বিধবা_বিবাহ পর্ব-২২

0
827

#বিধবা_বিবাহ (ত্রয়োবিংশ পর্ব)
“আসুন আসুন অরিন্দমবাবু, আপনার কথাই চিন্তা করছিলাম এতক্ষণ ধরে।” খোঁপার বজ্রআঁটুনি এড়িয়ে ঝুলতে থাকা একথোকা চুলের গুচ্ছকে কপালের একপাশে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো সংগীতা। কিছুক্ষণ আগেই অতনু স্যারের নির্দেশ অনুসারে অরিন্দমকে মুক্তকণ্ঠে জেরা করার পারমিশন পেয়ে গিয়েছে সে। সেইমতো অরিন্দমকে থানায় তলব করেছে সে। প্রথমে খানিক কিন্তু কিন্তু করলে ভালোমানুষের মুখোশটি বজায় রাখতে ভট্টাচার্য বাড়ির ছোট ছেলে সীমানার বাইরে গিয়ে বেগড়বাই করার সাহস পায়নি, তা বলাই বাহুল্য। অরিন্দম ভট্টাচার্যের থেকে সম্মতি পাওয়ার পর তাই অতনুস্যারের তরফ থেকে পাওয়া এভিডেন্সগুলো সঙ্গীতা মনে মনে আউরে নিচ্ছিলো এতক্ষণ।
“কেন বলুন তো? কি এমন করে ফেলেছি যে এই অধমকে এমন অসময়ে মনে পড়লো?” গোঁফের কোণে সূক্ষ্ম হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে স্বভাবজাত সতর্কভঙ্গিতে বলে উঠলো অরিন্দম। ওর কথা বলার ভঙ্গিতে চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো সংগীতা। প্রতিপক্ষ যে স্বভাবে বেহিসাবি ধুরন্ধর সেটা তার কথাতেই স্পষ্ট। চাকুরীর সুবাদে বহু লোকের সংস্পর্শে এলেও কারোর কাছেই এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সপ্রতিভ জবাব পায়নি সে। বস্তুত হাজিরা দেওয়ার জন্য থানায় ডাকা হলে বেশিরভাগই কুঁকড়ে থাকে, ভুলভাল অসংলগ্ন উত্তর দিয়ে ফেলে। কেউ কেউ আবার জমে থাকা রাগ, হতাশার বহিঃপ্রকাশও ঘটিয়ে ফেলেন সহজেই। কিন্তু অরিন্দমের চরিত্রে সমসাময়িক ঘটনা সম্পূর্ণ উলোটপুরান দেখে দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল সংগীতার। তারপর নিজেকে সামনে বলে উঠলো,”কি করবো বলুন… চাকরি টিকিয়ে রাখতে হবে যে। তাই রুটিন ইনভেস্টিগেট বজায় রাখতেই হবে। দোষী নির্দোষ সবার ক্ষেত্রেই একই নিয়ম প্রযোজ্য।”
“হ্যাঁ সেতো অবশ্যই।”সংগীতার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল অরিন্দম..”তাছাড়া দোষী হলে আমার বাড়িতেই আপনারা সদলবলে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে আসতেন। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়তা, মান-সম্মানের প্রশ্ন উঠে যেত তখন।”
“চলুন, অন্য ঘরে গিয়ে বসা যাক।” অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলকে ইশারা ইঙ্গিতে নিজের সাথে আসতে বলে ভেতরের ঘরে পা বাড়ালো সংগীতা। পিছুপিছু ওকে অনুসরণ করলো অরিন্দম।

