বিবর্ণ জলধর পর্ব:০৩

0
1470

#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৩
______________

কয়েকদিন কবির সাহেবের বাড়িতে খুব ঝামেলা চললো। শ্রাবণ কিছুতেই বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরেছে। কবির সাহেবও কম যান না। তিনিও শ্রাবণকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এ বিয়ে করতেই হবে তাকে। যদি এই বিয়ে না করে, তাহলে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। কোম্পানি থেকেও চাকরিচ্যুত করবেন। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার সময় একটা টাকা দেবেন না সাথে। ভিখারির মতো বেরিয়ে যেতে হবে বাড়ি থেকে।
শ্রাবণ নিজের বাবাকে খুব ভালো করে চেনে। বাবা যা বলেছে সেটা করার ক্ষমতা সে রাখে। এমনটা করা তার কাছে কোনো কঠিন ব্যাপার না। বাবার দেওয়া এসব হুমকি-ধামকির পর শ্রাবণ একটু দমেছে। তবে একেবারে না। মনে মনে তার বিদ্রোহ চলছে। রুমকি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না সে। রুমকি এখনও জানে না বাড়িতে শ্রাবণের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। শ্রাবণ এটা জানানোর সাহস পায়নি।
তাছাড়া কবির সাহেব জানিয়ে দিয়েছেন, রুমকির কানে যেন এ ব্যাপারে কিছু না যায়। রুমকি সেয়ানা মেয়ে। কবির সাহেব ছেলের বিয়েতে কোনো ঝামেলা চান না। যে ঝামেলা টাকা দিয়ে মিটিয়ে দিয়েছে, সে ঝামেলা উল্টো করে ঘুরে আবার ফিরে আসবে, এটা সে বরদাস্ত করবেন না। রুমকির ভূত অতি শীঘ্রই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হুকুম দিয়েছেন তিনি শ্রাবণকে।
শ্রাবণের জন্য পাত্রী ঠিক করার ব্যাপারটি সম্পন্ন হয়েছে। লায়লা খানম নিজে পছন্দ করেছেন মেয়েকে। কবির সাহেবকে বলার পর তিনিও অমত করেননি। বরংচ তার খুব পছন্দ হয়েছে এই সম্বন্ধ। পাত্রী ভালো। নম্র, ভদ্র। দেখতেও রূপসী। শ্রাবণের সাথে মানাবে খুব। মেয়েটার সাথে লায়লা খানমের ভালো সম্পর্ক। পাশের বাড়িতে থাকার কারণে মেয়েটার অনেক আসা যাওয়া হয়েছে তাদের বাড়িতে। মেয়েটার কথাবার্তা, চাল-চলন, আচার-আচরণ দেখে এ মেয়েকেই শ্রাবণের উপযুক্ত হিসেবে মনে হয়েছে তার। মেয়ে খুব পছন্দের লায়লার। প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিনই বেশ মনে ধরেছিল মেয়েটাকে। ছেলের বউ করে আনবেন এমনটা মনে আসেনি তখন। কিন্তু ছেলের বিয়ে নিয়ে কথা ওঠার পর এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা উদয় হলো। চিন্তা ভাবনা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। মিহিকের সাথেই বিয়ে দেবেন শ্রাবণের। মিহিকের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাবও রেখেছেন ইতোমধ্যে। তার বিশ্বাস, এই প্রস্তাবে সম্মতি পাবেন তিনি।
কিন্তু তার ধারণা কিঞ্চিৎ ভুল। কারণ, যার সাথে ছেলের বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করেছে, সেই মেয়েই বেঁকে বসেছে। মিহিক বিয়ে করতে চায় না শ্রাবণকে।

______________

মিহিক শ্রাবণের সাথে বিয়ের কথাটা শুনেই মা-বাবাকে বললো,
“কী? ওই পাগল শ্রাবণকে বিয়ে করবো আমি? তোমাদের কি মাথা খারাপ? যে ছেলে কিছুদিন আগে একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিয়েছে, বিয়েতে উপস্থিত এত এত মানুষের সামনে চিৎকার করে বলেছে সে রুমকিকে ভালোবাসে, রুমকির সাথে তার তিন বছরের প্রেম, তার সাথে কোন হিসেবে আমার বিয়ে দিতে চাইছো তোমরা? তোমাদের মাথা কি আসলেই খারাপ হয়ে গেছে?”

