বিদায়_বরণ পার্ট ৬

#বিদায়_বরণ
পার্ট ৬
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী

শিখিনী ধীর পায়ে নিচে নামতে লাগল। সেদিনের মত প্রেমের চোখ দুটো টকটকে লাল। শিখিনী মাথা নীচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রেমের সামনে।
শিখিনীকে অবাক করে একটি কলম ফুল হাতে দিয়ে প্রেম বলল, এই নেও তোমার পছন্দের একটি ফুল। চলো ,হেঁটে আসি। ”

সামনে সরু রাস্তা, দু’পাশে সারি সারি গাছে।
শিখিনীর হাত ধরে প্রেম হাঁটছে। পার্ক ছেড়ে পূর্ব পাশে এক দিঘির রাস্তায় হাঁটছে দুজনে।
ওদের পার্কে হাঁটলে অনেকে দেখত,সবাই চেনা পরিচিত। তাই প্রেম এদিকটায় নিয়ে আসে।

শিখিনীর অসুস্থতার জন্য প্রেমের কারণে। কিন্তু শিখিনী সেটা কখনোই স্বীকার করবে না। প্রেম বিমর্ষ কণ্ঠে বলল, “আমার কারণে তোমার অসুস্থতা। ”
শিখিনী লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে রাখে। প্রেমের সাথে থাকলে তার এমনি অসস্তি ভর করে। তবুও ধীর কণ্ঠে বলল,
“কী বলছ এসব! তোমার কারণে কেন হবে।”
প্রেম শিখিনীর হাঁতটা বুকের মাঝে ধরে হাটতে লাগল। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে তারা। এমনিতে প্রতিদিন দুজনের মাঝে দৌড় প্রতিযোগিতা হয়। তবে আজ শিখিনী অসুস্থ বলে।

রাস্তার পাশের একটি বেঞ্চে দুজনে বসল। সামনে এক নদী বয়ে চলেছে। আর পুরোটাই বাগান। বেশ নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ।

শিখিনীর হাতটা বুকের মাঝে ধরেই প্রেম বলল,
“জানো শিখি, গতরাতে এসব ভেবে আমার ঘুম হয় নি!”
শিখিনী হুট করে বলে উঠে, “সিগারেট খাওনি তো?”
প্রেম মুচকি হেসে বলে, না, তোমার কথা আর ফেলতে পারি বলো। ”

শিখিনী লজ্জায় আবার মাথা নত করে রাখে। প্রেম বিমর্ষ চেহারা নিয়ে শিখিনীর শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণে মন খারাপ নিয়ে বলল,
“তুমি শুধু শুধু এমন টেনশন করেছ। জ্বরটা স্বাভাবিক, আসতেই পারে।”
“এখনো দূর্বল লাগছে তোমার? ”
“হ্যাঁ, একটু। কিন্তু তোমার কাছে থাকলে আমার মন শরীর, মন এমনি ভালো হয়ে যায়। ”
“পাগলী একটা। ”

শিখিনীকে আরো কাছে টেনে নিলো প্রেম। শিখিনী লজ্জা ভাবেই প্রেমকে জড়িয়ে ধরল।
প্রেম মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। শিখিনীর খুব ইচ্ছে করছে প্রেমকে বলতে, ” তোমার বুকে মাথা রেখে ভীষণ ইচ্ছে করছে একটু ঘুমাতে।”

প্রেম শিখিনীর মুখটা ধরে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,
” শিখি, আজ তুমি আমার সাথে থাকবে। আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে চাই।”
শিখিনী নত কণ্ঠে বলল, ” আচ্ছা, আমি থাকব।”
“আর তোমার মা? ”
“আমি ম্যানেজ করে নিবো।”
“অনেক কিছুই ম্যানেজ করতে শিখে যাচ্ছ। তোমার বাচ্চামোটা আমি খুব মিস করছি। ”

শিখিনী মাথা তুলে বলে,
“তোমাকে পেয়েছি, এখন সব কিছু ম্যানেজ করেই তো চলতে হবে। ”
“না, চলার দরকার নেই। আমি চাই, তুমি তোমার বাচ্চামিতে মেতে থাকো। এতে তোমাকে বেশ কিউট লাগে, আদর করতে ইচ্ছে করে, আর একটা কিস!

