ফেইরিটেল পর্ব-৫৪

0
1134

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–54

রিকশা যখন অফিসের সামনে থামলো, তখন বৃষ্টিও থেমে গেল। ইমানের মনে হলো, বৃষ্টি জেনে-বুঝেই তাদের দুজনের জন্য ধরণী কাঁপিয়ে নেমেছিল। এই বৃষ্টির জন্য তার রিকশা সফর এতো আনন্দময় হলো৷ অফিসের স্টাফরদের অনেকেই বাইরে অবস্থান করছে তাকে রিসিভ করার জন্য। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, মিরা রিকশা থেকে ইতিমধ্যে নেমে পড়েছে৷ মাথার উপর হুট আর বৃষ্টি থেকে গা রক্ষা করার জন্য পলিথিন থাকলেও বৃষ্টির ছাঁটে মিরার শাড়ির আচল, মুখমণ্ডল আর চুলের সামনের অংশ ভিজে গেছে। ভেজা মুখে তাকে যেন আরোও অধিকতর সুন্দর লাগছে। চোখের কাজল লেপ্টে আছে৷ ভেজা চুলগুলো কপালে পড়ে আছে। মেয়েটার মুখে বুঝি মায়া আছে, বারংবার সেই মায়ায় আটকা পড়তে মন চায়৷

ন্যান্সি ম্যাডামের কথায় তার ঘোর কাটলো। উনি বলে উঠে, ” এই যে সিইও বস, আপনি গাড়ি রেখে রিকশায় কেন এলেন? এনি ওয়েস, ওয়েলকাম টু আওর অফিস৷”

ইমান মৃদ্যু হেসে বলে, ” থ্যাংক ইউ ম্যাম। রিকশা জার্নিটা আমার লাইফের বেস্ট জার্নি ছিল।”

কথাটা শেষ করেই আড়চোখে মিরার দিকে তাকালো সে। মিরা তাকে উপেক্ষা করে অফিসের ভেতর ঢুকে পড়ে। ইমানকে নিয়ে অফিসের ভেতর আসা হয়। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। এরপর লাঞ্চ করার জন্য ক্যান্টিনে নিয়ে যাওয়া হয়। তার আগমনের জন্য অফিসের মেন্যু আজকে অনেক ভালো। ওইসময় মিরাও খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে অবস্থান করে৷ ইমানের আসতে দেরি হওয়ায় বাকিরা আগেই দুপুরে খেয়ে নিয়েছে৷ ক্যান্টিন ফাঁকা। বিকেলের জন্য কফি তৈরির কাজ চলছে৷ কেবল মিরা লাঞ্চ করার জন্য বসেছিল। ইমান ইচ্ছা করেই তার টেবিলে এসে বিপরীতে, মুখোমুখি বসলো। ন্যান্সি ম্যাডাম দাঁড়িয়ে থেকে খাবারের তদারকি করছিলেন। এবং সে ইমানের পাশে বসে বললো, ” খাবার গরম করতে বলেছি। গরম হলে সার্ভ করবে। তোমার দুজন একটু বস। আচ্ছা ভালো কথা, ইমান ও হচ্ছে মিরা৷ আমাদের এখানে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছে৷ ওর কাজ খুব চমৎকার। প্রতিটা ডিজাইন আমার খুব পছন্দ হয়। আর পাবলিক পছন্দও করে ওর ডিজাইন করা ড্রেস। অনেক ট্যালেন্টেড একটা মেয়ে ও।”

ইমান বলে, ” মাশাল্লাহ।”

মিরা নিজের প্রশংসা শুনে খুব লজ্জা পায়৷ তখনই খাবার আসলো। কিন্তু ইমান নাকী এসব খাবে না। সে কেবল এক প্লেট সালাদ খাবে। তার জন্য ন্যান্সি ম্যাডাম আবারো সেফের কাছে গেলেন।

ম্যাম যাওয়ার পর মিরা খাওয়ায় মনোযোগ দিল৷ ভাতের সঙ্গে ডাল মিক্স করে মুখে তুলবে তার আগেই ইমান তার পায়ে পা দিয়ে ঘঁষা দিল৷ প্রথমবার মিরা আমলে নিল না। হয়তো ভুলবশত করে ফেলেছে। দ্বিতীয়বারও ইমান তার পায়ে পা দিয়ে সুরসুরি দিয়ে এমন ভান ধরে যেন কিছুই হয়নি৷

মিরা কঠিন সুরে বলে, ” এটা কী করলেন আপনি? ”

–” কী করলাম আমি?”

