ফেরারি প্রেম পর্ব -২৮

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_২৮
#নিশাত_জাহান_নিশি

গু’ন্ডা গুলো ছুটে এসে নীহারিকাকে ধরার পূর্বেই রূপল উপস্থিত হয়ে গেল! রূপলকে দেখামাত্রই ছেলেগুলো লেজ গুটিয়ে পালালো! রূপলের সাথে মা’রা’মারি করার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে তাদের! তাই খাল থেকে কুমির আনার মত পাপ কাজ করতে চাইলনা তারা।

মাথার কাঁটা অংশে হাত রেখে ফারহান হতভম্ব হয়ে একই জায়গায় বসে রইল। তার সাথের দলবল পালিয়ে যাওয়ার পর তার শক্তি অনেকাংশেই কমে এলো! তবুও যেন হিম্মত হারালো না সে! বুকে সাহস রেখে একরোখা ভাব নিয়ে একই জায়গায় শক্ত হয়ে বসে রইল। রূপলের দিকে হিংস্র দৃষ্টি তার। চাহনিতেই লুকিয়ে আছে রূপলের শেষদিন! সুযোগ পেলে যেন এখনই সে রূপলকে আস্ত চিবিয়ে খাবে! ফারহানের এই আক্রমনাত্নক প্রতিক্রিয়া দেখে রূপল ধীর গতিতে হেঁটে এলো ফারহানের দিকে। গাঁ ছাড়া ভাব তার। যেন কোনো দিকেই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার! সামনের মানুষটিকে গোনবারও সময় নেই। নিতান্ত প্রয়োজনের খাতিরেই সামনের মানুষটির মুখোমুখি হতে হলো তার।

ফারহানের সোজাসুজি টি-টেবিলের উপর ধপ করে চড়ে বসল রূপল। পাখার বাতাসেও তার শরীর থেকে গরম ভাপ উঠছিল। তাই সে অস্থির ভাব নিয়ে শার্টের কলারটা দুই দিকে ছড়িয়ে দিলো। সেই সুযোগে ফারহান ধপ করে রূপলের শার্টের কলার চেপে ধরল! চোঁয়াল উঁচিয়ে বলল,

“এই কে তুই? আমার সাথে দাদাগিরি করতে এসেছিস? চিনিস আমি কে?”

গাঁয়ে হাত উঠার পরেও ভাবশূণ্য রূপল! তার শার্টের কলার থেকে চোখ উঠিয়ে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফারহানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। চাহনিই যেন বলে দিচ্ছে ফারহানের অধ্যায় আজ এখানেই শেষ! টনক নড়ল এতক্ষণে ফারহানের! রূপলের তেজস্ক্রিয় মুখের পানে তাকিয়ে সে বাধ্য হলো শুকনো ঢোঁক গিলতে। পটাপট রূপলের শার্টের কলারটা ছেড়ে দিলো সে। আপাতত তার মধ্যে ভীতসন্ত্রস্তা কাজ করলেও সে গলা উঁচিয়ে বলল,

“কী ভেবেছিস আমি তোকে ভয় পাই?”

“না। আমার ঘাড়কে ভয় পাস!”

বলেই রূপল শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ফারহানের গালে জোরে এক চড় বসিয়ে দিলো! সঙ্গে সঙ্গেই ফারহানের কানে বিকট এক শব্দ হলো। মনে হলো কানের পর্দা তার ফাটল বলে! পুরো দুনিয়া তার ফট করে ঘুরে এলো। এই দৃশ্য দেখে মারজিনা বেগম মরিয়া হয়ে উঠলেন। চিন্তিত হয়ে তিনি রূপলকে পেছন থেকে ডাকলেন। করুন সুরে বলল,

“বাবা ছেড়ে দাওনা। আমার বাড়িতে আমি কোনো দাঙাদাঙি হোক চাইনা। তাছাড়া তুমিই বা এই সময়ে এখানে এলে কী করে? তুমিতো বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিলে তাইনা?”

