#বালিকা_বউ
#পার্টঃ১৪
লেখিকা ঃ মারিয়া
তারপরও মাকে জোর করে খাওয়ালাম।
পরের দিন সকালে হসপিটালে গিয়ে বাসায় চলে এসেছি। রোশনির এখনও জ্ঞান ফেরেনি। কেন জানিনা ওকে ওই অবস্থায় দেখতে আমার সহ্য হচ্ছিল না। স্নান সেরে আলমারি থেকে শার্ট বের করার জন্য আলমারি খুলেছি হঠাৎ একটা কিছু নিচে পড়ল। তাকিয়ে দেখি ইশুর দেওয়া সেই গিফটটা। এখনও রেপিং অবস্থায়ই আছে। বিয়েতে এত বিজি ছিলাম যে আর খুলে দেখতেই টাইম পাইনি।প্যাকেটটা তুলে আলমারির দরজা অফ করে প্যাকেটটা খুললাম। বের করে দেখলাম একটা ডায়রি। ভীষণ কৌতূহল হলো এটা কার ডায়রি। আর ইশু এটা আমাকেই দেবে কেন। দেখে মনে হচ্ছে খুব পুরানো। মলাটটা খুলতেই
বড় বড় অক্ষরে লেখা সূর্যের আলো। নিচে লাভের মধ্যে লেখা আদিত্য রোশনি। বুঝতে বাকি রইল না এটা রোশনির ডায়রি। আর আগ্রহ টাও বেড়ে গেলো। পেজ উল্টানোর পর লেখা ছোট ছোট অক্ষরে ” কেন চলে গেলেন আদিত্য বাবু ”
তার পরের পেজে ” আপনার কি আমাকে একটুও মনে পড়ে না “। অনেক মিস করছি আপনাকে।
পরের পেজে ” রাতে ঘুম আসছে না। আপনাকে জড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসে না। সব জেনেও চলে গেলেন ”
কতদিন রাত যে আধপেট খেয়ে ঘুমিয়েছি তার কোনো হিসাব নেই। আপনি তো দিব্যি আছেন।
ফিরে আসুন না আদিত্য বাবু। আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
তারপরের বছর তারিখ আর সালটাও লেখা ছিল। কতদিন দেখি না আপনাকে। এখন তো মামনির কাছে ফোনও করেন না। করলেও কিছুক্ষণের জন্য।
আচ্ছা আপনি কি আমাকে ভুলে গেছেন। নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসেন এখন। কিন্তু আমি তো আপনাকে বড্ড ভালোবাসি।
এটা পড়তেই অজান্তেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো।
তারপর কয়েক পৃষ্ঠা কিছুই লেখা নেই।
এরপরে দেখলাম লেখা আজ আপনি ফিরছেন। এত আনন্দ হচ্ছে বোঝাতে পারব না। খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি।
এরপর একটা চোখ,, জল পড়ছে এরকম আকা। তার নিচে লেখা সবার সামনে অপমানটা না করলেও পারতেন। আগে তো শাড়ি পড়লে কিছু বলতেন না। কিন্তু আজ শাড়ি পড়ার পরেও ফিরেও তাকালেন না। ভেবে ছিলাম অন্তত আপনি আমার মান ভাঙাবেন কিন্তু আসলেনই না।
তার পরের পেজে
আজ আপনি কিস করেছেন। এই প্রথম আপনার এতটা কাছে ছিলাম। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিল জানেন। এটা পড়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটলো।
এরপর লেখা ” আমি জানি প্রতিদিন রাতে আপনিই এসে আমার কপালে কিস করে যান। কখনো দেখিনি কিন্তু আমার বিশ্বাস। তাই তো জানালাটা খুলে রাখি ঠান্ডা হাওয়া আসা সত্ত্বেও। কারন ওটাই আমার উষ্ণতার কারন। খুব ভালোবাসি আপনাকে খুব।
এরপরে আর কিছুই লেখা নেই। ডায়রিটা বুকে জড়িয়ে বেডের উপর বসে পড়লাম। ও আমাকে এতটা ভালোবাসে কিন্তু আমিই বুঝতে পারলাম না। এতটা ডাফার আমি। রোশনি প্লিজ আবার সুস্থ হয়ে যাও। আই সোয়্যার আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না।
চোখের জল টা মুছে ডায়রিটা ডেস্কে রেখে শার্ট পড়তে পড়তে নিচে নামলাম। শ্যামলি একটা বক্স ধরিয়ে দিয়ে বলল দাদাবাবু আপনাদের খাবার। ওটা নিলাম তারপর বলল বৌমনি কেমন আছে।