“বিগত দুই তিনদিন আগে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?” টেবিলের উপর থাকা রাইটিং প্যাডটা টেনে নিয়ে বলে উঠলো সংগীতা। ওর চোখ
তখন নিবদ্ধ রয়েছে স্বচ্ছ কাচের দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলের দিকে।
কোনরকম ভুমিকা ছাড়াই সরাসরি প্রসঙ্গে এসে যাওয়ায় হতচকিত হয়ে গেল অরিন্দম। তারপর নিজেকে সামলে বলে উঠলো,”কাছেই, বারুইপুরে। এক বিজনেস পার্টনারের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেদিনই তো বললাম!” ওর কণ্ঠস্বরে তখন ফুটে উঠেছে স্পষ্ট বিরূপতা। উত্তরটা শুনে সঙ্গীতার ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। তারপর ড্রয়ারে রাখা প্রিন্টেড কাগজটা এগিয়ে ছিল অরিন্দমের দিকে। কিছুক্ষণ আগেই ডকুমেন্টটা ওর হাতে এসে পড়েছে অফিশিয়াল একাউন্টের মাধ্যমে। তারপর সেখান থেকে প্রিন্ট আউট বার করা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
“কি এটা?” অরিন্দম কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করতেই হঠাৎই কাগজটা নিজের দিকে সরিয়ে নিলো সংগীতা। তারপর উল্টোদিকে বসে থাকা সুদর্শন যুবকের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,”মনু যাদব কে?”
এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন অরিন্দম যে আশাই করেনি তা বলাই বাহুল্য। মুহূর্তের মধ্যেই ওর চোখের তারায় ফুটে উঠল সহস্র আক্রোশের বিন্দু। সেই চাহনি পড়ে নিয়ে সঙ্গীতার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এমন হিংস্র, শীতল, নিষ্ঠুর চাহনি নিজের চাকরি জীবনে খুব কমই দেখেছে সে। কিন্তু চরম দ্রুততায় নিজের ভাবাবেগ মনের গোপন কন্দরে বন্দি করে ফেললো অরিন্দম। তারপর সযত্নে ছেটে রাখা গোঁফের কিনারায় হাসি ঝুলিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে উঠলো,”কে মনু যাদব? আমি তো নামটাই প্রথম শুনছি।”
গ্রামেগঞ্জে থাকার সুবাদে গিরগিটির দেহত্বকের রং বদল বহুবার বহুরকম ভাবে চোখে পড়েছিল সঙ্গীতার, কিন্তু উল্টোদিকে বসে থাকা মানুষটার মনের ঘনঘটার ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন তাকে মনে করিয়ে দিল এই জগতে মানুষই হয়তো বহুরূপীদের সম্রাট…
“মনু যাদব, যার সাথে আপনার আজই পাঁচবার কথা হয়েছে। আর গত একমাসে সাতশো মিনিট..” বলে স্যারের তরফ থেকে পাঠানো কাগজটা অরিন্দমের দিকে ঠেলে দিলো সংগীতা। প্রিন্টেড হরফে লেখা কথোপকথনের সময় তারিখ ফুটে উঠেছে সেখানে। সেদিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই অরিন্দমের গলা বেয়ে থুতুর দলাটা নেমে গেল নিঃসাড়ে।
“কি হলো বলুন” স্থির দৃষ্টিতে অরিন্দমের ঢোঁক
গেলা দেখতে দেখতে বলে উঠলো সংগীতা। ইউনিফর্ম চাপিয়ে বসে থাকা মেয়েটির ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে অরিন্দম ভয় পেয়েছে।
“এই ভদ্রলোক আমাকে ফোন করে বিরক্ত করতো… কোথা থেকে কিভাবে যে লোকের নম্বর পেয়ে বসে!” আমতা আমতা করে জবাব দিলো অরিন্দম। “তাছাড়া ব্যবসায়ী মানুষ তো! বহু লোকজনের কাছে নম্বর থাকা স্বাভাবিক। বক্তব্যের সমর্থনে এবার পরোক্ষভাবে নিজের ঢাক পিটাতে শুরু করল অরিন্দম।
“তাই বলে সাতশো মিনিট? সারাদিন অজানা অচেনা মানুষদের সাথে কথা বলেই সময় কাটাতেন নাকি?”অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে কুট করে হুল ফুটিয়ে বলে উঠলো সংগীতা।
“আমি কার সাথে কতক্ষণ কথা তার জবাব আপনাকে দিতে হবে? আমার টাকা আমার ফোন, যতক্ষণ খুশি যার সাথে কথা বলব আমি!” প্রবল উত্তেজনায় চেয়ার ঠেলে মেঝেতে দাঁড়িয়ে পড়েছে অরিন্দম। টেবিলে পড়ে থাকা কাগজটিও
নিজের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে।
“ওটা নষ্ট করলেও কোনো লাভ হবে না।” আশ্চর্য রকম শান্ত স্বরে জবাব দিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে কাগজটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো সঙ্গীতা। প্রাবল্যের চোটে সেটার একটা কোনা ছিড়ে গিয়েছে অপ্রত্যাশিতভাবে। তবে ছাপানো অক্ষরগুলোর যে কোনো ক্ষতি হয়নি, তা বলাই বাহুল্য।
“আপনার পয়সা, আপনার ফোন, আপনার সিম, আপনার সময়, আপনি যতক্ষণ খুশি যার সাথেই কথা বলুন না কেন… সেটা আপনার একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার।” অরিন্দমের কথার রেশ টেনে বলে উঠলো সংগীতা,”কিন্তু সেই কলটা যদি ফেরার হয়ে যাওয়া আসামিকে করা হয়ে থাকে, তবে ব্যাপারটা কিন্তু আর ব্যক্তিগত থাকেনা অরিন্দমবাবু। ব্যাপারটা তখন তদন্তের আওতাভুক্ত হয়ে পড়ে যে! আপনি আপনার পয়সায় আপনার ফোনে সাতশো মিনিট একজন দাগি আসামির সাথে কি কথা বলছেন সেটা জানা আমাদের একান্ত কর্তব্য। বুঝতেই পারছেন আপনার বলা পাঁচ মিনিটের কনভারসেশন মোটেই বিশ্বাস করিনি আমি। তাহলে সময় নষ্ট না করে চটপট বলে ফেলুন তো, বারুইপুরের কথা বলে আপনি কোথায় ছিলেন? আর মনু যাদবের স্ত্রীকে কেন মনু যাদবের দ্বিতীয় নম্বর থেকে ফোন করতেন?”

