বিদায়_বরণ পার্ট ৮

#বিদায়_বরণ
পার্ট ৮
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী

প্রিয়মের একটু ভালো ব্যবহারেই যামিনীর ভালোলাগা কাজ করল।
এই প্রথম প্রিয়ম তার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে। নয়ত, সেই ভার্সিটির প্রথম দিন থেকে অকারণে যামিনীর পিছনে লেগেই থাকত।
যামিনীর মাঝে অন্যরকম অনুভূতি হলো। ভালোলাগার অনুভূতি!

বিভাবরী বেগম দরজা খুলে হলরুমে বসে রইলেন। শিখিনী এখনো বাহির থেকে আসেনি, মেয়েটা অসুস্থ। তবুও কোনো ভাবনা নেই। বাহিরে চলে গেল।
শিখিনী আর প্রেম বাহির থেকে ঘুরে ফিরে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। শিখিনী অসুস্থ হলেও বেশ খুশি লাগছে তাকে। প্রেম সাথে আসে যে। শিখিনীর হাতটা এখনো প্রেম ছাড়েনি। শিখিনী লজ্জায় কিছু বলতেও পারছে না। যদি কেউ দেখে নেয়!
” প্রেম,হাতটা ছাড়ো। ”
প্রেম একটু উপরে তাকিয়ে দেখল, আশেপাশে কোউ আছে কিনা! শিখিনীকে আর কথা বলতে না দিয়ে কোলে তুলে নিলো।

শিখিনীর হার্টবিট বেড়ে গেল। ভড়কে চোখে প্রেমের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার আজ হলো কী! কত বার প্রেমের কাছে আবদার করেছে শিখি, প্লিজ একবার কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠো। সব সময় রিজেক্টই হয়েছে প্রেমের থেকে। মাথা দুলাতে দুলাতে ভাব নিয়ে চলে যেত।
পাঁচতলা! শিখিনীকে কোলে নিয়ে পাঁচতলায় উঠতে প্রেমের ঘাম ঝড়ে যাওয়ার অবস্থা। একটা-দুটো সিঁড়ি নয়ত আর। এক ধাপ সিঁড়ি এখনো বাকী। শিখিনীকে নামিয়ে প্রেম নিজের বাসায় উঁকি দিলো, দরজা বন্ধ। কিন্তু শিখিনীদের বাসার দরজা খোলা।
শিখিনীর দিকে অসহায় চোখে তাকাল প্রেম।
“দুঃখিত ময়ূর পাখি, এই ধাপটা তোমাকে একাই যেতে হবে। আর তুমি যদি বলো তবে কাউকে পরোয়া না করে কোলে করে নিয়ে যেতে পারব। কী চাও বলো!

প্রেমের কথার উত্তর দেওয়ার শব্দ মিলাতে পারল না শিখিনী। আকস্মিক প্রেমের পরিবর্তনে শিখিনীর মুখের ভাষা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যে মানুষ শিখিনীকে টাইম ধরে সময়দিত, আজ সে এতটা প্রায়োরিটি দিচ্ছে! প্রেমিক হোক বা স্বামী, হঠাৎ কাছের মানুষের পরিবর্তন কোনো মেয়েই সহজে ধারণ করতে পারে না।
শিখিনী ঠিক ওরকম ফিলই হচ্ছে। তবে, কিছু পরিবর্তন কষ্টের নয়, সুখেরও হয়।

শিখিনী মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মুচকি হাসল। পুরোনো প্রেমের সাথে নতুন রুপের প্রেমের তফাৎ খুঁজছে মনে মনে। প্রেম এগিয়ে শিখিনীর দু’কাঁধে হাত রাখল। শিখিনী চমকে উঠল।
” কী হলো, এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”

শিখিনীর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে প্রেম। শিখিনীর গাল দুটো টমেটোর মত লাল হয়ে আছে। চোখের নিচে বাদামি রঙে রঙ্গিন হয়েছে। কতরাত নির্ঘুম কেটেছে শিখিনীর, সেটা প্রেমের হিসেবের বাইরে।
“এই ময়ূর পাখি।”
“উমম, কিছু নয়। ”

শিখিনী প্রেমের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। এক একটা সিঁড়ির ধাপের সাথে শিখিনী তার হৃদয়ের৷ কম্পন শুনতে পাচ্ছে। বুকের বা-পাশে ধকধক ধকধক করছে। প্রেমের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তার জন্য, নাকী হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টির মত প্রেমের ভালোবাসা পেয়ে! যেটাই হোক না কেন, শিখিনীর হাত পা সামান্য কাঁপছে।

শিখিনীর পিছনে প্রেমও উপরে উঠে এলো। প্রেমের দিকে শেষ আরেকবার চেয়ে শিখিনী দরজাটা বন্ধ করে দিলো। সব কিছু যেন স্বপ্নের মত ঘটে যাচ্ছে। শিখিনীর মনে হচ্ছে তার স্বপ্ন এখনি ভেঙে যাবে। স্বপ্ন ভেঙে দেখবে সকাল হয়েছে, সে বিছানায় শুয়ে আছে, বিছানা হাঁতরে মোবাইলটা অন করে দেখবে প্রেমের কোনো ফোন কল আদৌও আসেনি!

