#বিধবা_বিবাহ ( একত্রিংশ পর্ব )
“কথা লুকিয়ে যাওয়া কবে শিখলে? এটা তো আমার নেচার ছিল। আমি মনের ভাবনা লুকিয়ে যেতাম তোমার কাছ থেকে।” অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে উত্তর দিলো ঐশী। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা নার্ভাস পুরুষটির মনের গভীরতা ততক্ষণে ধরা পড়ে গিয়েছে তার কাছে। কাজের তাড়নায় যোগাযোগ রাখতে না পারলেও মানুষটি চিন্তা যে তাকে ঘিরেই অবর্তন করে তা বলাই বাহুল্য।
নারীর স্বাভাবিক অনুমান ক্ষমতায় বুঝে গিয়েছে
অরিন্দমের সাথে দেখা করার কারণে অতনুর মনের মধ্যে চেপে বসেছে ভয়। কিন্তু, ভয়টা ভাঙিয়ে দেওয়ার সোজা রাস্তায় হাঁটলো না ঐশী। বরং স্বভাবজাত পছন্দসই টেরা বাঁকা রাস্তাটাই অবলম্বন করল সে।
“কি হল বলো। তুমি জানতে চাওনা অরিন্দমের সাথে আমি কি কথা বলেছি? পার্সোনাল স্পেস তো বুঝলাম! কিন্তু হাতে পায়ে এত কাঁপুনি ধরছিল কেন?”ঐশীর তাড়া খেতেই অতনু এদিক সেদিক চাইল। থানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কর্মচারীদের সকলেই নিজের কাজে ব্যস্ত। ওদের দিকে ওদের লক্ষ্য করছে না সেইভাবে। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গলাটাকে খাদে নামিয়ে অতনু বলে উঠলো “কি কথা হয়েছে ওর সাথে?”
“পথে এসো বাছাধন। পেটের মধ্যে গুড়গুড় ফুসফুস। কিন্তু মুখে…” বলে অসম্পূর্ণ রেখেই চুপ করে গেল ঐশী। তারপর অতনুর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,”অরিন্দম বোধহয় ভাবতে পারেনি বছরের দূরত্ব সরিয়ে ওর সাথে আমি দেখা করতে আসবো। যাই হোক, প্রথমে নিজের ভালবাসার কথা সপাটে বলে দিল। অ্যাস এক্সপেক্টেড।”
“তারপর” সেকেন্ডের ব্যবধানও যেন সহ্য হচ্ছিল না অতনুর। মনটা বারবার জানান দিচ্ছে কলেজে পড়াকালীন তৈরি হওয়া সফট কর্নার এখনো জেগে আছে ঐশির মনমধ্যে।
“আমি ওকে রাখঢাক না করে সত্যিটাই বলে দিলাম। ইনফ্যাচুয়েশন বলো বা সফট কর্ণার, সারা জীবন একসাথে চলার মত উপাদান এটা নয়। ইনফ্যাচুয়েশনে জীবন চলে না। যেখানে সফট কর্ণারটা আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ভালোবাসা এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।” বলে ঐশী তাকালো অতনুর হাতের দিকে। কাঁপাকাঁপি থেমে গিয়ে হাতটা শান্ত হয়ে টেবিলের উপর রাখা আছে তখন।
“তারপর!” একটা মুহূর্তের ব্যবধানও যেন সহ্য হতে চাইছে না অতনুর। কিন্তু নিজের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করা নেহাতই বোকামি…
“অবিনাশের লাশ মনু যাদবের শোয়ার ঘরের মেঝেতে পোঁতা আছে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল ঐশী।
“হোয়াট তুমি কি করে জানলে!” উত্তেজনায় কণ্ঠস্বরটা তীব্রতর হতে চাইলেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিচুস্বরে বলে উঠলো অতনু,”তুমি কি করে জানলে অবিনাশের লাশ মেঝেতে পোঁতা আছে। আই মিন তুমি তো অরিন্দম এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে।”
“অরিন্দমই বলেছে।”ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠল ঐশির। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারটি বুঝতে পারল না মেয়েটার মনের মধ্যে কি পরিমান ঝড় বয়ে চলেছে। হাসিটা যে কষ্ট লুকিয়ে রাখা আছে একটা সূক্ষ্ম প্রয়াস, তাও অধরা রয়ে গেল অতনুর কাছে। প্রত্যুত্তরে ফের প্রশ্ন করার আগেই ঐশী বলে উঠলো “আমরা বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই অরিন্দম বেরিয়ে যায় বেগুসারাই এর উদ্দেশ্যে। ব্রেক জার্নি করে হানিমুনে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল অবিনাশ, ভেবেছিলো দ্বিতীয় গাড়িটা খাদে ফেলে দেবে। দুনিয়ার চোখে ‘ইউজলেস’ মেয়েটা মরে যাবে, তারপর প্রিপ্ল্যান অনুযায়ী ব্যবসায়ে নামাবে আমাকে।”
“কিন্তু তুমি এত ডিটেইলসে খবর পেলে কি করে?” বিস্ময়টা যেন তখনো কাটতে চাইছে না অতনুর। তদন্তের খাতিরেই ঐশীকে সবকিছু জানায়নি সে। কিন্তু ঐশী এত খবর পাচ্ছে কি করে!
