#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–30
ইমান বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ আবদার পূরণ করতে চাইলেই তো হলো না! তাকে ভাতের ব্যবস্থাও করা লাগবে৷নিউইয়র্কে ভাত পাওয়া যায় কিন্তু খুঁজে বের করতে হবে। কোন দোকানে পাওয়া যায় সে বিষয়ে তার কোন আইডিয়া নেই৷ গ্লোসারি শপিং সে কোনদিন করেছে কিনা নিজেরই মনে নেই। কোথা থেকে ভাতের চাল আনবে? কার কাছে সাহায্য চাইবে? তখনই প্রথমেই যার নামটা ব্রেইনে ভেসে আসলো সে হলো জুই। জুইয়ের এসব সম্পর্কে জ্ঞান থাকার কথা৷ সে রান্না করতে ভালোবাসে৷ কোন সময় অপচয় না করে সে জুইকে কল লাগালো৷ ওপাশ থেকে জুই ফোন রিসিভ করে বলে উঠে, ” মিষ্টার খান, তুমি হুটহাট অফিস থেকে চলে এলে কেন?”
ইমান একদণ্ড খামোশ থেকে বলে, ” আমার বাসার কাছাকাছি কোন গ্লোসারি শপে রাইস পাওয়া যাবে?”
জুই ওপাশ থেকে অবাক হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করে বলে, ” তুমি রাইসের খোঁজ নিয়ে কী করবে? নিজের বাসার কিচেন চিনো তুমি? ”
ইমান গলার স্বর ভরাট করে বলে, “একজন খুব করে ভাত খেতে চাইছি। হেল্প মি প্লিজ।”
জুই চটজলদি ঠিকানা বলে দিল। সে যে বিষ্ময়ে ইয়া বড় একটা হা করেছিল এটা ইমান ফোনের প্রান্ত থেকেই বুঝে যায়। জুই জানিয়ে দিলন, সেই দোকানে ইন্ডিয়ান সবরকমের প্রোডাক্ট পাওয়া যায়৷ তবে রাত আটটার মধ্যে দোকান সাট আউট হয়ে যাবে৷ আটটার পর সেল করে না৷
ইমান তার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে ঘড়ি দেখল। শিট সাতটা পনের বাজছে। সে জলদি ক্রেডিট কার্ড বের করে নিচে নেমে গেল৷
সাদ তখন হলরুমে পপকর্ণ খাচ্ছিল তার নেটফ্লিক্সে ফ্রেন্ডসের এপিসোড দেখছিল। সাদ আএ ইমান দুইজনেরই “ফ্রেন্ডস” সিরিজ খুব পছন্দের। এই নিয়ে সে দুইবার সম্পূর্ণ সিরিজ দেখেছে৷ তাকে বেরুতে দেখে সাদ প্রশ্ন করে, “এই বৃষ্টির মধ্যে বের হবে তুমি?”
ইমান ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে, “যেতে হবে৷ আসছি।”
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে হাসনাহেনা নিজের ছেলেকে বলে উঠে, “ওই মেয়ে আসার পর তোমার ভাইয়ের ভাব-হাব ভালো লাগছে না৷”
সাদ পপকর্ণ মুখে পুড়ে বলে, ” বাংলাদেশ থেকে আসা মেয়েটাকে একবারও দেখলাম না। ফিলিং স্যাড ফর মি। ”
হাসনাহেনা বলে, “মেয়েটা দেখতে ভারী সুন্দর। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। চুলগুলো ও সুন্দর। ”
সাদ বলে, ” তুমি ওর প্রশংসা করলা! ক্যান্ট বিলিভ।”
হাসনাহেনা রাগ দেখিয়ে বলে, ” যার রুপ আছে তার রুপের প্রশংসা তো করবই।”
–” ওর সাথে তাহলে মিট করতেই হয় এবার।”
ইমানের পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় আটটা বেজে গেল। মাঝে হুট করে একটা ইমার্জেন্সি কল এসেছিল ক্লায়েন্ট থেকে৷ কল রিসিভ করে কথা না বললেও চলছিল না। সে যখন “খুবসুরত ফুড এন্ড বেকিং” নামক ছোট ঘুপচি এই দোকানের সামনে আসল, তখন দোকানী তার চোখের সামনে ওপেন সাইনবোর্ডটা ঘুরিয়ে ক্লোজ করে দিল৷ মেইন মার্কেট থেকে দু’মিনিট হেটে বাম পাশে এই দোকান। এতো ছোট একটা দোকানের নাম জুই সাজেস্ট করবে তা কল্পনাও করেনি ইমান৷ সে দোকানের দরজা খুলে প্রবেশ করতে ধরলে, বৃদ্ধ দোকানী রাগী গলায় ইংলিশে বলে উঠে, এই যে ছেলে, ঢোকার আগে চোখ দিয়ে ক্লোজ লেখাটা দেখোনি?”
