বিধবা_বিবাহ পর্ব-২৫

0
859

#বিধবা_বিবাহ(ষট্‌বিংশ পর্ব)
“নিজের মায়ের কাছ থেকে এত বড়ো সত্যিটা তুই লুকিয়ে রাখতে পারলি মনি? একবারও চিন্তা করলিনা এত বড় খবরটা জানার পর মায়ের মনের অবস্থা কিরকম হতে পারে!” পিসির সাথে খুনসুটি সেরে সবেমাত্র ঘর ছেড়ে বাইরে এসেছিল ঐশী। এমন সময় হঠাৎ বেরোনোর মাত্রই বিনা ভূমিকায় প্রশ্ন করে উঠলেন সবিতাদেবী। প্রশ্নটা শুনেই ঐশীর গোটা গা নাম না জানা কারণে কেঁপে উঠলো। এবার হয়তো শুরু হয়ে যাবে দোষারোপের পালা, মায়ের কথা অমান্য করার খেসারত স্বরূপ শুরু হয়ে যাবে একের পর এক বাক্যবাণ। কিন্তু ঐশীর মনে বেঁচে থাকা ধারণা মিথ্যা হয়ে গেলো এক নিমেষেই। চোখের পলক ফেলার আগেই মেয়ের হাতদুটো জড়িয়ে ধরে কাছে এগিয়ে এসেছেন তিনি। হতাশা বিষাদের ঘনঘটায় ভরে যাওয়া ছোটখাটো মুখটায় তখন খেলা করছে একরাশ মমতার অভিব্যক্তি। যেন হারিয়ে ফেলা ধন ফিরে পেয়েছেন তিনি।
“ওরা দুই ভাই কি করেছো তোর সাথে?” সিমেন্টের বাধানো চাতালে বসতে বসতে বলে উঠলেন সবিতাদেবী। সধবার চিহ্ন আঁকা হাতদুটো এখনো বন্দি রেখেছে নিজের বিধবা মেয়ের হাতদুটোকে।
“পুলিশ ব্যাপারটা তদন্ত করছে। সব শেষ হলে জানাবো, কেমন?” আমতা আমতা করে উত্তর দিলো ঐশী। বস্তুত ওর মনমধ্যে এখনো জেগে আছে অবিনাশকে কেন্দ্র করে মায়ের উদ্বিগ্নতা, জ্যোতিষকাকুর ভবিষ্যৎবাণী, অবিনাশ ঐশী দুজনেরই কুষ্ঠিতে দোষ এবং দুর্ব্যবহার। চোখের সামনে জেগে থাকা সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে যেন ফুটে উঠেছে বছর কয়েক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার রিপিট টেলিকাস্ট।

“তোদের দুজনেরই কুষ্টি বিচারে দোষ পেয়েছে জ্যোতিষ মহারাজ। উপরন্তু তুই মাঙ্গলিক। দোষ খন্ডন করতে যজ্ঞ করতে হবে। নইলে তোর এই দোষ এর কারণে দুজনার যেকোনো একজনকে মরতে হবে! আর তুই আগুপিছু না ভেবে বিয়েতে রাজি হচ্ছিস?” মেয়ের হাত ধরে বোঝানোর ভঙ্গিতে বছরচারেক আগে বলে উঠেছিলেন সবিতাদেবী। নিজের ধ্যান-ধারণার প্রতি অবিচ্ছেদ্য বিশ্বাসের বাঁধনে বারে বারে বারণ করেছিলেন মেয়েকে। অন্যদিকে ঐশীও মায়ের নিষেধ অমান্য করে এগিয়ে গিয়েছিল সুতীব্র বেগে, ঠিক যেমনটা পতঙ্গ ধেয়ে যায় উজ্জল অগ্নিশিখার দিকে।
“আমি এসব বিশ্বাস করিনা মা.. আমাকে বিয়ে করার কারণে অবিনাশ মারা যাবে এই হাস্যকর যুক্তি তুমি তোমার কাছেই রেখো। ছেলে খারাপ হলে আমি ওকে ছাড়তে দুমুহূর্ত ভাবতাম না। কিন্তু একটা অন্যায়,ভিত্তিহীন সংস্কারের বশে এইসব জুলুমগিরি মানতে পারবো না আমি!” বয়সোচিত রূঢ় কণ্ঠস্বরে ঐশী নেহাতই তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিয়েছিল মায়ের বিধি-নিষেধকে। তার বছরকয়েক পরেই দুর্ভোগের শুরু।

