বিদায়_বরণ পার্ট ৪

বিদায়_বরণ
পার্ট ৪
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী

সন্ধ্যে নেমেছে শহরে, ক্ষনিক আগেই সূর্য ডুবে গেল পশ্চিমাকাশে। প্রেমের ছাদের পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে। গতকাল সন্ধ্যের সময়টা ভাবছে।শিখিনীর কথা ভাবছে।

নিভৃতে এক জীবন ভালোবেসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে তারপর পেয়ে আবার শূন্য হয়ে জীবনটা কাটানো দুঃসহ হয়ে ওঠে।
তখন জ্বলে পুড়ে হৃদয়টা একেবারে ছাই হয়ে যায়, অনুভূতি শূন্য হয়ে যায় জীবন! প্রেম এটা মানতে পারে না। সে যাকে ভালোবাসে, তাকে পেয়েই তবে থামবে। আর গতকাল যখন সে ভালোবাসা নিজ থেকে ধরা দিয়েছে, তাকে কীভাবে ফিরিয়ে দিবে!
গত সন্ধ্যের মত আজ সময়টা যদি সেই মধুর মিলনের হত।
প্রেম সন্ধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, হে প্রিয়তমা, তোমার ভালোবাসার জলন্ত কয়লার মত জ্বলছি, তুমি কী অনুভব করতে পারছ না সে জ্বালা!

দুপুর থেকেই শিখিনীর ভীষণ জ্বর আসে। এত পরিমান জ্বর শরীরে, সেই উত্তাপে উঠে বসার শক্তি টুকু পায় না। দরজাটা এদিকে বন্ধ, বিভাবরী বেগম হয়ত আসতেও পারছে না। আসলে দেখতে পারত, কতটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে মেয়েটা। আরো ফ্যানটা চলছে ফুল স্পিডে।
শিখিনীর গলা শুকিয়ে আছে, জ্বরে, ঠান্ডা হওয়ায় হিরহির করে কাঁপছে, মনে হচ্ছে, আজই তার শেষ দিন। মৃত্যুর কোলে ঢলে ধরছে ক্রমশ। ডান হাত দিয়ে ফোনটা হাতাচ্ছে। কাউকে যদি কোনোভাবে বলা যেত। কিন্তু পারল না সে! সেভাবেই সময় কাটতে লাগল। একসময় অচেতন হয়ে পরে রইল বিছানায়।

রাত প্রায় ৯টা,
যামিনী তার ভাই কিংশুককে বাসে উঠিয়ে দিয়ে এসে বাসায় সবে মাত্র ঢুকল। দেখল বাসায় কয়েকজন চেনা মানুষের গুনজন। একটু এগিয়ে দেখল, শিখিনীর রুমে সবাই ভীর করেছে।
শিখিনী বিছানায় শুয়ে, ডক্টর এসেছে, স্যালাইন চলছে। বিভাবরী বেগম মেয়ের মাথার কাছে বসে কাঁদছেন। এতক্ষণ যে কাঁদছেন সেটা তার চোখ মুখ ফুলা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। বিছানার পাশে সোফায় বসে আছে মিসেস আনোয়ার।

শিখিনীর এই অবস্থা দেখে যামিনী খুব ব্যথিত হলো।
“আন্টি, শিখি আপুর এই অবস্থা কী করে হলো? ”
” দেখো না যামিনি, মেয়েটা জ্বরে জ্ঞান হারিয়ে পরেছিল, সেটা এই সন্ধ্যায় এসে জানতে পারলাম আমি।”

