#বিধবা_বিবাহ (অষ্টম পর্ব)
ঘন নীলরঙা অন্তর্বাসটার কোমল বুনোটে একমনে হাত বুলিয়ে চলেছে এক পুরুষালী অবয়ব। নরম ফ্যাব্রিকের কোণায় কোণায় ছুয়ে যাচ্ছে শক্ত পুরুষালী আঙুলগুলো। সরু সরু দুটো লোভী চোখের ধূর্ত চাহনি মেপে চলেছে সেই বক্ষবন্ধনীর ব্যাসার্ধকে। এমন সময় ব্যবহৃত সেই অন্তর্বাসটা নাকে ঠেকিয়ে গন্ধ নিতে যেতেই ভারী দরজার আগল দুটো খুলে গেল। আচম্বিতে এমন কাণ্ড ঘটতেই চুরি করে আনা অন্তর্বাসটা লুকোনোর চেষ্টা করলো বালিশের নিচে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলনা। বক্ষবন্ধনীর মালকিন দেওরের এই চরম কুকীর্তি দেখে ফেলেছে ততক্ষনে। কিন্তু চোখের সামনে নিজের বৌদিকে দেখেও কোনরকম অপরাধবোধ চাগাড় দেয়নি অরিন্দমের। বরং ফাঁকা বাড়ি থাকার সুযোগ নিতে চেষ্টা করেছিল পূর্ণমাত্রায়।
“ছি!” ঘৃণামিশ্রিত সুতীব্র এক অভিব্যক্তি বেরিয়ে আসতে চাইলো ঐশীর কণ্ঠস্বর থেকে।”ভাগ্যিস সেদিন আমি ঈশ্বরের কৃপায় ছাড়া পেয়েছিলাম লম্পটটার হাত থেকে!”
মাসদুয়েক আগে ঘটে যাওয়া সেই দিনের ঘটনাবলী এখনও জীবন্ত ঐশীর মানসপটে। শয্যাশায়ী শ্বশুর মশাইকে মাসিক চেকআপের জন্য চেম্বারে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্বাশুড়িমা। আর নিজের ছেলেকে স্কুলে দিতে ছোটো জাও বার হয়েছিল বাড়ির বাইরে। সামান্য গা গরম, সর্দি থাকায় ঐশী সেদিন সিকলিভ নিয়েছিল। পরে অরিন্দমের ঘরে জলখাবার দিতে গিয়েই অলিখিত দুর্ঘটনা ঘটে যায় ওর জীবনে।
নিজের সহপাঠী তথা দেওরের ঘৃণ্যরূপ আবিষ্কার করে যার পর নাই অবাক হয়েছিল ঐশী। নিজের দাদা মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই এমন কুৎসিত কাজ কীকরে করতে পারে অরিন্দম, সেটাও ভাবনায় এসে গিয়েছিলো তার। কিন্তু পরে সদ্যবিধবা মেয়েটি বুঝতে পারে, দাদার সাথে বিয়ে হওয়ার পরেও অরিন্দমের মনোভাবের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। বরং সময়ের সাথে সাথে নববধূর ছাপ লেগে থাকা একমাত্র বৌদির প্রতি জেগে থাকা কামরিপু আরো তীব্রতর হয়েছে।
দেওরের চরিত্রের এমন বিষম রূপ আবিষ্কার করামাত্র ঐশী ছুটে গিয়েছিলো নিজের শ্বাশুড়িমায়ের কাছে। কিন্তু অাশ্চর্যজনকভাবে উনি নিজের ছোটছেলের কোনো দোষ খুঁজে পাননি। পুত্রস্নেহে অন্ধ সেই মা নিজের সদ্যবিধবা বৌমাকেই দোষারোপ করতে থাকেন সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। এমনকি বড়োছেলের মৃত্যুর কারণ বশত বৌমাকে অলক্ষ্মী, অপয়া বলতেও ছাড়েননি তিনি।
