#বিধবা_বিবাহ (ষষ্ঠ পর্ব)
সবিতাদেবী ধীরপায়ে মেয়ের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর দুই করতলে মাঝে মুখটা গুঁজে দিল ঐশী। দুর্ভাবনায় মাথাটা যন্ত্রণা করছে ভীষণভাবে। রাত্রের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়াটাই এখন বেস্ট অপশন, কিন্তু হাজার রকম চিন্তার মেলবন্ধনে নিদ্রাদেবী পালিয়েছে ওর সান্নিধ্য ছাড়িয়ে।
বস্তুত বিয়ের পরে সবিতাদেবী আর ঐশীর বাবার মধ্যে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্কই বলা চলে। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে কুষ্টি মিলিয়ে দুই পরিবারের ইচ্ছানুসারে ঐশী মা-বাবা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও মানসিক বন্ধন কখনোই গড়ে ওঠেনি। সবিতাদেবীর অতিরিক্ত সংস্কার, আচার বিচার দুজনের মধ্যে দূরত্বের কারণ তো ছিলই.. উপরন্তু স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের সংঘাতে দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি।ঐশীর বাবা অতিরিক্ত উপার্জনের আশায় স্টেটসে পাড়ি জমাতে চাইলেও সবিতাদেবী নিমরাজি ছিলেন স্বামীর এই সিদ্ধান্তে। কিন্তু যার যাওয়ার থাকে তাকে কি টেনে-হিঁচড়ে আটকিয়ে রাখা কী সম্ভব…? কিছু সময়ের জন্য ভুলিয়ে ভালিয়ে শক্তিপ্রয়োগে আটকে রাখা গেলেও চিরস্থায়ী হয়না,ত বলাই বাহুল্য। ঠিক তেমনভাবে ঐশীর বাবাকে নিজের কাছে টেনে ধরে রাখতে পারেননি সবিতাদেবী।
তাই ঐশী, কৃশানুর বয়সন্ধিকালীন সময়ে পরিবারকে ফেলে ইউকেতে পাড়ি জমান তিনি।
মাঝেমধ্যে ইন্ডিয়াতে বেড়াতে এলেও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি, তা বলাই বাহুল্য।
স্বামী মাসে মাসে যথেষ্ট টাকা পাঠালেও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন সবিতাদেবী। কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া মানুষটি সংসার সম্বন্ধে তখনও একপ্রকার অনভিজ্ঞই বলা চলে। কিন্তু সময়স্রোতে ভাসতে ভাসতে এদিক সেদিক ঠোক্কর খেতে খেতে মানুষ একসময় আবেগ ভুলে বাস্তবে বাঁচতে শেখে। জগতের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে থাকে দৃপ্তগতিতে। সেইমতো দুই ছেলে মেয়ের পড়াশোনা, নিজের সংসার সামলিয়ে এগিয়ে যেতে পারলেও সবিতাদেবী নিজের সংস্কার বিশ্বাসকে ছুঁড়ে ফেলতে পারেননি পুরোপুরি। অাজন্মলালিত সংস্কারকে ছুঁড়ে ফেলা অতটাও সহজ নয় বোধহয়। তাই স্বামী বিদেশে চলে যাওয়ার পরেও বৈধব্য, জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে খুঁতখুঁতানি, এঁটোকাটা এখনো তিনি মেনে চলেন সযত্নে।
গোঁড়া রক্ষণশীল হওয়ার সুবাদে মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাবকেও সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু আজ মেয়ের মুখে নিজের কঠোর বাস্তব জীবনের কথা শুনে তার অন্ধবিশ্বাসের পাল্লাটা খানেক নড়ে উঠলো যেন।
“সত্যিই তো, আমাদের বিয়েটা তো কুষ্টি বিচার করেই হয়েছিল। তবে কেন মতের এতটা অমিল হলো!” যেতে যেতে মায়ের বলে ওঠা কথাটা এখনো জীবন্ত ঐশী মানসপটে।
“না জানি কতশত মেয়েকে বিয়েতে সাজিয়ে-গুছিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর অজুহাতে পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে…” আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী। “কখনও দাদা, কখনও বা ভাইয়েরা এই চক্রান্তে লিপ্ত। বিধবা হওয়াটা তো এক্ষেত্রে একটা অজুহাত মাত্র!”