“কারণ, অরিন্দমই সব জানিয়েছে আমাকে। নিজের দোষ স্বীকার করেছে অরিন্দম।” অতনুকে প্রচন্ড অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো ঐশী।
“প্রেয়সিকে বাঁচাতে নিজের দাদাকে গাড়ির মধ্যেই মেরে ফেলে দিয়েছে অরিন্দম। ব্রেক জার্নির দ্বিতীয় গাড়িতে বসেছিল মনু যাদব, অরিন্দমের নির্দেশমতো। চলতে চলতে নির্দিষ্ট সময় এলে ব্রেক ফেল হয়ে গিয়েছে বলে চিল্লাতে শুরু করে মনু। আমিও আগুপিছু না ভেবে ঝাঁপ মারি দরজা খুলে। অবিনাশকে মনু সেখানেই মেরে ফেলে। স্বরচিত জালে জড়িয়ে যায় নিজেই।”
“কিন্তু বডিটা..” অতনুর কৌতুহল যেন থামতেই চাইছেনা। কথা বলতে বলতে দম নেওয়ার জন্য খানিক থেমে গেলেও তাড়া দিয়ে উঠছে ফের।
“আমি লাফ দিয়ে নেমে যাওয়ার পর গাড়ি আরো কিছুদূর এগিয়ে যায়। ইতিমধ্যেই প্ল্যানের দফারফা হওয়ার কারণে অবিনাশ রেগে গিয়েছিল। মনুর উপর চড়াও হয় তখন। কিন্তু মনুও সবকিছু প্রিপেয়ার করেই এসেছিল।”
“কিরকম?” অসীম কৌতুহলভরে প্রশ্ন করে ওঠে অতনু। এখনো যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না অরিন্দম মুখ খুলেছে। শত অত্যাচারেও যে মানুষটার মুখ থেকে টু শব্দটা বার হলো না, কোন যাদুমন্ত্রবলে তার মনের গোপন কথা টেনে করে আনছে ঐশী!
“বেইমানিটা ধরে ফেলেছিল অবিনাশ। সাথে থাকা ফল কাটার ছুরিটা প্রায় বসিয়ে দিয়েছিল মনুর শরীরে। কিন্তু মনু তার আগেই…” বলতে বলতে চুপ করে গেল ঐশী। নৃশংস ঘটনাটা অপরের মুখ থেকে শুনলেও যেন চোখে ভেসে উঠেছে তার। গোটা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। নাম-না-জানা অনুভূতিতে ছেয়ে ফেলেছে গোটা মনটা। অবিনাশ তার ক্ষতি করার চেষ্টা করলেও ঐশী কখনই চায়নি এরূপ পরিণতি হোক। সৃষ্টি করা ক্ষমতা নেই যার, কিভাবে ধ্বংস রচনা করতে পারে সে! জীবন মৃত্যুর পাওনাগণ্ডি কি এতটাই তুচ্ছ! যেখানে আবেগ, দুর্বুদ্ধির বশে মানুষ মেরে ফেলে অন্য মানুষকে। উপায় কি কিছুই ছিল না তবে…
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। এমন পরিণতির কথা অতনুও ভাবেনি। ভাবেনি জলজ্যান্ত এক মানুষকে নিজের কর্মফলে প্রানটাকেই হারিয়ে বসতে হবে…
“ধস্তাধস্তির সময়ে মনুর শরীরে আঘাত লাগে। পর্যবেক্ষণ করলে পিঠের বাঁদিকে দাগটা দেখতে পাবে তোমরা।”থেমে থেমে বলে উঠলো ঐশী। “অরিন্দম এটুকুই জানিয়েছে আমাকে। দুজনের মধ্যে কথা হয়েছে এইটুকুই।”
“কিন্তু এতশত কথা তোমাকেই কেন জানালো! আমরা বহুবার কথা বের করার চেষ্টা করেছে ওর পেট দিয়ে, কিন্তু…”অতনু বলার চেষ্টা করেও পুরোটা বলতে পারলোনা, কারণ বক্তব্যের মাঝখানে ঐশী বলে উঠেছে,”ও আমাকে বলেছে কারণ বিশ্বাস রাখে আমার প্রতি। কিন্তু আমি তোমাকে বলে দিলাম অতনু, আবেগের বশে তুমি শাস্তির মেয়াদ কমাবে না। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ তোমার হাতের মুঠোয়। জানি চাইলে অরিন্দমের শাস্তির মেয়াদ কমানো শক্ত কাজ নয়। কিন্তু, ওর ভুলটা বুঝতে হবে…”