অমনি পাশ থেকে গালে হাত দিয়ে গম্ভীর ভাব নিয়ে দাড়িয়ে থাকা নীহারিকা তার মায়ের মুখের কথা টেনে নিলো। প্রত্যত্তুরে বলল,

“আমিই উনাকে আসতে বলেছি!”

নীহারিকার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চাপলেন মারজিনা বেগম! ছোটো আওয়াজে তিনি নীহারিকাকে শাসিয়ে বলল,

“খুব সাহস বেড়েছে তোর তাইনা? ছেলেটাকেও এই ঝামেলার মধ্যে টেনে আনলি? দাড়া ঝামেলাটা মিটুক তোর সাহস আমি বের করছি।”

ইতোমধ্যেই ফট করে রূপল ফারহানের শার্টের কলার চেপে ফারহানকে নিয়ে বাড়ির ড্রইংরুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। বিক্ষুব্ধ হয়ে সে ঝাঁজালো গলায় মারজিনা বেগমকে বলল,

“আমাকে থামতে বলবেন না আন্টি। তার এত বড়ো সাহস কী করে হয়? বাড়ি বয়ে এসে হুমকি দেওয়ার? তাও আবার সাথে করে গুন্ডা পান্ডা নিয়ে। এখন যদি নীহারিকা বুদ্ধি করে আমাকে খবরটা না জানাত তাহলে আপনাদের সাথে কী কী ঘটতে পারত আপনাদের কোনো ধারণা আছে?”

বিপরীতে কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা রূপল। একগুঁয়ে ভাব নিয়ে সে আ’হ’ত ফারহানকে টানতে টানতে বাড়ির গেইটের বাহিরে নিয়ে এলো! বাড়ির ভেতর থেকে দঁড়ি এনে বাড়ির গেইটের বাইরে থাকা বড়ো খাম্বাটির সাথে বেঁধে দিলো! মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে এলাকা শুদ্ধ লোক জড় হয়ে গেল। সবার মধ্যে কৌতূহল, উদ্দীপনা এবং আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। রূপলের এই ভয়ানক রূপের সাথে এলাকাবাসী সবাই পরিচিত। আর কোনো কারণ ছাড়া যে রূপল কাউকে এভাবে ধরে বেঁধে পিটায়না তাও তাদের জানা!

রূপল বেশ ভাবসাব নিয়ে ফারহানের মুখোমুখি চেয়ার পেতে বসল। পায়ের উপর পা তুলে সে হাঁপাতে থাকা ফারহানের দিকে ভ্রু দুটি উঁচিয়ে তাকালো। থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে সে প্রশ্ন ছুড়ল,

“তো এবার বল? এলাকাবাসী সবার সামনে বল যে, তুই কেন কী কারণে মিস নীহারকাদের বাড়িতে এসেছিল তাকে হুমকি দিতে? সবারই তো বিষয়টা জানার অধিকার আছে তাইনা?”

রূপলের ভয়ে অনবরত কাঁপতে লাগল ফারহান। বিশেষ করে রূপলের হাতে মোটা রট দেখে! একটু নত না হলে আজ-ই হয়ত তার প্রাণটা যাবে! অন্যের এলাকায় এসে যে নিজের দাপট চলেনা তা সে বিষয়ে তার বেশ ভালোভাবেই জ্ঞান আছে। বুদ্ধি খাটিয়ে ফারহান এবার বিনয়ী ভাব নিলো। কাতর গলায় রূপলকে বলল,

“ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিন! আর কখনও কোনোদিনও আপনার এলাকায় পা রাখব না আমি।”

“ওকে। তা না হয় রাখবিনা। কিন্তু নিজের কুকীর্তি গুলো তো সবার কাছে স্বীকার কর! কী কারণে আজ তোকে এখানে বেঁধে রাখা হলো খোলসা করে সব বল?”

ফারহানের স্বীকারোক্তি ভিডিও করতে চাইছিল রূপল! ভেবেছিল এসব দুষ্কৃতকারীদের অপকর্ম গুলো নেট দুনিয়ায় ছেড়ে দিলে মানুষ অনেককিছু শিখতে পারবে, জানতে পারবে। সঙ্গে এসব নোংরা মনমানসিকতার পুরুষ মানুষদেরও চিনতে পারবে। কিন্তু তা আর হলোনা! স্বয়ং নীহারিকা এসে রূপলের হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নিলো! রূঢ় গলায় সে রূপলকে বলল,

“ছেলেটির বাঁধনটা খুলে দিন!”