হাফিজা বললেন,
“রুমকি মেয়েটার সাথে শ্রাবণের কোনো প্রেম ছিল না, সেটা তো তুই নিজেই শুনেছিস। শ্রাবণ…”

“প্রেম ছিল, কি ছিল না সেটা তো মুখ্য বিষয় না। মুখ্য বিষয় হলো ওই শ্রাবণ। যে ছেলে একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিয়েছে, লোক সমাজে চিৎকার করে নিজের ভালোবাসার কথা বলেছে, সে ছেলে একটা অসভ্য, অভদ্র ছাড়া আর কী? আর তার চয়েজের প্রশংসাও তো না করে পারা যায় না। রুমকির মতো একটা লোভী, বাজে মেয়েকে তার পছন্দ। ছি! যেমন সে, আর তেমনি তার পছন্দ! এরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করা ইম্পসিবল!”

ইদ্রিস খান বললেন,
“কবির ভাই, লায়লা ভাবি নিজ থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাদের না করে দিই কী করে? শ্রাবণ ভালো ছেলে। কোনোদিন মাথা তুলে কথা বলেনি আমাদের সাথে। দেখা হলে ভদ্র ভাবে কত আন্তরিক হয়ে কথা বলে। রাস্তা-ঘাটেও কখনও কোনো বেয়াদবি করতে দেখিনি। কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেছে, ঘোরাঘুরি করেছে এমনটাও নজরে পড়েনি। হ্যাঁ, এটা সত্য যে রুমকির বিয়েতে ও একটা ঝামেলা করেছে। কবির ভাইদের ধারণা শ্রাবণের মাথায় সাময়িক একটু গন্ডগোল দেখা দিয়েছে, যার জন্য অমন করেছিল। আমাদেরও তাই মনে হয়। তা না হলে শ্রাবণের মতো একটা ছেলে ওরকম করতে পারে না। সাময়িক প্রবলেম এটা। বিয়ের পর এসব ঠিক হয়ে যাবে।”

“কী ধরণের কথা বলছো বাবা? তুমি কি চাইছো ওই মাথা খারাপ ছেলেকে আমি সত্যিই বিয়ে করি?”

“বিয়ে করতে ক্ষতি কী?” হাফিজা বলে উঠলেন।
“কত বড়ো লোক ঘরের ছেলে। ছেলের মা-বাবা কত ভালো। এত বড়োলোক হওয়ার পরেও কোনো অহংকার নেই তাদের। সবার সাথে কত আন্তরিক তারা। এমন মানুষ আজকাল কম দেখা যায়।
শ্রাবণের ফ্যামিলি তো দেখেছিস। ফ্যামিলির একটা মানুষও কি খারাপ? বলতে পারবি এমনটা? কবির ভাইদের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, এটা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। সবার এই সৌভাগ্য থাকে না। ও ঘরে বিয়ে হলে অনেক সুখে শান্তিতে থাকবি। ধনী পরিবার, শ্বশুর-শাশুড়ি ভালো। একটা মাত্র ছোট ননদ। দেবর যেটা আছে সেটা তো দেশে থাকে না। সব মিলিয়ে খুব ভালো থাকবি তুই।”

“ধনী, একটা মাত্র ছোট ননদ, শ্বশুর-শাশুড়ি ভালো, সেসব তো বুঝলাম। কিন্তু মেইন কথা হলো আমি যাকে বিয়ে করবো সেই তো ভালো না। যেখানে হাসব্যান্ডই ভালো না, সেখানে আমি ভালো শ্বশুর-শাশুড়ি দিয়ে কী করবো? কতটা ভালো থাকবো?”

“শ্রাবণকে খারাপ ছেলে ভাবছিস? ও তো খারাপ না। দুই বছর ধরে দেখছিস ছেলেটাকে। কখনও কোনো খারাপ আচরণ করেছে তোর সাথে? খারাপ চোখে তাকিয়েছে কোনোদিন? কারো কাছ থেকে কখনো কোনো খারাপ কথা শুনেছিস ওর সম্পর্কে?”