সেরকমই বলে দ্রুত বাইরে থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খুব দ্রুত ড্রাইভ করছি। অলরেডি ৪৮ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। বুকের ধুকপুকানি বেড়েই চলছে। কেন এমনটা হলো ওর কিছু হলে আমিও নিজেকে শেষ করে দেবো। রোশনি ছাড়া আমার জীবনের কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই হসপিটালের কাছে চলে এলাম।
হসপিটালের সামনে গাড়ি থামিয়ে বক্সটা হাতে নিয়ে ভিতরে গেলাম। আমাকে দেখে ইশু রাজ দাড়িয়ে গেল। মাকে বললাম মা রোশনির কি অবস্থা।
মা হাউমাউ করে আমার বুকে আছড়ে পড়ে বলল এখনো জ্ঞান আসেনি। আমার কিছু ভালো লাগছে না আদি আমার রোশনিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে।
এর মধ্যে দেখলাম কয়েকজন নার্স ওয়ার্ড বয় ছোটাছুটি করছে। একজনকে দাড় করিয়ে বললাম সিস্টার কি হয়েছে।
৩৮ নম্বর বেডের পেশেন্ট ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে।
চোখ বড় বড় করে বললাম রোশনির।
আপনি কি ওনার বাড়ির লোক।
আমি এক মুহুর্ত আর না দাড়িয়ে রোশনির কেবিনের সামনে দাঁড়ালাম। রোশনি জোরে জোরে শব্দ করে শ্বাস নিচ্ছে। ডক্টর নার্স সবাই ভিতরে দরজা লক করা।
দরজা খুলুন আমি রোশনির কাছে যাবো। মা ইশু রাজ শব্দ করে কাঁদছে আমার পিছনে। রোশনির কষ্ট আমি আর দেখতে পারছি না। দরজা এভাবে ধাক্কানোর জন্য ওয়ার্ড বয় আর কিছু নার্স আমাকে সরানোর চেষ্টা করছে। ওদের সাথে আমিও জোর খাটাচ্ছি। এক পর্যায়ে ওরা আমাকে টেনি নিয়ে বেডের উপর শুইয়ে দিল জোর করে। আমি হাত পা ছোড়াছুড়ি করছি আর বলছি ছাড়ুন আমাকে। আমাকে রোশনির কাছে যেতে দিন। এর মধ্যে কেউ আমার হাতে ইনজেকশন পুশ করল। আস্তে আস্তে আমার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
চোখ খোলার পর মাথাটা ঝিম ধরে আছে। হাতেও ব্যাথা হচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম সামনে তাকিয়ে দেখি রোশনি আমার হাতটা ধরে মাথা নিচু করে কাঁদছে। আমার মনে হচ্ছে রোশনি আমার সামনে বসে আছে। ও কি সুস্থ হয়ে গেছে নাকি এটা স্বপ্ন। যদি স্বপ্ন হয় তাহলে খুব করে চাইছি সময়টা যেন এখানেই থেমে যায়। আর আমি আমার রোশনিকে দুচোখ ভরে দেখতে পারি। তারপর অস্ফুটস্বরে বললাম
রোশ,,নি।
রোশনি সাথে সাথে আমার দিকে তাকিয়ে বলল আদিত্য বাবু।
পাশ থেকে মা ইশু ও দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলো।
আমি আস্তে করে ওঠার চেষ্টা করলাম। রাজ আরেকটা নার্স আমাকে হেল্প করলো। মা এগিয়ে এসে বলল আদি তোর জ্ঞান ফিরেছে।
রোশনির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও একটা হুইল চেয়ারে বসা। হাতের সাথে স্যালাইনের ক্যাব লাগানো। স্যালাইন চলছে। রোশনিকে কথা বলতে দেখে আমার শরীরে প্রান ফিরলো মনে হলো। মা বলল রোশনির জ্ঞান ফিরছে না দেখে তুই ই অজ্ঞান হয়ে গেলি বাবা। সত্যি তোদের ভালোবাসা,,, এমন যুগ যুগ ধরে যেন থাকে।
ইশু পাশ থেকে বলল আমাদের বৌদি ও কম ভালোবাসে না। দাদা অজ্ঞান হয়ে গেছে শুনে এই কেবিনে চলে এসেছে। ডক্টর রাও ওর জেদের কাছে হার মানলো। তুই জানিস না দাদা। বৌদি কে আসতে দিচ্ছিল না বলে হাতের ক্যাব খুলে ফেলছিল ওষুধ ফেলে দিচ্ছিল। রোশনি আমার হাতটা এখনও শক্ত করে ধরে বসে আছে। রাজ বলল ঈশিতা মা চলুন আমরা বাইরে যাই। ওরা চলে গেলো।
আমি গম্ভীর স্বরে বললাম কেন এমন পাগলামি করছিলে। ওষুধ খাওনি যদি আবার সেন্সলেস হয়ে যেতে।
সেটা আপনিও তো করেছিলেন। আমি কি কিছু বলছি।।।
দুহাত দিয়ে ওর মুখ ধরে বললাম পাগলী আমার। খুব ভালোবাসি তোমাকে। তুমি জানো না তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে আমার কেমন লাগছিলো। মনে হচ্ছিল আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
