বদ্ধ হৃদয়ের অনুভুতি পর্বঃ৩০

0
3229

#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ৩০
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

পুরো ঘরে সিগারেটের বিকট গন্ধ।চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মদের বোতল।কোনোটা খালি তো কোনটা পরিপূর্ণ।দরজা জানালা বন্ধ হওয়ায় যেনো দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা।মাহাদ এর পুরো শরীরে মদের তীব্র ঝাঁঝানো উটকো গন্ধ।বিছানার সাথে হেলান দিয়ে মাথাটা পেছন দিকে কাত করে বসে আছে সে।এক পা গুঁটিয়ে অন্য পা ছড়িয়ে রেখেছে।পাশ থেকে আস্ত এক বোতল নিয়ে ঢগঢগ করে গিলতে থাকে।

ভেজানো দরজা সরিয়ে ঘরে ঢুকে আলতাফ।ধোঁয়ার কুন্ডলি পাকিয়ে সারা ঘর ভরে আছে।আলতাফ ত্রস্ত হাতে বারান্দার থাই,জানালা গুলো খুলে দেয়।মাহাদ এর সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষেপা গলায় বললেন—

“কী শুরু করেছেন এইসব!এইভাবে এইসব খেলে তো মরেই যাবেন।”

মাহাদ শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় হেয়ালি করে বললো—

“মরে গেলেই ভালো।আমি মরলে কার কী!

আলতাফ শাসিয়ে বললেন—

“তাহলে বউমনির কী হবে?

মাহাদ ম্লান হাসলো।ফিকে গলায় বললো—

“সে কী আমাকে ক্ষমা করবে!কখনো না।আরে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যই না আমি।কী দিয়েছি আমি তাকে!কষ্ট ছাড়া কিছু দেইনি।”

আলতাফ গমগমে গলায় বললো—

“যখন বুঝতেই পারছেন কষ্ট দিয়েছেন তাহলে কেন করলেন এইসব!চলে যেতেন তাকে নিয়ে কোথাও।”

মাহাদ আওয়াজ করে হেসে উঠলো।তার হাসিতে বিদ্রুপ ছিলো নিজের ভাগ্যের প্রতি।আলতাফ এর হাত ধরে নিজের পাশে বসালেন।নেশায় বুদ হয়ে আছে মাহাদ। আর্দ্র গলায় বললো—

“নেশা করলে নাকি সব ভোলো যায়!তাহলে আমি কেন তাকে ভুলতে পারছি না!সে রোজ আমার স্বপ্নে আসে।রোজ আমার কানে তার ওই কন্ঠ বাজতে থাকে।কী অদ্ভুত !
তাই না চাচা!

আলতাফ কিছু বললেন না।চেয়ে রইলেন কাতর দৃষ্টিতে।মাহাদ এর ভাঙা চোয়াল দেখে বুকটা হু হু করে উঠে আলতাফ এর।বাদামী রঙের গভীর দৃষ্টির চোখ দুটো একদম নিষ্প্রভ।চেহারার ঔজ্জ্বল্য একদম ম্লাণ।শরীরটাও কেমন ভেঙেচুরে গেছে।সারাদিন ঘাপটি মেরে ঘরে বসে থাকে।খায় না।খিদে পেলেই মদ গেলা শুরু করে।সিগারেট ফুঁকে।অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই ধোঁয়ার কুন্ডলির দিকে।হাত দিয়ে কী যেনো বের করে আনতে চায় সেই কুন্ডলি থেকে।
আলতাফ প্রায়ই দেখে অদ্ভুত আচরণ করে মাহাদ।একা একাই কথা বলে।এই হাসে তো এই কাঁদে।

আলতাফ মৃদু গলায় বললেন—

“তাকে ফিরিয়ে আনেন।চলে যান এখান থেকে।”

স্মিত হাসে মাহাদ।হেয়ালি গলায় বললো—

“বলেন তো চাচা মানুষের সবচেয়ে আপনজন কে হয়!নিশ্চয়ই তার মা।তাহলে আমার মা কেন এমন!