“বেগুসরাইতে… আমি বেগুসরাইতে ছিলাম।” হিসহিসিয়ে গলার স্বর প্রায় খাদে নামিয়ে বলে উঠলো অরিন্দম।”আর মনুর বউটা এই ব্যবসায় নামতে রাজি হচ্ছিল না কিছুতেই। শালা সতী খা** একটা! বাপ-মায়ের মুখে চুনকালি মাখিয়ে মন্ডপ পালিয়ে প্রেমিকের গলায় মালা দিতে পারে… কিন্তু মুখ লুকিয়ে শুটিং করতে পারেনা। এদের সতীগিরি দেখলে পা থেকে মাথা অব্দি জ্বলে ওঠে আমার। ওয়াক থু!” বলে থানার মেঝেতেই একদলা থুতু ফেলল অরিন্দম। তারপর গলায় ততোধিক আক্রোশ মিশিয়ে বলে উঠলো,”কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলাম না মালটাকে। তাই মনুর কথা মতোই স্নানঘরে ক্যামেরা ফিট করেছিলাম আমি।তারপর সেই ছবি পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেল করতাম মেয়েটাকে। কিন্তু ওই যে বলে না সতীগিরি রোগের ওষুধ নাই, ঠিক তেমনই মনুর বউটাকে সততায় রোগে চেপে ধরেছিল। আমার কলহিস্ট্রি নিয়ে ছুটে গিয়েছিল থানাতে! ভাবা যায় কত বাড় বেড়েছিল শালা খান*!”
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন যুবকের কথা শুনে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত একস্থানে স্থির হয়ে বসে আছে সংগীতা। ঘটনার আকস্মিকতায় যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে সে। খুলে থাকা দুই কর্ণকূহরের ব্যাপ্তি জুড়ে ছেয়ে যাচ্ছে অরিন্দমের তীক্ষ্ণ ফলার চাদরে মুড়ে যাওয়া কর্মকাণ্ডগুলো।
“মালটা ভাবতে পারেনি লোকাল থানাতে আমাদেরও লোক ছিল। তাই রিপোর্ট লিখিয়েও কিস্যু হয়নি। কিন্তু আমার মেল ইগোতে জব্বর আঘাত লেগেছিল। তাই দিলাম ছড়িয়ে!” হিসহিসিয়ে ফের বলে উঠলো সে।
“কি ছড়িয়ে দিলে?” অস্ফুটে বলে উঠলেও মৃদু সেই শব্দসমষ্টি পৌঁছে গেল অরিন্দমের কানে, ঠিক যেমন হিংস্র শ্বাপদের কানে চলে আসে প্রতিপক্ষের প্রতিটি আনাগোনা।
“ওর বিবস্ত্র, উলঙ্গ ভিডিও। ফুলশয্যার রাতের, স্নান করার সময়ে, স্বামী স্ত্রীর দুজনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা মুহুর্তের মধ্যে পৌঁছে দিলাম লক্ষ লক্ষ মানুষের মুঠোফোনের জালে। এবং অবশ্যই মনুর মুখটা অস্পষ্ট করে রেখে। যাদববাবু আমার একনিষ্ঠ বিশ্বস্ত সহকারী, ওকে আড়াল করে রাখা মালিক হিসেবে আমার কর্তব্য, ঠিক কিনা?” ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো অরিন্দম। ওর কথা শুনে বাচনক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সংগীতা। ফুলশয্যার রাতে দুই অক্ষরের কথাটা বারে বারে ধাক্কা মারছে মস্তিষ্কের কোটরে…”তবে কি মনু যাদব এই চক্রের নোংরা উদ্দেশ্য পূরণ করতেই নাবালিকা, অল্পবয়স্কা মেয়েটিকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিল… কে বেশি দোষী! অরিন্দম নাকি মনু। একজন পয়সার লোভে নিজের বিবেককে নিলামে তুলে দিয়েছে, অপরজন নিজের পরিবারের বিশ্বাসকে…”
“ভিডিও বলতে কোন ভিডিও বুঝতেই পারছ আশা করি,” হালকা হেসে ফের বলে উঠলো অরিন্দম,”ঐশিকে যে ভিডিও পাঠিয়ে ছিলাম আমি। যদিও ঝাপসা, অস্পষ্ট লো কোয়ালিটির ভিডিওই পাঠিয়েছিলাম। ভালবাসি যে! কি করে ক্ষতি করব ওর। কিন্তু আমার কথার অবাধ্য হলে অবশ্যই করবো, ওই মালটাকে বিয়ে করলে তছনছ করে দেবো ঐশীর জীবন। তখন ওর অবস্থা মনুর বউয়ের মতই হবে। বিয়ের শাড়ি গলায় বেঁধে ঝুলে থাকবে সিলিং ফ্যানের সাথে। চোখ বড় বড় হয়ে যাবে, এই এত্ত!” বলে হাতের পাঁচটা আঙুলের সাহায্যে সাহায্যে বড় গোল করে দেখালো অরিন্দম।”জিভ বেরিয়ে যাবে, খুব বিচ্ছিরি দেখতে লাগবে কিন্তু!”