শিখিনী লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখল। প্রেম শিখিনীর মুখটা হাতের মুঠোয় নিয়ে গালে চট করে একটা কিস করে দিলো। শিখিনী মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। প্রেম এমনটা করবে জানলে কখনো সাথে আসত না, যদি কেউ দেখে নেয়, কী লজ্জা!
প্রেম একটি নীল পাথরের পেনডেন্ড শিখিনীর গলায় পরিয়ে দেয়। শিখিনীর ভীষণ পছন্দ হয়।
” ওয়াও, প্রেম। এটা ভীষণ সুন্দর!
” আমার ময়ূর রাণীর থেকে বেশি নয়। প্রেমের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসে শিখিনী।

গহনার মাঝে ছোট একটি ফুলের নাকফুল পরা শিখিনী। সামান্য এতটুকুতে ভীষণ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। শুভ্রতায় ভরপুর। দূরে একটি দোকানে রুটি তরকারি পাওয়া পায়। সেখান থেকে প্রেম একটি প্লেটে খাবার নিয়ে এসে নিজ হাতে শিখিনীকে খাইয়ে দেয়।
শিখিনী এক টুকরো রুটি প্রেমের মুখের দিকে এগিয়ে দেয়। প্রেম নিবার্ক তাকিয়ে থেকে মুখে তুলে নেয়। খেতে খেতে প্রেম বলে, ” এত ভালোবাসা বেসো না আমায় শিখি, আমার কপালে কিন্তু সুখ সহ্য হয় না!

শিখিনীর ভীষণ খারাপ লাগে কথাটায়। চোখ ছলছল করে উঠে, এক দমে দাঁড়িয়ে যায়। একটু পরই হয়ত চোখের জল গড়িয়ে পরবে।
কিন্তু সেটা গিয়ে পরল প্রেমের বুকে, প্রেম শিখিনীকে জড়িয়ে ধরেছে। শিখিনীও প্রেমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। চাপা কণ্ঠে বলল, প্রেম, এমনটা আর কখনো বলবে না। ”
“পাগলী আমার। আচ্ছা, আর বলব না। ”
“আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি প্রেম। ”
শিখিনীর হাবা মুখটার দিকে তাকিয়ে প্রেম চট করে হেসে উঠে, গোলগাল গালটা টেনে বলে,
” আমিও ভালোবাসি আমার ময়ূর পাখিকে। ”

দূর থেকে ওদের দুজনকে দেখে চোখ ভর্তি জল নিয়ে পিছনে হাঁটতে লাগল মৌ। বছর দুই আগে প্রেম দেশে ফিরলে ভালোবাসার মানুষ বানিয়ে নেয় প্রেমকে।
কিন্তু সে তো জানত না, তার ভালোবাসার মানুষকে অনেক আগেই একজন নিজের আপন মানুষ করে রেখেছে!
ভীষণ দুঃখ হলো তার! কষ্ট হতে লাগল। প্রেমের থেকেও বেশি শিখিনীর প্রতি জ্বলতে লাগল মৌ।

যামিনী উঠে তৈরি হয়ে বিভাবরী বেগমের কাছে গেল, আন্টি আমি আসছি।
“আচ্ছা মা,সাবধানে যেও।খেয়েছ? ”
খা”ওয়ার সময় নেই আন্টি, ক্যান্টিনে খেয়ে নিবো। আমাকে ৭টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। ”
“আচ্ছা যাও।”

যামিনী বেড়িয়ে যেতেই বিভাবরী বেগম গতকালকে আসা কিংশুকের কথা ভাবতে লাগলেন। বেশ চেনা পরিচিত মনে হলো ছেলেটিকে।বাসাও বলল ফরিদপুর। কিন্তু তিনি কী ভুল ভাবছে, নাকী সঠিক!
তখনি সাখাওয়াত এসে শিখিনীর কথা জিগ্যেস করল।