“কিরকম?” অতনুর মনের মেঘ ততক্ষনে কেটে গিয়েছে। কি টেনশনেই পড়ে গিয়েছিল ও। ভেবেছিলো আবেগের বশে বিবেককে দূরে ঠেলে দিয়ে ঐশী হয়তো পুরনো ইনফ্যাচুয়েশনের কাছে দুর্বল হয়ে পড়বে। ভুলে যাবে, অতনু কতখানি ভালবাসে ওকে। কিন্তু এহেন উলোটপুরাণে মেয়েটার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল ওর। বুঝতে পারল কলেজের ইনফ্যাচুয়েশন কাটিয়ে আসা মেয়েটি আজ পরিণত। কাঁটা ভরা মাছ বেছে খেতে শিখে গিয়েছে সে… অতনুর মনটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। ভালবাসা হয়তো এটাই। শতমাইল দূরে থেকেও একসঙ্গে থাকা, একদিন যোগাযোগ না রাখেও তার সাথেই থাকা।
“সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট।” অতনুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে উঠলো ঐশী। “স্কুল, কলেজে পড়ার সময় এই শব্দটার সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত ছিলাম। বেঁচে থাকার লড়াই। মনে আছে অতনু?”
“হ্যাঁ, মনে আছে। কিন্তু হঠাৎ এসব বলছ?” ঐশীর কথার খেই না পেয়ে বলে উঠলো অতনু।”সামথিং কিছু একটা থিওরি ছিল।”
“অ্যাবসোলিউটলি রাইট। চার্লস ডারউইনের সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট।” স্মিতহাস্যে মুখটা ভরিয়ে দিয়ে বলে উঠল ঐশী। “সেখানে লেখা ছিল পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলার উপায় রপ্ত করতে হয়। সফলরা টিকে থাকে সংগ্রামে, আর বিফলরা রয়ে যায় কারাগারের পিছনে।”
ঐশীর কথা শুনে চমকে তাকালো অতনু। এত সহজ-সরল ব্যাখ্যা শোনার আশাই করেনি সে। বড্ড অচেনা লাগছে অতিচেনা এই মানুষটাকে। এতটা পরিণত হয়ে উঠল কবে!
“সমস্যা সবার জীবনেই থাকে। কারোর কম, কারোর বেশি। সমস্যার কাছে মাথা নোয়ালে চলে আসে অবসাদ। যার ফলশ্রুতিতে ভিড় জমায় অপরাধ।” অতনুর চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে ঐশী।”সমস্যা তোমার জীবনেও ছিল, আমার জীবনেও ছিল। কলেজ পাশের পর চাকরির চিন্তা, মায়ের শরীর খারাপ, তদন্তের ভার আরো কত কিছু। তবুও দিনরাত এক করে খেটে চলেছো তুমি। ঠিক তেমনই আমার জীবনেও সমস্যা ছিল। ভালোবাসার মানুষ খুঁজতে গিয়ে ঠকে যাওয়া, বিধবার যন্ত্রণা, অফিস প্রেসার সবকিছুই জীবনে এসেছে একে একে। কিন্তু আমরা কেউই সমস্যার কাছে মাথা নোয়াইনি। অবসাদ এলেও মাথায় চড়তে দেইনি তাকে। কখনো ভাবিনি আমরা একলা। নিজেকে সাথে নিয়ে চলতে শিখেছি। কিন্তু অরিন্দম অবসাদকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকে ভালবাসতে ভুলে গিয়েছিল। তাই খাবার, একস্ট্রা ফেসিলিটি দেখেও রিজেক্ট করে দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। হি ইজ নট দ্যা ফিটেস্ট। সেই কারণেই জীবনসংগ্রামে হেরে গিয়েছে সে। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হয়েও ডুবে গিয়েছে অপরাধের চোরাবালিতে। কেন জানো? নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বেরিয়ে গেছিল তার হাত থেকে। অবসাদ নিয়ন্ত্রণ করছিল ওকে।” একদমে কথা বলার পর হাঁপিয়ে উঠেছে ঐশী। কনফিডেন্সে ভরা ওর মুখটা থানায় জ্বলা টিউবলাইটের আলোতেও জ্বলজ্বল করছে। মুগ্ধ দৃষ্টিটা সেখান থেকে সরিয়ে জলের বোতলটা এগিয়ে দিল অতনু। এক ঢোঁক জল খেয়ে ফের বলে উঠলো ঐশী,”আমি কোনো সাইক্রিয়াটিস্ট নই। কিন্তু এটুকু জানি অবিনাশকে আটকানোর উপায় ছিল। না, পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ নয়। কারণ পুলিশকে বলে দিলে নিজের ধরে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেত। কিন্তু ইচ্ছে থাকলে উপায় থাকে।”
“কিরকম?”
