ফেইরিটেল পর্ব-৫৫

0
1120

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–55

সেদিন একটানা খানিকক্ষণ বাদে বাদে ধরণী ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি নামছিল। সোয়া ছয়টা থেকে একাধারে বৃষ্টি নামায় ইমাদের আজকেও স্কুল যাওয়া হলো না৷ এতে অবশ্য ওর বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। সে বৃষ্টির দিকে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে থেকে নিজ থেকে তোতাপাখি কণ্ঠে বলে, ” বৃষ্টি তুমি প্রতিদিন আসো না কেন?”

তার কথায় আম্মু-আব্বু দুইজনই হাসলো। সে কখনো তার মা-বাবাকে একসাথে দেখেনি৷ আজকে এই প্রথম দেখছে৷ তার কী যে আনন্দ লাগছে৷ নিজের সবচেয়ে প্রিয় দুটো মানুষ একসঙ্গে আছে তার কাছে৷ সে মা-বাবায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ” আই লাভ ইউ আম্মু-আব্বু।”

মিরা ছেলের দিকে তাকালো। আহারে তার ছেলে যখন তাকে এমন আদুরে কথা বলে তার বুক শান্তিতে ভরে উঠে। সে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে, ” স্কুলে পাঠাই নি জন্য আই লাভ ইউ বলা হচ্ছে দুষ্টু বাচ্চা আমার।”

ইমাদ মুখ গম্ভীর করে বলে, ” আমি এজন্য মোটেও বলি নি।”

ইমাদের এই মুখখানা দেখলে অবাক হয় মিরা। যেন ভাবখানা এমন যে উনি বড় কোন অফিসের বস। বিশাল বড় দায়িত্বে আছেন উনি। সিরিয়াল মুড যাকে বলে।

ইমান তার দিকে এগিয়ে এসে ওকে চুমু দিয়ে বলে, ” লাভ ইউ টু৷”

মা-বাবার আদর একসঙ্গে ক্ষুদ্র জীবন এই প্রথমবার ছোট্ট ইমাদ পেল। সে খুশিমনে আবারো শুয়ে পড়ে৷ বাবা পাশে বসে আছে। এবং আম্মু মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে৷

সাতটার দিকে যেন আরো বৃষ্টির প্রকোপ বাড়লো৷ মিরপুরে একটু বৃষ্টি নামলেই রাস্তায় পানি জমে। অতিমাত্রায় জ্যাম সৃষ্টি হয়৷ মিরা একটু পর পর বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি পড়ার গতিবেগ পর্যবেক্ষণ করছে৷

ইমান রুম থেকে বলে, ” আজকে ছুটি নিলেই পারো। বৃষ্টি আজকে সারাদিন হবে৷”

মিরা ভাবলো কিছুক্ষণ। তার গাড়ি আছে। সে চাইলে বের হতে পারবে৷ কিন্তু কথা হলো বৃষ্টির অযুহাত দিয়ে আজকে অনেকেই অফিস করবে না৷ তাদের অবর্তমানে দেখা গেল ন্যান্সি ম্যাডাম তাকে ভর্তুকি দিতে বলবে। এর চেয়ে না যাওয়াই ভালো৷ এম্নিতে সে গত পড়শু কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে৷ আপাতত চাপ কম।

সে রুমে এসে ফোন দিল ন্যান্সি ম্যাডামকে। ইমান বিছানায় শুয়ে সবটা দেখছে৷ ইমাদ ততোক্ষণে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে৷

ন্যান্সি ম্যাডাম তার ফোন দেখেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠে, ” আজকে ছুটি নিতে চাও নাকী?”

–” হ্যাঁ, ম্যাম।”

–” আমাকে কল না করে, নতুন সিইও স্যারকে মেইল কর। উনি ছুটি দিলে ছুটি কাটাও।”

মিরার মুখ কালো হয়ে আসলো। এইজন্য বুঝি ইমান আগ বাড়িয়ে ছুটি নেওয়ার বুদ্ধি দিল! মানে কত ফাজিল হলে এমন করে একটা মানুষ!

