বিন্নি ধানের খই পর্ব-২৩

0
3353

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২৩
#মিদহাদ_আহমদ

*গ্রুপে এড হয়ে তারপর গল্প পড়বেন৷

আসিফ একবার আমার দিকে তাকালো। আরেকবার তার বোনের দিকে। এদিকে মনের ভেতরে আমার জাগ্রত হওয়া শঙ্কা যে কাটছেই না। আসিফ কী করবে এই টাকার? যদি কোন খারাপ পথে সে ব্যয় করে বসে?

আমার ননাস তার স্বামীর হাত থেকে টাকা এনে ধরিয়ে দিলেন আসিফের হাতে। আসিফ না না করে উঠলো। ননাস তার দিকে চোখ ইশারায় বললেন,

‘রাখ’

আসিফ দেখলাম অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো কেমন জানি৷ দুলাভাই আসিফের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেব,

‘শালাবাবু, সংসার করছো, এখন দায়িত্ব নিতে শিখো৷ দায়িত্ব না নিলে পরের জীবন পার করবা কীভাবে? এজন্য তো দায়িত্ব নেয়া শেখা উচিত আগে। তাইনা?’

আসিফ চুপ করে থাকলো। আমার দিকে তাকালো আরেকবার। আমি কেন জানিনা ইশারায় তাকে টাকাটা রাখতে বললাম৷ ননাস তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘খুব খুশি হলাম রে ভাই। খুব খুশি হলাম। তুই এই টাকাটা রেখেছিস ভেবে আমার যারপরনাই ভালো লাগছে। আমি জানি আমার ভাই এখন ঠিক আগের মতো হয়ে উঠবে। দায়িত্ব নিতে জানবে৷ সংসারী হবে৷ জানিস ভাই, সব মেয়েরা স্বপ্ন দেখে একটা নিজস্ব সংসারের। একটা নিজস্ব দুনিয়ার। এই দুনিয়া ছেড়ে কেউ কখনো বাঁচতে পারে না৷ আর এই বাঁচার মানেটাই তো সংসার। দেখ, তোর দুলাভাইকে আঁকড়ে রেখে আমি আমার সংসারের স্বপ্ন দেখেছি। তাকে দেখেই আমি বাঁচতে শিখছি। আজ এত বছর পরও আমাদের কোন সন্তান নেই। কিন্তু…’

দুলাভাই আমার ননাসের মুখের সামনে হাত এনে তাকে চুপ করতে বললো। খেয়াল করলাম দুলাভাইর চোখের কোন ঝাপসা হয়ে আসছে। দুলাভাই বললো,

‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি তানিয়া৷ কখনো এই ভালোবাসার মধ্যে অন্য কোনকিছু যেনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কখনোই না।’

ননাস তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরলো। আসিফ দেখতে লাগলো চোখ ভরে। আর আমি মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে যে, দুজন মানব মানবী তাদের নিজের মতো করে জীবন আবার গড়তে শুরু করেছে৷

বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো। সিলেটে এই বৃষ্টি এই রোদ। একবার সিলেট বাতিঘরে সমরেশ মজুমদার এসেছিলেন৷ আমি আবার ওনার ভক্ত। কালবেলা, কালপুরুষ, উত্তরাধিকার পড়ে কতোবার যে সেই গল্পের চরিত্রে নিজেকে আবিস্কার করেছি আর কল্পনায় বিভোর হয়েছি তার ইয়াত্তা নেই৷ সমরেশ মজুমদারকে দেখার জন্য আমি সেই গ্রাম থেকে সিলেট বাতিঘরে আসি। সামনাসামনি প্রশ্নোত্তর পর্বে ওনাকে জিজ্ঞেস ও করেছিলাম,

‘সিলেটের কোন জিনিস আপনার ভালো লাগে?’