যামিনী একটু মিউয়ে গেল। ইশ্ কী ভুলটাই না করল সে! গতকাল সন্ধ্যায় ফিরে শিখিনীর রুমে তো সে একবারও আসেনি। যখন বিভাবরী বেগম জিগ্যেস করলেন, তখন মিথ্যে বলেছিল যে শিখিনী ঘুমিয়ে গিয়েছে। তখন থেকেই কী জ্বর ছিল! যামিনী ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। একবার আসা উচিত ছিলো!
প্রিয়মকে মনে মনে একশ একটা গালাগাল দিল যামিনী। গতকাল সন্ধ্যায় প্রিয়মের সাথে দেখা হয়েছিল তার। বেয়াদব ছেলেটা যেভাবে রূঢ় ব্যবহার করল, আশ্রিত বলে অপমান করল। সেজন্য নিজের প্রতি রাগে, দুঃখে শিখিনীর রুমে আসার কথা সে খেয়ালই করেনি। কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। মধ্যেরাতে উঠে দেখে বিভাবরী বেগমের রুমে আলো জ্বলছে। কখন এসেছে জানতে গিয়ে, তখনি বলে শিখিনী ঘুমিয়ে আছে। কারণ, দরজা বন্ধ দেখে ভেবেই নিয়েছিল, শিখিনী রুমেই আছে।
অগ্নিমূর্তি চোখে প্রিয়মের দিকে তাকাল যামিনী। প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, মনে মনে ভাবল, গাইয়া মেয়েটা আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন! দেখাচ্ছি, পরে মজা!

বিভাবরী বেগম জড়ানো কণ্ঠে শিখিনীকে ডাকতে লাগল,
“শিখি মা, উঠ মা। কী করে এভাবে জ্বর বাঁধালি? সব আমার অসাবধানতা। আমার সকালেই খোঁজ নেওয়ার দরকার ছিল! সব আমার ভুল।

মিসেস আনোয়ার এগিয়ে এসে বললেন, আহা আপা, এখন এসব বলে কী হবে? ডক্টর তো দেখছেন, শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে। ভয়ের কিছু নেই।
ভাইজান, কী দেখলেন?
” ভয়ের কিছু নেই, জ্বরটা কমে আসবে ধীরে ধীরে। স্যালাইন এটা শেষ হয়ে গেলে, দ্বিতীয়টা দিয়ো। বাকী এই ঔষধ গুলো আনিয়ে রাখো। আমি এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। সুস্থ হয়ে যাবে। আজ আমি আসি!
” বাসায় চলুন মামা। ব্যাগটা দিন।”
ডক্টরকে নিয়ে প্রিয়ম বাহিরে চলে গেল।

প্রিয়মের আপন মামা দেলোয়ার হোসেন ডক্টর। এই শহরেই বাসা। বিভাবরী বেগম মেয়ের এহেম অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়ছিলেন, চিৎকার দিয়ে শিখিনীকে ডাকতে লাগলেন, কিন্তু শিখিনী তখন অচেতন অবস্থায়।
বিভাবরী বেগমের কান্না দেখে, সাখাওয়াত দৌড়ে গিয়ে মিসেস আনোয়ারকে ডেকে আনেন। প্রিয়মই তখন তার মামাকে ডেকে আনে। সারারাত সারাদিন না খাওয়ায় শরীর বেশ দূর্বল হয়ে পরেছিল, তাই স্যালাইন দেওয়া হয় জলদী।

যামিনী পায়ের কাছে বসে, মুখটা শুকিয়ে পাংশুটে হয়ে আছে। শিখিনীর এই অবস্থা দেখে ভীষণ লজ্জাবোধ হচ্ছে নিজের প্রতি।

শিখি, এই শিখি।
মা।
শিখির জ্ঞান ফিরেছে। জ্বরটাও হালকা কমে এসেছে। এখন সে স্পষ্ট তাকিয়ে চারপাশটা দেখতে পারছে। পাশে তার মা, দূরে যামিনী আর তার ভাই। নড়তে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেল, স্যালাইন লাগানো হাতে। বুঝতে বাকী রইল না, সবাই তার পরিস্থিতি জেনে গিয়েছে।
বিভাবরী বেগমের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
“কীরে মা, জ্বর বাঁধালি কখন!”
” দুপুরের দিকো ঘুম ভাঙলে মনে হয় জ্বরে গা পুরে যাচ্ছিল। ”
যামিনী বলল, “সে কী, আজও সকালে গোছল করেছিলে?”
“হ্যাঁ, করেছিলাম। ”
বিভাবরী বেগম চিন্তিত গলায় বললেন,
“কিন্তু, ও তো প্রতিদিনই সকালে গোছল করে!