ইমান তার দিকে বারবার দেখছে আর ফোন হাতে নিয়ে কী যেন করছে। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে মেইল পাঠালো৷ দু’সেকেন্ডের ব্যবধানে ইমান হোহো করে হেসে উঠলো। মিরার এতো রাগ হলো। আশ্চর্য!তার ই-মেইল দেখে এতো হাসার কী হলো?

মিরা বলে, ” এই যে শুনছেন? এতো হাসির কী দেখলেন? আগে কোনদিন মেইল দেখেন নি? কেউ কখনো ফর্মাল মেইল সেন্ড করেনি আপনাকে? এরপর একদণ্ড থেমে বলে, ” আপনাকে তো মেইল পাঠায় না কেউ। সব মেয়েরা তো আপনার কাছে লাইন দিয়ে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এ কথা বলে।”

ইমান ভ্রু কুচকে তাকালো তার দিকে এরপর ফোন ঘেঁটে বলে, ” ওহ আচ্ছা, তুমি একদিনের ছুটি চেয়ে মেইল দিয়েছো৷ আমি মাত্র দেখলাম। ওকে তোমার ছুটি মঞ্জুর।”

মিরা তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বিছানার অপরপ্রান্তে গিয়ে শুয়ে পড়ে৷ বৃষ্টি হতে থাকায় পরিবেশ শীতল। ইমান উঠে গিয়ে ফ্যানের স্পিড কমালো। এরপর ইমাদ আর মিরার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিতে গেলে মিরা চোখ খুলে ফেলে৷ ইমান প্রশ্ন করলো, ” ব্রেকফাস্ট এ কী খাবে?”

মিরা এহেন প্রশ্নে সামান্য হচকচিয়ে যায়। পরবর্তীতে মনে পড়ে মিষ্টার খানের তো আজ থেকে হাউজ হ্যাসবেন্ড হওয়ার ডিউটি শুরু। সে বলে উঠে, ” রুটি আর আলুভাজি।”

–” আর কিছু? ”

–” ডিম পোজ আর এক কাপ চা।”

–” আমি সারাজীবনের জন্য তোমার বেড-টি বানানোর দায়িত্ব নিতে চাই।”

মিরা পাশ ঘুরে ইমাদের দিকে ফিরে শুলো।

______________________________

মিরা যখন ঘুম থেকে উঠে তখন কানে ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর শুনতে পেল৷ ব্যাপার কী? ইমাদ তো ওয়ান-টু এসব শিখে ফেলেছে। সে ঘুম থেকে উঠে আশেপাশে তাকাচ্ছে। রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা কিন্তু বারান্দা থেকে শব্দ আসছে। সে শব্দ উৎসের দিকে হেঁটে গেল৷ বারান্দায় পাটি বিছিয়ে দুই বাপ-বেটা পুশ আপ দিচ্ছে৷ ইমাদ অবশ্য পারছে না। বাবাকে নকল করার চেষ্টা করছে। আবার টায়ার্ড হলে থেমে গিয়ে বসে বসে বাবার পুশ আপ দেওয়ার সংখ্যা গননা করছে৷

–” এইট, নাইন, টেন……. ” বলেই ইমাদ হাতে তালি দিল।

ইমান পুশ আপ করতে করতে মিরার দিকে তাকালো। এরপর বলে উঠে, ” গুড মর্নিং। ”

মিরা হাই তুলে বলে, ” কি হচ্ছে এসব?”

–” বাবা পুশ আপ দিচ্ছে আম্মু৷ কিন্তু আমি দিতে পারি না ঠিকঠাক মতো। বাবা আমাকে শেখাবে।তুমি শিখবে পুশ আপ দেওয়া? ”

শেষের কথাগুলো ইমাদ ভারী দুঃখ নিয়ে বললো। মিরা ইমানের দিকে তাকালো। সে আপাতত উঠে বসে বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছে। এটা মিরার সবচেয়ে অপছন্দের কাজ। কেউ বোতলে মুখ লাগিয়ে খেলে মিরা সেই বোতলের পানি খেতে চায় না একদম।

ইমান তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” সকালের নাস্তা টেবিলে আছে। আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। তো হার হাইনেজ, আপনাকে খাইয়ে দিব নাকি নিজে খাবেন?”