বিভাবরী বেগম কিচন রুম থেকে বাহিরে এসে দেখলেন মেয়ে তার দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি এগিয়ে দিয়ে মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখলেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রায় শরীর ফুলে আছে। শিখিনীর নীরবতা দেখে তিনি আর কিছু বলার সাহস পেলেন না। রুমে এনে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে শুইয়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, শিখি মা, চোখ বুজে দেখো সবই সত্যি। তোমার স্বপ্ন নয়। সবই সত্যি।

শিখিনী ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। অতীতের দূর্বীসহ দিনগুলো মনে না করে আজকের সকালটা নিয়ে ভাবতে লাগল, সে সময়ের স্মৃতিটা তার চোখের মণিতে ভাসছে। প্রেমের সাথে হাতে হাত ধরে হাঁটা, প্রেমের হাতে খাবাট খাওয়া, ভালোবাসি শব্দটা শুনা। প্রেমের এক একটা কথা, সত্যিই তো, তার জীবন কত সুন্দর! ভালোবাসার মানুষ আছে, মা আছে, ভাই আছে, এই তো পরিপূর্ণ জীবন, শুধু! শুধু তার বাবা নেই।

শিখিনীর মুখে অস্ফুটে কণ্ঠে বাবা ডাকটা শুনে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন বিভাবরী বেগম। তার নিজের চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। ধীর পায়ে চলে এলেন নিজের ঘরে।
কতগুলো বছর কেটে গেল তার নিঃসঙ্গে, নিভৃতে। যখন খুব বেশি স্বামীকে মনে পরত, দেওয়ালে টানানো ছবিটা ধরে কাঁদতেন।

খাটের পাশে দেওয়ালে একটি বড় ছবি টানানো। ছবিটা শিখিনীর বাবার। মেজর আমজাদ হোসেন। মিশন যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেননি।
বিভাবরী বেগমের বাবা একজন আর্মির সৈনিক ছিলেন। তারা পরিবারে এক ভাই, এক বোন ছিলো। মফস্বলে তাদের বেড়ে উঠা। বেশ নিয়মের মাঝে বড় হয়েছেন তিনি। বাবা যখন একজন বয়স্ক মেজরের সাথে বিয়ে দিতে চাইলেন, তখনও না শব্দ উচ্চারণ করতে পারেননি বিভাবরী বেগম।

স্বামীর অনুমতিতে পড়াশোনা শেষ করেন, এর মাঝেই শিখিনীর জন্ম।
স্বামীর সাপোর্টে বেশ সুখেই ছিলেন তিনি। মধ্যবয়স্ক এক লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে। কখনো মনেই হয়নি। একসাথে সংসার ঘুছিয়ে নিয়েছিল দু’জনে। কত আনন্দময় জীবন ছিলো সে সময়ে। আসলে আমজাদ হোসেন একজন অনাথ ছিলেন। আপনজন বলতে তেমন কেউ ছিলো না। আর্মিতে যাওয়ার পর সংসার সাজানোর বিষয় তার কখনোই আগ্রহ হতো না। নিজের অনিশ্চয়তার জীবনে কাউকে কখনো স্থান দিতে সাহস পেতেন না তিনি। শেষবার বিভাবরী বেগমের সাক্ষাৎ পেয়ে বেশ সাহস করেই বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। সে থেকেই তাদের জীবনের নতুন সূচনা।

কিন্তু সময় ৫ বছরের বেশি আগাতে পারেনি। সাখাওয়াতের জন্মের আগেই চিরতরে নিদ্রা যান তিনি। বিভাবরী বেগমের তখন যৌবন বয়স।
বিভাবরী বেগমের বাবা ভাবলেন, মেয়ে তো নিজের কাঁধে এসেই পরল। তাই আবার বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু সাখাওয়াত গর্ভে আসায় বেশ ঘাবরে গেলেন তারা। মধ্যবিত্ত পরিবারে দুটো সন্তান নিয়ে বিভাবরী বেগম কীভাবে জীবন পার করবে!

যখন বিভাবরী বেগম জানতে পারলেন তার গর্ভের সন্তান নষ্ট করার প্ররোচনা চলছে।তখন বাবার বাসায় আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে মেয়েকে নিয়ে শহরে চলে আসলেন আমজাদ হোসেনের এক বন্ধুর কাছে। আনোয়ার চৌধুরী সেই বিশ্বস্ত বন্ধু।
নিজের যোগ্যতায় চাকরী নিলেন। সন্তানদের নিজে লালন পালন করার ভার নিলেন কাঁধে। বাবার সাথে আর যোগাযোগ করেননি তিনি। সাহসী মেজর আমজাদ হোসেনের সহধর্মিণী যে সে! সন্তানদের অনাথ করে অন্যের সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন সে কোনোদিনই দেখেননি!
সে থেকেই তিনি সিঙ্গেল মাদার।

পুরোনো কথা ভেবে স্বামীর ছবির সামনে কাঁদতে লাগলেন বিভাবরী বেগম। পিছনে সাখাওয়াত এসে মা বলে জড়িয়ে ধরল। তিনি শীঘ্রই নিজের চোখের জল মুছে নিলেন। সিঙ্গেল মাদারদের চোখের জল সন্তানকে দেখাতে নেই যে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here