#বিধবা_বিবাহ(প্রথম পর্ব)
“ঐশীর বিয়েতে দুই ভরির সাতনরী হারটা গড়িয়ে না দিলে তোমার পেটের ভাত হজম হচ্ছিলনা বলো? প্রথম বিয়েতে তোমার বাবা যা যা দিয়েছিলেন সেটা কি যথেষ্ট ছিলনা? নাকি বোনের বিয়ের চক্করে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা ভুলতে বসেছো তুমি!”
ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার সকালে খুশিমনে দাদার ঘরের দিকে আসছিল ঐশী। এমন সময় বৌদির কটূক্তি শুনে চোখদুটো জ্বালা জ্বালা করে উঠল ওর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে ফিরে আসার উপক্রম করতেই বৌদির ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর ফের আছড়ে পড়লো ওর কর্ণপটহে। “তোমার বোন ভাইফোঁটা দিতে এলে ভুলেও কিন্তু কপালে ফোঁটা নেবে না বলে দিলাম! বিধবা মেয়েছেলে… কোথা থেকে কী অনর্থ ঘটে যাবে, টেরটিও পাবেনা। আগে থেকে সাবধান হয়ে রাখা ভালো।”
“উফফ, লাবনী! যে ব্যাপারে বোঝনা সেই ব্যাপারে মন্তব্য করতে এসো না তো! ঐশী আমার বোন, তাই ওর বিয়েতে দাদা হিসেবে আমি কি দেবো, সেই ব্যাপারে তোমার এত মাথা না ঘামালেও চলবে।” দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাদার কথাগুলো কানে যেতেই ঐশীর জ্বালাপোড়া মনটাতে এক টুকরো ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো যেন। কিন্তু বৌদির কথা শুনে ভাইফোঁটা দেওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেল মনের মধ্যেই। চোখের কোনে জমা হওয়া গাঢ় নোনতা তরলটা মুছে ঐশী পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।
“মনি, এত তাড়াতাড়ি দাদাকে ফোঁটা দেওয়া হয়ে গেল?” ঐশী ঘরে ঢোকামাত্র মাড়বিহীন হলদেটে সাদা থান পরা মহিলাটি বলে উঠলেন। সিঁদুরবিহীন লালচে সিঁথি, প্রায় কদমছাঁট চুলের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে তিনিও ঐশীর মতোই বিধবা।
“তোমার ফেনা ভাত হয়ে গেলো পিসি?” প্রশ্নটা এড়াবার জন্য হাসিমুখে বলে উঠল ঐশী… তারপর লালচে চোখটা নজরের আড়াল করতে ঘরের অন্যপ্রান্তে চলে গেল সে। দশ বাই দশ ফুটের চৌহদ্দিটাকে যদিও ঘর না বলে কুঠুরি বলাই ভালো, কিন্তু এই ছোট্ট চৌহদ্দিই ঐশীর বিধবাজীবনের চড়াই উৎরাই এর সাক্ষী।
গোটা বাড়ির অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ঠাসা এই ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই, উপরন্তু ছোট ছোট দুই জানলা দিয়ে ঘরে আলো বাতাস ঢোকেনা বললেই চলে। তাই দিনের আলোতেও এই ঘরে সবসময় একটা ভ্যাপসা অন্ধকারভাব বিরাজ করে।
“উহহ মরে গেলাম গো!” টিনের ট্রাঙ্ক এর এককোনায় আঘাত লেগে আর্তচিৎকার করে উঠলো ঐশী। উঁচিয়ে থাকা বেয়াড়া কোণে ধাক্কা লেগে ওর পাটা কেটে গিয়েছে ততক্ষনে। “মেঝেতেও বসার উপায় নেই এতো আসবাব এই ছোট্ট ঘরে!” না চাইলেও বিরক্তিটা উগরে বেরিয়ে আসলো ঐশীর মুখ চিরে।
“এ যে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে মনি! তুই বস, আমি এখনই ওষুধ নিয়ে আসছি।” পরনের কাপড়টা সামলে বাসন্তীলতাদেবী বাইরে বেরিয়ে যেতেই প্রায়ান্ধকার ঘরটাতে চোখ বুলাতে লাগল ঐশী।