যামিনী বেড়িয়ে যেতেই দেখল প্রিয়ম বেরিয়েছে। দু’জন দুজনকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। একসাথে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। প্রিয়ম জোরে নামতে লাগলে যামিনী ধীরে ধীরে প্রিয়মের পিছনে নামতে লাগল।
তিন তলায় এসে মৌকে দেখে থেমে গেল প্রিয়ম। এই মেয়েটাকে দেখলে প্রিয়মের ভীষণ বিরক্ত লাগে, অভার স্মার্ট দেখায়। প্রাইভেটে পড়ে। গায়ে পরে কথা বলতে আসে। কিন্তু, আজ কেমন মন মরা দেখতে লাগল।
প্রিয়ম যামিনীকে দেখে বাঁকা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু যামিনীর কোনো ভাবান্তর হলো না। যামিনী স্বাভাবিক ভাবেই নিচে চলে গেল। এতে করে প্রিয়ম ভীষণ বিরক্ত হলে। যামিনীর পিছনে নামতে লাগল। শেষ ফ্লোরে গিয়ে যামিনীর হাত চেপে ধরল।
যামিনী ভড়কে উঠল।

যামিনীর হাতটা ঘুরিয়ে প্রিয়মের বুকের সাথে ঠেকাল। যামিনীর মসৃণ চুলগুলো প্রিয়মের মুখটা ঢেকে নিল। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো প্রিয়মের। যামিনীকে কষ্ট দিতে চেয়েছিল প্রিয়ম, কিন্তু নিজেরই রাগ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল,
যামিনী ভয়ে কথা বলতে পারল না, শুধুমোচড়াতে লাগল। এই অবস্থান দু’জনকে কেউ দেখে নিলে যামিনীর-ই ক্ষতি!

একটা লোক নেমে আসার শব্দ পেয়ে প্রিয়ম যামিনকে নিয়ে সিঁড়ির নিচে চলে গেল।
এরপর একই ভাবে ধরে দেওয়ালে ঠেকাল। যামিনীর মুখের এক পাশ দেওয়ালে ঠেকল। প্রেম নিজের রাতে ফুঁসতে লাগল,
” প্রিয়ম, হচ্ছে টা কী, ছাড়ুন আমায়। ”
” একদম নড়বে না, তোমার ডানা ঝাপটানো একদম বন্ধ করে দিবো আমি। ”
“কী করেছি টা কী আমি!”
” শুনো, আমি কী জানি না, বাসার সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তোমার অপেক্ষায়। কে হ্যাঁ, বফ?
যামিনীর কান্না চলে আসল, চাপা কণ্ঠে বলল,
ও আমার বন্ধু।
এমন বন্ধু আমার অনেক দেখা আছে বুঝলে।

যামিনীকে দেওয়ালে সাথে মিশিয়ে একদম ঘেঁষে দাঁড়াল প্রিয়ম। যামিনীর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরল। প্রিয়মের স্পর্শ যামিনীকে কষ্টে দূর্বল করে তুলল।
“প্লিজ৷ দূরে সরুন।”
প্রিয়ম সেভাবেই রাগী কণ্ঠে বলল,
“শুনো, একদম এখান থেকে নড়বে না। ঐ ছেলেটাকে আমি চলে যেতে বলব, এরপর বের হবে। নয়ত, তোমাকে এখানে কে থাকতে দেয়, আমিও দেখব!
” প্রিয়ম , ভালো করছেন না এসব! আমি কিন্তু চিৎকার করব।”
যামিনীকে ছেড়ে দিয়ে প্রিয়ম ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
হাহ্, তোমাকে এখানের কেউ বিশ্বাস করবে না। এই পুরো এলাকা জানে, প্রিয়মের মত ভালো ছেলে দুটো খুঁজে পাবে না। সো, মুখটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকো!

প্রিয়ম চলে গেল। আর যামিনী চোখে জল নিয়ে প্রিয়মের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গত একমাসে এই ছেলেটার কী এমন ক্ষতি করেছে সে! পিছনে লেগেই আছে এভাবে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here