ইমান নরম গলায় বলে, “সো সর্যি স্যার। আমি দেখেছি৷ কিন্তু শপিং করা আমার জন্য দরকার। আমার চাল কিনতে হবে৷ আশেপাশে ভারতীয় কোন শপ নেই।”
দোকানী বিরক্ত হয়ে বলে, ” কাল এসো। দ্যা শপ ইজ ক্লোজড নাও।”
ইমান অনুরোধের কণ্ঠে বলে, “আমি যখন আসি তখনই শপ ক্লোজ হলো৷এক মিনিট লেইটকে ক্ষমা চোখে দেখুন । একটু দরকার জন্য এই বৃষ্টির মধ্যে এসেছি।”
দোকানী বলে, “কত বছর ধরে নিউইয়র্কে আছো?”
–” ছোট থেকেই।”
— তাহলে তো ভাতের জন্য এতো ক্রেভিংস হওয়ার কথা না। আমেরিকান কালচার তোমার রক্তে মিশে গেছে এতাদিনে। সামনেই ইটালিয়ান ফুডকোর্ট। ওখান থেকে পিজ্জা, ম*দ কিনে খাও৷ আমি আটটার পর সেল করিনা।”
ইমান দোকানীর কাছে পুনরায় অনুরোধ করে বলে, ” ওর আচানক জ্বর আসলো। পিজ্জা-হটডগের নাম শুনলেই বমি পাচ্ছে। খালি পেটে এন্টিবায়োটিক দিতে পারছিনা। কিছু মুখে দিবে না সে। শেষে বলল, ভাত খাবে। আপনার এখানে চাল না পেলে দু কিলোমিটারের বেশি ড্রাইভ করে চাল কিনে আনতে হবে ইন্ডিয়ান মার্কেট থেকে।”
দোকানী রাগী গলায় বলে, ” ও টা কে হয় তোমার? ”
ইমান মাথা চুলকে বলে, ” ওয়াইফ।”
বৃদ্ধের রাগী চেহারা মুহুর্তে হারিয়ে গেল। আপাতত তার চোখে ইমানের জন্য শ্রদ্ধা দেখা যাচ্ছে। সে মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,” কয় কেজি নিবে?”
— চার কেজি দেন৷
দোকানীর বয়স সত্তরের কাছাকাছি। কাজ করে ধীর গতিতে। উনি সময় নিয়ে চাল প্যাকেট করে। এরপর বলে, ” বউকে অনেক ভালোবাসো? ”
ইমান বলে উঠে, ” ভালোবাসি কীনা সিউর বলতে পারছি না৷ কিন্তু আজকে ও না খেলে, আমারও খাওয়া হবে না৷”
বৃদ্ধ হাসল৷ প্যাকেট বুঝিয়ে দিয়ে বলে, “এটার নামই ভালোবাসা। তুমি আজকের দিনের লাস্ট এন্ড বেস্ট কাস্টমার এজন্য তোমার জন্য ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট।”
________________
মিরার আজ নিউইয়র্কে প্রথম সকাল। কিন্তু আজকের সকালটার মধ্যে কোন এক জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। প্রকৃতি ইচ্ছে করেই আজকের সকালটাকে সুন্দর করে উপস্থাপন করেনি৷ আজকের সকালটা ভারী মেঘলা। মনমরা একটা ভাব। ধূসর ও ছাই রাঙা মেঘকুঞ্জ গুলো শুভ্র সাদাটে আকাশের দিগন্ত জুড়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডা ভাব কালকের চেয়েও বেড়েছে। জ্বরের ঘোরে মিরার কিচ্ছুটি মনে নেই৷ তার মনটাও ভালো নেই। ভেতরকার মনটা একদম মরে গেছে যেন৷ এই তিনটে মাসে সে অনেক কিছু সয়েছে। বাবা-মার দ্বন্দে, বোঝাপড়ার মধ্যে তাদের দু’বোনকে অনেককিছুই সহ্য করতে হলো৷ ইরার তো এসএসসি পরীক্ষার প্রিপারেশনও ঠিকমতো নেওয়া হলো না। সে নিজেও এক প্রকার লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘরে চুপটি মেরে বসে থাকলো! সবকিছু অসহ্য লাগত। ভাড়া বাসায় মন টিকত না। বারবার পুরনো বাসার জন্য মন কাদতো। দাদীর কথা মনে পড়ত। বড় আব্বুর শাসন সবকিছু স্মৃতির মানসপটে ঘুরে বেড়াত৷ ছোট্ট দুই কামড়ার বাসায় নিজেকে বন্দী বন্দী লাগত। মিরা বুঝে পায় না এতো ছোট বাসায় মানুষ কীভাবে বাস করে! তারপরও শান্তি ছিল সেই বাসায়। কিছুদিনের মধ্যে শান্তিও পালিয়ে গেল। রেখে গেল কেবল হাহাকার! বাবার কর্মে সে শোকাহত!