ঠাণ্ডা স্যাঁতসেতে ঘরটাতে মানুষদুটো কিভাবে থাকছে দিনের পর দিন, তা কেবলমাত্র ঐশীই জানে। চক্রবর্তী পরিবারের অকাজের জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখার একমাত্র জায়গা এই ঘরটা। “ঠিক যেমন আমি আর পিসি পড়ে রয়েছি এই ঘরে..”আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী। স্বামী হারিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে আসার পর নিজের বাড়িতেই আজ বড্ড ব্রাত্য হয়ে পড়েছে। যেন অবিনাশের মৃত্যুটা ওর জন্যই হয়েছে আর শ্বশুরবাড়ির মাটি কামড়ে মেরুদণ্ডহীন মানুষের মত পড়ে না থেকে, ঐশী ভুল করে ফেলেছে।
যতই স্বামীর ভিটে হোক, সন্মান না থাকলে সেই জায়গায় এঁটে থাকা কি অতই সহজ?
“সবার চরিত্রে যে গুঁটলি পোকার বৈশিষ্ট্য থাকবে, তার কোনো মানে নেই..” কথাটুক বলে ঐশী চোখ রাখে নিজের রংচটা আলমারির দিকে। কুমারী জীবনের সকল উত্থান পতনের সাক্ষী ছিল এই আসবাবটা। বৈধব্য জীবনেও এই জিনিসটা ঐশীর সঙ্গী, তা বলাই বাহুল্য।
নিজের রুচির সাথে মানানসই না হলেও এই ঘরখানি ঐশীর বড্ড প্রিয়। কারণ এই চৌহদ্দির সাথে যেন মিলেমিশে গিয়েছে অসমবয়সী দুই বিধবার সত্তা। অপ্রয়োজনীয় ও অকাজের…ঠিক আসবাব গুলোর মতই।
বিয়ের আগে এই ঘরখানাকে ঐশী ‘পিসির ঘর’ বলেই জানত।
ঘুপচিতে পড়ে থাকা পিসির প্রতি তখনকার অবিবাহিত ঐশীর করুণা জন্মালেও এখনকার ঐশী বৈধব্যের পরিস্থিতিতে পিসির সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। পূর্বেকার করুণা রূপান্তরিত হয়েছে নিখাদ ভালোবাসাতে।
চক্রবর্তী বাড়ির দুইতলায় দক্ষিণ খোলা বিশাল বড় বেডরুমে নিজের একছত্র অধিকার ফলাত তখনকার অবিবাহিত মেয়েটা।
কিন্তু বিয়ের পর পর মেয়েদের যেমন ঠিকানা বদলে যায়, ঠিক তেমনই ঐশীর নিজের ঘরখানার অধিকারনামা চলে যায় অন্য কারোর হাতে।
বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পড়াশোনার সুবিধে হবে ভেবে ঐশির ভাইঝি থাকতে শুরু করে সেই ঘরে। কিন্তু স্বামীকে হারিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এলেও নিজের ঘর খানা আর ফেরত পায়নি ঐশী।
একতলাটা ফাঁকা থাকলেও সেখানে থাকতে পারেনি এই বাড়ির বিধবা মেয়েটি।
“ওখানে ভাড়া বসানো হবে বোন, তুই বরং পিসির সাথেই থাক। বুড়ো মানুষটা একলা একলা থাকে, তুই থাকলে ভরসা পাবে পিসি।” দাদার বলা কথাগুলো আজও জীবন্ত ঐশীর মানসপটে।
“তোরাও তো থাকতে পারতিস পিসির সাথে,” যোগ্য জবাবটা মুখ ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইলেও শেষমেষ আর বলে উঠতে পারেনি ঐশী।
“সারাদিন তো অফিসেই কাটে, রাত্রিটুকু দিব্যি কেটে যাবে।” এই ভেবে পিসির ঘরে চলে আসলেও কাজটা যে উচিত হয়নি, তা ভালোমতোই টের পাচ্ছে এখন।
“আজই বাড়ি ফিরে দাদার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবো…” আপনমনে বলে ওঠে ঐশী। “কিন্তু বিয়ে উপলক্ষে দাদার তরফ থেকে এত দামি হারটা দেওয়ার কারণটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না যে!”