এমন সময় মুঠোফোনটা সশব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে ঐশী চোখ রাখে ডিজিটাল স্ক্রিনে। অতনুর সেভ করার নম্বরটা জ্বলজ্বল করছে তখন।
“সরি, বাড়ি পৌঁছে তোমাকে ফোন করে দিতে পারিনি কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম..” কলটা রিসিভ করে বলে ওঠে ঐশী।
“তোমার দেওরের নাম কি অরিন্দম?” ওপ্রান্ত হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠেছে ততক্ষনে।
“হ্যাঁ কিন্তু কেন?” অতনুর মানসিক উত্তেজনার ছোঁয়া লেগে গেল ঐশীর কণ্ঠস্বরে।
“শিগগির চ্যাটবক্সটা খোলো, তোমাকে আমার কিছু দেখানোর আছে।” অতনুর কথা শোনামাত্র লাইনটা ডিসকানেক্ট করে চ্যাটবক্সে ঢুকলো ঐশী।
পিনড চ্যাটে ততক্ষণে কুড়ি ত্রিশটা মত মেসেজ এসে জমা হয়েছে। নোটিফিকেশনের টুং টুং শব্দ ঘণ্টার মত শোনাচ্ছে।
চিন্তিত মুখে অতনুর চ্যাটটা ওপেন করা মাত্র শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শীতল স্রোত নেমে গেল ঐশির। অরিন্দম এর তরফ থেকে পাঠানো হুমকিগুলো চ্যাটবক্সে জ্বলজ্বল করছে তখন।
“এত বড় সাহস! অতনুর ফোন নাম্বার জোগাড় করে ওকে হুমকি দিচ্ছে!”আপনমনেই মনে বলে ওঠে ঐশী।
রাগতে গিয়েও মাথাটা আচমকাই কেমন ঠান্ডা হয়ে গেল ওর। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টায় চোখটা বন্ধ করে ফুসফুসদুটো ভরে নিল প্রশ্বাসে। তারপর কানেক্ট করল অরিন্দমকে।
“বল কি চাইছিস তুই?” ওপ্রান্ত রিসিভ করা মাত্রই বলে ওঠে ঐশী। কণ্ঠস্বরে উত্তপ্ততার ছাপ স্পষ্ট।
“বাব্বাহ, এত্ত রাগ মনি! তুই জানিস না রাগলে তোকে কতখানি সুন্দর দেখায়…” ঐশিকে আরো তাতিয়ে দেওয়ার জন্য বলে উঠলো অরিন্দম।
“কি চাইছিস বল!” কণ্ঠস্বর বিন্দুমাত্র নমনীয় না করে ঐশী বলে উঠলো এবার।
“কাকে আবার তোকে!” নির্লজ্জের মত বলে উঠলো অরিন্দম।
“বেশতো। তোর বউ কে কি কথাটা আদৌ জানিয়েছিস?” কণ্ঠস্বরে শ্লেষ মিশিয়ে বলে উঠল ঐশী।”তার গুণধর স্বামীর কথা না জানলে সবটুকু যে অসম্পূর্ণই থেকে গেল।”
“সে জেনেই বা কি করবে! আটকানোর থাকলে বহু আগেই আটকে নিতে পারতো।” হাসতে হাসতে বলে উঠলো অরিন্দম,” তাছাড়া যে কারণে ওকে বিয়ে করেছিলাম। সেই কারণটা আজ ফুরিয়েছে, তাই ভাবছি ওকে আমি ডিভোর্স দেব।”
“তোর মতো মানুষের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক…” বলতে গিয়েও চুপ করে গেল ঐশী। এই চ্যাপ্টারটা ঘাটতে বিন্দুমাত্র মন চাইছিল না ওর। নিজের মৃত স্বামীর কুকীর্তি জানার পরেও হতাশা দুঃখ তেমন ভাবে আঁচড় কাটতে পারেনি মনে। কিন্তু নতুন জীবন শুরুর লক্ষ্যে অযাচিত ভাবে কাঁটা এসে পড়লে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায়না বৈকি। আর
অতনুর কাছে হুমকি চলে আসা মানে ব্যাপারটা আরো বহুদূর গড়াতে পারে। এমনকি অতনুও ওকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তও নিয়ে নিতে পারে!
“কিছুতেই আমি অরিন্দম চক্রান্ত সফল হতে দেবো না..” আপনমনে বলে ওঠে ঐশী।
“ঠিক আছে আমি তোর বাড়ি যাবো, তুই যেটা চাইছিস সেটাই হবে… আর তুই কোন ব্যাপারে জানাতে চাইছিলিস সেটাও ক্লিয়ার হবে।” মনের ভাবটা সম্পূর্ণ গোপন করে বলে উঠল ঐশী।
“আশা করি এরপর তুই আমাকে আর বিরক্ত করবিনা!”
