বিদায়_বরণ পার্ট ৫

#বিদায়_বরণ
পার্ট ৫
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী

ভোর ৫টার সময়,
ভোর হয়েছে। শিখিনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ব আকাশে এখনো সূর্য উঠেনি। গতরাতে আর ঘুম হয়নি তেমন একটা! সারাদিন রাত বিছানায় শুয়ে থাকায় আরো চোখ মুখ ফুলে উঠেছে।
শিখিনীর মনে হচ্ছে, তার হাত পা-সহ ফুলেছে, এমনিতে মোটাসোটা, তার উপর গালটা ফুলে টইটম্বুর। দু’চোখের নিচে হালকা লালচে রঙ উঠেছে!
শিখিনীদের বিল্ডিংয়ের পাশে ছোটখাটো একটা গার্ডেন আছে। সেখানে সবাই হাঁটাহাঁটি করে। বাচ্চারা খেলাধুলা করে। এই এপার্টমেন্টের সামনে জায়গাটাও ভীষণ সুন্দর, দু ‘একটা পাখি ডাকছে, এই আকাশে উড়ে যাচ্ছে, এই গাছের ডালে এসে বসছে। রাস্তায় শারি শারি গাছ।
শিখিনীর সবুজ প্রকৃতি ভীষণ ভালো লাগে। যামিনী বলেছে, গ্রামের প্রকৃতি আরো সুন্দর হয়। শহর মানেই তো বড় বড় বিল্ডিং, আর যানজট! তারও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, এই বদ্ধ শহর ছেড়ে সবুজে সমারোহ কোনো শহরে চলে যেতে, প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে। যামিনীর কাছে প্রকৃতির গল্প শুনলে তার আরো আফসোস হয়! ছোট থেকে তো সেই শহরেরই বড় হয়ে এসেছে! ক’জন বন্ধুদের দেখতে বিশেষ বিশেষ ছুটিতে নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি গ্রামে বেড়াতে যেত। আর তার তো সেটাও নেই!

শিখিনী মন মরা হয়ে পার্কের দিকে তাকিয়ে থাকে। শরীরটা দূর্বল লাগছে, সেজন্য আজ আর হাঁটতে বের হলো না।
কিছুক্ষণ বাদে নিচে প্রেমকে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ অসস্তিতে পরে গেল শিখিনী। ছেলেটা ঘেমে ভিজে একাকার। শিখিনীর দিকে তাকিয়ে ফুঁসছে। জগিং করে এলো বোধহয়। হাতে একটি কীসের ফুল যেন!
এত সকালে প্রেমের দেখা পাবে, সে ভাবেইনি! কারণ, যে রাতে শিখিনীকে ফোন দিয়ে পাবে না, সে-রাতে আর প্রেম ঘুমায় না।
তার মানে কী, প্রেম রাতে সত্যি ঘুমায়নি!

রাতে বেশ কয়েকবার ফোন এসেছিল প্রেমের, কিন্তু শিখিনী ধরেনি। ভীষণ অসস্তি হচ্ছে তার। পাশে বিভাবরী বেগম শুয়ে আছেন। যদি ফোন ধরলেই বলে বাহিরে আসো, তাহলে কীভাবে সম্ভব হবে। আর এই ছেলেটা যা ত্যাড়া টাইপের, কথা শুনে না একদম!

শিখিনী মনে মনে ভাবল সকালে প্রেমকে বলবে সে ঘুমিয়ে ছিল। ফোন দিয়েছে, দেখতে পায়নি, এখন যত খুশি দিক। কিন্তু বেশ মন খারাপ ও হলো তার ফোনটা না ধরায়।
ফোনটা পাশে রেখে দিলো। ডায়েরিতে মনোযোগ দিলো।

প্রথমেই ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় হাত বুলাল, এই লেখাটা একবছর আগের। হ্যাঁ, একবছর আগেই সে ডায়েটি লিখতে শিখেছে। পিছনের ২০বছরের অতীত সে লিখে আসছে।
সবটাই প্রেম আর তার জীবনের এক একটা দিন।
শিখিনী মুচকি হেসে মোবাইলের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ডায়েরি টা পড়তে লাগল।