সমরেশ মজুমদার মাইক হাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিলেন, সিলেটের চা বাগান আর বৃষ্টি ওনাকে পুরোপুরি দার্জিলিং দার্জিলিং ফিল দেয়৷ অন্ধকারে নিয়ে এসে আলোয় ছেড়ে দিলে দার্জিলিং এর বাগান আর সিলেটের বাগান দুটোকে গুলিয়ে ফেলবে যে কেউ৷ আর বৃষ্টিও।’

ননাস আসিফকে বললো,

‘আজ শেষ ইফতার। ইফতারে এই ভূণা খিচুড়ি আর ডিম খেয়ে নিও তোমরা। আগামীকাল ঈদ। আর এই এখানে একটা পাঞ্জাবি আর একটা শাড়ি আছে৷ নুপুর, এই শাড়িটা কেমন হয়েছে বলো?’

ননাস আমার হাতে একটা গাঢ় বেগুনি রঙের কাতান শাড়ি তুলে দিলেন৷ কী সুন্দর এর রঙ! একেবারে চোখ জুড়ানো। এমন শাড়ি দেখেছিলাম আমাদের স্কুলের সাগরিকা ম্যাডামের পরনে। ম্যাডামের গায়ে শাড়িটা যা মানাচ্ছিলো না! কপালে কালো টিপ পরে ম্যাডাম যখন আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন, তখন শাড়িটা দেখে দেখেই আমি এক অপার মুগ্ধতায় ভাসছিলাম। আমি হাসিমাখা মুখে বললাম,

‘অনেক সুন্দর হয়েছে আপা। আমি এমন শাড়ি এর আগে কখনোই পরিনি৷ কী মিষ্টি!’

‘তোমার থেকে বেশি মিষ্টি নয় অবশ্যই? আমার ছোট ভাইয়ের বউ যেমন গুণবতী, তেমন রূপবতীও।’

দুলাভাই বললো,

‘কী তানিয়া? এমন কেন বলছো? নজর লেগে যাবে না? দেখো দেখো শালাবাবুও তোমার দিকে চেয়ে আছে। সে মাশাআল্লাহ। কুইক।’

‘বোনের উপর বড় বোনের নজর লাগে বলো? সুন্দর ও সেখানে দোয়ায় পরিনত হয়।’

আমি আমার ননাসের কথায় মুগ্ধ হয়ে উঠলাম। ভেতরে ভেতরে আমার মন জোড়ায়ে বইতে লাগলো খুশির ঝলকানি। তিনি আমাকে নিজের বোন ভাবছেন! আল্লাহ মনে হয় আজ নাহয় কাল, মানুষের চাওয়াগুলো পূর্ণ করে দেন নিশ্চয়ই৷ আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম একটা ঘরকন্নার কাজ করতে। সুন্দর বর, সুন্দর মন, সুন্দর মানুষের সহচার্য পেতে। আল্লাহ হয়তো আমার কিছু চাওয়া পূর্ণ করছেন। কিছু চাওয়া হয়তো স্বপ্নেই থেকে যাচ্ছে। যা হয়তো কখনো পূর্ণতা পাবার নয়৷

কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামলো। এই থমকে থমকে বৃষ্টি আমার পছন্দের না। এক নাগাড়ে যে বৃষ্টি হয় সেই বৃষ্টি এক মোহনীয় গানের সুর বানিয়ে ফেলে। মাটিভেজা গন্ধ বাতাসে ওড়ে। সেই বাতাসের ঘ্রাণ শুকতে মনে কী এক আন্দোলন শুরু হয়! মনে হয় যেনো উপর থেকে আসা স্বর্ণের ঘ্রাণ, ভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশে বাতাসে ছড়াচ্ছে তার প্রেমের আর্তনাদ। মানুষ হয়ে উঠছে মোহনীয়। আয়োজনে প্রেম দাবি করছে যেনো গোটা প্রকৃতি৷ ননাস আর ননাসের স্বামী বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেলো। আসিফ সিগারেট ধরালো একটা। দুলাভাইয়ের এই সিগারেট দেয়াটা আমার পছন্দ হলো না৷ একের পর এক সিগারেট ফুকতে লাগলো আসিফ পাগলের মতো। সন্ধ্যায় ইফতার শেষে সে বেরিয়ে গেলো৷ আমি বাসায় একা একা বসে ছিলাম৷ কোনকিছু ভালো লাগছিলো না দেখে ওড়না মাটিতে বিছিয়ে নামাজ পড়তে বসলাম৷ কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। ভেবেছিলাম আসিফ হবে৷ কিন্তু না। বাড়িওয়ালি এসেছেন৷ এসেই উনি আদেশের সুরে বলতে লাগলেন,