কুসংস্কার যে আমাদের সমাজে বড়ো বালাই, তা বলাই বাহুল্য। আজও স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকক্ষেত্রে কারণ হিসেবে অলিখিত ভাবে স্ত্রীয়ের ঘাড়েই দোষ চেপে বসে। বিধবার কষ্ট বোঝা তো দূর! বরং বাড়িছাড়া করতে পারলেই যেন অমঙ্গল দূর হবে, এমন মনোভাব বিরাজ করে। ঐশীর শ্বাশুড়িমাও তার ব্যতিক্রম ছিলেননা মোটেই। তাই সুবিচারের আশায় ঐশী যখন শয্যাশায়ী শ্বশুরের কাছে প্রায় কেঁদেকেটে পড়ছিলো, তখনও দুতরফা কথা শোনার পরেও শ্বাশুড়িমা নিজের একচোখা আচরণ বজায় রেখেছিলেন। “ছেলেমেয়ের কুকীর্তি চাপা দিতে আজও এমন কতশত মানুষ রয়ে গিয়েছেন কে জানে!” আপনমনেই বলে ওঠে ঐশী। সেই অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে ঐশী ফিরে এসেছিল নিজের বাপের বাড়ি। নিজের বিয়ের গহনা আর ডকুমেন্টস নিয়ে সোজা উঠেছিল শোভাবাজারের বাড়িতে। কিন্তু বিয়ের আসবাব, আরো কিছু জিনিসপত্র রয়ে গিয়েছিলো সেখানেই। শ্বাশুড়ি, দেওরের ভয়ে ভীত ঐশী আর সাহস পায়নি সেই জিনিস ফিরিয়ে আনতে। কলঙ্কের জ্বালায় যে আইনের দ্বারস্থও হতে পারেনি, তা বলাই বাহুল্য।
“ম্যাডাম এসে গিয়েছে আপনার লোকেশন।” সামনের সিটে বসা চালকের কণ্ঠস্বর শুনতেই অতীতের জাল কেটে ঐশী ফিরে আসলো বর্তমানের মাটিতে। খানিকটা দূরেই রাস্তার ধারে অতনুর লম্বা রোগা চেহারাটা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে নজর পড়তেই কমদামী হ্যান্ডসেটে নিজের মুখটা একবার দেখে নিল ঐশী। ইদানিং ওর আয়নায় নিজেকে দেখার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।
“এখানেই থামান,” বলে চালকের পাওনাটা মিটিয়ে দিল ঐশী, তারপর পা বাড়ালো গাড়ির বাইরে।
“আরে তোমাকে আজ হেব্বি লাগছে মাইরি। দেখে চোখ ফেরাতে পারছিনা।” স্বভাবজাত কৌতুক ভঙ্গিতে অতনু বলে উঠলো ঐশীকে দেখে।
“বিয়ের পর আরো দেখবে, কেমন?” বলে ঐশী হাটতে লাগল অতনুর হাতটা ধরে… এই মোড়টা পেরোলেই ওর গন্তব্য। অরিন্দমের নিজের বাড়ি তথা ওর প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ি…
আচমকা ঐশীর হাতটা ধরে খানিকটা যেন চমকে গিয়েছে ছেলেটা। অতনুর শক্ত পুরুষালী হাতের মৃদু মৃদু কম্পন ঐশী টের পাচ্ছে ভালোমতোই।
“তোমার কি ভয় করছে নাকি…” পরিস্থিতিটা সহজ করার জন্য অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠলো অতনু।
“ভাবখানা এমন করছে, যেন আমি ভয় পাচ্ছি!” আপনমনেই বলে উঠলো ঐশী। তারপর ওর কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললো,”আমিতো না হয় ভয় পাচ্ছি… কিন্তু তুমি তো লজ্জা পাচ্ছো অতনু…” ভাবি স্ত্রীয়ের তরফ থেকে এমন স্পষ্ট বক্তব্য অতনু আশা করেনি বোধহয়। তকতকে কামানো গালে হালকা হাসির রেখা টেনে মুখটা নিচু করে চলতে লাগলো সে।
“তুমি পারো ও বটে! প্রাক্তন শ্বশুর বাড়িতে নিজের বর্তমানকে নিয়ে যাচ্ছো..” নিজের জড়তা ভাব কাটাতে অতনু বলে উঠলো এবার।
“সবটুকুই তোমার জন্য অতনু।” হালকা হেসে বলে উঠলো ঐশী। তুমি পাশে থাকার কারণেই রূপের মোহে ভেসে না গিয়ে নতুন করে ভালোবাসতে শিখেছি। সাথে ফিরে পেয়েছি নিজের আত্মবিশ্বাস…”
“আর পিসি?” প্রত্যুত্তরে বলে উঠলো অতনু,” তিনি না থাকলে নতুন করে জীবনটা শুরু করতে পারতে কি? নাকি নিজের দাদার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতে?”