জায়গা থেকে দাড়িয়ে পড়ল রূপল! নীহারিকার দিকে সূচালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ধমকের স্বরে বলল,

“হোয়াট?”

“বাঁধনটা ছেড়ে দিতে বলছি। ছেড়ে দিন। তাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে আসুন।”

বলেই নীহারিকা মাথা নুইয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। নীহারিকার সিদ্ধান্ত বা তার কথার ভিত্তি কিছুই বুঝতে পারলনা রূপল। মেয়ে মানুষের মাথায় কখন কী চলে বুঝাই যায়না! দেরি হচ্ছিল দেখে নীহারিকা আবারও গেইটের বাহিরে উঁকি দিলো। রূপলকে তাড়া দিয়ে বলল,

“প্লিজ তাকে নিয়ে ভেতরে আসুন।”

রাগে গজগজ করে রূপল বাধ্য হলো ফারহানের বাঁধন খুলে দিতে। পুনরায় ফারহানের শার্টের কলার টানতে টানতে রূপল ফারহানকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। বাড়ির গেটটাও ভেতর থেকে লাগিয়ে দিলো! গেটের বাইরে অবস্থানরত মানুষজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কোনো সমস্যার সমাধান না করেই তারা অপরাধীকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল? এ আবার কেমন সিদ্ধান্ত তাদের?

ফারহানকে নিয়ে বাড়ির ড্রইংরুমে ঢুকেই রূপল রাগী দৃষ্টিতে নীহারিকার দিকে তাকালো। বেশ চোট পাট করে নীহারিকাকে বলল,

“হোয়াটস ইউর প্রবলেম হুম? কী করতে চাইছেনটা কী আপনি?”

বিপরীতে অস্থির হয়ে নীহারিকা রূপলকে বুঝানোর স্বার্থে বলল,

“দেখুন। এলাকার অনেকেই দিশাকে চিনে। বিশেষ করে দিশার অনেক রিলেটিভ এই এলাকায় থাকে।”

“হ্যাঁ তো? তাতে আমার বা আপনার কী?”

“কারণ, আমি চাইনা আমাদের এলাকায় দিশার কোনো বদনাম হোক! সমস্যাটা দিশার সাথে আমার। সেটা আমাদের মধ্যেই রাখতে চাই।”

“এতকিছু ভাবলে তাকে পুলিশে দিলেন কেন? তখন কী লোক জানাজানি হয়নি?”

“তখন যা হয়েছে তা দুই এলাকার বাইরে হয়েছে! এলাকার ভেতরে কিছু হয়নি। তারা ব্যক্তিগতভাবে হোক বা পারিবারিকভাবে হোক বিষয়টা সামলে নিয়েছে। কিন্তু এখন বিষয়টা পাবলিসিটি হয়ে যাচ্ছে! বিশেষ করে আপনার ভিডিও করাটা। দিশার অপকর্ম নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ুক আমি চাইনা! আমাদের বাইরে অপরিচিত দু-একটা মানুষ তাকে খারাপ ভাবুক আমি চাইনা। তার থেকে যা শোধ নেওয়ার ছিল আমার নেওয়া হয়ে গেছে! আমার কাছে তার পরিবারের কাছে এমনকি সানির কাছেও সে আজীবন দোষী হয়ে থাকবে এই আমার জন্য অনেক।”

অবাক হলো রূপল। বিস্মিত গলায় বলল,

“আশ্চর্য আপনার লজিক। তাহলে ছেলেটা যে বাড়ি বয়ে এলো আপনাকে থ্রেড দিতে তার কী হবে?”

“তার শাস্তি তো সে পেয়েই গেছে! মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি না তার? সঙ্গে আপনার শক্ত হাতের গরম গরম চড়!”