আলতাফ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।তার অন্ত:পুরের আত্না কেঁদে উঠে।মাহাদ আবারো তার নেশার্ত কন্ঠে বললো—

“কোনো মা কী করে তার সন্তানের কাছে তার মাতৃদুগ্ধের মূল্য চায়!বলতে পারেন চাচা!মাতৃদুগ্ধের মূল্য কী কখনো দেওয়া যায়!

আলতাফ কিছু বললো না।নিঃশব্দে কাঁদলেন তিনি।সেই কান্নায় আছে ধিক্কার।এক মায়ের প্রতি মাতৃত্বের ধিক্কার।

মাহাদ জড়ানো গলায় বললো—

“সে আমার কাছে তার দুগ্ধের মূল্য চায়।কী করে একজন সন্তানের কাছে তার মা এমন দাবী করতে পারে!
কিন্তু আমি দিয়েছি তাকে সেই দাম।আমার প্রাণভোমরা কে আমি তাকে দান করেছি।”

আলতাফ শান্ত গলায় বললেন—

“আপনার এমনটা করা উচিত হয়নি।”

মাহাদ ফুঁসলে উঠে।অনেক কষ্টে বিছানায় হাত ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়ায়।স্থির হতে পারে না সে।তবুও হেলেদুলে দাঁড়ায় সে।শক্ত গলায় বললো—

“কী করতাম তাহলে আমি!ওই মহিলা সারাজীবন নিজেকে নিয়ে ভেবেছে।তাহলে আমাকে কেন জন্মদিলো।আমি যদি এতোই অগ্রাহ্য হই তাহলে জন্মের সময় মেরে ফেললো না কেন আমাকে!মরে যেতাম আমি।”

মাহাদ হেলে পড়ে আলতাফ এর উপর।অস্ফুট ভাবে তখনো বলতে থাকে—

“মরে যেতাম আমি,মরে যেতাম আমি।মরে……।”

,
,
,
আজ সাতদিন হলো আম্বের শেখ বাড়িতে এসেছে।সেদিন আম্বের কে এই বাড়িতে আনার পর থেকে একদম চুপ হয়ে যায় আম্বের।কারো সাথে কথা বলে না।আম্বের কে দেখার পর ফাহাদ পাগলের মতো আচরণ করা শুরু করে।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফাহাদ আম্বের কে বিয়ে করতে চায়।কিন্তু ফাহাদ এর বাবা সৈয়দ রাহাত শেখ কোনো একটা কাজে দেশের বাইরে গেছেন।তার ফিরে না আসার আগ পর্যন্ত এই বিয়ে হবে না।

বিছানার উপর ধুম ধরে বসে আছে আম্বের।তাকে খাবার দিয়ে দেওয়া হয়েছে।কিন্তু না খেয়ে একমনে চেয়ে আছে খাবার এর দিকে।আর চোখ দিয়ে টপটপ করে পড়ছে পানি।
ফাহাদ এসে বসে তার সামনে।ফাহাদ এর উপস্থিতিতে চোখের পানি মুছে নেয় আম্বের।ফাহাদ স্বাভাবিক গলায় বললো–

“খাচ্ছো না কেন তুমি?

আম্বের চুপ করে থাকে।কয়েকবার হেঁচকি তুলে নিঃশ্বাস ছাড়ে।শান্ত গলায় বললো—

“আমাকে যেতে দাও ফাহাদ।”

ফাহাদ ভ্রু নাচিয়ে বললো—

“কোথায় যাবে তুমি!ওই মাহাদ এর কাছে?