ভাবি স্বামীর কথা শুনে ঐশী পথচলা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে মাঝপথেই।”আমি তো ওকে কিছুই জানাইনি এতসব।” আপনমনেই বলে উঠলো ও।
ওর মুখে ফুটে উঠেছে হাজারো প্রশ্নবিন্দু।
সেই চাহনি পড়ে অতনু বলে উঠলো ফের,”তোমাদের বাড়ির সমস্ত খবরাখবর পিসি মাধ্যমে পেয়ে যাই আমি। আর এটাও জানি তোমার মা আমাদের এই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়…”
অতনুর কথা শুনে কপালে চিন্তার ভাঁজটা আরো প্রকট হয়ে উঠলো ওর কপালে। কিন্তু প্রতুত্তরে কিছুই বলতে পারলোনা, কারণ সাদা রংয়ের দুই তলা বাড়িটার কাছে ওরা এসে গিয়েছে ততক্ষনে।
“তুমি এখানেই থাকো, আমি ভিতরে ঢুকে কথা বলছি, কেমন…” বলে ঐশী কলিংবেল বাজানোর উপক্রম করতেই বাধা দিয়ে উঠলো অতনু,”এতটা পথ যখন তোমার সাথে আসতে পেরেছি, তখন বাকি পথটুকুও আমি নিশ্চয়ই যেতে পারবো..” বলে কলিং বেলটা চাপ দিয়ে বসলো সে।
সুরেলা পাখির মিষ্টির স্বরে কর্ণপটহ ডুবে যেতে যেতে ঐশীর মানসপটে ফিরে এলো দুইমাস আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা। “অমন ভরাট গতর হলে পুরুষ মানুষের তো নজর পড়বেই। খুব হানিমুনে যাওয়ার শখ হয়েছিল! নিজের তো ছেলে নেই! ছেলে হারানোর বেদনা তোর মত মুখপুড়ি বুঝবে কি করে! বাড়ি ছাড়া হতে পারলে আমি বাঁচি!” শিক্ষিতা, রুচিশীলা হয়েও শ্বাশুড়িমার মুখ দিয়ে কিভাবে ওমন খারাপ কথা বার হতে পারে, সেটা আজও বুঝতে পারেনা ঐশী।
পুরনো কথা কথা মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ঐশির বুক চিরে। তারপর অতনুকে কিছু বলে ওঠার উপক্রম করতেই সামনের শক্ত কাঠের দরজাটা খুলে গেল।
“একি তুমি!” নিজের প্রাক্তন বৌমার দিকে তাকিয়েই খানিকটা হতচকিত হয়ে বলে উঠলেন বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি। প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব না দিয়ে একমনে চেহারাটা দেখতে লাগল ঐশী। চোখের কোনে গাঢ় কালির ছোপ পড়েছে। সযত্নে চর্চিত গালে ছাপ পড়েছে সময়ের আঁকি-বুকি। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, যে বড় গোলগাল সিঁদুরের টিপখানি বড় কপালের শোভা পেত, সেটি অনুপস্থিত। এমনকি মোটা করে পরা সিঁদুরের ভগ্নাংশও অবশিষ্ট নেই আজ।
“বাবা মারা গিয়েছে?” অস্ফুটে কথাটা বলে উঠল ঐশী, সঙ্গে সঙ্গে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় মনটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো ওর। দজ্জাল শাশুড়ির ধূসর ছবি পেরিয়ে একজন স্নেহময় শ্বশুরমশাইয়ের সান্নিধ্য যে পেয়েছে, সেই বুঝবে দ্বিতীয়বার বাবা হারানোর বেদনা।