মায়ের কথায় মিহিক একটু মুষিয়ে পড়লো। শ্রাবণ কখনও খারাপ চোখে তাকায়নি ওর দিকে, খারাপ আচরণ তো দূরের থাক। কখনও কোনো খারাপ কথাও শোনেনি তার সম্পর্কে। মিহিক বললো,
“না, খারাপ আচরণ করেনি, খারাপ চোখেও তাকায়নি। আর খারাপ কিছু শুনিওনি তার ব্যাপারে। কিন্তু ওটা তো তার বাইরের বৈশিষ্ট্য। তার ভিতরে কী আছে সেটা কী করে জানবো? ভিতরের বৈশিষ্ট্য যা একটু প্রকাশ করেছে, তাতে বোঝা যায় সে একটা অভদ্র। তার ভিতরে রুমকির বসবাস। যে ছেলের ভিতরে অন্য একটা মেয়ে বাসা বেঁধে আছে, তার সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে চাও কোন আক্কেলে?”

“বোঝার চেষ্টা কর মিহিক। শ্রাবণরা উচ্চবিত্ত ফ্যামিলি। তারা নিজ থেকে তোকে বউ করে নিতে চাইছে। অনেক আন্তরিক ভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। লায়লা ভাবির তো তোকে অনেক পছন্দ। এই বিয়ের প্রস্তাব যদি আমরা এখন ফিরিয়ে দিই, তাহলে কেমন হবে বুঝতে পারছিস? তাদের তো মনোক্ষুণ্ন হবে আমাদের উপর। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কও আর আগের মতো থাকবে না। তোর বাবা শ্রাবণদের অফিসে চাকরি করে। অফিসেও তোর বাবাকে কত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে চাকরির ক্ষেত্রেও একটা জড়তা সৃষ্টি হবে। তোর বাবা হয়তো ওই কোম্পানিতে চাকরিই করতে পারবে না আর। তুই কি বুঝতে পারছিস না? কবির ভাইয়েরা তো জীবনেও রুমকিকে বাড়ির বউ করে ঘরে তুলবে না। তোকে তাদের খুব পছন্দ। ছেলের মা-বাবা পছন্দ করে তোকে ছেলের বউ করছে। তাদের কাছে কতটা আদর যত্নে থাকবি ভেবে দেখেছিস?”

হাফিজার কথায় মিহিক দমতে গিয়েও দমলো না। হার না মানা গলায় বললো,
“কিন্তু স্বামী? স্বামীকে কী করবে? সে তো রুমকিকে ভালোবাসে…”

মিহিক আর কিছু বলার আগেই ইদ্রিস খান মেয়ের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,
“বললাম না, ওটা একটা সাময়িক গন্ডগোল। বিয়ের পর ওসব থাকবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“সব ফ্যামিলিরাই বিয়ের আগে বলে এটা। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কিছুই ঠিক হয় না।”
মিহিক উপরে কাঠ গলায় এটা বললেও, মনে মনে দ্বিধায় ভেঙে পড়লো। যদি এ বিয়ে না হয়, তাহলে কি লায়লা আন্টিদের সাথে তার ফ্যামিলির সম্পর্ক ক্ষুণ্ন হবে?

______________

মৃদু মন্দ হাওয়ায় হাস্নাহেনা ফুলগুলো দুলে দুলে উঠছে। বারান্দায় এই একটি মাত্র ফুল গাছই আছে। গাছটি নোয়ানার লাগানো। মিহিক হাত বাড়িয়ে একটা দুটো ফুল ছিঁড়ছে। মিহিকের সামনে ভ্রু কুঞ্চিত করে চেয়ে আছে নোয়ানা, তিন্নি। মিহিকের সাথে শ্রাবণের বিয়ের প্রস্তাব এসেছে এটা তারা জানতো না। বাড়ি ফেরার পর জেনেছে। মিহিককে জানালো হয়েছিল আজ সকালে। আর তারা দু বোন জানলো সন্ধ্যায়।
মিহিক অনেকক্ষণ নীরব থেকে বোনদের উদ্দেশ্যে বললো,
“আমার কী করা উচিত বলতো? পাগল শ্রাবণকে বিয়ে করা কি উচিত হবে?”

তিন্নি জোর দিয়ে বলে উঠলো,
“আলবদ উচিত হবে। কত উচ্চ ঘরে বউ হয়ে যাবে বলো তো? এটাও তো একটা সম্মানের ব্যাপার। আর সেদিন তোমার কথার খেই ধরে ওই কথা বলেছিলাম। কিন্তু শ্রাবণ ভাই আসলেই ভদ্র মানুষ। অভদ্র নয়।”

মিহিক বিরক্ত নজরে তাকালো তিন্নির দিকে। কণ্ঠে বিরক্ত মিশিয়ে বললো,
“উচ্চ ঘর ধুয়ে ধুয়ে কি আমি পানি খাবো? শ্রাবণকে বিয়ে করা আমার চরম ভুল হবে আসলে। শ্রাবণকে বিয়ে করলে পরে আমাকে আফসোস করতে হবে, পস্তাতে হবে!”