আম্বের চটজলদি বলে উঠলো—

“আমি মাহাদ কে ভালোবাসি।”

ফাহাদ ক্ষেপে গিয়ে আম্বের এর গলা চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো—-

“এতো কিসের ভালোবাসা তোর ওর প্রতি!সত্যি করে বলতো তুই কী ওর সাথে রাত কাটিয়েছিস!এতো মায়া কিসের তোর ওর প্রতি!
তোর জন্য শুধুমাত্র তোর জন্য ইলহাম আর জাসিন এর অবস্থা আমি কী করেছি দেখেছিস!মাহাদ তো শুধু ওদের মেরে ফেলতে বলেছিলো।ওদের ওই নির্মম অবস্থা আমি করেছি।ওদের সাহস কী করে হয় তোকে ছোঁয়ার।”

আম্বের এর গলায় চাপ পড়ায় ককিয়ে উঠে সে।অস্ফুটভাবে বললো—

“ছাড়ো আমাকে,ছাড়ো।”

ব্যস্ত পায়ে সেখানে আসেন ওলিজা,ফাহাদ এর মা।হকচকিয়ে ফাহাদ থেকে ছাড়িয়ে নেয় আম্বের কে।ব্যগ্র গলায় বললো—-

“আরে আরে কী করছিস!মরে যাবে তো মেয়েটা!

ফাহাদ গমগমে গলায় বললো—

“এভাবে চলতে থাকলে এমনিতেই মরে যাবে।আজ কতোদিন ধরে ঠিকমতো খায় না অবস্থা দেখেছো ওর!

ওলিজা তপ্ত গলায় খেঁকিয়ে উঠে আম্বের কে বললো—

“এই মেয়ে সমস্যা কী তোর!না খেয়ে থাকলেই কী তোকে আমরা যেতে দিবো!

আম্বের চিৎকার করে বলে উঠলো—

“কেন যেতে দিবেন না!কেন আটকে রাখবেন!কী বলেছেন আপনারা মাহাদ কে?

ওলিজা একটা চড় বসিয়ে দেয় আম্বের এর গালে।তা দেখে চিৎকার করে চেঁচিয়ে উঠে ফাইরুজা।

“মামি!

ওর গলার আওয়াজ এ পেছন ফিরে তাকায় ওলিজা আর ফাহাদ।ফাইরুজা তটস্থ পায়ে ওদের সামনে এসে ধমকে উঠে বললো—

“এইসব কী হচ্ছে!আর গায়ে হাত তুলেছো কেন তোমরা।”

ফাহাদ শক্ত গলায় বললো—

“তোর এইসবে নাক না গলালেও চলবে।যা এখান থেকে।”

ফাইরুজা ফাহাদ এর কথার তোয়াক্কা না করে ওদের শাসিয়ে বললো—

“এখনই এখান থেকে বের হবে নাহলে আমি মামাকে কল করে বলবো কী করছো তোমরা।”

ওলিজা ধাতস্থ হয়ে ফাহাদ কে নিয়ে চলে যায়।আম্বের এর সামনে বসে ফাইরুজা।দু হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে নির্মল গলায় বললো—

“কেমন আছো আম্বের?

আম্বের চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে নম্র গলায় বললো—

“আপনি আমার নাম জানলেন কী করে!কে আপনি!

ফাইরুজা চটপটে গলায় বললো—

” আমি ফাহাদ এর কাজিন।
খাচ্ছো না কেন তুমি?

“ইচ্ছে করছে না।”

“তা বললে কী হয়!না খেয়ে থাকা যায় নাকি!

ফাইরুজা খাবারের প্লেট হাতে নেয়।আম্বের কে জিঙ্গেস করলো—

“তুমি কিন্তু বেশ মিষ্টি দেখতে।এই জন্যই বুঝি ফাহাদ তোমার জন্য এতো পাগল হয়ে গেছে?

আম্বের ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে।থমথমে গলায় বললো–

“আপনি মাহাদ কে চেনেন?

ফাইরুজা কপট বিস্ময় প্রকাশ করে বললো—

“কোন মাহাদ!
মাহাদ আবইয়াজ?