“উনি আর নেই..” বৌমাকে দেওয়া জবাবটা বেশ ম্রিয়মাণ শোনালো এবার। রূঢ় ব্যবহারে সময়স্রোতের পলি পড়েছে। তারপর অপ্ৰত্যাশিতভাবে বলে উঠলেন,”ভিতরে আসো।” মাথাটা এক দিকে হেলিয়ে সম্মতি প্রদানের পর ঐশী জুতো খুলে ভিতরের দিকে পা বাড়াতেই ফের বলে উঠলেন তিনি,”সঙ্গে আবার কে!” তারপর চোখ রাখলেন প্রাক্তন পুত্রবধূর ফাঁকা সিঁথির দিকে।
দরজা থেকে একটু দূরে দাঁড়ানো অতনুর অবয়বটা যে সবেমাত্র খেয়াল করলেন তিনি, তা বলাই বাহুল্য।
একপা দুপা করে ঘরে ততক্ষনে ঢুকে পড়েছে ঐশী, আর তার পিছু পিছু অতনু। ঘরে ঢুকে প্রাক্তন শ্বাশুড়িমায়ের বিস্মিত মুখের দিকে একপলক নজর বোলালো ঐশী। তারপর আচমকা অতনুর পুরুষালী হাতটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে মুখে বলে উঠল,”আমরা বিয়ে করতে চলেছি, হপ্তাখানেকের মধ্যেই…”
সেই কথা শুনে মুখটা হা হয়ে গেলো ঐশীর শাশুড়ির। ঘরে বাজ পড়লেও বোধহয় এতটা চমকাতেননা তিনি। হঠাৎই এক অদ্ভুত অভিব্যক্তিতে মুখটা পরিপূর্ণ হয়ে গেল তার। দ্বেষ, ক্রোধে মিশ্রিত এক অপূর্ব সহাবস্থান দেখে থতমত খেয়ে গেল ঐশী। ভদ্রমহিলাকে কিছু বলার উপক্রম করতে যেতেই তিনি বলে উঠলেন ফের,”নিজের স্বামীকে খেয়ে আরেকজন ছেলের সর্বনাশ করতে বসেছো তুমি! ছি! এ কেমন মানসিকতা।”
ভাবি স্বামীর সামনে নিজের অপমান শুনে ততক্ষনে থতমত হয়ে গেছে ঐশী। ওর পাংশু হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে অতনু বলে উঠলো এবারে,”মানসিকতা ভালো খারাপের কি আছে! আপনার ছেলের বউ মারা গেলে ছেলেকে নতুন করে বিয়ে দিতেন না আপনি?”
এমন সপাট জবাব বোধহয় আশা করেননি ভদ্রমহিলা। পাতলা, উঠে যাওয়া ভুরু কুঁচকে অতনুকে সরাসরি আক্রমন করে বসলেন এবার,”একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝো! স্বামী হারানোর পর মেয়েদের আর বিয়ে করা চলে না… একটা বিধবাকে বিয়ে করলে তোমার অমঙ্গল হবে!” রাগের দাপটে ক্রমশ চড়ছে তার কণ্ঠস্বরে। পূর্বের ম্রিয়মাণতা যে লোপ পেয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। স্রোতের বিপরীতে গেলে প্রশ্নগুলো কাঁটাছেঁড়া করে বৈকি।
“আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম এই মেয়ে সুবিধার নয়। প্রথমে আমার বড় ছেলেকে খেয়েছে। তারপর গতর দেখিয়ে আমার ছোট ছেলেকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে! সেখানে পাত্তা না পেয়ে তোমাকে…” গলার স্বর চড়িয়ে বলে উঠলেন ঐশীর শ্বাশুড়ি। তারপর মুখখানা ঐশীর দিকে ফিরিয়ে বলে উঠলেন,”পুরুষের সঙ্গ ছাড়া কি তোমার চলবে না? এত কামভাব!”