“এই ঘরটায় থাকতে তোর খুব কষ্ট হয়, তাই নারে মনি?” পিসির কোথায় ভাবনার এলোমেলো জালটা ছিঁড়ে ঐশী ফিরে এলো বাস্তবের মাটিতে। ভাইঝির কেটে যাওয়া পাটা এক হাতে টেনে নিয়ে ততক্ষনে মলম লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি।
“ওকি পিসি কি করো! আমি করে নিচ্ছি।” বলে নিজের পাটাএকপ্রকার জোর করেই ছাড়িয়ে নেয় পিসির হাত থেকে।
ছোটখাটো এই মানুষটিকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছা করে তার। পিসির ম্যাড়মেড়ে শাড়ির মমতামাখা গন্ধ পেরিয়ে ঐশী যেন খুঁজে পায় নিজের মাকে।
“না পিসি, আমার কষ্ট হয়না। এই ঘরটা আমার নিজের, যেমনটা তুমি…” বলে নিজের মাথাটা বাসন্তীলতাদেবীর বুকে গুঁজে দিয়ে বলে উঠলো ঐশী। “তাছাড়া কয়েকদিন বাদেই অন্য কারোর ঘরে যেতে হবে, তখন সেই অচেনা ঘরটাকে আপন করে কাছে টেনে নিতে হবে। মেয়েদের আবার কোন ঘর হয় নাকি!” শেষের কথাটুকু ঈষৎ হাস্যচ্ছলে বলে উঠলেও ভাইঝির মনের কষ্টটা ঠিক ধরতে পারলেন বাসন্তীলতাদেবি। ভাইঝির না আঁচড়ানো এলোমেলো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠলেন,”সত্যি করে বলতো মনি, দাদাকে তুই ফোঁটা দিয়েছিস?”
“উফফ,” চোরাবিরক্তিটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইলেও নিজের মধ্যে গিলে নিল ঐশী। “পিসির সবকিছুই ভালো, কিন্তু অন্যকে ভালো রাখার রোগটা কবে দূর হবে কে জানে!” আপন মনেই বলে ঐশী পা বাড়ালো আলমারির দিকে।
আজ ভাবি স্বামী অতনুর সাথে দেখা করার কথা আছে ওর। সকাল দশটা নাগাদ চেনা এক কফিশপে মিট করার কথা আছে। অত্যন্ত গোপন কিছু কথা ভাগ করে নেওয়ার জন্যই আজ অতনুকে ডেকেছে ঐশী। সেইমতো রেডি হওয়ার জন্য অফহোয়াইট কুর্তিটা বার করলো আলমারি থেকে।
“আবার সেই সাদা থান চাপিয়ে যাচ্ছিস! কয়েকদিন বাদে মেয়ের বিয়ে, এদিকে সাদা রংয়ের মায়া কাটাতে পারছেনা।” একপ্রকার ভর্ৎসনা করেই বাসন্তীলতাদেবী ভাইঝির হাত থেকে কুর্তিটা কেড়ে নিলেন। তারপর সদ্য কেনা লালরঙা সিল্কের কুর্তিটা এগিয়ে দিলেন ঐশির দিকে।
“একি! তুমি এটা কোথা দিয়ে পেলে!” আনন্দ বিস্ময়ে ঐশীর চোখে তখন রামধনুর সাতটি রং হেসে খেলে বেড়াচ্ছে।”
“কেন? তোর পিসি কিনে দিতে পারেনা?” আলগা হেসে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“কিন্তু আমি এই রং পরবোনা পিসি, এই রং পরলে…” খানিকটা ইতস্তত করে বলে উঠতেই মাঝপথে থামিয়ে দিলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“তুই এই রংই পড়বি। আর একটাও কথা নয়।” দৃঢ়কণ্ঠে কথাগুলো বলে লালরঙের কুর্তিটা ভাইঝির হাতে গুঁজে দিলেন বাসন্তীলতাদেবী। তারপর অফ হোয়াইট কুর্তিটা নিজের হাতে রেখে পা বাড়ালেন ঘরের বাইরে। “শিগগির রেডি হয়ে নে, নয়টা কিন্তু বেজে গিয়েছে।”