“কিরে শুনছিস!” মায়ের তীক্ষ্ম কন্ঠস্বরটা কানে ভেসে আসতেই অতীতের মায়া কাটিয়ে বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলো ঐশী।”আমাকে এখনই বলতে হবে, সব।” মুখটা কঠিন করে আদেশের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন সবিতাদেবী।
“অবিনাশ বেঁচে আছে মা, পুলিশ ওর খোঁজে জোর তল্লাশি চালাচ্ছে। দুইভাই মিলে এতদিন বোকা বানিয়ে রেখেছিল সব্বাইকে।” মেঝের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে উঠল ঐশী।
“বাহ, আর এই কথাটা তুই আমার কাছে লুকিয়ে গেলি! চমৎকার।আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কিসব বলছে জানিস!”কণ্ঠস্বরের শ্লেষ মিশিয়ে বলে উঠলেন সবিতাদেবী। বস্তুত সংসারের রাশ হাত ফসকে পিছলে বেরিয়ে যাওয়ার ভয় চেপে ধরল আরো তীব্রভাবে।
“যা খুশি বলতে চায়, বলুক না মা! মুখ আছে কথা বলবেই। সেগুলো মাথায় ঢুকাতেই হবে, এমন কোন ডিল আছে কি? ওদের মুখ থাকলে আমাদেরও কান আছে।” অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলে উঠলো ঐশী। মায়ের তিরস্কার যদিও বা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু মুখোশের আড়ালে থাকা ভালো মানুষেরবেশধারী এই ‘লোকগুলোর’ খবরদারি কিছুতেই মানতে পারা যায় না, তা বলাই বাহুল্য। “সময় সুযোগ বুঝে করুনার ভঙ্গিতে কাটা ঘায়ে নুন ছেটানোর ওদের কায়দা কানুন আমার জানা হয়ে গিয়েছে, পারলে আত্মীয় কুটুম্বদের নতুন কিছু ভঙ্গি ট্রাই করতে বলতে পারো। এইভাবে করুণা দেখিয়ে আর কয়দিন!” স্পষ্ট বিরক্তির ভাঁজ এঁটে বসেছে ঐশির কণ্ঠস্বরে।
“নানা, করুণা কেন করবে! আমি কথাগুলো ওদের কাছে জানানোর পর জিজ্ঞাসা করল বিয়েটা তুই করবি কিনা।” মেয়ের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীতে ঘুরে গিয়ে বলে উঠলেন সবিতাদেবী।
“মানে তুমি জানতে সবকিছুই। অরিন্দমের গ্রেফতার, অবিনাশের বেঁচে থাকা.. সবকিছু জানতে, তাই না? তবে কেন আমার কাছে এসে বললে তোমাকে কিছু জানানো হয়নি! তুমি তো সবকিছুই জেনে বসে আছ!” মায়ের কথা শুনে মনের মধ্যে যেটুকু ধৈর্য অবশিষ্ট ছিল, মিলিয়ে গেল খোলামকুচির মত। বস্তুত, এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটতে একেবারে মন চাইছিল না ওর। সেইমতো বাসন্তীলতাদেবীও আগ বাড়িয়ে কিছু জানতে না চাওয়ায় ঐশী নিজে থেকে কিচ্ছুটি বলেনি পিসির কাছে। তাছাড়া অতনুর কাছ থেকে আপডেট সময়মতো পেয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, তা বলাই বাহুল্য।
“তো কি হয়েছে? তুই আমার মেয়ে। তোকে আমি জিজ্ঞেস করতে পারিনা?” মেয়ের কথা বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলেন সবিতাদেবী।
“অবশ্যই জানতে পারো, কিন্তু জানা জিনিস কতবার জানবে বলো।” ক্লান্তস্বরে উত্তর দিল ঐশী। “তাছাড়া আত্মীয় স্বজনদের সাথে মিলে তুমি যেটা শুরু করেছো সেটা জিজ্ঞেস করা না, খোঁচানো বলে।” মনের মধ্যে জেগে থাকা কথাটা সম্পূর্ণভাবে স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে বলে উঠলো ঐশী। “তাছাড়া অবিনাশ বেঁচে থাকুক বা না থাকুক, বিয়েটা আমি করব। আর অতনুর মার শরীরটা খারাপ হওয়ার কারণে চাইছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাপারটা মিটে যাক।”