৭ই সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার

সময় সন্ধ্যে সাতটা,
আজ কেন যেন ভীষণ খারাপ লাগছে।চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। আমার জন্য নয়। প্রেমের জন্য। মানুষটা এত রেয়ার।
গতকাল বৃহস্পতিবার, হাফডে ক্লাস ছিলো। তাই বাসায় চলে আসলাম। উদ্দেশ্য বিকেল থেকে প্রেমের সাথে কাটানো।
দেশে ফিরে পাক্কা দু’ মাস আমার সাথে যোগাযোগ করেনি, তবুও সব অভিমান ভুলে নিজ থেকে কথা বলেছি। বিভিন্ন কারণে, অকারণে মানুষটার সাথে দেখা করতে উঁকিঝুঁকি দিয়েছি। এমনটা নয়, সে আসেনি আমার কাছে। এসেছে, লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকেও দেখেছে। সারা বিকেল সন্ধ্যা আমার সাথে ছাদে পরে থাকত। দু’একটা কথা বলত, আর সারাক্ষণ চুপ থাকত। আর আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকত। এত বেহায়া ছিল, আমি তো লজ্জায় চোখ তুলে তাকিয়ে নিজ থেকে কিছু বলতেও পারতাম না।
একদিন সাহস করেই বললাম, আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন! আমার অসস্তি হয় না!
মানুষট সোজা বলে দিলো, আমার চোখ দিয়ে আমি দেখি, তোর সমস্যা কী!
হ্যাঁ,মানুষটা আমাকে তুই ডাকে, তবে যখন রেগে যায় তখন। ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। কী রেখে কী বলে দেয়!

কিন্তু গতকাল কেমন যেন ছাদে যেতে মন চায়নি, শেষে একটু মায়ের সাথে গিয়েছিলাম, দেখলাম প্রেম সাহেব আসেনি, মা ছিলো বলে, বিষয়টা নিয়ে আর ভাবিনি! বাসায় এসেই ঘুমিয়ে গেলাম। সত্যি বলতে প্রেমের শূণ্যতা অনুভব করছিলাম! আর আমি কোনো অসস্তিতে থাকলে ঘুমাতে চলে যাই!

মধ্যে রাতে মানুষটা ফোন দিয়ে বলল, ছাদে যেতে।এটা মানা যায়! ভীষণ রাগ হলো। ফেনটাও ধরলাম না। নিজের প্রতি নিজে বিরক্ত হয়ে ম্যাসেজ করলাম, আপনার খেয়াল খুশি অনুযায়ী ডাকবেন, আর আমি চলে যাবো। আমি তো আর পুতুল নই!

ব্যস, এটাই ছিল আমার জন্য কাল। নিশ্চয় আমার অভিমান বুঝেছিল। আসলে আমাদের সম্পর্কের কোনো নাম ছিলো না! আমরা মনে মনে হয়ত বা দু’জনকে ভালোবাসি, কিন্তু কেউ এখনো স্বীকার করতে পারিনি! আমি তো লজ্জায় বলতে পারিনি, প্রেম কেন পারেনি, সেটা জানি না।

আজ শুক্রবার, খুব ভোরে উঠলাম, কারণ, সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলাম।
ঘুম ভাঙলে উঠে তাহাজ্জুদ পরলাম। আজান দিতে দেখি এখনো অনেক সময়। প্রেমের কথা মনে পরল। মন খারাপ হলো। সাহস করে ছাদে যাওয়ার জন্য বাহিরে এলাম।
ধীরে ধীরে ছাদে যেতে লাগলাম। তিনতলার একটি মেয়েকে দেখলাম ছাদ থেকে নেমে গেল। ভীষণ রাগ হলো। প্রেম নিশ্চয় ছাদে। প্রেম দেশে আসার পর একটা দিনও যদি দেখেছি প্রেমের পিছনে দৌড়ায়নি, বেহায়া মেয়ে একটা!

