বিন্নি ধানের খই পর্ব-৪৭

0
1958

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৭
#মিদহাদ_আহমদ

আসিফ ছাড়া আমরা সবাই তামান্নার বাড়িতে গেলাম তামান্নার স্বামী রাজীবকে বিদায় দেয়ার জন্য৷ গাড়ি থামতেই রাজীবের মা এসে শাশুড়িকে হাস্যরসে বলে বসলেন,

‘জামাই যাওয়ার সময় এলেন বেয়াইন। এতদিন আর এসে দেখলেন না একবারও।’

‘হা হা৷ কী যে বলেন! আসা শুরু করলে আর পরে বন্ধই হবে না।’

‘না না। বুঝতে পেরেছি। মেয়ে একটা নিয়ে কত ঝামেলা, কত কাহিনি। সবকিছু বুঝতে পেরেছি বেয়াইন। এমন অভাগা মেয়ে যার কপালে জুটে সেই বুঝে। আমাদের কাজের মেয়ে যে কুলসুমা, ওর মেয়েরও দুই দুইবার জামাই তালাক হয়েছে৷ প্রতিদিন এসে বিলাপ করে আমাদের বাড়িতে।’

আমি একবার ননাসের দিকে তাকালাম। ননাসের মুখটা একেবারে ছোট হয়ে গিয়েছে দেখলাম। তামান্নার শাশুড়ি আবার বললেন,

‘তা খাবার দাবাড়ের গাড়ি কই? পেছনে বুঝি?’

‘আরে না বেয়াইন। আপনি তো আর হাতি না৷ আপনি আমার মতোই পিঁপড়া। তাই এই গাড়ির ভ্যানে করেই এনেছি। পিঁপড়ার জন্য হাড়ির জল সমুদ্র সমান। আপনি হাতি হলে সুরমা নদী তুলে নিয়ে আসতাম।’

কথাটা শ্বশুর বলতে বলতে এক গাল হেসে দিলেন। তামান্না বাইরে এলো৷ আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলো৷ তামান্নার ননাস নাস্তা এনে দিলো৷ ট্যাংক তুলে দিলো একে একে আমাদের সবার হাতে। আমার ননাসের হাতে ট্যাংক তুলে দেয়ার সময় বললো,

‘ওরে আল্লাহ! একী! তুমি এখনও হাতে চুড়ি পরছো? এগুলা তো বিয়াইত্তা বেটিদের নিশানা। তোমার তো ডিভোর্স হয়েছে শুনলাম। এখন নিশিবালাদের মতো হাতে চুড়ি পরবা নাকি? কেমন দেখায় না?’

আমার রাগে কেমন যেনো কড়মড় করতে লাগলো৷ তামান্নার স্বামী রাজীব সামনেই ছিলো৷ সে এসে বললো,

‘আপা তুমিও না! কিচ্ছু মনে করবেন না আপা এসব মজা করছেন। আমাদের সাথে কত মজা যে করেন! আমাদের সেঝো আপা আমাদের বংশের মাঝে সবার কাছে এই মজার জন্য প্রসিদ্ধ।’

আমি থেমে গেলাম৷ খেয়াল করলাম রাজীব তার বোনকে চোখ ইশারায় চুপ করতে বলছে। বুঝতে বাকি রইলো না যে রাজীব কেন এসব বলেছে। বোনকে বন্ধ করাতেই এসব বলা। একদিক দিয়ে ভালো লাগলো যে যাক, যার সাথে আমাদের সম্পর্ক সে হয়তো বুঝতে পেরেছে৷ আর এরচেয়ে বড় কোন পাওনা আমাদের হতে পারে না ৷ আমি শাশুড়ির দিকে তাকালাম। শাশুড়ি চোখ ইশারায় তথমথ খাওয়ার অবস্থা৷ ননাসের চোখ দুইটা ছলছল করছে৷ শুধু চোখ টপকে অশ্রুকণা বের হতে পারছে না এই যা। আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো৷

দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসেছি আমরা৷ টেবিলে নানা পদের খাবার সাজানো। তামান্নার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে মাছভাজা তুলে দিতে দিতে বললেন,

