#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
part–53
মিরপুর, ঢাকা৷
কয়েকদিন পরের ঘটনা, দিনটি ছিল ৮ ই মে । আজ মা দিবস। মিরার অবশ্য মনেও ছিল না। ইমাদকে স্কুলে যাওয়ার জন্য যখন ঘুম থেকে ডাক দিল, সে এক ডাকেই উঠে পড়ল। এরপর মায়ের গালে চুমু দিয়ে বলে, ” হ্যাপি মাদারস ডে, আম্মু। আজকে আমি স্কুলে যাব না৷”
বলেই বেডে আঠার মতো চিপকে শুয়ে পড়ল। মিরা বলে উঠে, ” উইশ করলেই স্কুল মিস দেওয়ার পারমিশন দিব না আমি৷ উঠো।”
ইমাদ চোখ বন্ধ রেখেই বললো, ” আজকে আমি কোনভাবেই স্কুলে যাব না। গতকাল মিসকে বলে এসেছি।”
মিরা ভ্রু কুচকে বলে, “কেন?”
ইমাদ মুখ ফসকে বলে বলে, ” আজকে স্পেশাল ডে।”
মিরা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় এবং বলে, ” কিসের স্পেশাল ডে? শুনি? যতোই বিশেষ দিন হোক স্কুল মিস দেওয়া যাবে না।”
ইমাদ বলে, ” স্কুল মিস দেওয়া যাবে আম্মু। গতমাসে সৃজা চারদিন আসেনি। মিস ওকে কিছু বলেনি। আমি তো একদিনও মিস দেই না৷ আজকে আমি যাব না স্কুলে।”
মিরা তাও জোরাজোরি করতে লাগলো। বুঝাতে লাগলো স্কুল যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা৷ কিন্তু দুষ্ট ইমাদ কান বন্ধ করে রাখে। তবুও সে হাল ছাড়ে না৷
সুপ্তি বেগম রুমে প্রবেশ করে বলে, ” এতো চাপাচাপি করিস না তো৷ একদিন না গেলে কিছু হবে না। আমরা বাচ্চা বড় করি নি?”
নানুর সাপোর্ট পেয়ে ইমাদ কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে গেল। মিরা আর ফোর্স করল না। নিজে কিচেনে যেতেই ভারী অবাক হলো। রান্নাঘর ভর্তি বাজার। গরুর মাংস, খাসির মাংস, দেশী মুরগী, হাঁসের মাংস। বিভিন্ন ধরনের সবজি। সঙ্গে আছে রুপচাঁদা মাছ, ইলিশ, চিংড়ি, রুই আর কৈ মাছ৷
কৈ মাছ দেখেই মিরার কেন যেন ইমানের কথা স্মরণ হলো। ও গরম ভাত আর কৈ মাছ ভাজী খেতে পছন্দ করে৷ রান্নাঘরে একজন সাহায্যকর্মী কাজ করছে। উনি মাছ পরিষ্কার করছে৷ সুপ্তি বেগম মিরা রান্নাঘরে আসার একটু পর এলেন।
মাকে দেখে মিরা প্রশ্ন করলেন, ” এতো বাজার কেন মা? বাসায় অনুষ্ঠান নাকী? আমি তো কিছুই জানি না।”
সুপ্তি বেগম পায়েস রাঁধতে ব্যস্ত হলেন৷ রান্নার মাঝে বলে উঠে, ” না। আজকে কোন অনুষ্ঠান নেই। দু’জন মেহমান আসবে।ওদের জন্য রান্না করছি। তোর কোন সমস্যা? ”
মিরা মায়ের প্রশ্নে চমকে উঠে বলে, ” আমার কী সমস্যা হবে? তোমার মেহমানদের জন্য যা খুশি রাঁধো। রান্না করে খাওয়াও৷”
— ” তাহলে তুই সাহায্য কর আমাকে। রোস্টটা বানিয়ে দিয়ে যা৷”
–” আচ্ছা৷”
মিরার কিছু কিছু রান্না খুব মজা হয়। সবাই প্রশংসা করে। যেমন তার রোস্ট খুব বিখ্যাত। তেমনই সেমাই ভালো বানাতে পারে।
মিরা বলে, ” মা, সেমাই করে দিয়ে যাই? তোমার গেস্ট জনাবের ভালো লাগবে।”
–” হ্যাঁ, বানা৷ দুধ জাল দেওয়াই আছে।”
মিরা দেখল মা দারুণ খুশি। তার খুশি-উল্লাস মুখে ধরা দিচ্ছে। সে পায়েস মুখে দিয়ে দেখল মিষ্টি ঠিল হয়েছে কীনা।
মিরা বলে উঠে, ” কে আসবে মা?”