সে বিছানা থেকে উঠে আশেপাশে তাকালো। রুমে সে একা। নিচ থেকে ঘেরঘের শব্দ ভেসে আসছে। জানালা দিয়ে নিউইয়র্কের সৌন্দর্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে মুগ্ধ না হয়ে পারল না৷ নাম না জানা গাছগুলো কী অপূর্ব। আকাশটাও কতো স্বচ্ছ। সবকিছু ঝকঝকে করছে। আগ্রহ নিয়ে সে নিচে নেমে আসে৷ ঘুম ঘুম চোখে হলরুমের দিকে পা বাড়ালো। সাক্ষাত হলো ইমানের সৎ মায়ের সঙ্গে। নিজের পরিচয় অবশ্য মিরা কাউকে জানায়নি৷
সে হাসনাহেনাকে বিনীত গলায় সালাম দিল৷ উনি সালামের জবাব নিয়ে বলে, “তোমার নাম মিরা তাই না?”
–“হ্যাঁ।”
—” ইমান তোমাকে নাস্তা খাওয়ার পর মেডিসিন নিতে বলেছে। তুমি সাডেনলি সিক হলে। ইমানের কী অস্থিরতা! একবার কফি বানালো, ওকে এই প্রথম আমি রান্না করতে দেখলাম। সবসময় অর্ডার দিয়ে খায় ও। আবার বৃষ্টির রাতে তোমার জন্য বাইরে গেল। রাতে আমাকে ফোন দিয়ে ভাত রান্না করে দিতে বললো৷ কোনদিন আমার সঙ্গে কথা বলে না। কাল রাতে ফোন দিল৷”
মিরার আবছা মনে পড়ে যায় রাতের কথা৷ ইমান সম্ভবত তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিল৷ তার শরীর সত্যি অনেক খারাপ ছিল নাহলে কোনদিন সে ইমানের হাতে খেত না৷
সে হাসনাহেনাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আন্টি। আসলে বাংলাদেশে আমরা দু’বেলা ভাত খাই। জ্বরের ঘোরে রিচ ফুড দেখলেই বমি পাচ্ছিল৷”
হাসনাহেনা নাস্তার টেবিল গোছাতে গোছাতে বলে, “আমেরিকা এসেছো, এখানকার লোকাল ফুড টেস্ট করো৷ ভাত তো দেশে গিয়ে খেতেই পারবে৷ পাউরুটি খাও তো?”
— ” জি খাই।”
— ” জেলি, মেওনিজ, নোসিলা, নিউট্রেলা সব আছে৷ যেটা দিয়ে খেতে মন চায় খাও৷”
মিরা বহু কষ্টে শুধু একটা পাউরুটি খেল। তার খাওয়ার রুচি নেই। মুখ তেতো হয়ে আছে৷ খাওয়া শেষ করেও সে দোতকায় গেল না। নিচেই হাসনাহেনার সঙ্গে থাকল। বেলা একটায় এ বাসার ছোট ছেলে ভার্সিটির ক্লাস মিস দিয়ে বাসায় ফিরল৷ মিরার সঙ্গে তার প্রথম মিট এন্ড গ্রিট। সম্পর্কে ছেলেটা তার দেবর হয়৷
সাদ তাকে দেখামাত্র উত্তেজিত হয়ে বলে, ” ওহ মাই গড, তুমি তো দেখি একদম একটা রাজকন্যার মতো সুন্দরী। মনে হচ্ছে কোম ফেইরিটেল থেকে লাফ দিয়ে আমাদের বাসায় ঢুকে পড়েছো।”
মিরা তার কথায় সামান্য লজ্জা পায়। সাদ ছেলেটা খুব ভালো। প্রানবন্ত। সহজেই তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তারা সমবয়সী। এজন্য খুব ইজিলি তাদের মধ্যে কথাবার্তা হলো৷
সাদ বলে উঠে, ” এখন তো তুমি সুস্থ । চল তোমাকে আমার ভার্সিটি ঘুরিয়ে আনি।”
মিরা তার সঙ্গে ভার্সিটি ভিজিটে যেতে রাজী হয়ে যায়৷ সাদ তাকে নিয়ে নিজের ক্যাম্পাসে যায়।
মিরা এতোবড় ভার্সিটি দেখে টাস্কি খেল। কী সুন্দর প্রকৃতিতে ঘেরা আশপাশ। মিহি বাতাস। হলদে গাছের পাতায় ভার্সিটি প্রাঙ্গন ভরে গেছে। মাঠটা কী বিশাল। বিপত্তি ঘটে যায়। সাদকে তার প্রোফেসর দেখে ফেলে এবং ক্লাসে জয়েন করার আদেশ দেয়। সাদ নিরুপায়। ক্লাস না করলে স্যার রেগে যাবে। কিন্তু নতুন অতিথিকে একা ফেলেও তো যাওয়া যায় না৷ পাশেই ভাইয়ার অফিস। সে ভাবল ওকে ভাইয়ার কাছে রেখে ক্লাসে আসবে।
চলবে।