ফেইরিটেল পর্ব-৫৬

0
1189

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–56

বিপদের আভাস টের পেতেই মিরা দিশেহারা বনে গেল। তার নিজের বুদ্ধিমত্তা যেন লোপ পাচ্ছে। একটা মানুষ অনেক বৃহৎ আকারের ব্যথা অনায়াসে সহ্য করতে পারলেও সন্তানের মুখে সামান্য “আহ্” যেন সোজা কলিজায় গিয়ে বিঁধে৷ সে তড়িৎবেগে ইমাদের দিকে ছুটে যায়। নিষ্পাপ, সর্বদা হাসি-খুশি উজ্জ্বল মুখটা যেন কাহিল হয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। সে গিয়ে ইমাদের হাত ধরলো। ভীষণ জোড়ে কাঁপছে ওর হাত৷ নিজের বুকের সঙ্গে ইমাদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল সে৷ মাথা যেন হ্যাংক মেরে বসে আছে৷ সে সাহায্যের জন্য আশেপাশে তাকাচ্ছে। আজ বাসায় কেউ নেই। টিভিতে তখনোও ডোরেমন চলছে। মিরা সেন্টার টেবিলের উপর নিজের ফোন দেখতে পেল। সাত-পাঁচ না ভেবে সে ইমানের নাম্বারে কল দিল৷ ইমাদের শরীরের তাপমাত্রা হুহু করে বেড়েছে। বুকের ভেতর জড়িয়ে নেওয়ায় সে ছোট্ট শরীরটার উষ্ণতা অনুভব করে৷ অপরপ্রান্তে দু’বার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। মিরা ব্যতিব্যস্ত, বিচলিত, আতংকিত, অস্থির এবং ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠে, ” ইমান আপনি জলদি বাসায় আসেন৷ বাবু হুট করে কেমন জানি করছে। আমার খুব ভয় হচ্ছে৷ আপনি এক্ষুনি আসুন।”

ওপাশ থেকে ইমান কী উত্তর দিল মিরা শুনতে পেল না। ফোন কেটে যায়৷ করুণাময় সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে মিনিট দশেকের মধ্যে ইমাদের হাত কাপা-কাপি বন্ধ হলো। সে নিশ্চুপ হয়ে মায়ের বুকে নেতিয়ে থাকলো। মিরা চুপচাপ তাকে কোলে নিয়ে বসে থাকলো। হাসপাতাল যাওয়া উচিত। কিন্তু এতো বৃষ্টি হচ্ছে। ইমান আসা অব্দি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই৷ আরো পনের মিনিট পর গাড়ির হর্ণ বাজলো। ক্ষণেই ইমান এবং সাদ হুড়মুড় করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে৷ মিরা এক ঝলক তার পানে তাকালো। ইমানের চুল, শার্ট সহ সমস্ত শরীর ভিজে গেছে। সে ছুটে ইমাদের কাছে আসলো৷ মিরার কোল থেকে নিজের কোলে তুলে নিল। দু’দন্ড পর্যবেক্ষণ করে এবং মিরার মুখে বাকি ব্যাখা শুনে সে বলে উঠে, ” বাবুর খিচুনি উঠেছিল। আমার আম্মারও জ্বর বা সাডেন শক পেলে খিচুনির রোগ দেখা দিত। ছোট্ট বাচ্চাদের জ্বর বা বিভিন্ন কারণে খিচুনি হতে পারে৷”

এরপর সে পরপর ইমাদের গালে চুমু খেল। সাদ পানির গ্লাস এনে মুখে-চোখে পানি দিল৷ একটুপর পিটপিট করে ইমাদ চোখ খুলে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমার ভালো লাগছে না বাবা৷ মাথাব্যথা করছে। ”

মিরা উঠে এসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ” আমার সোনা বাচ্চার কী হলো হুট করে?”