শিখিনী মায়ের হাত ধরে রাখল শক্ত করে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরল।
“মা, আমার না পেটে ব্যাথা করছে। ”
“পেটে ব্যাথা করছে? সারারাত না খেয়ে ছিলি তাই না, একটু যদি নিজের যত্ন করে! ”
মিসেস আনোয়ার চৌধুরী বললেন,
“এখন তো স্যালাইন চলছে। খাওয়ানো যাবে না। দু’ঘন্টা পরে অল্পকিছু ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিয়েন।
শিখিনী না সূচক মাথা ঝাকিয়ে বলল, “না মা, আমার একটু বেশী পেটে ব্যাথা করছে! ভাইকে বলো বাহিরে যেতে।”

বিভাবরী বেগমের বুঝতে সময় লাগল না, মেয়ের হঠাৎ এত জ্বর কীভাবে আসল। ছেলেকে বললেন, বাজার থেকে কিছু সতেজ ফল নিয়ে আসতে। যামিনীকে বললেন, বাহিরে থেকে এসেছ, কাপড় ছেড়ে নেও, আমি আছি শিখির সাথে।

প্রায় মধ্যরাত, শিখিনীর এখনো স্যালাইন চলছে, তবে, বেশ কিছুটা সুস্থ এখন। খাটের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ঘরে ডিম লাইট জ্বলছে। বিভাবরী বেগমের চোখে ঘুম নেই। সন্তান অসুস্থ হলে কী মায়ের আর খাওয়া, ঘুম থাকে।
শিখিনী বিরক্ত হয়ে বলল,
মা, এবার তুমি ঘুমাও তো, ১টা বেজে গেছে। আমি এখন ঠিক আছি।
বিভাবরী বেগম নাছোড়বান্দা। মেয়েকে আগে ঘুম পারাবেন।
“না, তুমি আগে ঘুমাও, যদি কিছু প্রয়োজন পরে তোমার।,”
” উফ, আমি তো সারা সন্ধ্যে ঘুমিয়েছি মা, এখন ঘুম আসবে না আমার । আর ওটাকে দেখো, কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাচ্ছে।

বিভাবরী বেগমের হাসি দুই ভাই বোনের ঝগড়া দেখলে, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“শিখি, ও তোর ছোট ভাই না, ওভাবে বলিস কেন!

“কেন!ছোট বলে কী ওর কোনো দোষ থাকবে না। ওর অসুস্থের সময় তো আমাদের হার জ্বালিয়ে মারে, আর এখন দেখো, কী ঘুম ছেলের!
” হ্যাঁ, ছোটই তো। ছোটদের আবদার বেশি থাকে। তাছাড়া, ছোট এখনো, কতক্ষণ জেগে থাকবে। আর, ঐ তো আজ তোর রুমে প্রথম এসেছিল, নয়ত কী যে হত!

এই তিনজনের সংসার। ১৮টা বছর কেটে গিয়েছে সংসারের। সুখ, দুঃখে, এরাই এদের আশা ভরসা।
শিখিনী শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল,
মা, আমার ডায়েরীটা এনে দেও। পড়তে পড়তে ঘুম চলে আসবে।
টেবিল থেকে মেয়ের ডায়েরিটা এগিয়ে দিয়ে অভিমানি সুরে বললেন,
” এই নেও, এটাই তো তোমার সব।”

“কেন, তোমার তো ডায়েরী আছে, বাবার কথা মনে পরলেই তো সেই ডায়েরি পরে কী সব লেখো,আমি কী দেখতে যাই,!
বিভাবরী বেগম কোমড়ে হাত রেখে বলেন,
” শিখি শুনো, মায়ের সাথে একদম তর্ক করবে না।
শিখিনী ভাব নিয়ে ডায়েরিতে মনোযোগ দিয়ে বলে,
তাহলে, তুমি ঘুমাও, আমি আমার কাজ করি!

বিভাবরী বেগম ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে যান। শিখিনী ডায়েরী খুলে পড়তে পড়তে বেশ সময় চলে যায়। এরপর দেখে পাশে মোবাইলটা জ্বলছে, প্রেম ফোন করেছে, ভাগ্যিস ফোনটা সাইলেন্ট ছিল। নয়ত, মা জেগে যেত!

চলছে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here