হঠাৎ একটা নার্স আসলো। আমি রোশনির মুখ ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। নার্স হালকা হেসে রোশনিকে বলল
এখন আপনাকে নিজের কেবিনে যেতে হবে। ওষুধ খেতে হবে।
হ্যা যাও রোশনি। আমি আবার আসবো তোমার কেবিনে।
আচ্ছা।
নার্স রোশনির চেয়ার ঘুরিয়ে ওকে নিয়ে গেলো। এরপর মা ইশু আসলো। মা বলল তোকে সামলানো যাচ্ছিল না দেখে নার্স তোকে সেন্সলেস করার ইনজেকশন দিয়েছিল। ওদিকে রোশনিও জোরে একটা শ্বাস নিয়ে শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম বলে হুহু করে কেঁদে উঠলো।
ইশু মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল কিন্তু ডক্টর বলল ওর প্রান আছে। পরে লাস্ট ট্রাই করলো ইলেকট্রিক শক দিয়ে ওর জ্ঞান ফিরলো।
আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। যার জন্য আমার রোশনির এতটা কষ্ট সহ্য করেছে তাকে তো আমি ছাড়বোই না। কিছুতেই না মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম।
রাতে নার্স বলল যেকোনো একজনকে থাকতে দেওয়া যাবে। তাই মা ইশু আর রাজকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমি থেকে গেলাম। রোশনির স্যালাইন চলছে সাথে স্যুপ জুস লিকুয়েড জাতীয় খাবার খাওয়াতে বলেছে। সারারাত এক হাতের ওপর ভর করে থেকেছি। এভাবে সাতদিন যাবার পর আজ সকালে ডক্টর ওকে রিলিজ করলো। পেটে সেলাই লেগেছে। খুব সাবধানে থাকতে হবে কয়েকমাস। বাসায় এসে সম্পুর্ন বেডরেস্ট। ওকে ওষুধ খাওয়ানো মাঝে মাঝে গার্ডেনে নিয়ে যাওয়া এসব আমিই করতাম। সাথে ইশু মা বা শ্যামলি ওর যত্ন করতো। ড্রেস চেন্জ বাথরুমে নিয়ে যাওয়া এসব।
আস্তে আস্তে রোশনি হাঁটতে পারলে থানায় গিয়ে শুভ্রর নামে মামলা করলাম। বিকালে পুলিশের সাথে গিয়ে দেখি ছাদে ও আরও কয়েকজন মিলে ড্রিংক করছে। ওর কলার টেনে উঠিয়ে বললাম রোশনিকে কষ্ট দিয়ে তুই এখানে ফুর্তি করছিস। কিন্তু তোর আনন্দের দিন শেষ।
ও ভয়ার্ত মুখ করে বলল আদি তুই তুই এখানে।
শুধু আমি একা নই বলে সরে যেতেই পুলিশ দাড়ানো দেখল।
শুভ্র বলল স্যার আমি কিছু করিনি। বিশ্বাস করুন।
কে বলেছে। আমি তো কিছু বলিনি। আগে জেলে চল তারপর প্রমান হবে। তুই কি কি করেছিস। আর রোশনি দেবী কিন্তু সুস্থ হয়ে গেছেন। সেটা মাথায় রাখিস।
তারপর টেনেহিঁচড়ে ওকে সহ বাকিদের গাড়িতে তুললো।
কেস চলাকালীন কোর্টে রোশনি সবার সামনে বলল শুভ্র ওকে মারার চেষ্টা করেছিল এবং ওর পেটে ছুড়ি দিয়ে কয়েকবার আঘাত ও করেছিলো। হসপিটালের রিপোর্ট সহ বাকি পেপার্স সাবমিট করা হলো। তারপর সেই রিকশা চালক ও সাক্ষী দিলেন যে সেদিন শুভ্র এসেছিল। কিন্তু পরে পালিয়ে যাওয়ায় আর কিছুই দেখেন নি।
জর্জ সাহেব বললেন সকল সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে আদালত এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে
অভিযুক্ত শুভ্র সেনকে ১৪ বছরের জন্য জেলে থাকতে হবে। আর তার সঙ্গীদের ২০,০০০ টাকা করে জরিমানা প্রদান করতে হবে। কেউ তাতে অস্বীকৃতি জানালে আইন তার বিপক্ষে আইনি ব্যাবস্থা নিবে।
শুভ্রকে শাস্তি দিতে পেরেছি এতে প্রচন্ড মানসিক শান্তি হচ্ছে। আর যাইহোক আর কেউ কখনো রোশনির ক্ষতি করতে পারবে না।
মা ইশু আমাদের মিল দেখে খুব খুশি হলেন। আমিও মনে মনে ভেবে নিলাম আজ রোশনিকে একটা সারপ্রাইজ দেবো।
চলবে,,,,,