মিরা বলে উঠে, ” আমি নিজে খেতে জানি। ইমাদ আসো তোমাকে নাস্তা খাওয়াব৷ আসো জলদি।”

ইমান বিড়বিড় করে বলে, ” হাউজ হ্যাসবেন্ডরা বউদের খাইয়ে দেয় তো!”

ইমাদকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বোঝা গেল, সে বাদে সবাই খেয়ে নিয়েছে। কাল রাতে সোনালী আপু থেকে গিয়েছিল৷ আপু, ইরা আর সাদ ড্রয়িংরুমে গল্প করছে।

সে ইমাদকে রুটি আর আলুভাজি খাইয়ে দিল। তখনই ইমান আসল। সেও ব্রেকফাস্ট করেনি৷ মিরার সঙ্গে খাবে বলে৷ সে টেবিলে বসতেই ইমাদ ওর আম্মুকে বলে উঠে, ” আম্মু তুমি বাবাকে খাইয়ে দাও। যেভাবে আমাকে খাইয়ে দিলে।”

ইমান তখন গ্লাসে জুস ঢালছিল। ছেলের কথা শুনে সে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। কথা হলো, ছেলেটা তার মনের কথা কেমনে বুঝে গেল? বাপ রে! কিন্তু পোড়া কপাল! ছেলে তো আর জানে না তার মা-জননী কতো হৃদয়হীনা।

মিরা বলে উঠে, ” তোমার বাবা তো বাচ্চা না। সে একা একা খেতে পারে। তাছাড়া তুমিই তো বলো তোমার বাবা সুপারম্যান। সুপারম্যান কখনো কারো হাতে খায় না।”

ইমাদ মুখ ঘুরিয়ে বলে, ” তাহলে আমিও তোমার হাতে খাব না। আমি স্পাইডার ম্যান। স্পাইডার ম্যানও আম্মুর হাতে খায় না৷”

মিরা ভারী ঝামেলায় পড়ে গেল। ইমাদ পটরপটর করে তোতাপাখির মতো সব কথা বললোও, নিজে নিজে ঠিকমতো খেতে পারে না। একলা রুটি ছিঁড়ে ও কোনদিন নাস্তা খেয়েছে কীনা সন্দেহ।

মিরা বলে, ” তুমি বাবু স্পাইডার ম্যান। বাবুদের হিসাব আলাদা।”

ইমানও সায় দিয়ে বলে, ” হ্যাঁ বাবাই। আম্মুর কথা শোন।”

কিন্তু নাছোড়বান্দা ইমাদ জেদ ধরলো। বাবাকেও খাইয়ে দিতে হবে। একসময় সোনালী আপু এসে বললো, ” ইমাদের কথা শুন। ছোট মানুষ আবদার করেছে। ”

পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে ইমাদ কিছুতেই মুখ খুলছে না। মুখে খাবার নিচ্ছে না। অগত্যা বাধ্য হয়ে ছেলের জন্য মিরা ইশারায় ইমানকে এদিকে আসতে বললো। ইমান তার কাছে আসলে, এক লোকমা খাবার তার মুখে তুলে দিল৷ ইমাদ খুশি হয়ে সারাবাসা প্রচার করে বেড়ালো এ খবর। ইমান মিরার হাত থেকে খাবার খেয়ে উঠে সোজা বেডরুমে চলে যায়। বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। মিরার হাসি পেল ভারী।

দুপুরের পর ইমাদের জ্বর আসলো। ওর একদম মুখ-চোখ শুকিয়ে গেল। ক্লান্ত দেখালো ওকে। দুষ্টুমি সব বন্ধ হয়ে গেল ওর। সে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে রইল৷ ইমানের সে কী চিন্তা। এক মুহূর্তের জন্য ছেলের কাছ থেকে উঠছে না। আজকে বিকেলে ইমাদকে নিয়ে ঘুরার পরিকল্পনা ছিল। তাই ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে ইমানের৷

মিরা বলে, ” বাচ্চারা প্রায়ই অসুস্থ হয়। এতে এতো বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।মেডিসিন খেয়েছে৷ সেরে যাবে৷ ”