–” আমার কাছের একজন আসছে৷”
–” আমি তাকে চিনি?”
–” সেটা এলেই দেখিস৷ আজ অফিস থেকে জলদি আসিস৷”
–” আচ্ছা। ইমাদ সারাদিন বাসায় থাকবে। ওর দিকে একটু খেয়াল রেখো। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে যেন৷”
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখল ন্যান্সি ম্যাডামের ম্যাসেজ। উনি লিখেছেন আজকে পরিপাটি হয়ে আসতে অফিসে৷ মিরা অবাক হলো না। এটা নতুন কিছু না। উনি প্রতিমাসেই একবার করে ড্রেস কোর্ড দেন। সবাইকে সে রঙের ড্রেস পড়ে আসতে হয়৷ মিরা নিজের আলমারি খুলল। ছোট্ট ইমাদ তখন ঘুমিয়ে গেছে। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। সে হেঁটে এসে ছেলের গালে আর কপালে দুটো চুমু দিল। মিরা ভেবে পায় না, এই বিচ্ছু নয়টা মাস তার পেটে থাকল অথচ পেট থেকে বের হলো ইমানের কার্বন কপি হয়ে। শুধু তাই নয়, বাবার সঙ্গে তার বহু গোপন কথা থাকে কিন্তু মায়ের সঙ্গে তার কোন গোপন কথা নেই৷
সে আলমারির সামনে ফিরে গেল৷ আজকে কোন সালোয়ার কামিজই পছন্দ হচ্ছে না। একটা পছন্দ হলো, সেটার ওড়না মিলছে না। যেহেতু ম্যাডাম আজকে পরিপাটি হয়ে আসতে বলেছেন৷ কাজেই সালোয়ার কামিজ না পড়ে শাড়ি পড়া যাক। শাড়ির তাক থেকে ম্যাজেন্টা রঙের শাড়ি বের করল। সিল্কের শাড়ি৷ ভেতরে সাদা সুতার কাজ করা আছে৷ পাড়টাও সাদার উপর কাজ করা৷ সে দীর্ঘ সময় নিয়ে রেডি হলো।
টিভির রুমে ইরার সঙ্গে দেখা হলো তার৷ ইরা ফোন চালাচ্ছে। মিরা মুগ্ধ নয়নে ইরার দিকে তাকালো। তার বোনটা প্রতিদিন বুঝি একটু একটু করে সুন্দর হচ্ছে৷
মিরা বলে উঠে, ” আজকে ভার্সিটির ক্লাস নেই?”
–” আছে৷”
–” কখন যাবি?”
–” আজকে যাচ্ছি না আমি।”
–” তোকেও ইমাদের রোগ এসে ভর করলো?”
ইরা হেসে বলে, ” আজকে মিমো আর ইমাদ একসঙ্গে বাসায় চিল করবে৷ বাই দ্যা ওয়ে, তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। ”
–” বাজে বকিস না।”
–” সত্যি বলছি আপু। তুমি আর আগের মতো সাজ-গোজ করো না কেন শুনি? প্রতিদিন এমন সাজবে। তোমাকে দেখেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে৷”
মিরার অস্বস্তি হতে লাগলো। আজকে হুট করে কেন সে সেজে ফেললো? লিপস্টিক, কাজল মুছে ফেলবে? এতো সময় হাতে নেই৷ এখন অফিসের জন্য বের হতে হবে৷ নাহলে জ্যামে আটকা পড়বে। আর অফিসের জন্য লেইট হবে। হাতে সময় না থাকার জন্য সে মেকাপ আর মুছলো না। অফিসের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ল৷
অফিসে যেন উৎসব লেগেছে। বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। সিইও স্যারের কেবিন সাজানো৷ অফিসে এসে বোঝা গেল নিউ সিইও আজ জয়েন করবেন। ওনার ওয়ার্ম ওয়েলকামিং এর ব্যবস্থা চলছে৷ ন্যান্সি ম্যাডাম খুব ব্যস্ত৷ এদিক-ওদিক ছুটছেন। মিরাকে দেখে সে থেমে গিয়ে বলে, ” ওয়াও! মিরা, তোমাকে কী যে সুন্দর লাগছে। তুমি যে এতো সুন্দরী এটা আজ জানলাম। নিজের রুপ লুকিয়ে রাখো নাকী?”