মিরা বলতে পারল না সে কী করেছে কাজেই প্রসঙ্গ পালটে বলে, ” সমস্যা কী?”

–” তুমি দুপুরের খাবার এতো দেরিতে কেন খাচ্ছো? এখানেই আমার সমস্যা। ”

–” এটাই আপনি সমস্যা?”

–” হ্যাঁ।”

–” এয়ারপোর্টে ছিলাম। এজন্য খেতে পারি নি। জানেন না বুঝি!”

ইমান হেসে বলে, ” ওসব কিছু না। অযুহাত শুধুমাত্র। আসলে জামাইকে ছাড়া খেতে বুকে কষ্ট হয় জন্য না খেয়ে ছিলে।”

মিরা এসব কথা শুনেও চুপ থাকল। নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিল। কচকচ করে একটা সবুজ মরিচে কামড় বসালো। আগের মিরা হলে একচোট ঝগড়া বাঁধিয়ে দিত৷ কিন্তু সে এখন যথেষ্ট ম্যাচিউর হয়েছে৷ এসব বাচ্চামো তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না৷ কাচা মরিচে ঝাল ছিল খুব। কামড় দেওয়ার সাথে সাথে জিহ্বা , ঠোঁট আর গলা ঝালে জ্বলে গেল। ঠোঁট লাল হয়ে আসলো তার। ইমান পানি এগিয়ে দিল। সে ঢকঢক করে পানি গেল। ইমান বলে, ” সাদা ভাত খাও। ঝাল লাগা কমে যাবে৷”

মিরা কয়েক লোকমা সাদা ভাত খেল। আসলেই ঝাল এখন কম লাগছে তার৷ ইমান বলে, ” তুমি আকাশ হলে, আমি জমিন। তুমি বৃষ্টি হলে, আমি হবো মেঘ। তুমি মরিচ হলে, আমি হবো সাদা ভাত৷”

— ” সাহিত্যিকগিরি বন্ধ করুন৷”

ন্যান্সি ম্যাডাম এগিয়ে আসছেন। ইমান আরেকবার তার পায়ে গুঁতো মেরে বলে, ” তোমার ঐ ঝাল লাল ঠোঁ-টে-র আ’দু’রে ছোঁ/য়া নি-তে মন চাইছে খুব করে৷”

মিরা বিষ্মিত চোখে তাকালো। কিন্তু কিছু বলা হলো না৷ ম্যাডাম সালাদের প্লেট নিয়ে এসে দাঁড়ালেন৷