তবুও ইমান বিকেল অব্দি মাথায় জলপট্টি দিল৷ পাশে বসে থাকল। কিন্তু বিকেলের দিকে সুপ্তি বেগম বললেন, ” মিরার দাদীকে হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসতে হবে।”

ইমানকে সে রিকুয়েষ্ট করল যাওয়ার জন্য। কিন্তু মিরা জানিয়ে দিল সে যাবে না। তাকে রেখে সবাই গেল। আশ্চর্যজনক ভাবে সুপ্তি বেগমও গেলেন সবার সঙ্গে। সাদ যদিও তাদের কাছের কেউ না, তাও ভাইয়ের ফ্যামিলি মেম্বার মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। এজন্য মানবিকতার খাতিরে সেও গেল। বাসায় রইল কেবল মিরা আর ইমাদ। ইমাদের কিছুটা সুস্থবোধ হচ্ছে জন্য সে টিভির রুমে ডোরেমন দেখছিল। মিরা তার জন্য স্যুপ বানাতে বানাতে অতীতে বিচরণ করে।

দাদী নামক ব্যক্তি তার খুব প্রিয় ছিলেন একসময়। যদিও দাদীর চিন্তাভাবনা সেকালের। সে নাতি-নাতনিদের খুব ভালোবাসেন। কিন্তু কেন যেন তার ছেলের বৌদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক কোনকালেই ছিল না। বড়আম্মুর সঙ্গেও তার ঝামেলা বাঁধত। মিরা যখন ফোরে পড়ে তখন সোনালী আপুর আম্মু মারা গেলেন। বড় আম্মু মিরা-ইরা দুজনকেই খুব আদর করত৷ ওনার গত হওয়ার পর সমস্ত দুর্ব্যবহারের শিকার সুপ্তি বেগম হয়ে এসেছেন। পুত্রের দোষ তার চোখে ধরা দিবে না৷ কাজেই যাবতীয় সকল দোষ সুপ্তি বেগমের। এসব পুরাতন কথা। সব জানার পরও যৌথ পরিবারে তারা থেকে এসেছে৷ একসঙ্গে থাকলে টুকটাক ঝামেলা হবে জন্য মা মানিয়ে চলত। এতোকাল এটাই ভেবে এসেছিল মিরা৷ কিন্তু ইমানের ঐ বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়ার পর একক বাসা গঠন করার পর মিরা তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য জানতে পারল। ওই সময় বাবা অকারণেই খুব বাজে ব্যবহার করতেন। এমনকি তার আদরের মেয়েদেরকে উপর চিল্লাতেন। ইরাকে একদিন থাপ্পড়ও মেরেছিল। দুই ভাই এতোকাল একসঙ্গে ছিল জন্য সম্পত্তির বন্টন হয়নি এতোদিন৷ কিন্তু আলাদা হতেই বোঝা গেল আজিজ তালুকদার সাহেবের নামে তাদের বাবা তেমন কিছু লিখে যান নি। এদিকে আজিজ সাহেব ভাইয়ের ব্যবসায় জড়িত ছিল। নিজের বলতে তেমন কিছু নেই। ভাইয়ে ভাই ঝগড়া বাধল৷ আজমল সাহেব তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা গুটান ফলে অর্থনৈতিক ভাবে আজিজ সাহেব দুর্বল হয়ে পড়লেন। মাথা ঠিক থাকত না তার৷ এমনই একদিন সুপ্তি বেগমের সঙ্গে তার কী নিয়ে লাগলো যেন। তিনি মেজাজ ধরে না রাখতে পেরে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের সামনেই স্ত্রীদের গা’য়ে হা’ত তু’লে’ন। মায়ের গাল লাল হয়ে যায়। সে আঘাত প্রাপ্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। জ্বর আসে তার৷ মিরা সেরাতে মায়ের কাছে যায়। কারণ মায়ের কষ্ট সে উপলব্ধি করতে পারছিল। সেও তো বিবাহিত। ওই রাতে মায়ের কাছে গেলে, মা নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। জ্বরের ঘোরে সে মিরাকে তার বাবার সমস্ত অতীত বলে দেয়। নিজের বাবা অতীত মিরা মানতে পারেনি। এদিকে ঘরে প্রতিদিন অশান্তি। উড়ো খবর আসল আজিজ সাহবে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সুখ সে যেন মরিচীকা। বাসাটা নরকে পরিনত হলো যেন৷