“কিন্তু অবিনাশ বেঁচে থাকলে বিয়েটা কি করে করবি!” মেয়ের কথায় প্রচন্ড অবাক হয়ে বলে উঠল সবিতাদেবী। “বেঁচে থাকলে তুই যে এখনো ওর বিবাহিতা স্ত্রী। কিন্তু ডেথ সার্টিফিকেট, অফিশিয়াল কাগজপত্র…” দুর্বোধ্য গোলকধাঁধায় নিজের অজান্তেই পড়ে যাওয়ার মতো ঐশীর মা যেন খেই হারিয়ে ফেললেন। বস্তুত অবিনাশ বেঁচে থাকলে এইসব সার্টিফিকেটের প্রয়োজনীয়তা কি!
“একজন দাগি অপরাধীর বিবাহিতা স্ত্রী রূপে বেঁচে থাকার থেকে ডিভোর্সির তকমা এঁটে বেঁচে থাকা সম্মানজনক।” মায়ের বক্তব্যের মাঝেই ঐশী বলে উঠলো দৃপ্তভঙ্গিতে। “তদন্তের গতি জানিয়ে দিচ্ছে অবিনাশ খুব শীঘ্রই ধরা পড়তে চলেছে। সেক্ষেত্রে ওর অপরাধ প্রমাণের আগেই আমি ডিভোর্সের ফাইল রেডি করে রাখবো।”
“মানে জ্যোতিষীর পরামর্শের বিরোধে গিয়ে তুই যজ্ঞ না করেই ফের বিয়ের পিঁড়িতে বসবি?” মেয়ের অবাধ্যতায় এবার যারপরনাই রেগে গেলেন সবিতাদেবী।বস্তুত নিজের কুসংস্কারবশত এতদিন ধরে নিজের মেয়েকেই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে অবিনাশের মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেগে দিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাওয়ার কারণে ঐশী এবার নিশ্চয়ই আঁকড়ে ধরবে মায়ের বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণাকে। কিন্তু বাস্তবে সেই পথকে হেলায় সরিয়ে দিয়ে ঐশী যখন ফের নিজের রাস্তাতেই চলতে আরম্ভ করলো তখন ধৈর্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে গেল সবিতাদেবীর পক্ষে।
“কোনদিনই আমার কথা শুনে চলিসনি। আমারই ভুল তোকে ফের বোঝাতে এসেছিলাম আমি! ভুলে গিয়েছিলাম এইপরিবারের রক্ত তোর শরীরেও বইছে। পিসি, ভাইঝি সব সমান! সব…” রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এবার প্রায় চিল্লিয়ে দিয়ে উঠলেন তিনি।”এদিকে বিয়ের তারিখ এগোনোরও শলা-পরামর্শ হয়ে গেছে।”
“শলা-পরামর্শ না মা। আলোচনা হয়েছে, কারণ অতনুর মায়ের শরীরটা প্রচন্ড খারাপ। অলরেডি দুবার স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে ভদ্রমহিলার। তাই সাততাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দেখেই…” বক্তব্যের মাঝপথেই থেমে গেল ঐশী, কারণ দরজার পর্দা ঠেলে ততক্ষনে বেরিয়ে এসেছেন বাসন্তীলতাদেবী।
সেদিকে তাকিয়ে মনের ছাইচাপা আগুনটা ফের দপ করে জ্বলে উঠলো সবিতাদেবীর। মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে ঐশীর এইরূপ ‘বেয়াড়াপনার’ একনিষ্ঠ সমর্থক যে এই মানুষটিই তা বলাই বাহুল্য।
“যা মন চায় কর! এরপর কোন বিপদ বাঁধলে আমার কাছে বলতে আসিসনা।” নিজের ঠাকুরঝির দিকে তাকিয়ে গুছিয়ে রাখা ব্রহ্মাস্ত্রটি নিক্ষেপ করে বড় বড় পা ফেলে সবিতাদেবী চলে গেলেন রান্নাঘরে। পিছু পিছু ওনাকে অনুসরণ করলেন বাসন্তীলতাদেবী।