“হু।”

“তাকে কে না চিনে!কেনো?হঠাৎ তার কথা কেন জিঙ্গেস করলে?

“মিসেস শেখ তার কী হয়?

ফাইরুজা বিগলিত গলায় বললো—

“মাহাদ এর মা।ফাহাদ মাহাদ এর সৎ ভাই।ওদের মা এক বাবা দুই।”

আম্বের বিস্মিত গলায় বললো—

“কিন্তু মাহাদ যে বললো তার কেউ নেই।”

“কারণ এইটা না থাকার মতোই।কিন্তু তুমি এতো কথা কেন জিঙ্গেস করছো?

“ওরা আমাকে মাহাদ এর কাছ থেকে জোর করে নিয়ে এসেছে।”

কথা শেষ করে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আম্বের।ফাইরুজা তটস্থ হয়ে বললো—-

“আরে মেয়ে কাঁদছো কেন!
একদম কাঁদবে না।মেয়েদের এতো নরম হলে হয়!স্ট্রং হতে হয়।”

আম্বের খেয়াল করে কথার ফাঁকে ফাঁকে ফাইরুজা তাকে খাইয়ে দিয়েছে।যেমনটা মাহাদ করতো।আম্বের নরম গলায় প্রশ্ন করলো—

“আপনি কী জানলেন আমি কথা বলতে বলতে খাই?

ফাইরুজা একগাল হেসে বললো—

“ডাক্তার তো তাই একটু আকটু জানতে হয়।আর কথা নয়।বাকি কথা কাল।এখন অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও।আর ডোন্ট ওয়ারি।আমি আছি।”

ফাইরুজা আম্বের এর কপালে ছোট্ট চুমু খেলো।আম্বের আজ অনেকদিন পর এমন মমতাভরা স্পর্শ পেলো।আনম্র গলায় বললো—

“আমি আপনাকে আপু ডাকি?

“শিউর।এমনিতেও বয়সে আমি তোমার বড়।সো ইউ কল মি আপু।বাই।গুড নাইট।”

আম্বের কে শুইয়ে একটা পাতলা চাদর টেনে দেয় তার গায়ে।লাইট অফ করে রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখে ওলিজা আর ফাহাদ দাঁড়িয়ে আছে।ওদের দেখেই উষ্ণ গলায় বললো—

“আজকের পর একদম ওর গায়ে হাত দিবেনা।ভালো হবেনা কিন্তু।”

দপ দপ করে পা ফেলে নিজের ঘরে আসে ফাইরুজা।দরজা লক করে বিছানায় বসে মাহাদ কে কল করে।

“কেমন আছে সে?

“ভালো।মেয়েটা কিন্তু অনেক শান্তু।”

মাহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো—

“জানি।”

“তুমি আমাকে আগে কেন জানাওনি?

“অনেক কষ্টে তোমার নাম্বার খুঁজে বের করেছি।তার দিকে খেয়াল রেখো।”

“এতোই যখন ভালোবাসো তাহলে দূরে সরালে কেন! আর কাদের কাছে পাঠিয়েছো ওকে!এরা কী মানুষ!ফাহাদ এর কন্ডিশন তো জানোই।রিহ্যাব থেকে ফিরেছে।আম্বের চট্টগ্রাম থেকে আসার পর পাগল হয়ে গেছিলো পুরাই।”

“সব জানি আমি।কিন্তু মিস আম্বের আমার কাছে সেইফ নয়।আর মাত্র কয়েকটা দিন।প্লিজ দেখে রেখো তাকে।আমি কৃতার্থ হবো।”

ফাইরুজা রসালো গলায় বললো—

“ওকে নায়ক সাহেব,ওকে।ডোন্ট ওয়ারি।এখন রাখছি।টায়ার্ড আমি।”

“থ্যাংকস আ লট।”

মোবাইল বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে ফাইরুজা।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here