মির সামান্য হাসলো৷ ন্যান্সি ম্যাডাম বলে উঠে, ” এইচ আরয়ের সঙ্গে তাহলে তুমিও যাও। এতো সুন্দর করে সেজে এসেছো যেহেতু।
মিরা বিব্রতবোধ করে বলে, ” আমি গিয়ে কী করব?”
–” শুধু ফুল দিয়ে আর বলবে ওয়েলকাম স্যার৷ আপনাকে আমাদের লিডার হিসেবে পেয়ে, আমরা খুব খুশি৷ দ্যাটস ইট!”
ন্যান্সি ম্যাডামকে না বলা যাবে না। কাজেই সে বিরক্ত মনে এইচ আর হাবিবুর রহমান ভাইয়ের সঙ্গে গেলেন।
এয়ারপোর্ট রোডের দিকে চলতে শুরু করলে মিরা প্রশ্ন করে, ” এয়ারপোর্টের দিকে কেন যাচ্ছি হাবিব ভাই?”
–” স্যারকে তো এয়ারপোর্ট থেকেই রিসিভ করব। ”
–” উনি দেশের বাইরে থাকেন?”
–” হ্যাঁ, আমেরিকা থেকে আসছেন৷”
আমেরিকা দেশটার নাম শুনতেই মনের পিঞ্জর থেকে বহু স্মৃতি ডানা ঝাপ্টা মারলো৷ গাড়ি এয়ারপোর্ট এসে নামতেই তারা বের হলো৷ আকাশ হুট করে মেঘলা হয়ে এসেছে৷ ইদানীং বৃষ্টির মৌসুম না তাও হুট করে আকাশ কালো করে মেঘ আসে। বৃষ্টি নামে মুষলধারে।
এয়ারপোর্টের ভেতরে অবশ্য কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তারা আধঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে। হাবিব ভাই মিরাকে এয়ারপোর্টের ক্যাফে থেকে গলাকাটা দামে কফি খাওয়ালো। অবশেষে জনাবের আসার সময় হলো। এনাউন্সমেন্ট করল এয়ারপোর্ট থেকে।
হাবিব ভাই তার হাতের ফুলের তোড়া দিয়ে বলল, ” আপু আপনি আগে ওয়েলকাম করবেন৷ আমি পিছে আছি৷”
মিরা ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। একঘন্টা পাড় হতে চললো। সে বুঝে পাচ্ছে না ব্যাটার এতো সময় কেন লাগছে? বিরক্ত লাগছে৷ আচমকা তার চোখের সামনে কেউ একজন এসে দাড়ালো। তার পারফিউমের গন্ধে মিরার মাথা ঝিম ধরল। চোখ যেন অক্ষিকোটর থেকে বের হতে চাইছে। মুখে কোন কথা ফুটলো না৷ কেমন হা হয়ে চেয়ে রইল সে। তার মাথায় যেন বিশাল এক বজ্রপাত পড়েছে৷ অতিরিক্ত শকে সে পাথর বনে গেল। ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে কিন্তু ফুল এগিয়ে দিল না। হাবিব ভাই দু’বার বললেন ফুল দিয়ে স্বাগতম জানানোর জন্য , কথা কানে গেল না তার। ইমান তার সামনে এসে দাড়িয়েছে। তার পরনে সেই সবুজ রঙের শার্ট যেটা নিউইয়র্কের কোন একদিন মিরা তাকে পরার জন্য সিলেক্ট করে দিয়েছিল। কিন্তু ও এই শার্ট না পরে কফি কালারের একটা শার্ট পরেছিল। এতোদিন পরেও এই শার্ট ও যত্নে রেখেছে?