এরপর কিছু দিন পর, সুপ্তি বেগম মিরাকে সিদ্ধান্ত জানালো যে ওদের নানাবাড়ি চলে যাবেন। তিনি-ই মিরাকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন৷ মা তো জানত না, ইমানের সঙ্গে মিরার সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই। সে চাইছিল মিরা নিউইয়র্ক গিয়ে সেটেল হলে ইরাকে গতি করে দিবে৷ দু’মেয়ের চিন্তা থেকে সে মুক্তি পাবে৷ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনি। অশান্তি হাত থেকে বাঁচার জন্য সে নিউইয়র্কে চলে আসে। কাউকে কিছু না জানিয়ে। বড় আব্বু তার জন্য পাসপোর্ট আর ভিসা বানিয়ে ফেলেছিল। টাকা জোগাড় করে নিউইয়র্ক আসতে তার অবশ্য ক’দিন সময় লেগেছিল৷ বাবার লজ্জাজনক কৃতকর্মের দায় থেকে সে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। এজন্য মূলত নিউইয়র্কে আসা৷ মানসিক শান্তির জন্য সে বাংলাদেশ ছাড়ে৷ কিন্তু নিউইয়র্কে তার জন্য আরো ক্ষতিকর সত্য অপেক্ষা করছিল। নিজের সৎবোনের সন্ধান মিললো সেখানে। শ্বশুড়ের অপমান, স্বামীর জন্য নিজের বোনের ভালোবাসা মিরা ওই বিশ বছর বয়সে সহ্য করতে পারেনি। বুকে ব্যথা নিয়ে মাকে হতাশ করে ফিরে আসে। কিন্তু মা তাকে দূরে ঠেলে দেয়নি। বুকে আগলে রাখলো। তার কাছ থেকে সব সত্য শুনে সে নীরব থেকেছে৷ তবে মেয়ের জন্য সে ঢাল হয়ে থাকল৷ ঐ সময় দাদী তাকে এবং তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” দুই মা-মেয়ে স্বামী-সংসার ফেলে কী বে/শ্যা গিরি শুরু করতে চাস?”