ইমানের জন্য সালাদ আনা হলো। সে সালাদটাও ঠিকঠাক খেল না। তিন চামচ খেয়ে রেখে দিল। খাওয়ার পর্ব শেষ করে, ন্যান্সি ম্যাডাম এনাউন্সমেন্ট করল, নতুন সিইও আসায় অফিসে গ্রান্ড ওয়েলকামিং পার্টি হবে আগামী শুক্রবার। পার্টি-প্রোগ্রামের কথা শুনলেই অফিসের সব এমপ্লয়ি খুশি হয়৷ সকাল দশটা টু পাঁচটা অফিস করে কারোই বিনোদনের বা আনন্দ উপভোগ করার সময় থাকে না। কিন্তু মন দিয়ে কাজ করার জন্য রিফ্রেশমেন্টও প্রয়োজন। এ’কারণে অফিসে পার্টি হলে একটু সবার সঙ্গে আনন্দ করা যায়৷ সেদিন ইমান বেশিক্ষণ থাকল না অফিসে। একটু পর বেরিয়ে গেল। মিরা জানে না সে কোথায় গেল। এদিকে তাকে একটা মিটিংয়ে থাকতে বলেছে। কাজেই আরো দেড়ঘন্টা পর সে অফিস থেকে বের হবে৷ মিটিং শেষে ক্লান্ত হয়ে যখন মিরা বাসায় ফেরে তখন তার কাছে বাসার পরিবেশকে ঈদ মনে করে বিভ্রম হলো। মানে বাসার মেইন গেইট খোলা। ভেতর থেকে হাসাহাসির আওয়াজ আসছে৷ ইমাদের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। খাবারের গন্ধ বাসার বাইরেও মো মো করছে। বাসায় ঢুকে আজ তার জন্য ইমাদ অপেক্ষারত ছিল না। টিভিতে টম এন্ড জেরিও চলছে না৷ অথচ এই সময় ইমাদ নিচ থেকে খেলে এসে কার্টুন দেখে আর নানুমনির হাতে বিকেলের নাস্তা খায়৷ বসার রুম থেকেই পর্দার আড়ালে সে খাওয়ার রুমে উঁকি মারলো। ইমান বসে আছে টেবিলে। মা তাকে এটা-সেটা খাওয়াচ্ছে। তার চোখ বড় হয়ে গেল। তার মানে মায়ের কাছের প্রিয় মেহমান ইমান-ই। শিট! এটা তো একবারও মাথায় আসেনি। আসলে ইমানকে অফিসের বস রুপে দেখে সে বিশাল এক শক খেয়েছে৷ শক খাওয়ার পর ব্রেইন কাজ করছে না। আজকের মিটিংয়েও সে বেশ অমনোযোগী ছিল৷

মিরার কানে আসলো, ” মা, আমাকে আরেক বাটি সেমাই দিন। যেটা মিরা রান্না করে গেছে৷”

সুপ্তি বেগম বলে উঠে, ” আর কিছু দিব বাবা?”

–” মিরার বানানো রোস্টটা দিয়েন৷ এতো কষ্ট করে ও সকালে উঠে বানিয়ে গেছে৷ ওগুলো আগে খাই৷ ওর বানানো খাবার খাবো জন্য দুপুরেও আমি তেমন কিছু খাইনি।”

–” শুধু রোস্ট না সঙ্গে মায়ের হাতের পোলাও খাও বাবা৷।”

ইরা তাল মিলিয়ে হেসে বলে, ” ভাইয়া তো দেখছি বউয়ের হাতের রান্না খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে।”

মিরাকে তখনও কেউ খেয়াল করেনি৷ ইমানের বলা কথা গুলো শুনে তার গা বেয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। ইমাদ বুঝি তার মাকে দেখে ফেলে। সে চেচিয়ে বলে, ” আম্মু এসে গেছে৷”

তার চেচামেচিতে সকলে চুপ বনে গেল এবং ড্রয়িংরুমের দিকে তাকালো। মিরা এমনভাবে অভিনয় করল যেন সে মাত্র ঢুকেছে৷ কাউকে বুঝতে দিল না, সে আগে থেকে উপস্থিত ছিল৷ ইমাদ লাফিয়ে এসে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আজকেও লেইটে কেন আসলে আম্মু?”

–” সর‍্যি বাবাই৷”

— ” আম্মু সারপ্রাইজ দেখো। বাবা এসেছে তোমাকে সার…. ”

ইরা তখনই ইমাদকে থামিয়ে বলে, ” আপু, দুলাভাই এসেছে। একটু আগেই এলো বাসায়৷ তোমাকে ফোন দিয়ে জানানো হয়নি৷”

মিরা একবার তাদের সকলকে দেখে ভেতরে গেল। আবারো গল্প করার শব্দ আসতে লাগলো৷ সে গোসল সেড়ে যখন রুমের বাইরে আসল, তখন দেখা গেল ইমাদের মধ্যে দারুণ অস্থিরতা। সে একা একাই রেডি হচ্ছে৷ প্যান্টের চেইন লাগাতে পারছে না। আম্মুকে দেখে বলে উঠে, ” আম্মু চেইন লাগায় দাও।”

মিরা তার কাছে এসে বলে, ” বিচ্ছু বাচ্চা, কাজের সময় আম্মু, আর গল্প করার সময় আব্বু তাই না?”