“সেকী রে! এতো তাড়াতাড়ি রাজিও হয়ে গেলি! আমি তো ভেবেছিলাম…”অরিন্দমের গলায় তখন স্পষ্ট খুশির সুর। যেন অনেকদিন বাদে কাঙ্খিত বস্তুর হদিশ পেয়েছে সে। লম্পট, নারীমাংস লোভী সহপাঠীর হাসি শুনে ঐশিও আপনমনে হেসে উঠেছে ততক্ষনে। “তাহলে বল, কখন যাবো তোর বাড়ি?” মনের ভাব গোপন করে বলে উঠলো ঐশী।
“নানা! আমার বাড়ি কেন!” প্রায় চিল্লিয়ে উঠলো অরিন্দম এবার।”তোকে নিয়ে বাড়ি কীকরে যাবো! আমার ফ্যামিলি থাকবে যে, তুই বরং হোটেলে আয়। ওটাই বেস্ট হবে।
“ব্লাডি স্কাউন্ড্রেল!” গালাগালিটা গিলে নিয়ে হেসে অরিন্দমের উদ্দ্যেশে বলে উঠলো ঐশী,”তাহলে তাই হোক, কিন্তু অতনু যেন কিছুতেই না জানতে পারে। টাইম, প্লেস ঠিক করে জানিয়ে দিস।”
“অতনু কি! অতনুর বাপও জানতে পারবেনা ডার্লিং। আর ওইসব ম্যাড়মেড়ে কাপড়জামা পড়ে আসবিনা। অন্তর্বাসও ঠিকঠাক চাই কিন্তু।” কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলে উঠেছে ওপ্রান্ত। “আশা করি তুই জানিস আমার ফেভারিট কালার কি…”
“জানি।” সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে কলটা ডিসকানেকট করে দিল ঐশী। ওর মাথায় তখন অন্য পরিকল্পনা ঘুরছে…
“বোন, এখনও ঘুমাসনি?” ঘরে আলো জ্বলতে দেখে ওর দাদা পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলেন।
“পিসি না এলে আমি কি ঘুমাই?” উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে উঠলো ঐশী। “এই লোকটার মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও আর কিছুতেই গলবো না আমি,” আপনমনেই বলে উঠলো সে।
“না আসলে, আমি তো ঠিক জানিনা আরকি।” আমতা আমতা করে বলে উঠল কৃষানু।”আলো জ্বলছে, তাই ভাবলাম…”
“তুই তো আলো জ্বলছে কিনা দেখতেও আসিসনা। হঠাৎ কি হলো আজ!” পাল্টা খোঁচা দিয়ে বলে উঠলো ঐশী। তারপর চোখ রাখলো সামনে ঝুলিয়ে রাখা ক্যালেন্ডারে। ভাইবোনের এমন মধুর সম্পর্কের আশায় ঐশী দিন গুনলেও এখন সবই অতীত। স্বার্থহীন সম্পর্কের স্মৃতিতে কঠোর বাস্তবতার পেরেক ঠুকেছে কৃষানু নিজেই।
“যাই হয়ে যাক না কেন..নিজের ভালোটা বুঝে নিতে হবে।” পিসির কথাগুলো আপনমনে বলে ওঠে ঐশী। “রক্তের সম্পর্কে যখন স্বার্থ এসেই গেলো তখন না হয় আমিও খানিক নিজের স্বার্থ দেখলাম!”
“দাদা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। বাড়িটা আমি বিক্রি করতে দেবনা!” আচমকাই কৃষানুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ঐশী। তারপর ফিনফিনে কাগজটা এগিয়ে দিলো দাদার দিকে।
দুর্বল তক্তপোশে সবেমাত্র বসার উপক্রম করছিল কৃষানু। এমনসময় বোনের কথা শুনে ফের দাঁড়িয়ে পড়লো ও। ভাবখানা এমন, ঐশীর কথাটা ঠিক যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়নি ওর…
“কিন্তু কেন!” কৃষানুর কথাটা প্রায় আর্তনাদের মতো শোনালো এবার।
“কারণ প্রস্তাবটা আমার মনপূত হয়নি।” আগলা হেসে বলে উঠলো ঐশী।”তাছাড়া আমার অনুমতি না নিয়েই একতরফা ভাবে ডিল ফিক্সড করে দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমার সাথে প্রোমোটারবাবু কথা বলতে এলে ভেবে দেখতে পারি।”
“কিন্তু…” কৃষানুর আর বাক্যস্ফূর্তি হলোনা ঐশীর তরফ থেকে নরমভাবে কড়া জবাব শোনার পর।
“যেখানে রক্তের সম্পর্ক হেরে যায় রিপুর কাছে, সেখানে নিজেকে নত করা নেহাতই বোকামি।” নিজমনে কথাগুলো বলে ঐশী ভেলভেটের বাক্সটা টেনে নিলো নিজের কাছে। তারপর ছোটো, বড়ো, মাঝারি আকারের তিনটে বাক্স এগিয়ে দিলো দাদার দিকে। “এখনও এগুলো ব্যবহার করিনি বুঝলি তো! তাই আশা করি বৌদি এগুলো দোকানে ফেরত দিয়ে নতুন গহনা এক্সচেঞ্জ করে নিতে পারবে। অবশ্য চাইলে এগুলোও পরতে পারবে। সেক্ষেত্রে কিন্তু দুই ভরীর গহনায় সোনার পরিমাণ বাড়িয়ে বলতে হবে…” হাসতে হাসতে বলে ওঠে ঐশী।”সাতভরীর সাতনোরি আর জড়োয়ার ঝুমকোয় পাঁচভরি।”
রাগে অপমানে কৃষানুর কালচে মুখটা ততক্ষনে বেগুনি হয়ে গিয়েছে। সেইদিকে তাকিয়ে ঐশী বলে উঠলো হাসিমুখে,”পিসি এসে যাবে এক্ষুনি। এখন তুই বেরিয়ে গেলে আমরা ঘুমোতে পারবো নিশ্চিন্তে।”
© সম্প্রীতি রায়
আশা করি ভালো লাগছে সবার, সঙ্গে থাকবেন সবাই।
ক্রমশ
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/170289974751434/