“অরিন্দম চাইলে আগেভাগেই দাদার প্ল্যান বলে আমাকে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে পারত। তারপর শিক্ষার জোরে নিজে পাড়ি জমাতে পারতো অন্য কোন শহরে বা দেশে। কিন্তু আটকে গিয়েছিল অবসাদের যাঁতাকলে। মেরে ফেলাটা কোন সমাধান নয় কিন্তু!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে ঐশী। “তোমাকে বলা এই কথাগুলো অরিন্দমকে বলেছি আমি। বিশ্বস্ত মানুষের ভোকাল টনিকের পর নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে সে। ছেলেটা শিক্ষিত, সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে পারবে। হয়তো আমার প্রতি জেগে থাকা বিশ্বাস ওকে উপলব্ধি করাতে পেরেছে কিছুটা। নিয়মিত কাউন্সেলিং চললে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে ও।”
অতনুর বুক থেকে বিশাল বড় বোঝা নেমে গেল। আচমকাই ঐশীকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করলো ওর। কিন্তু সময়, পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখল সে। টোল পড়া গালে ফুটে উঠল হাসির বিন্দু।
“আমি আসি… তোমাদের বাড়ির কেনাকাটাও মনে হচ্ছে আমাকে সামলাতে হবে।” মুখটা বেকিয়ে চেনা ছন্দে বলে উঠল ঐশী।”বিয়ের আগামীকাল, কিন্তু পাত্র থানাতে।”
“আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বিয়েটা করবেই না।” অনুকূল পরিস্থিতি দেখে বেফাঁস মন্তব্যটা করেই ফেললো অতনু। মনের মধ্যে কথা চেপে রাখার ওর স্বভাব নয় যে!
“হ্যাঁ ঠিক বলেছো। পারফেক্ট লাইফ পার্টনার ছেড়ে ফিরে যাব নিজের ইনফ্যাচুয়েশনের কাছে। ছাপানো কার্ডগুলো পুড়িয়ে আগুন পোহাবো। আর নিমন্ত্রিত করা আত্মীয়স্বজনদের কপালে কার্ডপোড়া ছাই দিয়ে টিকা এঁকে দেবো, তাই তো?” দুই চোখে ছদ্ম রাগত ভাব নামিয়ে বলে উঠলো ঐশী। সেই চাহনিতে পুড়তে পুড়তেও হেসে ফেললো অতনু।
“হাসো বা কাঁদো। বিয়ের মন্ডপে এইরকম অাধখোঁচা দাড়িতে ঠাসা মুখ নিয়ে আসলে সোজা ভাগিয়ে দেব। কে বলবে ছেলেটার রাত পোহালেই বিয়ে!” মৃদু ভর্ৎসনা করে বলে উঠলে ইশারায় চুপ করতে বলে অতনু। বহুক্ষণ থানায় থাকার কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজন ইতিমধ্যেই ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অতনুর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল ঐশী। মুখে বলে উঠলো,”অরিন্দম বই পড়তে চেয়েছে। লাইব্রেরীতে বই আছে জানি। কিন্তু বলে দিও এটা আমার তরফ থেকে দেওয়া ওর জন্য উপহার।” বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল থানার বাইরে।
“স্যার। সঙ্গীতা ম্যাডাম ফোন করেছেন। মেঝে খোঁড়ার সরঞ্জাম, লোকজন রেডি হয়ে গিয়েছে। আপনার পারমিশন চাইছে।” হাতে রাখার রিসিভারটা সহকারি কর্মচারী এগিয়ে দিতেই ঘোর কাটল অতনুর। ঐশী বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে, দরজার পাল্লাদুটো খোলা রয়েছে আগের মতো।
“সবকিছু রেডি?” এগিয়ে রাখা রিসিভারটা মুঠোয় নিয়ে বলে উঠল অতনু। “এক কাজ করো, পুরো মোমেন্টটা ক্যামেরায় ক্যাপচার করো। অন্য গ্যাজেটে মোমেন্টটা লাইভ ভিডিও করো আমার সাথে। পুরো ব্যাপারটা আমি চোখের সামনে দেখতে চাই।”