“বাহ! আপনার কোনো জবাব নেই।” বিষাদ ক্রোধ মিশ্রিত এক নিদারুণ অভিব্যক্তি ফুটে বেরিয়ে এলো সংগীতার কণ্ঠস্বর থেকে। ওর হাতের মুঠিটা
চোয়ালের সাথে সাথে শক্ত হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছে করছে এক জোরালো ঘুষিতে অরিন্দমের সুন্দর মুখটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে, কিন্তু আইনের বাঁধনে অপরগ সে।
“সেতো অবশ্যই!” প্রশংসার আড়ালে ঢেকে রাখা অপমানসূচক বাক্যটা গিলে নিয়ে বলে উঠলো অরিন্দম।”জবাব নেই বলেই তো এতগুলো কথা আপনাকে বলতে পারলাম। ওহ্ সরি আমি কি বলেছি বলুন তো? কিছু কি আদৌ বলেছি আমি?” এক অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বলে উঠলো অরিন্দম। ওর কথোপকথনের বিন্দুমাত্র বুঝতে না পেরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সংগীতা। সেদিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে উঠলো অরিন্দম,”ঘরে কেবলমাত্র আমি আর আপনি আছি, আমি কিছু বলিনি। আর বলে থাকলেও আপনার স্মৃতিশক্তি কি আদালতে প্রমাণ করতে পারবে এই চক্রান্ত? মনুর বউ মরে যাওয়ার সাথে সাথে এই রহস্য ধামাচাপা পড়েছে। আর…”
“কে বলেছে এই ঘরে শুধু আমি আর আপনি আছি?” ঠোঁটের কোণে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে উঠলো সঙ্গীতা। ওর কথার বিন্দুমাত্র বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো অরিন্দম। সেই দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখা অতিক্ষুদ্র অডিও রেকর্ডারটা বার করে আনলো সংগীতা। অরিন্দমের সব বক্তব্য সেই ক্ষুদ্র যন্ত্রে যে ততক্ষনে বন্দি হয়ে গিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
“তবে রে শালী! মেয়েমানুষের এত্ত ঝাঁজ!” বলে টেবিলের উপর উঠে দাঁড়িয়ে এক ঝাঁপ দিলো অরিন্দম। ওর মুভমেন্ট বুঝে ক্ষিপ্রগতিতে এককোণে সরে গিয়েছে সংগীতা। ভিতরে কিছু গোলমাল চলছে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল দরজার ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে গিয়েছে ততক্ষনে…
খানিকক্ষণ অসম যুদ্ধের পর অবশেষে হেরে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে অরিন্দম বসে পরলো ঘরের এককোনাতে। সেইদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সঙ্গীতা অতনুকে ফোন করলো তড়িঘড়ি,”আপনার কথামত অরিন্দমের বক্তব্য ওর অজান্তেই রেকর্ড করে নিয়েছি। তদন্ত সমাপ্ত হয়েছে।”

