ফেইরিটেল পর্ব-৭

0
1918

#ফেইরিটেল
Part–7
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

ফেব্রুয়ারির দুপুর। ফেব্রুয়ারি মতো শান্ত মাসেও সূর্য এমন তাণ্ডব খেলা শুরু করেছে যে মিরা দরদর করে ঘামছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে৷ থেকে থেকে লিলুয়া বাতাস বয়ে যাচ্ছে৷ সেই বাতাসে মিরার আদুরে চুলগুলো খানিক নড়েচড়ে উঠছে অলসভঙ্গিতে৷ সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। ছাদে উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের দৃষ্টিই মিরার পানে। মিরা যেন চিড়িয়াখানার এক অদ্ভুত চিড়িয়া। তাকে চিড়িয়া ভাবার কোন কারণ নেই৷ কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সে আজ সবার মধ্যমণি। কারন তার সঙ্গে সবচেয়ে মশালাদার, ক্রিস্পি ডেয়ার খেলা হবে। একটু আগেই দ্যা গ্রেট নিউইয়র্ক ফেরত ইমান খান তাকে প্রোপোজ করতে রাজী হয়েছে। সোনালী আপু তাকে কাঠখড় পেরিয়ে রাজী করিয়েছেন৷মিরার অবশ্য এসব পুরাই ঢং লেগেছে। সুযোগ পেলেই যে কীনা ফ্লার্ট করার সুযোগ হাতছাড়া করে না, কফি ডেটে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে, তার তো রাজী না হওয়ার কোন কারণে দেখছে না মিরা৷

ইমান ঠিক যেই মুহুর্তটাতে তার দিকে এগিয়ে আসলো, তার মনে হচ্ছিল ছাদ থেকে ছুটে পালাতে। কিন্তু কোন এক কারণে পা চালিয়ে পেছন ফিরে দৌড়ে পালাবার শক্তি-সামর্থ্য তার মধ্যে নেই। সে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকলো। ইমান তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। দু’জনের মধ্যে দূরত্ব কেবল এক হাত বা তারও কম। বেশ কাছাকাছি অবস্থান করছে তারা একে অপরের। এতে অস্বস্তিরা যেন ঝেঁকে ধরে তাকে।

ইমান লো ভয়েজে বলে উঠলো, “Look into my eyes, Mira.”

বাক্যটা কর্ণপাত হতেই মিরা কেঁপে উঠে। গলা শুকিয়ে কাঠ হতে লাগলো তার৷ ঘাম ঝড়তে লাগলো কপাল বেয়ে৷ মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না তার। সে বহু শক্তি ব্যয় করে ইমানের চোখের দিকে তাকালো। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে, মূহুর্তের মধ্যে তার মনের মধ্যে ব্রজপাত হলো। তুমুল বেগে ধেয়ে আসতে লাগে ঘূর্ণিঝড়। এই ঘূর্ণিঝড়ের নাম বোধহয় প্রেম! ছেলেটার চোখে অদ্ভুত মাদকতা রয়েছে যা ক্রমশ মিরাকে তার দিকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য৷

ইমান মৃদ্যু গলায় মুখে একটা মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলা শুরু করলো, ” পৃথিবীতে সাড়ে সাত বিলিয়ন মানুষ, তাই ভালোবাসা” এর সংজ্ঞাও সাড়ে সাত বিলিয়ন। আমার কাছে মনে হয়, ভালোবাসা শব্দটা রাতের অন্ধকারে যতোটা কুৎসিত শোনায়, দিনের ফকফকা আলোয় এই শব্দটা ততোটাই পবিত্র। একদম ফুলের মতো স্নিগ্ধ। যেহেতু ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে, তাই বলতে ভয় পাই না। “ভালোবাসি তোমাকে” সবার সামনে বলতে পারাটা আদর্শ প্রেমিকের বৈশিষ্ট্য। দশ তলা বিল্ডিং কেন এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়েও চিৎকার দিয়ে বহুবার বলতে চাই, “আই লাভ ইউ, মিরা” বাক্যটা বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসুক আমার-তোমার, আমাদের জীবনে।