“বৌদি দাঁড়াও!” অসীম সাহস সঞ্চয় করে বাড়তে থাকা চুলের গোছাটা কানের পিছনে সরিয়ে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী। ঐশী যে ততক্ষনে নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু আপাত নিরীহ সেই শব্দজালে যে বারুদের সূক্ষ্ম কণা লুকিয়ে ছিলো তা কে জানতো! ঠাকুরঝির কথা শুনে নিমেষেই দপ করে জ্বলে উঠলেন সবিতাদেবী। মেয়ে ধারে-কাছে না থাকার সুযোগটি নিতে ভুললেন না কিছুতেই,”দেখো ঠাকুরঝি, মেয়েটাকে তো তুমি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছো’ই। এখন আবার মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আদিখ্যেতা দেখাতে এসো না! পিসি সইয়ের বাড়ি গেলেও একলা ছাড়তে চায়না মেয়ে! লাফাতে লাফাতে ঠিক হাজির হয়ে যায় পিছুপিছু। এদিকে আমি সামান্য কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেই চিল্লিয়ে ওঠে। আজকাল তো আমার মনে হয় তুমি জাদুটোনা করেছো আমার মেয়েটাকে।”
বৌদির মুখের ঝাঁঝালো কথা শুনে খেই হারিয়ে ফেললেন বাসন্তীলতাদেবী। মাত্র ঘন্টাখানেক আগেই দুজনে মিলে একসাথে সবজি কেটে ধুয়ে রেখেছেন, হাসতে হাসতে রান্নাও সেরেছেন। তবে হঠাৎ কি হলো। কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই সবজি কাটতে গিয়ে হাত কেটে যাওয়ার কারণে উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তড়িঘড়ি ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল নিজের ঠাকুরঝির হাতে! রান্নায় নুন কম হলেও উচ্চবাচ্য না করে খেয়ে নিতে পারে বিনা ঝঞ্ঝাটে!
বছরের পর বছর একসাথে থাকার কারণে বৌদির মুখঝামটা ডালভাতের মতই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে বাসন্তীলতাদেবীর কাছে। নিজের ধ্যানধারণা, বিশ্বাসে আঘাত পেলে সবিতাদেবী যত তাড়াতাড়ি ঝগড়া বিবাদ করতে এগিয়ে যান, তার থেকেও দ্রুততায় অভিমান খসিয়ে নিজের কাছে টেনে নেন নিঃশব্দে। কিন্তু মানবচরিত্রেও স্থিতিস্থাপকতার সীমানা থাকে বৈকি। একটানা টানা-হ্যাঁচড়া করতে থাকলে জীবমাত্রেরই কষ্ট হবে। বাসন্তীলতাদেবীও তার ব্যতিক্রম নয় মোটেই। কিন্তু আজ, জাদুটোনা করে ঐশীকে নিজের কাছে টেনে নেওয়ার কথাটা শুনে মনটা আচমকাই খারাপ হয়ে গেলো তার। নিজের ভাইঝিকে সন্তানজ্ঞানে স্নেহ করার দাম কি এই..?
শেষমেষ ‘কেড়ে নেওয়া!
“তুমি যা বলছো,ভেবে বলছো তো বৌদি?” মনের কোটরে জেগে থাকা অপমানের জ্বালাটা চেপে রেখে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।”মনি কিন্তু আজ চিল্লামেল্লি করেনি, আগে করতো ওইসব…ওই বয়সে বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই ছোটোখাটো কারণে উত্তেজিত হয়ে পড়ে।”
“আলবাত ভেবে বলছি আমি!” হিতাহিতজ্ঞান শূন্যের মতো ফের বলে উঠলেন সবিতাদেবী। “দিনভর গাধার মত খেটেখুটে সবার মুখের সামনে সবকিছু জুগিয়ে চলি। কিন্তু দিনশেষে শুনতে হয় আমি নাকি অন্যকে খোঁচাচ্ছি, বাহ রে বাহ!”