ইমাদ সঙ্গে সঙ্গে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পরে৷ কোনো একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছেন, মায়ের পরশ মহাঔষধ। মায়ের বুকে কোন ধরনের অসুস্থতা, অশান্তি, মন খারাপ হানা দেয় না৷

ইমান ডাক্তার কল করল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য ডাক্তারের আসতে সময় লাগবে জন্য নিজে গাড়ি নিয়ে ডাক্তারের বাসায় গেল। ডাক্তার এসে চেক করলেন। ওনার মতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়৷ মেজর অসুখও নয় তাই টেনশন নেওয়ার কিছু নেই। সিরাপের নাম লিখে দিল৷ ইমান দ্রুত সেই ঔষধ কিনে আনল৷ ইমাদকে খাওয়ানো হলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যে জ্বর নেমে গেল। রাত নয়টার পর বাবু সম্পূর্ণ সুস্থ। সুপ্তি বেগম ও ইরার আসতে লেইট হয়েছিল। তাদের পরবর্তীতে সাদ গিয়ে এনেছে৷ ইমাদের জন্য সকলেই চিন্তিত হয়েছিল কেননা সে এই বাসার প্রাণ। তাকে কেন্দ্র করেই এ’বাসার প্রতিটা মানুষ নতুন করে হাসতে শিখেছে৷ রাতে কেউ ঠিকমতো খাবার খেল না৷ ইমাদ খুব দ্রুত আরাম করে মা-বাবার মাঝে ঘুমিয়ে যায়৷ মিরা আর ইমাদ সে’রাতে ঘুমায়নি৷ সম্পূর্ণ রজনীতে তাদের বহুবার দৃষ্টিবিলাস ঘটেছে৷ ইমান বারবার মিরাকে ঘুমিয়ে যেতে বলে কিন্তু মিরার দু’চোখে ঘুম ধরা দিল না৷ সকালবেলা সব স্বাভাবিক। ইমাদের শরীর একদম সুস্থ। রাতের সমস্ত অসুস্থতা সে ঝেরে ফেলে সকালে উঠেছে। আজও স্কুলে গেল না জন্য সে দারুণ খুশি। সকালে মায়ের সঙ্গে নাস্তা করল। দেশের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাতে ঘূর্নিঝড় ধেয়ে এসেছে এজন্য এর প্রভাব রাজধানীতেও কম-বেশি পরেছে৷ আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে রাজধানী ঢাকায় একটানা ছয়দিন বৃষ্টি থাকবে। শহরবাসী বৃষ্টি পছন্দ করে। বৃষ্টি নামলে কেউ কেউ বৃষ্টিতে ভিজে, বেশিরভাগ বাসায় খিচুড়ি বানানো হয়৷ অনেকেই কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনে। মানুষ সোশালমিডিয়ায় বৃষ্টির ছবি তুলে পোস্ট দেয়৷ বলতে গেলে জমজমাটভাবে উৎযাপন করে তারা। কিন্তু সেটা একদিনের জন্য। দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হয় ভোগান্তি ও বিরক্তি। আজকে অফিস কামাই দেওয়া সম্ভব নয়৷ ইমান-মিরা দুজনই বের হবে৷ কিন্তু ড্রাইভার আবারোও ছুটি নিয়েছে৷ মিরা যখন রেডি হচ্ছিল তখন দেখা গেল বাপ-বেটা মিলে নিচে নামলো। যাওয়ার আগে ইমান তার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আনলো৷

মিরা যখন নিচে নামলো সে দেখতে পেল ড্রাইভিং সীটে বাবা-ছেলে বসে মিছি মিছি গাড়ি চালাচ্ছে। আবার ইমান বাবুকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। ভাবখানা এমন যেন ইমাদ সত্যিকার অর্থে গাড়ি চালানো শিখছে৷ মিরা কাঁচের জানালায় টোকা দিল। কাঁচ নামাতেই ইমাদ বলে উঠে, ” আম্মু আমি গাড়ি চালানো শিখছি। কাল থেকে আমি তোমাকে অফিস নিয়ে যাব৷”

মিরা ছেলের কথায় হেসে বলে, ” আমার বাবাই তো দেখছি অলরাউন্ডার।”

ইমান ইমাদকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ” এখন তাহলে বাসায় যাও বাবা৷ আমরা অফিসে যাব৷”

ইমাদ লিফটে করে উপরে উঠে গেল। ইমান ড্রাইভিং সীটে বসে থাকল। কিন্তু মিরা গাড়িতে উঠতে ইতস্ততবোধ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলে, ” আপনি যান৷ আমি পরে আসছি রিকশা…… “।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইমান নেমে পরে বলে, ” যাও তুমি।”