ইমানের কথা গুলো শুনতে শুনতে মিরার মাথার ঝিম মেরে উঠে৷ মাথার অগ্রভাগ ব্যথায় কটকট করছে। নিশ্বাস নিচ্ছে সে অস্বাভাবিকভাবে। চোখের দৃষ্টি অচঞ্চল। অবিন্যস্ত। কোন এক গোলকধাঁধা বা মরিচীকায় যেন কেউ তাকে ধাক্কা মেরেছে৷ রক্ষণশীল ফ্যামিলির মেয়ে হওয়ায় কখনো সেইভাবে কোন ছেলের সঙ্গে মেশা হয়নি৷ কথা হয়নি সেইভাবে৷ গার্লস স্কুল থেকে গার্ল কলেজে পড়ার দরুন ছেলেদের সঙ্গে মেশা হয়নি তার। সহজ নয় সে ছেলেদের সঙ্গে। ইমানই বোধহয় একমাত্র ছেলে যার সঙ্গে সে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাচ্ছে৷ এবং সে-ই প্রথম কেউ যে মিরার সঙ্গে এতো খোলামেলা!

মিরার কাছে সবকিছুই সত্য লাগছে। আজকের এই ঠাঠা রোদ, রেলিঙে বসে নিরলসভাবে কাকের বিরক্তিকর কাকা শব্দ, ফ্যানের ঘরঘর শব্দ, তার অব্যক্ত অনুভূতি সবকিছুই তার ভালো লাগছে। ভালো লাগছে ইমানের স্লো ভয়েজে বলা কথাগুলো। সবকিছুই সত্য বলে ভাবতে মন চাচ্ছে। এই মূহুর্তে সে সত্যি সত্যি চাচ্ছে ইমান তাকে খুব করে ভালোবাসুক। নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে যায় সে। ঠোঁট কামড়ে, ওড়নার কোণা হাতে গুটিয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে সে। মাথা সম্পূর্ণ ভার হয়ে আছে।সবকিছুর ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে সে শূন্যে ভাসছে৷ আশেপাশে সে আর ইমান বাদে কেউ নেই। সবাই অদৃশ্য শক্তি প্রয়োগে গায়েব হয়ে গেছে। পৃথিবীতে কেবল সে আর ইমানই আছে। সময় যেন থমকে গেছে। সেকেন্ডের কাটা আটকে গেছে নয়ের ঘরে।

এবারে ইমান হাঁটু গেড়ে বসে বলে উঠে,
“I need you like a sky needs a moon. তোমার প্রেমে আমি মাঝ সমুদ্রের পথভ্রষ্ট নাবিক হতেও রাজী, মিরা”

মিরার ঘোর কাটলো যখন আশপাশ থেকে করতালির শব্দ ভেসে আসে। এক কাজিন তো মুখ দিয়ে শিসও বাজালো৷ মিরা তিরতির করে চোখের পলক ফেলে চেয়ে আছে তার দিকে। সে উপলব্ধি করলো, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই দুষ্টু, বেয়াদব, ষ্টুপিড, অতিমাত্রায় সুদর্শন ছেলেটাকে সে নিজের অজান্তেই নিজের মনটা দিয়ে দিয়েছে৷ মন ফিরিয়ে নেওয়ার কোন পদ্ধতি থাকলে মিরা নিজের মনটা ফিরিয়ে নিয়ে আসত৷ কিন্তু হায় আফসোস, জগতে মনই একমাত্র বস্তু যা একবার কাউকে দিয়ে দিলে তা ফেরত আনা যায় না৷ হয় সে মনটা যত্নে আগলে রাখবে নয়তো, মনটা ভেঙেচুড়ে ফালি ফালি করে দিবে৷ মিরা চায় না তার মন ভাঙ্গুক। তবে সে কী চায়?

ইমান হেসে দিয়ে, উচু গলায় বলে উঠে, “ডেয়ার ডান৷”

বাক্যটি বিষের মতো যন্ত্রণা দিল মিরাকে। কেন এটা ডেয়ার হতে হলো? কেন সত্য হলো না? তবে কী তার অনুভূতিগুলো মিথ্যা? অনুভূতি কি মিথ্যা হয়?