এই একটা বাক্যের জন্য মিরা দাদীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করল। তখন ইমাদ পেটে ছিল। এতোবড় সুখবর পেয়েও তারা আনন্দ করতে পারে না। খুব হিসেব করে চলতে হত৷ ইমান দেশে আসে। তার কাছে ক্ষমা চায়। মিরা তখনো ট্রমা থেকে বের হতে পারছিল না কাজেই সে সময় চায়৷ ইমাদ হওয়া অব্দি ইমান দেশে ছিল। সমস্ত খরচ সে বহন করেছে। ইমাদের যখন তেরদিন ওই সময় ইমানকে নিউইয়র্ক যেতে হলো। পিটার নাকী তার উপর লিগ্যাল একশন নিচ্ছিল। ঝামেলা করছিল। ইমান নিউইয়র্ক যাওয়ার পর তাদের যোগাযোগ কমে আসলো। ইমাদ আরেকটু বড় হলে মিরা পড়াশোনা কন্টিনিউ করে। ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়া শুরু করল। কেননা ততোদিনে সে আর সুপ্তি বেগম অলনাইনে ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসা শুরু করার জন্য মূলধন বড় আব্বু দিয়েছিল৷ সহযোগিতাও করেছেন উনি। ওনার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতা থাকবে মিরার৷ ভার্সিটির প্রাঙ্গনে হুট করে রাকিবের দেখা মিলল। রাকিব যে এক সময় তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল৷ রাকিব ওর সিনিয়র ছিল৷ প্রথম দিকে মিরা রাকিবের সঙ্গে কথা বলত না। কিন্তু রাকিব তার সঙ্গে কথা বলার জন্য মরিয়া। মিরা বিবাহিত জানার পরও ফ্রেন্ড হতে চাইল। কিন্তু ও ফ্রেন্ডশিপ করল না। তবুও রাকিব তার সাথে নাইসলি বিহেইভ করা শুরু করল। মিরা ভেবেছিল রাকিব হয়তোবা ভালো মানুষ। তাকে সম্মান করে মন থেকে। কিন্তু সে আসলে মুখোশধারী মানুষ চিনতে শিখেনি। দু’মাসের মাথায় ভার্সিটিতে রাকিব রটিয়ে দিল তাদের মধ্যে প্রনয়ের সম্পর্ক আছে। এই কথা কীভাবে যেন দাদীর কানে যায়। দাদী তখন মিরার উপর বেজায় ক্ষিপ্ত। তিনি ইমানের কানে বিষ ঢালে। ইমান সরাসরি মিরাকে সন্দেহ করে প্রশ্ন করে বসে। এতেই মিরার ইগো হার্ট হলো। ছোট্ট ইমাদকে সামলে, পড়াশোনা, ব্যবসায় কাজ করতে করতে হাপিয়ে যাওয়া সংগ্রামী মিরা নিজের চরিত্রে দাগ সহ্য করতে পারলো না। ইমানের সঙ্গে ডিভোর্স নিতে চাইলো। সময় আর নিবে না। কিন্তু তাদের তালাক হলো না। দুটো কারণে, প্রথমত ইমান রিয়েলাইজ করে যে সে ভুল করেছে। আর দ্বিতীয়ত, তালাক হলেও ইমান ইমাদকে নিজের কাছে রাখবে বলে কাস্টাডি চাইছিল। ইমান ক্ষমা চাইছিল বারবার জন্য বড় আব্বু আর মা দু’জনই তাকে আরো ভাবতে বললো।
এছাড়াও সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদের অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়তে হবে ভেবে সুপ্তি বেগম সিদ্ধান্ত বদলাতে বলেন। ওনার ভাষ্যমতে, ওদের দু’জনের দোষ সমান। মিরাও সন্দেহ করেছিল৷ ইমানও করেছে। বরং ইমান ক্ষমা চায়। কিন্তু মিরা ক্ষমা চায়নি একবারও৷ এ ঘটনা যখন ঘটলো তখন ইমাদের বয়স আট মাস৷

তাদের সম্পর্ক শুরু থেকেই খাপছাড়া। ছন্নছাড়া। কোন কমিটমেন্ট নেই৷ ইমান প্রথম থেকেই কেমন দায়িত্বহীন৷ এজন্য হাইজ হ্যাসবেন্ড হিসেবে একমাস মিরা তার এক্টিভিটি চেক করবে। কেমন সাংসারিক সে! বাবা হওয়া সহজ কথা না। তাকে ঘর-সংসারের উপর মনোযোগী হতে হবে৷

মিরা অতীতের ভাবনা থেকে ফিরে আসলো। সে স্যুপ বাটিতে সার্ভ টিভির রুমে যেতেই হাত থেকে বাটি পড়ে গেল। ছোট্ট ইমাদ কেমন জানি করছে৷ বাচ্চার মুখ নীল হয়ে এসেছে। হাত-পা কাঁপছে ওর। মনে হচ্ছে শ্বাস নিতেও কষ্ট পাচ্ছে। সোফার এককোনায় পড়ে আছে। মিরা দৌঁড়ে গেল তার বাচ্চার কাছে। সে যেন চোখে আঁধার দেখছে।

চলবে৷

[ আই হোপ, আজকে সব ক্লিয়ার হয়েছে৷ অনেকেই বলতে পারেন, এতো ছোট কারণে কেন এতো দূরত্ব দেখালেন। আমি অনেক ভেবে এই রিজন দিয়েছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দূরত্ব আসার পেছনে দেখানো হয়, নায়কের অন্যকারো সঙ্গে প-র-কি-য়া ইত্যাদি। এমন কারণ আমিও দেখাতে পারতাম। সেটা বেশি লজিক্যাল হত৷ কিন্তু ইচ্ছা করে দেখাইনি। ভুল বোঝাবুঝি আর ইগো হার্ট অব্দি সীমাবদ্ধ রাখলাম কারণ মেইন লিডদের ইমেজ আমি ফল করতে চাচ্ছি না। ফেইরিটেল একটা তৈরীকৃত গল্প। বাস্তবতা থেকে নেওয়া নয়। সবাইকে ভালোবাসা অবিরাম। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here