কথাটি শেষ করে সে গ্যারেজ থেকে বের হলো৷ মিরপুরের এ’বাসাটা সাততলা। বিল্ডিংয়ের পাশ ঘেঁষে বিশাল বড় কৃষ্ণচূড়া গাছে আছে। গ্রীষ্মকাল হওয়ায় গাছের ডালে-ডালে, থোকায় থোকায় লাল ফুল উঠেছে। বাতাসে ফুল বৃষ্টির মতো ঝরছে। সারা রাস্তা জুড়ে লাল ফুলে ভরে গেছে৷ অপূর্ব দৃশ্য। শুধু কৃষ্ণচূড়া নয়, সোনালী রঙের সোনালু ও জারুল ফুলে শহর ছেয়ে গেছে। গ্রীষ্মকালের ঢাকাও এতো সুন্দর ইমান ভাবতেও পারেনি। নাকি এবার শহরে বেশ ফুল ফুটেছে? তখনই টুপ করে একটা কৃষ্ণচূড়া তার কাঁধে এসে পরে আটকে যায়। সে ফুল হাতে নিয়ে ধরে থাকলো৷ হর্ণের শব্দে ঘোর কাটে। মিরা গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে হর্ণ বাজাচ্ছে। রাস্তা সম্পূর্ণ ফাঁকা তাও কেন হর্ণ বাজাবে?

মিরা কাঁচ নামিয়ে বলে, ” যখন-তখন আবারো বৃষ্টি নামবে। গাড়িতে উঠুন। ”

ইমান মুচকি হেসে বলে, ” এমনই করে প্রতিদিন বৃষ্টি ঝরুক আর তুমি আমায় আপন করে নাও প্রিয় কৃষ্ণচূড়াময়ী!”

সে গাড়িতে উঠে মিরার কানে সেই কৃষ্ণচূড়া গুঁজে দেয়। সে ভ্রুকটি করে তাকাতেই ইমান বলে, ” তুমি কৃষ্ণচূড়ার থেকেও বেশি প্রিয়৷ ”

______________________________

ইরা আজকে বেশ সেজেগুজে ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হলো। বাসার সামন থেকে রিকশা ঠিক করে যখনই কেবল বসলো। আসমান থেকে টপকে সাদ তার রিকশায় লাফ দিয়ে উঠে বসে। সে বিষ্ময়ে অবাক হয়ে গেল।

সাদ এক গাল হেসে চুল ব্রাশ করে বলে, ” হ্যাপি ব্রেক আপ। সুইট সিক্স। ”

ইরা বলে, ” আমার ব্রেক আপে দারুণ খুশি মনে হচ্ছে। ”

–” অফ কোর্স খুশি। ব্রেক আপ হলেই তো আমি চান্স পাব৷”

ইরা মুখ কুচকে “ইউউ” ধ্বনি উচ্চারণ করে৷ সাদ তার দিকে তাকালো এরপর বলে, ” এম আই নট গুড লুকিং?”

–” আমি তোমাকে নিজের ফ্রেন্ড ভাবি।”

–” ফ্রেন্ড কী প্রেমিক হতে পারে না বা প্রেমিক কেন ফ্রেন্ড হতে পারবে না শুনি?”

–” আমার কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানে টাইম পাস।”

–” তাহলে আসো টাইম পাস করি।”

রিকশা গলির মোড় থেকে রোডে আসল। মেইন রাস্তায় এক হাঁটু সমান পানি জমে আছে। মরা জ্যাম বেঁধেছে৷ গাড়ি-রিকশা, মোটরসাইকেলে রাস্তা ভরে আছে৷ মানুষ চলাচলের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। ফাক-ফোকর দিয়ে মানুষ সমানে হেঁটে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সাদ ইরাকে প্রোপোজ করে বসে৷ ইরার সপ্তমতম বয়ফ্রেন্ড হতে চাওয়ার জন্য প্রোপোজ করল৷

ইরা বলে, ” না।”

–” সি, এক হাঁটু ময়লা বৃষ্টির পানিময় জ্যামের মধ্যে আমিই প্রথম কোন বান্দা যে প্রেম-নিবেদন করছিব। রাজী হও প্লিজ৷”

–” আমি রাজী হলে কততম গার্লফ্রেন্ড হবো?”

–” দশম। অরিজিনালি প্রথম এবং শেষ।”

–” বিষয়টা এমন দাঁড়ালো না, হোয়েন এ ফা/ক/ব/য় মিট এ প্লে’য়া’রগা’র্ল!”