স্যারের বুদ্ধিটা মনে ধরল সঙ্গীতার। কলকাতা থেকে বহুদূরে থাকা এই জায়গায় সশরীরে উপস্থিত হওয়া অতনু পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ভার্চুয়াল পথই ভরসা।
ডিজিটাল স্ক্রিনে মেঝে খোঁড়ার পালা চলছে তখন। নেমে আসা একের পর আঘাতে সদ্যনির্মিত সিমেন্টের মেঝেটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।
“তাড়াতাড়ি হাত চালাও।” স্পিকার থেকে সঙ্গীতার আওয়াজটা ভেসে আসতেই নড়েচড়ে বসল অতনু। গর্ত গভীর হচ্ছে। এমন সময় ইঁট,বালির স্তর পেরিয়ে হাত দিয়ে জমাট মাটি সরাতে শুরু করলো ওরা। পরিশ্রমে হাঁপিয়ে উঠেছে প্রত্যেকেই।
“ম্যাডাম! লাশ!” একজন চিল্লিয়ে উঠতেই চমকে মেঝেতে দাড়িয়ে গেল অতনু। অনুমান সার্থক… মেরে ফেলার পর অরিন্দম, মনু মিলে লাশটাকে ঘরের মেঝেতেই পুঁতে দিয়েছে। এর থেকে আর নিরাপদ জায়গা যে নেই, তা বলাই বাহুল্য। শ্মশান, কবরখানার ঝক্কি নেই। উপরন্তু অখ্যাত, নির্জনে লাশের সদগতি করতে হলে দুর্ভাগ্যগ্যবশত অন্যের নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল…
ইতিমধ্যেই মাটির স্তর সরিয়ে লাশটাকে বের করে রেখেছে মেঝেতে। দুর্গন্ধে সবাই নাকে রুমাল চাপা দিয়েছে।
“স্যার। এই যে লাশ। কিন্তু বোঝা যাচ্ছেনা কার। গলায় একটা চেন, হাতে ঘড়ি রয়েছে ব্যাস। আইডেন্টিফাই কি করে করব।” দেহাবশেষের খুব কাছে ক্যামেরাটা নিয়ে গিয়ে বলে উঠলো সংগীতা।
“ওয়েট ফর এ সেকেন্ড।” বলে ঐশির নম্বরে কানেক্ট করতে করতেও থেমে গেলো অতনু। মেয়েটার নিষ্পাপ মুখ ভেসে উঠছে ওর মানসপটে। কঠোর মনটা চাইছেনা ঐশী এইরূপ অবস্থায় নিজের প্রাক্তন স্বামীকে দেখুক..
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের প্রোফাইলটা লগইন করল অতনু। নিজের একাউন্টে প্রাক্তন স্বামীর সাথে দেওয়া ফটোগুলো আজও মুছতে পারেনি ঐশী। ব্যাপারটা বুকে বাজলেও চিন্তাটা জোর করে ঝেড়ে ফেলল অতনু। পর্দায় ইতিমধ্যে ফুটে উঠেছে অবিনাশ, ঐশির যুগলবন্দির ফটো। স্পষ্ট সেই পটচিত্রে অবিনাশের ঘড়ি, চেন দেখা যাচ্ছে।
“লাশটা অবিনাশেরই কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এইটুকু এভিডেন্সে চিড়ে ভিজবেনা। ফরেনসিকের কাছে পাঠাতে হবে। বডি স্যাম্পেল নিয়ে ওনারাই বলে দেবেন কনফার্ম খবরটা।” সঙ্গীতাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো অতনু,”তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশ আর মনুকে নিয়ে ফিরে এসো। কাল আমি অ্যাবসেন্ট থাকবো।”
“আচ্ছা স্যার।” সম্মতি পাওয়া মাত্র কলটা ডিসকানেক্ট করে দিলো অতনু। হাতে রাখা টাকাটা ঘামে ভিজে গিয়েছে ততক্ষনে। সিসিটিভির ফাঁদে পড়ে যাওয়া অরিন্দমের কাঁদতে থাকা শরীরটা নজরে আসছে। সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রিসিভারটা উঠিয়ে নিল অতনু,”হ্যালো ডাক্তারবাবু…”
ক্রমশ
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/192134275900337/
আশা করি ভালো লাগছে সবার সঙ্গে থাকবেন সবাই।
©সম্প্রীতি রায়