নোয়ানা বললো,
“ধুর আপু! এমন কেন ভাবছো তুমি? আমার তো তা মোটেই মনে হয় না। শ্রাবণ ভাইয়ার সাথে খুব ভালো থাকবে তুমি। শ্রাবণ ভাইয়া এবং তোমাকে খুব ভালো মানাবেও।”

মিহিক অপদ দৃষ্টি জোড়া নোয়ানার উপর ফেলে বললো,
“শ্রাবণকে পছন্দ করিস, তারপরও এই কথা বলছিস? তোর পছন্দের মানুষের সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে। অথচ তুই সেই আমাকেই বুঝ দিচ্ছিস তাকে বিয়ে করার জন্য?”

হঠাৎ মিহিকের এই কথায় নোয়ানা হকচকিয়ে গেল। হকচকিয়ে যাওয়া ভাবটা গিলে নিয়ে বললো,
“তুমি এরকমটা কেন ভাবো বলো তো? আমি সত্যিই পছন্দ করি না শ্রাবণ ভাইয়াকে। তার প্রতি আমার সেরকম কোনো ভালো লাগা নেই। ট্রাস্ট মি!”

মিহিক চোখ সরিয়ে নিলো। নোয়ানা শ্রাবণকে পছন্দ করে কি না সে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলো না। মাথাটা হেলিয়ে দিলো চেয়ারে। নিবিড় ভাবনায় ডুব দিয়ে বললো,
“বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে কি লায়লা আন্টি, কবির আঙ্কল কষ্ট পাবেন? তাদের সাথে কি আমাদের সুসম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে? আমার ফ্যামিলির জন্য কি ভালো হবে না ব্যাপারটা? আমি আসলে চাই না রে এরকমটা হোক। আবার শ্রাবণকে বিয়ে করবো এমনটাও চাই না। কী করবো আমি তাহলে? কোনটা করা ঠিক? আর কোনটা বেঠিক?”

______________

আজ কারিবের জীবনে ভীষণ খুশির একটা দিন। তার অতিপ্রিয় একটা মানুষ বিদেশ থেকে দেশে আসছে আজ।

কারিব এগারো বছর বয়স থেকে কবির সাহেবদের বাড়িতে আছে। এগারো বছর বয়স থেকে তার থাকা, খাওয়া, লেখাপড়া, বেড়ে ওঠা সব কবির সাহেবদের বাড়িতেই হয়েছে। কবির সাহেবরা খুব ভালো মানুষ। উদার মনের ব্যক্তি। তার কোনো কিছুতেই হেলাফেলা করেনি তারা। কারিবের আপন বলতে শুধু তার মা আছে। সে থাকে গ্রামে। বাবাকে হারিয়েছে আট বছর বয়সে। কারিবদের পারিবারিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না বলে কবির সাহেব মায়া করে কারিবকে নিজের সাথে ঢাকা নিয়ে এসেছিল। সেই আসা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বলতে গেলে সে খুব সুখে শান্তিতেই আছে। কবির সাহেবদের কোম্পানিতে চাকরিরত আছে সে। ভালো পরিমাণ টাকাই ইনকাম তার। গ্রামে মায়ের কাছে টাকা পাঠিয়ে দেয় মাসে মাসে। দুই, তিন মাস অন্তর নিজে গিয়েও দেখা করে মায়ের সাথে। গ্রামে গেলে মা আর আসতে দিতে চায় না। কিন্তু ওখানে থেকে যাওয়ার জো তো আর তার নেই। কয়েকদিন গ্রামে থেকেই আবার ঢাকা কবির সাহেবের বাড়িতে ব্যাক করতে হয় তাকে। মাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল ঢাকায়। কিন্তু সে স্বামীর ভিটে-মাটি ছেড়ে নড়বে না।

