খাবে?”

–” না।”

— ” বার্গার?

মিরা বলে উঠে, ” না। আমি এসব খেলেই বমি করে দিব।”

–” তাহলে কী খাবে?”

মিরা ঠোঁট বাকিয়ে বলে, “ভাত খাব আমি।”

ইমান শত চিন্তার মধ্যেও হাসল। দ্যাখো মেয়ের কথা! এই মেয়েকে নাকি সুপ্তি বেগম আগে ধরে-বেধে ভাত খাওয়াত! আর এখন জ্বর মুখে ভাত খেতে চাচ্ছে৷

হাজার হোক, ইমানের একমাত্র বউ, এবং প্রথম কোন মেহমান, সেই সাথে অসুস্থ মেয়েটা মুখ ফুটে কোন আবদার করল, তার আবদার না রেখে পারা যায় না।

চলবে।

[ গল্পটা ভালো লাগছে সবার? সবাইকে রমজান মুবারক। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here