—+—

“আয় মা, বস।”
পিসিকে নিয়ে অতনুর বাড়িতে ঐশী যখন ঢুকলো তখন ঘরে ঘরে জেগে ওঠা প্রত্যহিক সন্ধ্যা আরতি সমাপ্ত হয়েছে। ঐশীর চঞ্চল মনটা বারে বারে চলে যাচ্ছিলো হাতে থাকা মুঠোফোনের দিকে। কিন্তু ওর ইচ্ছেকে অপূর্ণ রেখেই নিষ্প্রাণ যন্ত্রটার স্ক্রিন মুড়ে আছে কালো চাদরে। কিছুক্ষণ আগেই সঙ্গীতার সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করেছে ও। কিন্তু প্রোফাইল লকিং নামক নতুন ফিচার থাকায় কিছুতেই খুলছেনা সঙ্গীতার প্রোফাইলটা। কাজেই মেয়েটা বিবাহিত নাকি অবিবাহিত, এই তথ্যটা অজানাই রয়ে গিয়েছে ঐশীর কাছ থেকে। বহুদিন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকার কারণে এই নতুন ফিচারটার সাথে ঐশী যে পরিচিত ছিলনা তার বলাই বাহুল্য।
“কিরে মনি বোস!” ভাইঝিকে আনমনা দেখে বলে উঠলেন খোদ বাসন্তীলতাদেবী। আজকাল ঐশীর আনমনা ভাব তারও নজরে পড়ছে বৈকি।
“হ্যাঁ বসছি।” বলে এগিয়ে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে ঐশী। অতনুর মা তখন ওদের জন্য শুকনো খাবার গোছাচ্ছেন।