কবির সাহেবদের বাড়িতে থাকার সুবাদেই ওই অতিপ্রিয় মানুষটির সাথে দেখা হয়েছিল তার। মানুষটি যে তার কতটা প্রিয় সেটা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। খুব ভালোবসে সে তাকে। তার প্রিয় মানুষটা দশ বছর বয়স থেকে আমেরিকাতে থাকে। এখন তার বর্তমান বয়স পঁচিশ। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে আমেরিকার মাটিতে বসবাসরত সে। আমেরিকাতে ফুফুদের কাছে থাকে। ফুফু নিঃসন্তান। মূলত তারা সন্তানহীন বলেই অনেক আবদার করে নিজেদের সাথে তাকে আমেরিকা নিয়ে গেছে। তাকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার পর, তার ফুফুরা আরও একটি সন্তান এডপ্ট নিয়েছে। যার নাম, ঝুম। তার বয়স আঠারো।

প্রিয় মানুষটির সাথে কারিবের দেখা হয়েছিল ষোলো বছর বয়সে। তখন তার প্রিয় মানুষটির বয়স পনেরো। দুই মাসের জন্য বাংলাদেশ বেড়াতে এসেছিল সে। প্রথম সাক্ষাতেই মানুষটিকে বেশ ভালো লেগে যায় কারিবের। মানুষটি খুব অমায়িক, মিশুক! প্রিয় মানুষটি দেশে এলে কারিবের খুব ভালোই হয়। সে যতদিন বাংলাদেশে থাকে, ততদিন কারিব একেবারে ফ্রি। কোনো কাজকর্ম করতে হয় না তার। কবির সাহেব সবসময় কারিবকে তার প্রিয় মানুষটির সাথে সাথে থাকার নির্দেশ দেয়। নির্দেশটা আগে শুধু সঙ্গ দেওয়ার প্রয়োজনার্থে থাকলেও, দুই বছর আগে কারিবের প্রিয় মানুষটি যখন বাংলাদেশ এলো, তখন কারিবকে তার সাথে সাথে থাকতে দেওয়ার উদ্দেশ্য পরিবর্তন হলো। কবির সাহেব কারিবকে চব্বিশ ঘণ্টা বডিগার্ডের মতো লাগিয়ে রেখেছিল সেবার তার পিছনে। বডিগার্ডের মতো লাগিয়ে রাখার কারণও ছিল অবশ্য।
এতক্ষণ কারিবের যে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে কথা হলো, সে আসলে কবির সাহেবের ছোট ছেলে আষাঢ়। আষাঢ়ের মাঝে একটু সমস্যা আছে। সমস্যাটা কোনো গুরুতর কিছু না। সমস্যাটা সামান্য। আর এই সামান্য সমস্যাটুকু হলো, আষাঢ়ের মেয়েদের প্রতি ঝোঁক আছে। ঝোঁকটাও সাংঘাতিক নয়। হালকা। কবির সাহেব ছেলের এই সমস্যার ব্যাপারে একটু আধটু জেনেছে তিন বছর হলো। এর আগে তিনি অবগত ছিলেন না। আর এটা জানতে পারার পর আষাঢ় যখন দুই বছর আগে বাংলাদেশ এসেছিল, সেবার কারিবকে সর্বক্ষণ আষাঢ়ের সাথে সাথে থাকার হুমুক দিয়েছেন। কড়া নজর রাখতে বলেছেন ছেলের উপর। তার ছেলে কখন কী করে সেই বিষয়ে সকল ইনফরমেশন তার কাছে দিতে বলেছিল।
কবির সাহেব আষাঢ়ের এই সমস্যার ব্যাপারে মাত্র তিন বছর ধরে অবগত হলেও, কারিব এ ব্যাপারে জানে অনেক আগে থেকে। আষাঢ়ের মাঝে প্রথম প্রথম যখন এই সমস্যার উদ্ভাবন ঘটেছিল, তখনই ধরতে পেরেছিল। কারণ, আষাঢ় ফোনে কথা বলতে এলেই বিভিন্ন মেয়েদের গল্প জুড়ে দিতো তার সাথে। প্রথম প্রথম তার কাছে এটা মোটেও ভালো লাগতো না। কিন্তু ধীরে ধীরে এসবের সাথে মানিয়ে গেল সে। আষাঢ় আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ এলে মেয়েদের প্রতি আষাঢ়ের এই ঝোঁক নিজ চোখেই প্রত্যক্ষ করেছে সে। কাউকে জানায়নি এ ব্যাপারে।
কিন্তু তিন বছর আগে কবির সাহেবের বোন মিসেস আইরিন, ভাইয়ের কাছে ব্যাপারটা শেয়ার করলেন। যদিও সব খোলাসা করে বলেনি। আংশিক একটু বলেছে। বাস, তাতেই কবির সাহেব ছেলের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এরপর আষাঢ় বাংলাদেশ আসলে কারিবকে চব্বিশ ঘণ্টা আষাঢ়ের সাথে লাগিয়ে রাখলেন। কারিবকে কবির সাহেব খুব বিশ্বাস করেন। কারিব যা বলে তা নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে নেন। কিন্তু কবির সাহেব কারিবকে চিনতে ভুল করেছেন। তিনি হয়তো জানেন না, কারিব আষাঢ়কে এতটাই ভালোবাসে যে, আষাঢ়কে দোষ মুক্ত রাখতে তার কাছে মিথ্যা বলতেও বাধে না কারিবের।
অন্য সবকিছুর বেলাতে কারিব একটা খাঁটি মানুষই। কবির সাহেবের কাছে কখনও মিথ্যা বলে না। কিন্তু এই আষাঢ়ের বেলাতে সে খাঁটি থাকতে পারে না, ভেজাল পূর্ণ হয়ে যায়।