‘তোমার বাসা থেকে জুতার ছাপ একেবারে নিচ পর্যন্ত। টাইলসে যে দাগ পড়লো এগুলো কে পরিস্কার করবে শুনি? নিচে লেখা দেখোনাই যে জুতা পরে সিঁড়িতে উঠা নিষেধ? নাকি এইটা দেখিয়ে দিতে হবে? আর আজ সকালে তুললাম এক ট্যাংকি পানি৷ সন্ধ্যা হতে না হতেই শেষ হয়ে গেলো? তোমরা তো দেখছি বাসার অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়বা। এমন করলে তো চলবে না৷ এমন চলবে না।’

কথাগুলো বলতে বলতে বাড়িওয়ালি মহিলা চলে গেলো৷ আরও কী জানি বললো সে। আমি শুনলাম না৷ দরজা লাগাতেই আবার হাক ছেড়ে জোর গলায় বললো,

‘বাপের দরজা নাকি? এত জোরে লাগাইলা? দরজা ভাঙ্গলে কি কিনে দিবা?’

আমি আর কথাও বললাম না৷ দরজাও খুললাম না৷ মানুষ যেনো এখন কেমন জানি ভয়াবহ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন৷ আমাদের সেই গ্রামে, একজন অন্যজনের ঘরে যাওয়া, একসাথে মিলেমিশে থাকা, সবার কাজে আগ বাড়িয়ে হাত লাগানো, বিকাল হলেই চুলে বিলি দেয়া, সাঁঝ নামার আগে কাচা আম মাখানো কিংবা রোজ রোজ রত্না বুবুর ঘর থেকে জলপাই আচার নিয়ে আসার দিনগুলো কি আর খুঁজে পাবো না? সহজ সরল মানুষের ভীড়ে কি আমি আর আমার চিরচেনা মানুষদের পাবো না? শহুরে মানুষ কেমন জানি জড়তা নিয়ে বাস করে৷ মানুষ মানুষের সাথে মিশে না

আমার মোবাইলে কল এলো৷ জায়নামাজে বসে কল ধরলাম৷ মা কল দিয়েছেন৷ জিজ্ঞেস করলেন কোথায় আছি৷ আমি বললাম,

‘যেখানে থাকার সেখানেই আছি ‘

‘যেখানে থাকার মানে?’

‘যেখানে থাকার মানে যেখানে থাকার সেখানেই৷ কেন কল দিয়েছ? কিছু বলবে?’

‘জামাই কই?’

‘জানি না। বাইরে গিয়েছে।’

মায়ের সাথে কথা বলার মুড আমার আর রইলো না। কল কেটে দিলাম। এরপর মায়ের মোবাইল থেকে আরও কল এলো দুইটা। আমি রিসিভ করলাম না। কেন করবো? মানুষের ভীড়ে এখন কি আর মানুষ পাওয়া যায় দুনিয়ায়?

ইমাম সাহেব মাইকে ঘোষণা করছেন আগামীকাল সকাল ৮ টায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে৷ ঘরে এক বিন্দুও কিছু নেই৷ বাইরে বৃষ্টি হওয়ায় কিছুটা ঠান্ডা ঠান্ডা আবহ কাজ করছে রুমে। আর নাহলে ছাদের গরমে এতক্ষণ অতিষ্ঠ হয়ে যেতাম। রুম ফ্যান ও নেই যে বাতাস দিবে।

রাত বেড়েই চলছে। এদিকে আসিফ আসছে না৷ আমার ভেতরে ভেতরে শঙ্কা বেড়েই চলছে। আসিফ কী তবে আবার মদ খেতে চলে গেলো? আমার শঙ্কা আরও গভীর হলো যখন আসিফকে কল দিলাম। কয়েকবার কল রিং হওয়ার পর সে ধরে বললো,

‘কী হলো? আমার আসতে দেরি হবে।’

‘কোথায় তুমি?’