সাদ হোহো করে হেসে ফেলে। ইরার হাত ধরতে ধরলে সে হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, ” রিমেম্বার এটা কিন্তু জাস্ট ফর ফান। টাইম পাশ। টেম্পরারি।”

সাদ মাথা নাড়ালেও মনে মনে বলে, ” তোমার টেম্পোরারি কমিটমেন্টকে দ্রুত পার্মানেন্ট করে নিব৷ প্যারা নাই, চিল।”

★★★

মিরার ভীষণ মেজাজ খারাপ। দু’ঘন্টা ধরে সে অফিসে বসে অন্যের কাজ সামলাচ্ছে। বিনামূল্যে কামলা খাটছে সে। বৃষ্টির জন্য আজ ছয়জন আসেনি। তাদের কাজ গুলো অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে ন্যান্সি ম্যাডাম। মিরা তার ভাগের কাজ শেষ করে ফাইল হাতে কেবিন ছেড়ে বের হলো। ন্যান্সি ম্যাডাম তার রুমে নেই। সেজন্য সে আনিস ভাইকে ডেকে বলে, ” ম্যাম কোথায়?”

আনিস মিয়া বলে, ” ম্যাডাম তো কমনরুমে আছে। আফা চা খাবেন?”

–” না।”

–” ক্যান্টিনে কলিজার শিঙ্গাড়া বানানো হয়েছে৷ খাবেন আফা?”

–” না, আনিস ভাই খাব না৷”

কমনরুমে ইমান আর ন্যান্সি ম্যাডামকে কথা বলতে দেখা গেল৷ মিরা যেতেই ফাইলটা ইমান চাইল। তাকে ফাইল দিতেই সে ফাইল চেক দিয়ে কিছু ভুল ধরে বলে, ” রুফটপে আসো।তোমাকে বাকিটা প্রোপারলি বুঝিয়ে দিব।”

মিরার বিরক্তিতে মুখ কালো হয়ে আসলো। সে ইমানের সঙ্গে দশতলা রুফটপে গেল৷ রুফটপের মাঝখানে টেবিল আর দুটো চেয়ার দেওয়া। তারা আসতেই আনিস ভাই দু’মগ কফি দিয়ে বিদাই হলো। ইমান চেয়ার টেনে মিরাকে বসার আহ্বান জানিয়ে বলে, “একদা তোমার সাথে কফি ডেটে যেতে চেয়েছিল। সেই সৌভাগ্য তো হলো না। তাই এখন সাধ পূরণ করছি।”

মিরা চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলে, ” দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন?”

ইমান হাসল এরপর চেয়ার টেনে বসে বললো,” মিরা?”

–” কিছু বলবেন?”

–” হ্যাঁ।”

–” সর‍্যি বলতে চাইলে নো নিড টু সে।”

–” এটাই বলতাম।”

–” কাজের ভুল গুলো শুধরে দিন।”

ইমান হাসতে হাসতে বলে, ” কোন ভুল নেই। হুদা প্যারা দিলাম।”

মিরা আজকে বিরক্ত হওয়ার বদলে হাসলো। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলো ইমান। বৃষ্টু থামার পরমুহূর্তে রুফটপে বসা সেই আত্মবিশ্বাসী রমণীর উপর ক্রাশ খেল ইমান৷ কত তম বার ক্রাশ খেল সেটা ইয়াত্ত নেই। কফির সঙ্গে ক্রাশ খাওয়া চিবিয়ে খেয়ে ফেলে বলে, ” ন্যান্সি ম্যাডাম ককক্সবাজারে আউটলেট আগামী সপ্তাহে ওপেন করবেন৷ একটা টিম বানানো হয়েছে যারা ওপেনিংয়ের সময় সেখানে উপস্থিত হবে৷”

–” আমি আছি কী সেই টিমে?”

–” তোমার ডিজাইন করা কালেকশন দিয়ে আউটলেট সাজানো হচ্ছে সো তুমি ইনভাইটেট ”

–” কক্সবাজার যাওয়ার মুড নেই।”

–” তোমার ওই মায়াভরা চোখ তো সমুদ্রের চেয়েও গভীর।”

–” লেইম ছিল।”

চলবে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here