“স্টপ! আমি এখানে আপনার কাছে নিজের চরিত্রের বিচার শুনতে আসিনি… আমার চরিত্র কেমন, সেটা আমার পরিবার না হয় বুঝে নেবে। যেহেতু আপনার সাথে কোনরকম কানেকশন নেই আমার, সুতরাং কথা বলার আগে একটু ভেবে বলবেন!” প্রাক্তন শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বলে উঠল ঐশী। তারপর সাইডব্যাগে রাখা মুঠোফোনটা বাড়িয়ে দিলে ওনার দিকে। অরিন্দমের তরফ থেকে পাঠানো হাজাররকম অশ্লীল বার্তালাপ এ ঠাসা চ্যাটবক্সটা জ্বলজ্বল করছে তখন।
“ইংলিশে গ্র্যাজুয়েট আপনি, আশা করি সম্পূর্ণটা পড়ে নিতে বিশেষ অসুবিধা হবে না।” বলে ঐশী মুঠোফোনটা এগিয়ে দিল ওনার দিকে….”সেদিন না হয় প্রমাণের অভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারিনি, কিন্তু আজ প্রমাণ আপনার হাতের সামনেই!” কণ্ঠস্বরে বিন্দুমাত্র কাঠিন্য কমেনি ঐশীর।
“আরেকটা কথা, আপনার ছোট ছেলের স্বরূপ তো নিজের চোখেই দেখলেন, আর বড় ছেলে স্বরূপটা না হয় অরিন্দম বাড়ি ফিরলেই জেনে নেবেন… কেমন?” বলে নিজের হ্যান্ডসেটটা ফের সাইডব্যাগে রেখে দিলো ঐশী।” ফিল্মস্টার বলে কথা আপনার বড় ছেলে!”
বৌমার কথায় বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে ঐশীর শ্বাশুড়িমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন…ওনার নিস্তব্ধতাই জানান দিচ্ছে ঐশীর প্রতিটি অক্ষরের বিশ্বাস করার অভিব্যক্তি।
“আপনার ছোটো ছেলেকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত আমার। সেদিনের সেই কান্ডটাই যে শাপে বর হবে, তা কে জানতো!” হাসিমুখে বলে উঠল ঐশী…
চরম গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলে মানুষের ঠিক যেমন অবস্থা হয়, ঐশী শাশুড়ি মায়ের অবস্থা ঠিক তেমন হয়েছে এখন। সেই দৃষ্টি পড়ে নিয়ে ঐশী বলে উঠলো এবার,”এই বাড়ি থেকে না বেরোলে আমি হয়তো আজও অতনুর মতো জীবনসঙ্গীকে পেতাম না…”
এমন সময় কোলাহল শুনে অরিন্দমের স্ত্রী এগিয়ে এসেছেন সেই ঘরের দিকে। নিজের ছোট জায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ঐশী বলে উঠল আবার,”ঘরে ছেলে বউ বেঁচে থাকা সত্বেও অন্য মহিলার দিকে কুদৃষ্টি দিচ্ছে, অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতে চাইছে। আমি তো না হয় স্বামীর মৃত্যুর পর অন্য কারোর সাথে বৈধ সম্পর্কে জড়াতে চেয়েছিলাম!” তাচ্ছিল্য ভরে হেসে বলে উঠলো ঐশী,”এবার থেকে একটু সামলে রাখবেন ওকে, থানা পুলিশ হয়ে গেলে মান সম্মান রাখার আর জায়গা থাকবেনা। আর হোটেল থেকে ফিরে আসলে নিজের বড়ো ছেলের কীর্তিটাও জেনে নেবেন।” চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো ঐশী,
“আর হ্যাঁ, কিছুদিন পরেই ফের আসতে হবে আমাকে এই বাড়িতে। ফেলা জিনিসগুলো ফেরত নিতে। চলো অতনু…” বলে শাশুড়িমার পাংশু মুখটা একবার দেখে নিয়ে ঐশী পা বাড়ালো বাড়ির বাইরে।