তাকে দেখে মুচকি হাসলো ইমান। এরপর চোখে চোখ রাখে। চোখের ভাষায় বোঝাল, তুমি আমার কাছ থেকে যতোই পালাতে চাও, আমি ঠিক ততোখানি তোমার কাছাকাছি আসব।”
হাবিব ভাই তৃতীয়বারের মতো বললো, ” মিরা স্যারকে ফুল দিয়ে ওয়েলকাম জানাও৷”
ইমান অবশ্য মিরার কষ্ট করে এগিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় রইল না। নিজে দু’কদম এগিয়ে এসে ফুল নিল হাতে। ফুল নেওয়ার সময় ইচ্ছা করে নিজের হাতের ছোঁয়া দিল মিরার হাতে। মিরা কেঁপে উঠে। দীর্ঘ ছয়টা বছর পর মানুষটাকে সে সামনা-সামনি দেখছে। বুকের ভেতর উত্তাল ঢেউ জোয়ার বুনছে। সে ঘেমে উঠে।
–” থ্যাংক ইউ, ম্যাডাম।”
খুব চমৎকার করে হেসে কথাটা বলে উঠে ইমান৷ মিরা চমকে উঠে। চোখ নামিয়ে নেয়। হাবিব ভাই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। লাগেজ নিজে টেনে নিয়ে গেলেন। যদিও বা ইমান বহুবার মানা করেছে৷ কিন্তু উনি শুনবেন না। হাবিব ভাই আগে আগে যাচ্ছেন৷ মিরা তাকে অনুসরণ করছে। এবং সবার শেষে ইমান আসছে।
এয়ারপোর্টের বাইরে এসে গাড়িতে ব্যাগ-পত্র তোলা হলে ইমান বলে, ” টানা চব্বিশ ঘন্টা প্লেনে থেকে এখন আর গাড়িতে উঠতে মন চাচ্ছে না৷ আমি রিকশা করে যেতে চাই। খোলা বাতাসে থাকতে চাই।”
বৃষ্টি ততোক্ষণে থেমে গেলেও, হাওয়া শীতল। পরিবেশে বৃষ্টির ছোয়া লেগে আছে৷ মন ভালো করার মতো আবহাওয়া আজ৷
হাবিব ভাই বলে, ” আপনি তো রাস্তা চিনবেন না স্যার৷”
ইমান মুচকি হেসে বলে, ” মিসেস কে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় উঠব৷ তাহলে সমস্যা হবে না৷”
হাবিবুর রহমান বুঝলো না এই মিসেসটা আবার কে?
ইমান মিরার দিকে তাকিয়ে খুব সুন্দর করে বলে, ” ম্যাডাম, আপনি কী আমার সঙ্গে রিকশা ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক?”
মিরা হ্যাঁ ও বললো না, না ও বললো না। তবে তার মৌনতাকে তারা সম্মতির লক্ষণ ভাবলো৷ হাবিব ভাই রিকশা ঠিক করে ভাড়া দিয়ে দিল। এখান থেকে সোজা অফিসে যাবে রিকশা। ভাড়া নিল এক’শ টাকা৷
রিকশায় পাশাপাশি বসে তারা। রিকশা আগাতেই মিরা ওদিকে চেপে বসে৷ ইমান তার দিকে তাকিয়ে বলে, ” দূরে কেন সরে যাচ্ছো?”
মিরা উত্তর দিল না। অন্যদিকে তাকালো। কেন যেন তার দু’চোখ ভরে উঠেছে। টলমল করছে। আচমকা তার উম্মুক্ত কোমড়ে শীতল হাতের স্পষ্ট স্পর্শ অনুভব করে সে। এই স্পর্শ, ছোঁয়া তার পরিচিত। আস্তে করে তাকে নিজের দিকে টেনে এনে কোমড় চেপে ধরেই, ইমান গুনগুন করে গাইতে লাগলো,
“ভেবে দেখেছো কী ?
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারো দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে…….. ”
মিরা আড়চোখে তাকালো। কে বলবে এই লোক ছয় বছরের এক বাচ্চার বাপ! বয়স যেন আরো কমেছে। তখনই ঝুমঝুম শব্দ তুলে বৃষ্টি নামে। এমন বৃষ্টি মুখর দিনেই বুঝি সবাই বাড়ি থাকে। কেবল ময়ূর পেখম তুলে নাচে৷ আজ তারাও ময়ূর!
রিকশাওয়ালা মামা একটা পলিথিন দিল তাদের৷ পলিথিন গায়ে মুড়িয়ে নিল তারা। এর ফলে দুজনের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। মিরার মুখের উপর ওর গরম নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে৷ ইমান তার হাত চেপে ধরে। সে ওর চোখের দিকে তাকালো। ইমান আস্তে করে বলে, ” বৃষ্টি যেমন করে ভূপৃষ্ঠের ময়লা ধুয়ে নিয়ে যায়, আমিও তোমার মনে পড়ে থাকা সবটা অভিমান-রাগ ভালোবাসা দিয়ে ধুয়ে ফেলব।”
বলেই অনেক গভীরভাবে শব্দ করে মিরার গালে চু-মু খে-ল। মিরার চোখ বড় হয়ে গেল৷
সে হেসে বলে, ” ওয়েলকামিং গিফট আদায় করে নিলাম।”
চলবে৷