‘বেয়াই এইটা আমাদের পুকুরের মাছ। ভালো লাগবে খেয়ে৷ একেবারে তাজা। বিয়েতে যে আপনারা মাছ খাইয়েছিলেন, উফ! কী গন্ধ ছিলো! আমি বাপু খেতেই পারিনি। আমাদের এখানে এসে সবাই বদনাম করেছে শেষে। আপনি এই মাছটা খান।’

টেবিলের পাশে ওভেন কেবিনেটের উপর তানিয়া আপার বানানো কেক রাখা। তামান্না জিজ্ঞেস করলো,

‘আপা এইটা তোমার বেকিং করা কেক?’

আমি বুঝতে পারলাম জেনেও তামান্না এইটা জিজ্ঞেস করছে কারণ সে চাচ্ছে তার বোনের অপ্রস্তুত ভাবাপন্ন সময়টা দূর করতে।

ননাস তখন আগ্রহভরে তামান্নাকে বললো,

‘হ্যাঁ। জানিস এইটার উপরের ফর্মিং করতে কত যে সময় লেগেছে আমার! দুইটা কেক টাইমিং ওলট পালট হওয়ায় আর ওভেন আগেই হিটে দেয়ায় জ্বলে গিয়েছে। এইটা হতে হতে ভোর প্রায়৷ আজান দেয়নি এই যা।’

তামান্না তার বোনকে জড়িয়ে ধরলো৷ তারপর কেকটা টেবিলে এনে কেটে যেই না মুখে দিবে ওমনি তামান্নার শাশুড়ি বললেন,

‘বউমা দুইদিন পর তুমি পোয়াতি হবা। আর এমন মেয়ের বানানো কেক খেয়ে আমি তোমার সংসার ভাঙ্গাতে চাই না৷ এখন এসব খাওয়ার সময় না। সবকিছু ভেবেচিন্তে করতে হয়। হুটহাট করে ফেললাম আর হয়ে গেলো জীবন এতো সহজ নয়৷ তোমাকে আর কত বুঝাবো? নুহাসের বউকে দেখেছো? পর্শুদিন ই তো নিয়ে গিয়েছি৷ দেখেছো শহরের মেয়ে হলেও কলসি ভরে ধান চাল দিয়েছে? উগারে যে ধান ফেলতে হয়, এইটা সেই যুগের হওয়া লাগে না৷ এই যুগের হলেও জানা যায়।’

আমি আর মুখ বন্ধ করতে পারলাম না৷ উঠে গিয়ে কেকটা কাটলাম৷ একপিস মুখে পুড়ে তামান্নার শাশুড়িকে বললাম,

‘খালা আমারও নতুন বিয়ে হয়েছে৷ আমি খেয়ে নিলাম এক পিস৷ তারপর দেখি কী হয়। আমার আবার এসব ঘর করা, সংসার করা ভালো লাগে না। সব কেমন জানি বন্দি বন্দি লাগে।’

তারপর আবার বললাম,

‘আহা! আহা! বাহাত খুব৷ কী দারুণ স্বাদ! আমি এই কেকটা গাড়িতে রেখে আসি কেমন? আপনারা তো খাবেন না৷ তারচেয়ে আমার ননাসের বানানো কেক আমি ফ্রিজে রেখে একা একাই খাবো৷ আমার শ্বশুর শাশুড়ি দুজনেরই ডায়াবেটিস৷ সব একা আমাকেই খেতে হবে ‘

পুরো মহল তখন থ বনে গেলো৷ রাজীব খেয়াল করলাম উঠে গেলো টেবিল থেকে। মুখে কিছু বললো না। রাজিবের বোন আর মায়েদের চোখেমুখে তাকানো যাচ্ছে না যেন৷