ইমাদ হাসল। এটুকু বয়সে সে বুঝে গেছে কখন চুপ থাকতে হবে!

মিরা প্রশ্ন করে, ” রেডি হচ্ছো কেন? ”

–” আমরা চাচ্চুকে আনতে যাচ্ছি। চাচ্চু স্লো। এজন্য চাচ্চুর প্লেনও দেরিতে রওনা দিয়েছে। বাবা তো সুপারম্যান। এজন্য আগে আগে চলে আসছে৷”

–” ওহ আচ্ছা। বাবা সুপারম্যান? তাহলে তুমি কী?”

–” আমি স্পাইডার ম্যান, আম্মু৷”

মিরা হেসে বলে, ” তাহলে আমি কী স্পাইডার ম্যানের আম্মু?”

ইমাদ একটু ভেবে জবাব দেয়, ” আম্মু তুমি সুপারম্যানের বউ৷”

মিরা ছেলের উত্তরে অবাক হলো। এই টুকুন বাচ্চা! এখনই বউ কী, জামাই কী বুঝে গেছে। ইমাদ কি বুঝে বলেছে নাকী না বুঝে বললো?

সে বলে উঠে, ” বাবু তুমি আর কখনো জামাই-বউ এসব কথা বলবে না। এগুলো বড়দের কথা। ঠিক আছে? মনে থাকবে?”

ইমাদ গম্ভীরমুখে বলে, ” আচ্ছা আমি বড়দের কথা আর বলব না৷ কিন্তু সৃজা, ওতো সবসময়ই বলে ও বিয়ে করবে৷ ওর বর বাজার করবে৷ ও রান্না করবে। ওকে কেউ মানা করে না কেন?”

মিরা ছেলের চুল আছড়ে দিল। ইমানকে তখন দেখা গেল রুমের ভেতর প্রবেশ করতে৷ মিরা তাকে আসতে দেখে বারান্দার উদ্দেশ্য হাঁটা ধরলে ইমান সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, ” সাদকে আনতে যাচ্ছি আমরা। রাত আটটার মতো হবে ফিরতে। ইরাও যাচ্ছে সঙ্গে। বাই।”

ইমান ইমাদকে ঘাড়ে উঠিয়ে হাঁটা ধরল। নিচে গাড়ি অপেক্ষা করছে৷ ওরা তিনজন বেশ আনন্দের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিরা রান্নাঘরে গিয়ে রান্না বসায়৷ কৈ মাছ ভাজী, বেগুন ভাজী আর শুকটি মাছ রান্না করে রাখবে। তার জানামতে, এগুলো ওর পছন্দের খাবার। হুট করে একটা কথার মাধ্যমে তার মনে তৈরি শক্ত পিলারে গড়া অভিমানের ঘরটা থেকে একটা ইট খসে পড়েছে আজ৷ সুপ্তি বেগম রান্নাঘরে এসে বললো, ” এতকিছু থাকতে তুই আবার কী বানাচ্ছিস? ”

–” রান্না করতে ইচ্ছা করলো তাই বানাচ্ছি। আচ্ছা মা শুন, আমার একটা কথা রাখবে?”

–” তোমর দশটা কথা রাখব। বল, কী বলতে চাস৷”

–” তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না এই কৈ মাছ ভাজী, শুটকি মাছ আমি বানিয়েছি।”

সুপ্তি বেগম হাসলেন এরপর বলে, ” পাগলী৷ আচ্ছা যা বলব না৷”

_______________________

সাদকে রিসিভ করে ফিরতে ফিরতে তাদের সাড়ে আটটার বেশি সময় লাগলো। ইমাদ বাসায় এসে চাচ্চু আর বাবার সঙ্গে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ইরা ওদের সঙ্গে বসে থাকলো। সাদ খানিকক্ষণ বাদে তার দিকে তাকাচ্ছে আর মিটমিট হাসছে। ইরা ততোবারই চোখ রাঙ্গানি দিচ্ছে। মিরা তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলে, ” খেতে আসো সবাই৷”