“সবাই তো সমান হয়না বৌদি।”সবিতাদেবীকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী।
“ওর কাছে আমিও কিচ্ছুটি জানতে চাইনি। কি দরকার পুরনো কথা তুলে। কষ্ট কমবে কি? উল্টে ছোট্ট ক্ষতটা বড়সড় ঘায়ের আকার নেবে। থাকুক না ও ওর নিজের মতো!”
“তোমার নিজের মেয়ে হলে এতোখানি হাত আলগা রাখতে পারতে তো? মায়ের মন তুমি বুঝবে কীকরে!” ফের স্বভাবজাত ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন সবিতাদেবী। কথাখানি যেন তীরের মতো বিঁধল বাসন্তীলতাদেবীর বুকে। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে দৃঢ়স্বরে বলে উঠলেন তিনি,”মনিকে আমি আলগা হাতে রাখিনি বৌদি। অতনুর তরফ থেকে তদন্তের প্রতিটা খবরাখবর পেয়ে যাই আমি। মনির কাছ থেকে কিন্তু কিচ্ছুটি জানতে চাইনি আমি!” সেই কথা শুনে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সবিতাদেবী তাকিয়ে রইলেন ঠাকুরঝির দিকে। বোধহয় মেপে নিতে চাইছিলেন ওনার মনে জেগে থাকা মেয়ের প্রতি ভালোবাসাকে। সেই দৃষ্টি পড়তে না পারলেও ফের বলে উঠলেন বাসন্তীলতাদেবী,”নিজের স্বামী, দেওরের কীর্তিতে মেয়েটা এখন ভয়ে থাকে রীতিমত। ঘুম ভেঙে গেলে রাতবিরেতে খাটের উপর উঠে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। এই অবস্থায় ওকে আত্মীয়স্বজনের কথা বলে মানসিক চাপ দেওয়াটা কি খুব প্রয়োজন?”
জোঁকের মুখে নুন পড়লে ঠিক যেমন হয়, সবিতা দেবীর অবস্থাও ঠিক সেরকমই হলো। মনে পড়ে গেল, কৃষানুর কাছে ছেলেবৌমার ডিভোর্স এর ব্যাপারে জানতে চাওয়ার কারণে হজম করা নিস্পৃহতা। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে বসে থাকা কৃশানুও যে নিজের ভাঙ্গাচোরা দাম্পত্যের গোপন কথা মাকে জানাতে চায়নি, তা বলাই বাহুল্য। একই পরিবারের ছেলে মেয়ে হওয়ার সুবাদে ঐশী, কৃষানু বরাবরই নিজের সমস্যা নিজেই মেটাতে ভালোবাসে…
কিন্তু আজন্মলালিত সংস্কারের বিনাশসাধন কি এতই সহজ। সুশিক্ষিত, অশিক্ষিত হলেও মানুষ যে অনেকক্ষেত্রেই সমাজের নিয়মের কাছে মাথা নত করে বসে, তা বলাই বাহুল্য। তাই পুষে রাখা বিশ্বাসের ঝান্ডা উঁচিয়ে তুলতে তুলতে ফের বলে উঠলেন তিনি,”আজ মেয়েটা বিধবা না হলে এতশত চিন্তা আসতো না আমার! যদি অতনুরও একই দশা হয় তখন? যদি মেয়েটা তখনও বিধবা হয়?”
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা নাছোড়বান্দার মতো ফের একই কথা আওড়াতে থাকলে নিজের অজান্তেই বাসন্তীলতাদেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর নিজেকে সামলে বলে উঠলেন,”অবিনাশ হয়তো মরেনি। তাই মনির জন্য ছেলেটা মরেছে এই কথাটা পুরোপুরি ভুল। ওর ধরাপড়ার খবরটা শুনলে আশা করি তোমার ভুল ভাঙবে? তাছাড়া স্রেফ দুর্ঘটনা ছিল ওটা। গাড়ি পিছলে খাদে পড়ে গিয়েছে। ঠিক যেমন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আমার আঙ্গুলটা কেটেছে।” বলে নিজের হাতটা উঁচিয়ে ধরলেন তিনি।
“অতশত বুঝিনা আমি! কিন্তু যদি দেখি আমার মেয়ের জন্য ছেলেটা প্রাণ হারায়নি, তবেই বিশ্বাস করবো আমি।” ঠাকুরঝির হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন সবিতাদেবী। “নইলে মনির বিয়েতে আমি থাকবোনা। আর অতনুকেও নিজের জামাই হিসেবে মানবো না! অন্য কারোর ক্ষতি হোক আমি চাইনা!”