খাওয়া শেষে তামান্নাকে নিয়ে তার রুমে গেলাম। তামান্নার সে কী কান্না! তামান্নার সব কথার শেষে শান্তি পেলাম সেখানেই যখন তামান্না বললো রাজীব তাকে বুঝে৷ রাজীবের দিক দিয়ে সে সেটিসফাইড আছে। আমি যেনো মরুতে এক পশলা বৃষ্টির মতো প্রশান্তি খুঁজে পেলাম। মানুষের জীবন সঙ্গী যদি জীবনের সাথে মিলে যায়, নারী জীবনের জন্য এরচেয়ে খুশির আর ভাগ্যের কিছু হতে পারে না। তামান্নাকে বললাম বুঝিয়ে যে এসব যেনো মা জানতে না পারেন৷ শত কষ্ট হলেও মানিয়ে নিতে নিজেকে। আজ দুঃখ আছে, কাল এই দুঃখের শেষে পুরো সংসার তার হবে৷ তামান্না আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করলো৷ আমিও তাকে থামালাম না৷ কান্না করলে ভেতরে জমে থাকা কষ্ট হালকা হয়৷ মেয়েটার এখন আর কে আছে যার কাছে গিয়ে এভাবে কান্না করবে!

বিকালেই আমরা গাড়িতে করে বাসায় ব্যাক করলাম। ননাস একেভারে দন্ডায়মান দন্ডের মতো শক্ত হয়ে আছে। শাশুড়ি বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

‘এজন্যই বলেছিলাম তাকে না নিতে। আল্লাহ আমাকে কেন এই দিন দেখাচ্ছেন আল্লাহ জানেন৷ আমার কোন জন্মের পাপের সাজা আল্লাহ আমাকে দিচ্ছেন। আমি কার কোন ক্ষতি করলাম।’

শাশুড়ি এসব বলায় আমি ভিমড়ি খেয়ে বসলাম। ননাস যে জায়গায় নিজের কষ্ট নিজের কাছে জমা রেখে আড়াল করতে চাচ্ছে, সে জায়গায় কেন তিনি এখন এসব বলছেন! ননাস এবারও কোন কথা বললেন না। ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন৷ আমি ননাসের সাথে উপরে যাবো এর আগে শ্বশুর ডেকে বললেন,

‘বউমা মাথায় বড্ড ধরেছে৷ কাজের মেয়েদের হাতের চা আমার খেলে পোষাবে না। তুমি যদি এক কাপ..’

‘না না বাবা৷ আপনি বসেন৷ আমি এক্ষুণি আপনার জন্য চা বানিয়ে আনছি ‘

আমার গন্তব্য রুমে না হয়ে রান্নাঘরে হয়ে গেলো। শ্বশুরের জন্য চা বানাতে গেলাম। শাশুড়ি পাশে এসে দাঁড়ালেন। আহাজারি করতে করতে বললেন,

‘বলেছিলাম না তাকে নিয়ে গেলে সমস্যা হবে? দেখেছো?’

আমি শাশুড়িকে চেয়ারে বসালাম। বসিয়ে বুঝিয়ে বললাম, এখন এই বিষয়টা আমরা যতো চেপে যেতে পারবো ততোই ভালো। কিন্তু যদি আমরা এই বিষয় নিয়ে কথা বলি তাহলে আপার কষ্টটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে৷ ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাওয়া মানুষটা একেবারে বাঁচতে বাঁচতে মরে যাবে।

শাশুড়ি মা আমার কথাগুলো বুঝলেন কিনা বুঝতে পারলাম না৷

এদিকে রুমে এসে দরজা লাগালো তানিয়া। টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ আর কলম এনে কাগজের মধ্যে লেখলো,

‘আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও বাবা মা। তোমাদের মেয়ে হয়ে তোমাদের সম্মানের কারণ না হয়ে তোমাদের অপমানের কারণ হতে হয়েছে আমাকে। মেয়ে হিসাবে এরচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর আমার হতে পারে না। সব দুঃখ বলা যায় না৷ কিছু দুঃখ মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর হয়তো আমাকে লাশকাটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে৷ জীবনানন্দের কবিতাটা হয়তো ভেসে উঠে ধ্বনিত হবে,

“লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেলো তারে…”