ফারহানও এবার নিস্তেজ ভাব নিলো। বিদীর্ণ গলায় নীহারিকার কথায় সায় জানিয়ে রূপলকে বলল,

“হ্যাঁ ভাই। আমার শাস্তি হয়ে গেছে! আর কখনও এই এলাকায় পা রাখবনা।”

ফারহানের কথায় নীহারিকা দাঁত কেলিয়ে হাসল! ইতোমধ্যেই মারজিনা বেগম ট্রে-তে করে লেবুর শরবত নিয়ে এলেন! ট্রে থেকে শরবতের গ্লাসগুলো হাতে নিয়ে নীহারিকা শুষ্ক হেসে একটি গ্লাস রূপের দিকে এবং অন্য একটি গ্লাস ফারহানের দিকে এগিয়ে দিলো। বলল,

“নিন ঠাণ্ডা হোন।”

সামনে ভেতর ঠাণ্ডা হওয়ার মত শরবত দেখে ফারহান ঝট করে রূপলের হাত থেকে তার শার্টের কলারটা ছাড়িয়ে নিলো! রূপল এবং নীহারিকাকে একদফা অবাক করে দিয়ে সে নীহারিকার হাত থেকে ছোঁ মেরে শরবতের গ্লাসটি ছিনিয়ে নিলো! গড়গড় করে সে গ্লাসভর্তি শরবত গিলে নিলো। শরবত খাওয়া শেষ হতেই ফারহান মুখ মুছে শরবতের গ্লাসটি নীহারিকার দিকে এগিয়ে দিলো। নীহারিকার দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ব্যস্ত গলায় বলল,

“ওকে। তাহলে আমি আসছি! বায়।”

যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ফারহান পিছু ঘুরতেই নীহারিকা ধুম করে পেছন থেকে ফারহানের শার্টের কলার চেপে ধরল! দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“এই কোথায় যাচ্ছিস তুই? তোর ক্লাস নেওয়া তো এখনও আমার বাকী! আমাকে কালো বলা না? কটুক্তি করা আমাকে নিয়ে? দাড়া দেখাচ্ছি মজা।”

বলেই নীহারিকা তার ফোনটা তাজ্জব হয়ে দাড়িয়ে থাকা রূপলের হাতে তুলে দিলো। বিরামহীন গলায় রূপলকে বলল,

“আমি তাকে ক্যালাব। আর আপনি তার ভিডিও করবেন!”

মেজাজ বিগড়ে গেল রূপলের! এই মেয়ে কী আসলে পাগল? এতক্ষণ তো রূপল ভিডিও করছিল বলে তাকে জ্ঞানের কথা শুনাচ্ছিল! এখন দেখি সে নিজেই বলছে ভিডিও করার কথা। হতভম্ব হয়ে রূপল মাথা চাপরে বলল,

“হেই। কিন্তু কেন?”

“কারণ তাকে ক্যালানোর ভিডিটাও আমি দিশাকে সেন্ড করব! আমার পাওয়ার সম্পর্কে তার ধারণা থাকতে হবেনা? আমি যে একাই তার ভাড়া করা পাতি গুন্ডাকে ক্যালাতে পারি, তা তো তার জানতে হবে।”

রূপল আছে সেই সাহস পেয়ে নীহারিকা ভয়ে কাতর এবং দুর্বল হয়ে থাকা ফারহানকে এলোপাতাড়ি চড়, থাপ্পর, ঘুঁষি মারতে লাগল! জায়গায় দাড়িয়ে রইল ফারহান! নরম হাতের মার খেতে লাগল সে! হতবাক দৃষ্টিতে সে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল। নিশ্চল গলায় বলল,

“এটা আবার কেমন ট্রিকস বইন? শরবত খাইয়ে ঠাণ্ডা করে এখন আবার ধপাধপ ক্যালানো হচ্ছে? এসব হচ্ছেটা কী? আমাকে দেখতে কী পাগল মনে হয়?”

ফারহানের কথা শুনে ভিডিও করা অবস্থাতেই ফিক করে হেসে দিলো রূপল!

#চলবে….?

[খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে দিয়ে লিখেছি। রি-চেইক করা হয়নি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here