——-

“কি ব্যাপার। আজ এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলে?” মুঠোফোনটা সশব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতেই তড়িঘড়ি ফোনটা রিসিভ করে বলে উঠলো ঐশী।
ডিজিটাল স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে অতনুর নাম।
“ব্যাঙ্কে যাচ্ছি। ব্যবসার জন্য একটা লোন অ্যাপ্লাই করতে।” ওপ্রান্তে বলে উঠলো অতনু। রিসেন্টলি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করার ইচ্ছে জেগে উঠেছে ওর। সেইমতো নিজের মায়ের নামে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন কোম্পানি খুলতে চলেছে সে।
“কিসের ব্যবসা? আর কতটাকা লোন নিচ্ছো?” অতনুর উদ্দেশে প্রশ্ন করে উঠলো ঐশী।
“একটা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি খুলতে চলেছি মায়ের নামে। কত আর লাগবে! ত্রিশ চল্লিশ লাখ। কিছু রিটায়ার্ড অফিসার থাকবেন আর এজেন্সি হাউস, ব্যাস! অবশ্য আমি একলা ইনভেস্ট করছিনা, পার্টনারশিপে। কিন্তু অত টাকা আমার কাছে নেই এখন, তাই অগত্যা লোন।” একদমে বলে গেলো অতনু।
ওর কথা শুনে বাড়ি বিক্রির টাকাটা মনে পড়ে গেলো ঐশীর। কিছুদিন আগেই ফাইনাল ডিলিং হয়ে গিয়েছে। সমান তিনভাগে ভাগ করার পাশাপাশি ঐশীর হাতেও বেশ কিছু এসেছে।
“আমার কাছে কিছু টাকা আছে অতনু। ধারে নিয়ে নাও। তুমি বেফালতু সুদ গুনতে লোন নিও না।” নিমেষেই পরিকল্পনাটা ছকে নিয়ে বলে উঠলো ঐশী..এই মানুষটাকে সে ভালোবাসে যে!
“কিন্তু আমি কেন নেবো তোমার টাকা? আইমিন..” আমতা আমতা করে বলে উঠলো অতনু।
“কেন? মেল ইগো?” মনের কথাটার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে পাল্টা বলে উঠলো ঐশী। আজকাল যে এতসব রাখঢাক করে রাখেনা, তা বলাই বাহুল্য।
“অন্য বন্ধু হলে অফারটা ফেরাতে পারতে কি?”

“নানা মেল ইগো না!” ঐশীর বক্তব্যকে নস্যাৎ করে বলে উঠলো অতনু। এমন সময় ওর ফোনে অন্য নাম্বার থেকে কল আসায় তড়িঘড়ি বলে উঠলো,”জাস্ট পাঁচ মিনিট, বেগুসরাই থেকে ফোন এসেছে। আমি কথা বলে কলব্যাক করছি।”
লাইনটা ডিসকানেক্ট করে ঐশী বিছানায় বসে পড়লো চুপচাপ। খাটের এককোণে ডাই করে রাখা বিয়ের কেনাকাটি অগোছালো ভাবে পড়ে আছে সেখানে। অতনুর মায়ের ইচ্ছেঅনুসারে বিয়েও এগিয়ে এসেছে কিছুদিন আগে। অন্যদিকে লাবনীও নিজের অন্যায় জিদকে বজায় রাখতে শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসেনি….

ক্রিং ক্রিং,
মুঠোফোনটা কিছুক্ষণ পর বেজে উঠতেই ধীরেসুস্থে কলটা রিসিভ করলো ঐশী। ঘরটা ততক্ষনে গুছিয়ে রাখা হয়ে গিয়েছে।
“হ্যালো ঐশী।’ হাঁফাতে হাঁফাতে অতনু বলে উঠলো এবারে। ওর পুরুষালি কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট উত্তেজনার ছাপ…

” কি হলো?”

“মনু যাদব ধরা পড়েছে…এইমাত্র অফিসার বললেন আমাকে!”

ক্রমশ
© সম্প্রীতি তিতির রায়
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/188107406303024/

আগামী পর্বে চমক থাকছে।
আশা করি ভালো লাগছে সবার, সঙ্গে থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here