ইতিমধ্যে সৌজন্যতা স্বরুপ সাদের সঙ্গে তার কুশল বিনিময় ঘটেছে। সাদ আসা থেকে তাকে ভাবী ডাকছে। শুধু তাই না,সে খেয়াল করেছে ইরাও ইমানকে ভাইয়ার বদলে দুলাভাই ডাকছে। ডিনার টেবিলে ইমান ভাত শুটকি মাছের তরকারি, কৈ মাছ ভাজি আর বেগুন দিয়ে খেয়ে উঠে। পোলাও-মাংস কিছু খেল না। খাওয়ার পর দু’চামচ সেমাই খেল। সে যে ডায়েট কন্ট্রোল করে ফিট আছে তা দিব্যি বোঝা যাচ্ছে৷ খাওয়ার পর সবাই একদফা গল্প করল। ঠিক হলো, সাদ আপাতত ইরার রুমে থাকবে। আর ইরা সুপ্তি বেগমের সঙ্গে রুম শেয়ার করবে৷ ইমান ইমাদকে কোলে নিয়ে মিরার বেডরুমে ঢুকল। ইমাদ সাধারণত দশটা অব্দি জাগে না। আজ সে সাড়ে দশটা পর্যন্ত জেগে আছে। বেচারার চোখ ঘুমে কাদা। সে টলছে ঘুমের ভারে৷ কিন্তু তবুও তার বাবাকে ছাড়বে না। আরোও গল্প করবে। মিরাও বাবা-ছেলের পেছনে বেডরুমে ঢুকল। ওরা গল্পের আসর মাত্র জমাচ্ছে৷

মিরা ধমক দিয়ে বলে, ” এখন কোন গল্প হবে না। ঘুমাবে। ইমাদ ব্রাশ করে এসে সোজা চোখ বন্ধ করবে৷ যাও বাথরুমে৷”

ইমাদ মায়ের বাধ্য ছেলে। আম্মুর সব কথাই সে শোনে। তাই ব্রাশ করতে চলে গেল। ব্রাশ করে এসে বলে, ” আম্মু বাবাকে ব্রাশ করতে বললে না কেন?”

মিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে৷ তার ছেলের স্বভাব জানা আছে৷ ইমাদ যাদের খুব পছন্দ করে, সে চায় তার পছন্দের ব্যক্তিরাও সে যেসব এক্টিভিটি করছে সেগুলো অনুসরণ করুক। এখন বাবা তার পছন্দের ব্যক্তি। সে রাতের শোয়ার আগে ব্রাশ করে। সুতরাং সে চাইবে তার বাবাও করুক। যদি না করে পরবর্তীতে সেও আর করতে চাইবে না। কারণ তার পছন্দের মানুষ সেটা করেনি।

সে বলে উঠে, ” ইমাদের আব্বু, যান ব্রাশ করে আসেন৷”

ইমান মোটেও এমন কোন আদেশের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে বলে, “সর‍্যি?”

— ” ব্রাশ করবেন, যান৷ দিনে-রাতে দু’বার ব্রাশ করতে হয়৷ জানেন না?”

ইমান একটু ধাতস্থ হয়ে হেসে বলে, ” যাচ্ছি, ইমাদের একমাত্র আম্মু।”

মিরা দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ইমান ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসলে মিরা প্রশ্ন করে, ” রাতে কোন রুমে থাকবেন?”