দরজাটা বন্ধ করে সবেমাত্র পরনের ম্যাক্সিটা খুলেছে ঐশী। এমন সময় মুঠোফোনটা সশব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে বসতেই বিরক্তিতে ঘন ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল ওর।”এই অসময়ে আবার কে!” বলে ছোট্ট হ্যান্ডসেটটা মুঠোয় নিয়ে নিলো ঐশী।
ডিজিটাল অক্ষরে ফুটে ওঠা আননোন নাম্বার টা দেখেই কপালে চিন্তার গাঢ় ভাঁজ পড়ল।
“হ্যালো কে বলছেন?” রিসিভ করে ওপ্রান্তকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ঐশী।
“এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলে কিকরে চলবে ম্যাডাম?” ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসা স্বল্পচেনা পুরুষালী কন্ঠস্বরটা ভেসে আসতেই এক অজানা ভয়ে ফ্রিজড হয়ে গেলো ঐশী। নিজের অজান্তেই সদ্য কেনা কুর্তিটা হাত ফসকে পড়ে গেল মেঝেতে।
“তুমি! আমার আবার আমাকে বিরক্ত করছো?” কাঁপা কাঁপা গলায় সম্পূর্ণটা বলে ওঠার আগেই ওপ্রান্ত বলে উঠলো ফের,”কি ভেবেছিলে? সব নাম্বার ব্লক করেই আমার হাত থেকে নিস্তার পাবে তুমি? নতুন সিম কিনতে কিন্তু বেশী পয়সা লাগেনা ম্যাডাম।” বলে হেসে উঠলো ফের।”শুনলাম নাকি আবার বিয়ে করতে চলেছো। বড্ড খুশি হলাম কথাটা শুনে, কিন্তু আমি কি আমার পাওনাটা থেকে বঞ্চিতই থাকবো?”
“স্টপ ডিস্টার্বিং মি। তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছ আমার ফোনের ব্লকিং অপশনটা এখনো খোলা আছে।” দাঁতে দাঁত ঘসে বলে উঠল ঐশী।
“মাত্র একটা রাতের জন্য এত গুমোর তোর? এমন ভাব করছিস যেন কতো বড়ো সতী তুই! শালী,” একটা অশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে উঠল ওপ্রান্ত। তারপর ফের বলে উঠলো,”ভুলিস না তোর প্রাণভোমরা এখনো আমার কাছে আছে। তাই বিয়ে করেই পার পেয়ে যাবি ভাবিস না! যতদিন না তোকে পেয়ে নিজের জ্বালা মেটাতে পারছি, ততদিন আমি তোর পিছু ছাড়বোনা বলে দিলাম।” একটা অশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে কলটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল এবার।
মুঠোফোনটা কানে চেপে রেখেই ঐশী তখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বড় বড় পটলচেরা দুই চোখ বেয়ে নেমে চলেছে নোনতা তরলের ধারা।
© সম্প্রীতি রায়
ক্রমশ