“মিষ্টি অল্পই দিলাম বুঝলি। বেশি বেশি এসব খাবার খেয়ে আমার মত রোগভোগ বাঁধানোর দরকার নেই।” বলে খাবারের প্লেটটা অতনুর মা এগিয়ে দিলেন ঐশীর দিকে।
“তোর কি এতসব না করলেই চলছিল না! অসুস্থ মানুষ। কোথায় আমরা এসে সাহায্য করবো।” প্রসাধন ঘর থেকে বাসন্তীলতাদেবী ততক্ষনে ফিরে এসেছেন এই ঘরে। তারপর বান্ধবীকে বিছানা ছেড়ে খাবার গোছাতে দেখে একপ্রকার রে রে করে তেড়ে উঠলেন তিনি।
“আহ্, তুই থাম দেকি!” সপাটে পিসিকে থামিয়ে বলে উঠলেন অতনুর মা,”মেয়েটা এই প্রথম এলো। এখন কি রোগের দোহাই দিয়ে শুয়ে থাকলে চলে। কিন্তু হ্যাঁ, বিয়ের পর কিন্তু এতকিছু করবনা মনে রাখিস। তখন আমি অসুস্থ হলে সব দায় তোদের দুজনের বুঝলি?”
ভদ্রমহিলার অকপট স্বীকারোক্তি শুনে একটা মৃদু ভালোলাগা ছেয়ে গেলো ঐশীর মনমধ্যে। এ যে অতনুর চরিত্রের নিখুঁত প্রতিবিম্ব। অকপট, সহজ সরল। কোনরকম ছলাকলা নেই, মিথ্যে আগলে রাখার অভ্যাস, লোকদেখানো ভালোবাসা নেই। সবকিছু স্বাভাবিক, যেন কোথাও কোনো বাড়তি নেই।
“কি রে, করবি না? রাখবি না আমার খেয়াল?” হবু বৌমার থুতনি নাড়িয়ে বলে উঠলেন তিনি,” মা নই জানি। কিন্তু শ্বাশুড়িমা তো বটেই…”
প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব না দিয়ে হালকা হেসে উঠলো ঐশী। নাম না জানা এক আড়ষ্টতা, লজ্জার অপূর্ব সহাবস্থানে ওর ফর্সা গালদুটো লাল হয়ে উঠলো নিজের অজান্তেই।
“এই দেখ অতনু কি বানিয়েছে।” হবু শ্বশুড়িমায়ের কণ্ঠস্বর শুনে মুখ তুলে তাকালো ঐশী। বাসন্তীলতাদেবীকে তখন নিজের মুঠোফোনের ডিজিটাল স্ক্রিনে ফুটে ওঠা একটা ফটো দেখাচ্ছেন অতনুর মা। ঘনকালো চুলের সহাবস্থানে একজন যুবতি মেয়ের জলছবি দেখা যাচ্ছে সেখানে।
“এটা কে?” ফটোটা দেখে অসীম কৌতুহলভরে প্রশ্ন করে উঠলো ঐশী।
“আমি রে এইটা। ছেলে বানিয়ে দিয়েছে কিছুদিন আগে। ওই কিসব অ্যাপ আছে, সেখান থেকে ছেলেকে মেয়ে, মেয়েকে ছেলে বানানো যায়। বয়সও কমানো বাড়ানো যায়। দেখ দেখ।” বলে মুঠোফোনটা বাড়িয়ে দিলেন ঐশীর দিকে।
এদিক সেদিক দেখতে দেখতে অ্যাপটা বেশ ভালই লাগলো ঐশীর। তাই নিজের ফোনেও ইনস্টল করে নিল চটপট। তারপর নিজের একের পর এক ফটো দিয়ে মজা নেওয়ার পালা শুরু। নিজের কিম্ভুত ফটোগুলো দেখতে দেখতে নিজের মনেই হেসে উঠছিলো সে।
“এবার অতনুর পালা।” বলে সুনির্দিষ্ট একটা ফটো পছন্দ করতে চাইলেও আঙুলের কারিকুরিতে মনু যাদবের ফটোটা চাপ দিয়ে বসলো সে।
“ধুত! এই লোকটা আবার কেন।” বলে সরিয়ে দিতে চাইলেও হঠাৎ এক অজানা কারণে ফটোটাকে খারাপ করার ইচ্ছে জেগে উঠলো মনমধ্যে। মহিলা, বয়স্ক করার পালা শেষে মনু যাদবের দাঁড়ি কামানো চকচকে মুখটায় দাঁড়ি লাগিয়ে আরো পুরুষোচিত করার খেলায় মেতে উঠলো সে…

“একি! এ যে…” এডিটিং শেষে প্রবল উত্তেজনায় সম্পূর্ণ শরীরটা কেঁপে উঠলো ওর। শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকা শীতল স্রোতটা টের পাওয়ার পরমুহূর্তেই হাত ফস্কে কমদামী হ্যান্ডসেটটা গিয়ে পড়লো মেঝেতে।এই মুখ যে তার ভীষণ চেনা, স্বল্পসময়ের আলাপ হলেও এই মুখ কি কখনও ভোলা যায়!
“ওকি মনি! ফোনটা যে পড়ে গেলো। এই ভাঙ্গাচোরা হ্যান্ডসেট নিয়ে আর কতদিন চালাবি…” পাশে বসে থাকা পিসির কণ্ঠস্বর কান অব্ধি পৌঁছালেও জবাব দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সে।

“এ যে ড্রাইভারবাবু! গাড়ি খাদে পড়ে যাওয়ার পড়েও বেঁচে আছে কীকরে!” অস্ফুটে বলে উঠলো ঐশী।

ক্রমশ
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/185184163262015/
© সম্প্রীতি রায়
আগামী পর্বে চমক থাকছে, আশা করি ভালো লাগছে সবার, সঙ্গে থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here