–” ইমাদ আর ইমাদের একমাত্র আম্মুর রুমে থাকব।”

মিরা বেডে শুয়ে পড়ল। মাঝে ইমাদ আগেই শুয়ে আছে। সে বাবাকে ডেকে বলল, ” বাবা, আমাকে আরেকবার সিন্ড্রেলার গল্পটা শুনাও।”

মিরা বলে উঠে, ” এসব ফেইরিটেল শুনে কী হবে? তার চেয়ে বাবার কাছ থেকে অংক শিখো।”

ইমান বেডে শুয়ে ইমাদকে গল্প শুনাতে লাগে। একটা সময় মিরা ঘুমিয়ে যায়। ঘুমানোর আগে শুনতে পেল, একদেশে এক রাজা ছিল। তার একটা রাণী ছিল৷

ঘুমের মধ্যে শীতল স্পষ্ট পেল সে। কেউ ধীর গলায় বলছে, ” শুভ জন্মদিন, শেহজাদী। ”

সে সাথে সাথে চোখ খুলল। ঘর অন্ধকার হলেও সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘরে চারপাশে ফেইরিলাইটস দেওয়া। সেগুলো জ্বলছে-নিভছে। ক্যান্ডেলও আছে। আবছা আলোয় ইমানের হাস্যজ্বল মুখটা দেখা গেল৷ পাশেই ইমাদ হাততালি দিচ্ছে। এমন না যে মিরা তার জন্মদিন ভুলে গেছে। তার মাদার’স ডেয়ের দিনই মনে পড়েছিল নিজের জন্মদিনের কথা। কিন্তু তাদের বাসায় তো জন্মদিন সেলিব্রেশনের কোন কালচার নাই। শুধু ইমাদের বার্থডেতে ঘুরতে যাওয়া হয়৷ গিফট দেওয়া হয় ওকে। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসতেই সবাই চেচিয়ে বলে উঠে, ” শুভ জন্মদিন। ”

মা, ইরা, সাদ ছাড়াও সোনালী আপু তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে৷ মিরা অপলক নয়নে চেয়ে থাকলো। ফুল আর কেক ও কার্ড টেবিলে রাখা৷ দুটো কেক রাখা। একটা কেকের উপর ইমানের বলা কথাটাই লেখা৷

” শুভ জন্মদিন, শেহজাদী।” এবং আরেকটায় লেখা, ” ওয়ার্ল্ড বেস্ট মাদার, আই লাভ ইউ।”

সে ইমাদকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বলে, ” থ্যাংক ইউ, আমার সোনা বাচ্চা৷”

ইমাদ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে, ” আমাকে না। বাবাকে থ্যাংক ইউ বলো আম্মু। এসব বাবার প্লান ছিল।”

মিরা একবার ইমানের দিকে তাকালো কিন্তু থ্যাঙ্কিউ বললো না৷ ইমান হাসলো শুধু।

সবাই আরেকবার হ্যাপি বার্থডে বললো। ঘড়ির কাটায় তখন বারোটা বাজে বিশ মিনিট ৷ সে ইমাদ আর সোনালী আপুর মেয়েকে নিয়ে কেক কাটে৷ সবাইকে সে নিজ হাতে কেক খাওয়ালো। বাদ থাকে কেবল ইমান আর সাদ। সাদ অবশ্য ছবি তুলছে তার ক্যামেরায়। সাইকোলজি নিয়ে স্ট্যাডি শেষ করে সে এখন ফটোগ্রাফার হওয়ার ভুত মাথায় চেপেছে৷

ইমাদ হচ্ছে এক নাম্বারের পাকনা। সব খেয়াল করবে সে। মিরা যে ইমানকে কেক খাওয়ায়নি এটা সে খেয়াল করে এবং বলে উঠে, ” আম্মু, বাবাকে কেন কেক খাওয়ালে না?”

মিরা ইমানের দিকে তাকালো। ইমান তার দিকে এগিয়ে আসলে কেবল ইমাদের জন্য সে কেক খাইয়ে দিল। এরপর সবাই ড্রয়িংরুমে চলে গেল৷ মিরাও আসলো সবার সঙ্গে। কেবল ইরা ইমাদ আর সোনালী আপুর মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়ল৷

ইমান সবার সামনে আবারো বলে, ” মিরা, সব ভুল বুঝাবুঝি দূর করে আবার একসঙ্গে থাকা যায় না? মানলাম আমার ভুল হয়েছে৷ এই এতো সুন্দর পরিবার আমাদের, শুধুমাত্র আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর সমস্যার জন্য সবাই ভুগছি। আমি আরেকটা বার সুযোগের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছি। তুমিও ভুল বুঝেছিলে আমাকে, আমিও তোমাকে ভুল বুঝেছি৷ আমি যদি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি, তুমি কেন পারছো না?”