‘যেখানে থাকার সেখানে।’

আসিফ কল কেটে দিলো। তার গলা শুনে আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না সে কোথায় আছে। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির মতো আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো।

এদিকে তানিয়ার স্বামী তানিয়াকে হেসে হেসে বলছে,

‘তোমার কথামতো এক লাখ দিয়ে এলাম। এবার ঠিকঠাকমতো শালাবাবু নেশা করলেই হয়৷ আর যে মদখোর নেশাবাজ তোমার ভাই, টাকা হাতে এসেছে এখন এসব ছেড়ে কি থাকতে পারবে? পারবে না। এক লাখেও হবে না। তারপর আবার চলে আসবে। খোঁজে টাকা নিবে। আমিও দিবো।’

তানিয়া হেসে হেসে বললো,

‘এছাড়া কি আর কোন উপায় আছে বলো? তাই করতে হবে এবার৷ একে এভাবে শেষ না কর‍তে পারলে আমাদের সব যাবে। সব হাতছাড়া হবে। সব, সব, সব।’

অন্যদিকে আসিফে মা নুপুরের মাকে কল করে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আমি যেমন বলেছিলাম আপনি তেমন করেছেন তো বেয়ান? জানি নুপুর আপনাকে খারাপ ভাববে৷ আসিফও আমাকে খারাপ ভাবছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। যে ছেলেকে ঘরে রেখে আমি ঠিক করতে পারিনি, আজ সেই ছেলেকেই আমার নিজ হাতে নিজ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছি শুধুমাত্র ভালোর রাস্তায় আনানোর জন্য। দুজনের সংগ্রামের জীবন হয়তো তাদেরকে নতুন এক জীবন দিয়ে দিবে। আমার একমাত্র ছেলের জীবন এভাবে নেশায়, মদে, নারীতে কাটুক এইটা মা হয়ে আমি আর দেখতে পারছি না। আজ যদি এমন না করতাম আমি, তাহলে হয়তো তার বোধশক্তি জাগ্রত হতো না। সে সংসারী হোক, বুঝুক সবকিছু এইটাই আমি চাই।’

‘হ্যাঁ বেয়ান। এজন্য আমিও তাদের এখানে থাকতে দেইনি। আপনার বলা মতোই তাদেরকে ইচ্ছা করেই চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছি৷ জানি না ছেলেমেয়ে দুটো কেমন আছে এখন। আমার মন কেমন করছে যেনো তাদের জন্য’

‘কোন চিন্তা করবেন না। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন৷ আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাথে আছেন। তাদেরকে সাহায্য করবেন। তাদের পথ দেখাবেন৷ আচ্ছা বেয়ান আমি রাখি এখন।’

‘আচ্ছা। আসসালামুয়ালাইকুম’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’

তানিয়ার স্বামী তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

‘সব সম্পত্তি তোমার নামে হবে তো?’

‘আরে ছেলেই যখন থাকবে না তখন আমার ই তো হবে। আর বাকি থাকলো তামান্না। দেখি তার সাথে কী করা যায়৷ তুমি আমাকে কিছু সময় দাও। সময়ের কাজ সময়েই করবো। আসিফ নেশা করবে তো আবার?’

‘কেন নয়? এজন্যই তো টাকা দিলাম তাকে। আর সিগারেটের ভেতরেও গাঁজা ভরে দিয়েছি মিক্সড করে৷ যা চড়বে না একদম!’

স্বামী স্ত্রী পাষাণের মতো একে অন্যের গায়ে পড়ে হাসাহাসি করতে লাগলো।

রাত একটা হয়ে গেলেও আসিফের আসার কোন নাম নেই। হয়তো কোন বারে পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে। আমার মন বারেবারে ভেঙ্গে যেতে যেতে এখন কেমন জানি অসার হয়ে উঠেছে৷ অনুভূতি বলে কোনকিছু আর অবশিষ্ট রইলো না আমার।

[আজকের পর্বে ৩ হাজার লাইক আশা করছি। পড়ে লাইক কমেন্ট করে যাবেন। এতে গল্প এবং গ্রুপ দুটোর রিচ বাড়ে। রিচ বাড়া মানে অনেক পাঠক পর্যন্ত গল্পটা পৌঁছা। আর লেখক হিসাবে আমার গল্প অনেকেই পড়ুক একটা আমার সহজাত চাওয়া। এই চাওয়াটুকু পূর্ণ করতে আপনারা পাশে থাকা চাই]

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here