ছাদে গিয়ে দেখালম প্রেম বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। রুমে ধোঁয়ায় ধূ ধূ করছে। অনেকগুলো সিগারেটের শেষ অংশ পরে প্রেমের সামনে পরে। প্রেমের চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। আমি কী বলব, কী করব, কিছু বুঝতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম প্রেমের প্রতি।

প্রেম এক নজর আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। ওর গায়ে টি-শার্ট খোলা দেখে আমার বুকের মাঝে ধকধক করতে লাগল। দরজাটা লাগিয়ে প্রেমের কাছে গিয়ে বসলাম।
” এসব কী শুরু করেছ, এত সিগারেট! তুমি না কথা দিয়েছিলে, সিগারেট খাবে না!
“তুমি তো কথা দিয়েছিলে, আমি যখনি ডাকব, চলে আসবে। ”
নিজের বোকামির জন্য তখন নিজের প্রতি ধিক্কার দিলাম। মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ অবস্থায় কয়েকটা প্রশ্ন করে বসলাম।
“তুমি এমন করবে কে জানত!”
“কেন? কী করেছি আমি!”
“ঐ মেয়েটার সাথে কিছু করোনি তো?”
প্রেম অবাক হয়ে বলল, “কোন মেয়েটা!”
“তিন তলার মৌ!”
“চিনি না আমি!”
“এই মাত্র ছাদ থেকে নামল যে!”
প্রেম আমার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমি কী জানি!”

আমি প্রেমের দিকে তাকিয়ে রইলাম, প্রেম আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল, “এই তুমি কী আমাকে সন্দেহ করছ? ”
আমি মাথা নিচু করে রাখালম। সন্দেহ একটু হলেও করেছিলাম।কিন্তু তখন স্বীকার কীভাবে করতাম। লজ্জা হচ্ছিল ভীষণ!

প্রেম আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আমায় জিগ্যেস করল,
“তুুমি কী আমায় ভয় পাচ্ছ?”
“না, কেন! ”
“যদি খেয়ে ফেলি!”
“ছিঃ কী সব কথা।”
” তেবিশ্বাস করো আমায়। ”
“হ্যাঁ, করি।”
“তাহলে, তখন এলে না কেন!”
আমি জবাব দিতে পারলাম না। ভয় আমি সত্যি পেয়েছিলাম। কীসের ভয় সেটা জানি না! প্রেম জলন্ত সিগারেটটা দূরে ফেলে দিলো। ফ্যান ছেড়ে দিলো। এরপর আমার কাছে এসে বসে বলল,
“একবারো আমার কাছে জানতে চাইছ, আমি কোথায় ছিলাম!কী হয়েছিল? কেন তোমাকে একনজর দেখব বলে ছটফট করছিলাম।”

আমার অপরাধবোধ হলো, প্রেম আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গুটিয়ে আমার কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পরল। বাচ্চা ছেলের মত ঘুমিয়ে পরল। যেন সে জানত আমি আসব, আর আমার কোলে সে মাথা রেখে ঘুমাবে। আজ প্রেমকে অন্যভাবে আবিস্কার করলাম। বেশ অন্যরকম লাগছিল প্রেমকে। একেবারে নতুন। তবুও, কেন জানি, আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। সেই শৈশবের স্মৃতি মনে পরছিল, এভাবেই আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকত। আর আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম, কখন জানি কে দেখে ফেলে আমাদের!

এরপর থেকে খুব সাবধানে থাকতাম। প্রেমের সাথে বুঝে শুনে চলতাম, কখন ওকে কষ্ট দিয়ে বসি সে ভয়ে।…
~শিখিনী

প্রেমকে কী বলবে, সেটা ভেবেই শিখিনীর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে!
শিখিনী ধীর পায়ে নিচে নামতে লাগল। সেদিনের মত প্রেমের চোখ দুটো টকটকে লাল। শিখিনী মাথা নীচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

শিখিনীকে অবাক করে প্রেম একটি কলমি ফুল এগিয়ে দিয়ে বলল, ” মাঠে, এই ফুলটাই পেয়েছি। চলো, ওদিকটায় হেঁটে আসি। ”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here