সুপ্তি বেগম বলে উঠে, ” মারে, আমার আর এসব সহ্য হয় না। আর ভালো লাগে না৷”

সোনালী আপু বলে, ” ইমান সত্যি তোর কাছে আরেকটা সুযোগ চায়৷ প্লিজ মানা করিস না৷”

সাদও বলে উঠে, ” প্লিজ মিরা ভাবী, আমাদের ইমাদের জন্য হলেও ভাইয়াকে একসেপ্ট করো আরেকবার। আমরা সবাই তোমাদের তিনজনকে একসঙ্গে দেখতে চাই। আলাদাভাবে না৷”

মিরা বুঝতে পারছে ওরা সবাই একজোট বেঁধে নেমেছে তাকে রাজী করানোর জন্য। সেও কম না। এতো সহজে দমবার পাত্রী না। ইমান তাকে পরপর দু’বার হার্ট করেছে৷ এবার তার পালা।

মিরা বললো, ” আপনি সত্যি আরেকবার চান্স চান?”

–” এটা আবার জিজ্ঞাসা করা লাগে?”

–” আমি চান্স দিব কিন্তু এক শর্তে।”

–” সব শর্তে রাজী।”

–” না শুনেই কেন রাজী হচ্ছে?”

–” তোমার জন্য সব শর্তেই রাজী।”

মিরা বাঁকা হাসলো। এরপর বলে উঠে, ” আমি একমাস সময় নিব। এই একমাসে আমি দেখব আপনি আমাকে পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন কীনা। এর আগের বার অযোগ্য পাত্র হয়েও আমাকে পেয়ে গিয়েছিলেন জন্য মূল্যায়ন করেননি। এবার যোগ্যতা প্রমান করতে হবে৷”

–” আমি শর্তে রাজী। একশ বার রাজী। ”

–” এটা তো শর্ত নয়। ”

–” তাহলে কী শর্ত?”

–” আপনাকে এই একমাস হাউজ হ্যাসবেন্ড হয়ে থাকতে হবে৷ আপনি কী এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবেন?”

উপস্থিত সবাই হতভম্ব হলো। সাদ প্রশ্ন করে, ” হাউজ হ্যাসবেন্ড এটা আবার কী?”

মিরা হেসে উত্তর দিল, ” হাউজ ওয়াইফের মেইল ভার্সন। তোমার ভাই এই একমাস বাসার সমস্ত কাজ সামলাবে৷”

সুপ্তি বেগম ঝারি মেরে বলে, ” পাগল তুই। চুপ কর। এসব কী বলছিস নিজেও জানিস না।”

ইমান সুপ্তি বেগমকে থামিয়ে মিরার চোখে চোখ রেখে বলে, ” আমি হাউজ হ্যাসবেন্ড হয়ে থাকতে রাজী। এতে যদি ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা যায় মন্দ হবে না। তুমি আমাকে আরেকবার সুযোগ দিচ্ছো এটা আমার সাত রাজার গুপ্ত ধন পাওয়ার মতো ভাগ্য।”

মিরা বলে উঠে, ” যতো সহজ ভাবছেন এটা মোটেও ওতো সহজ কোন চ্যালেঞ্জ না৷”

— তোমাদের আরেকবার কাছে পাওয়ার জন্য আমি সব ধরনের চ্যালেঞ্জ নিতে ইচ্ছুক।”

–” এস ইউর উইশ৷”

সুপ্তি বেগম বেজায় ক্ষেপলেন মিরার উপর। কিন্তু মিরা তার সিদ্ধান্তে অনড়। অপর দিকে ইমান চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করেছে। এবার দেখার পালা, ইমান কী পারবে চ্যালেঞ্জ ফুলফিল করতে?

চলবে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here