আচমকা ইমান তার গালে হাত রাখলো। তার উষ্ণ হাতের ছোয়া পেতেই মিরার বুকের বাম পাশে ধুকপুক করে ওঠা-নামা করা ছোট্ট মনটা হুহু করে উঠে। তার মন কাঁদছে। চোখ তো সবারই কাদে। অথচ কী অদ্ভুত! তার মন কাঁদছে৷ হৃদপিন্ড বেয়ে টুপটুপ করে অশ্রু ঝড়ছে। কিন্তু কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

মনের অশ্রুবিসর্জন কেবল আপনজন দেখতে পায়।

তার গালে লেপ্টে থাকা চোখের পাপড়ি ইমান নিজের আঙুলে চেপে মিরার সামনে তাক করে ধরে বলে, হাতটা বাড়াও তো।

মিরা যন্ত্রমানবীর মতো নিজের হাত বাড়িয়ে দিলে, ইমান তার হাতের উল্টোপিঠে পাপড়িটা ছেড়ে দিয়ে বলে, “মেক এ্যা উইশ।”

সে চোখ বুজলো। বিড়বিড় করে বলে উঠে, আপনার সঙ্গে আমি রুপকার জগতে পাড়ি জমাতে চাই। আপনার সঙ্গে অচীন এক ভিন্নদেশে যেতে চাই যেখানে ঝর্ণা দিয়ে মায়া ঝরে। গাছ বেয়ে ভালোবাসা পড়ে। বৃষ্টি হয়ে প্রেম নামে।

সে চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই ইমান তার হাতের উল্টোপিঠে মৃদ্যু ফুঁ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ খুলে দেখে, পাপড়িটা হাতের উল্টোপিঠে নেই। তার চোখ-মুখে আনন্দের ঝিলিক মেরে উঠে।

সোনালী আপু গলায় জোর এনে বলে, ব্যাপার কী? তোরা কি সত্যি-সত্যি একে অপরের প্রেমে পরে গেলি?

মিরা চকিত দৃষ্টিতে আপুর দিকে তাকালো। যেন তার চুরি ধরা পরে গেছে। সে হুট করে বুঝতে পারল, তার জ্বর-জ্বর করছে। গা গরম করেছে তার৷ হুট করে শরীর খারাপ লাগতে শুরু করলো তার। তবে কী এটা প্রেমজ্বর? ওহ মাই গড! সে কী প্রেম নামক ভয়ংকর মরণব্যাধি অসুখে আক্রান্ত হয়ে গেল?

মিরা উত্তর না দিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। দ্বিতীয় দফায় সবাই তার দিকে অবাক এবং কৌতুহলী চোখে তাকালো৷ ইমান তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গেয়ে উঠে,

” সুন্দরীতমা তুমি লীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতে পারো এই আকাশ আমার৷”

মিরা বাসার সামনে এসে বেল বাজাচ্ছে। এদিকে তার গায়ের ওড়না ঠিকঠাক নেই। কেমন নেতিয়ে যাওয়া চারা গাছ লাগছে তাকে, যেন এখনি কেউ তাকে পিষে দিয়ে গেছে। বিধ্বস্ত ভাবটা সে চেহারা থেকে লুকাতে পারছে না৷

সুপ্তি বেগম দরজার লক খুলে দিতেই মিরা তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে ঢুকে গেল। তার মা অবশ্য ঠাওর করতে পারেনি মেয়ের মনের মধ্যে কী চলছে!

মিরা দ্রুত বেগে নিজের রুমে ঢুকে, দরজা লাগিয়ে, বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। নিশ্বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিয়ে তার ভেতরের জ্বর ক্রমশ বাড়ছে৷

সে জ্বরের ঘোরে বুদ হয়ে বলে উঠে, “আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাই না কিন্তু তবুও ভালোবেসে ফেলেছি।”

চলবে।

বিঃদ্রঃ গত পর্বে ভুলে সোনালী আপুর হবু স্বামীর নাম রাকিব লেখা হয়েছিল। আসলে প্রান্ত হবে। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য ধন্যবাদ।

[ আমি একটু অসুস্থ। এইজন্য গত দুইদিন গল্প দিইনি। তার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনারা নিজের মতামত জানান৷ ভালোবাসা অবিরাম। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here