“মাই গড! তুমিতো একেবারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলে!” ঐশীর হাতটা ধরে আনন্দে নাচাতে নাচাতে বলে উঠলো অতনু।”আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মহিলার রিয়াকশন দেখে। নিজের ছেলের কথা বলতেই যেভাবে রে রে করে তেড়ে উঠলেন।”
এমন সময় মোড়ের মাথায় মোটাসোটা টাকমাথা অবয়বটা দেখে ঐশীর ভ্রূ দুটো কুঁচকে গেলো। “অবিনাশের ফ্যামিলি ল ইয়ার না!” নিজমনে বলে উঠতে না উঠতেই ভদ্রলোক এগিয়ে এসেছেন ঐশীকে দেখে। “ম্যাডাম ভালো আছেন? আপনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বহু খোঁজ করেছিলাম। কিন্তু পাইনি”
“হঠাৎ? কি ব্যাপারে!” জিজ্ঞাসু চোখে ঐশী প্রশ্ন করে উঠলো এবার।
“আপনার বাড়ির এড্রেসটা দেওয়া যাবে?” অতনুর থেকে চোখ ফিরিয়ে বলে উঠলেন তিনি। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে একজন অজানা অচেনা মানুষের সামনে তিনি কিছু বলতে অনিচ্ছুক।
“দিচ্ছি।” বলে নিজের বাপের বাড়ির ঠিকানাটা ভদ্রলোককে পাঠিয়ে দিল ঐশী। তারপর পা বাড়ালো সামনের দিকে।
“কী হলো কেস টা?” অবাক সুরে বলে উঠলো অতনু।
প্রত্যুত্তরে কোন জবাব না দিয়ে ঐশী চোখ রাখলো মেসেজ বক্সে। অরিন্দমের তরফ থেকে পাঠানো কমপক্ষে ষাট, সত্তরটা মেসেজ জমা হয়েছে চ্যাট বক্সে। ‘তোকে কেন হানিমুনে নিয়ে গিয়েছিল জানিস…” লেখা মেসেজটা ফের আরেকবার চোখে পড়ে গেল ঐশীর। তারপর অরিন্দমের কল আসছে দেখে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে গেল সে।
“এইজন্যেই বোধহয় কল রিসিভ করছিলিস না, তাইনা!” মুঠোফোনের আবরণ ভেদ করে অরিন্দমের চিৎকার এসে পৌঁছেছে অতনুর কানেও।
“মায়ে পোয়ে কথা হয়ে গেলো এত তাড়াতাড়ি?” গলায় শ্লেষ মিশিয়ে বলে উঠল ঐশী।
“তুই এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলি আমার সাথে! তোর শেষ দেখে ছাড়ব আমি।” ওপ্রান্তে আবার হিসহিসিয়ে বলে উঠেছে অরিন্দম।”জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ, এক্ষুনি চ্যাটবক্স খোল, জাস্ট নাও…” বলে লাইনটা ডিসকানেক্ট করে দিল সে।
সেই কথা শুনে চিন্তিত মুখে ঐশী নিজের চ্যাটবক্সটা খুলতেই পায়ের তলায় যেন মাটি সরে গেল ওর। আবছা এক নগ্ন নারীমূর্তির স্নানের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে সেই মুঠোফোনে ডিজিটাল স্ক্রিনে।
নিম্নমানের ক্যামেরা ও দূরত্বের দরুন মুখসহ গোটা শরীরটা অস্পষ্ট হলেও নিজের শরীরটা ঠিক চিনে নিলো ঐশী।
“অরিন্দম!” অস্ফুটে বলে উঠলো ঐশী…
ক্রমশ
আশা করি ভালো লাগছে সবার সঙ্গে থাকবেন সবাই,
© সম্প্রীতি রায়
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/171794117934353/?app=fbl