সবকিছু হারিয়ে একটু একটু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিলাম এই কয়দিন। কিন্তু না৷ পারলাম না৷ অনেক চেষ্টা করেছি। চেষ্টায় আমার কোন কমতি ছিলো না৷ হয়তো দুনিয়া আমাকে পারতে দিলো না। আর যতদিন বেঁচে থাকবো দুনিয়া আমাকে বাঁচতে দিবে না। এরচেয়ে ভালো আমিই দুনিয়া ছেড়ে দেই৷ এতে করে সবাই ভালো থাকবে। নুপুর, যখন আমার এই লেখাটা সবাই পড়ছে, আমি জানি তুমিও সবার সাথে কান্না করছো বসে বসে। হয়তো বলছো আমাকে অভয় দিয়ে, আমি কেন এই কাজটা করলাম। তোমার সামনে গিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার মুখ আমার নেই। হয়তো কোনদিন আমার ভাই কোন একটা ভালো কাজ করেছিলো। সেই ভালো কাজের ফল হিসাবে উপরওয়ালা তোমাকে আমার ভাইয়ের জীবনের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। একজন উপযুক্ত জীবনসঙ্গী পাওয়া যে জীবনের জন্য কতবড় আশীর্বাদ তা শুধুমাত্র সঙ্গীহীনারাই অনুধাবন করতে পারছে৷ কতকিছু করেছি তোমার সাথে। ভাবতেও আমার লজ্জা করছে৷ আর এই লজ্জা নিয়ে আমি তোমার সামনে দাঁড়াতে পারবো না। আমার এই দুর্বলতা তাই লিখে প্রকাশ করলাম। আমার এতকিছুর বিনিময়ে শুধু তোমার ভালোবাসা ছাড়া, একটুও ঘৃণা আমি পাইনি। কারো কাছে আমার কোন আফসোস নেই, আবদার নেই, ঘৃণা নেই, দাবিও নেই। তবে যে পাপ আমি করেছি, সেই পাপ আমাকে পরকালে শাস্তি দিবে। এও জানি, এখন যে পাপ করতে যাচ্ছি এই পাপের কারণে আমার স্থান জাহান্নামে হবে। তবে তোমরা কি জানো, দুনিয়ায় মরে মরে বাঁচার নাম আসলেই জাহান্নাম?’.

তাতের ওড়না ফ্যানের সাথে প্যাচিয়ে দিলো তানিয়া। এই ওড়নাটা ওর খুব প্রিয়৷ এষ কালারের মাঝে ফিরোজা রঙের ছোঁয়া। একেবারে নিসর্গ যেনো তার সবকিছু ঢেলে দিয়েছে এর মাঝে! ড্রেসের সাথে মিলিয়ে যখন তানিয়া এই ওড়নাটা গায়ে জড়াতো, বদরুল তখন বলতো, ‘তোমাকে আবার বিয়ে দেওয়া যাবে। একেবারে লাল টুকটুক বউয়ের মতো লাগছে’
গতবার বদরুলের সাথে যখন মানালি গিয়েছিলো, তখন এই ওড়নাটা এনেছে তানিয়া৷ তার চোখের সামনে ভাসছে মানালির উঁচুনিচু রাস্তা৷ হিমাচল প্রদেশের সব ঠান্ডা যেনো তাকে ভর করে আছে এই মুহূর্তে। কাশ্মীরি মেয়েদের বিড়াল চোখ যেনো মোহিত করে রেখেছে এক পশলা। ভারতের সবচাইতে এডভেঞ্চার ওয়ালা ট্রিপ ছিলো মানালির রাস্তায় রাস্তায় বাস দিয়ে ঘুরা। ড্রেসিং টেবিলের সাথের ছোট চেয়ারটা খাটের উপর তুললো তানিয়া৷ দাঁড়িয়ে গেলো চেয়ারের উপর। ফাস লাগালো গলায়। একবার উপরের দিকে তাকালো। আরেকবার জানালার দিকে চেয়ে আকাশ দেখলো। গলা বরাবর ওড়না এনে ঝুলে গেলো ওড়নায়। ফেলে দিলো টুলটা। ঘনঘটা অন্ধকার ছেয়ে গেলো চোখের সামনে। এ যেনো এক নতুন বিভীষিকা।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here