আষাঢ়ের কথা ভাবতে ভাবতে এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেল কারিব। আষাঢ়কে সে একাই নিতে এসেছে। আষাঢ় বাংলাদেশ এলেই কারিবের নিজেকে সেক্রেটারি সেক্রেটারি মনে হয়। আষাঢ়ের একান্ত সেক্রেটারি যেন সে। আষাঢ়ের সবকিছু করে দেওয়ার দায়িত্ব যেন তার। আষাঢ়ের মেয়েদের প্রতি ঝোঁক থাকার ব্যাপারটিতে কারিবের একটুও খারাপ লাগে না। বরং এটা এখন তার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হয়। বিদেশে নানান মেয়ের মাঝে ফ্রি ভাবে থাকতে থাকতে আষাঢ়ের মাঝে এই বাজে অভ্যাসটা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া তার ফুফুরা যদি একটু কড়া থাকতো তাহলেও এমন হতো না। কিন্তু ফুফুরা যে আষাঢ়ের প্রতি ভীষণ নরম। তাদের লাই পেয়ে পেয়েই ছেলেটা আদরে আদরে বাঁদর হয়েছে।

প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ানোর একটু সময় পরই আষাঢ়কে দেখতে পেল কারিব। আষাঢ়ের পিঠে একটা ব্যাগ, হাতে একটা লাগেজ। চোখে কালো সানগ্লাস। পরনে যে পোশাক আছে তাও কালো।
আষাঢ় কারিবের দিকে এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে। আষাঢ়কে দুই বছর পর সামনা সামনি দেখতে পেয়ে কারিবের অনুভূতি সব উপচে উঠলো। কিছুক্ষণ মায়া নিয়ে তাকিয়ে থেকে আদুরে কণ্ঠে ডেকে উঠলো,
“আষাঢ় ভাই!”

কারিব বয়সে আষাঢ়ের থেকে এক বছরের বড়ো হয়েও আষাঢ়কে সবসময় ‘ভাই’, ‘আপনি’ বলেই সম্মোধন করে। আষাঢ়ের প্রতি তার তীব্র শ্রদ্ধা থেকেই বোধহয় ভিতর থেকে ‘তুমি’ এবং কেবল ‘আষাঢ়’ বলে সম্মোধনটা তার মুখ থেকে বের হয় না।
কারিবের ডেকে ওঠায় আষাঢ় একটু হাসে। কারিব মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সেই হাসিটুকু মানসপটে এঁকে নিলো। আষাঢ়ের হাসি তার মারাত্মক রকমের প্রিয়। শুধু হাসি কী, গোটা মানুষটাই তো তার প্রিয়। মানুষটির চোখ, কান, নাক, ঠোঁট, হাত, পা, গলা সবই তার পছন্দ! আষাঢ়ের গায়ের বর্ণ একটু শ্যামলা। গায়ের রং শ্যামবর্ণ হলে হবে কী? সৌন্দর্য ধারালো। এই রূপেই কতশত রমণী পাগল হলো তার জন্য! কারিব একটা জিনিস খেয়াল করেছে, শ্রাবণ উজ্জ্বল ফর্সা, হ্যান্ডসাম হলেও আষাঢ়ের মতো এত সুদর্শন লাগে না তাকে। আষাঢ় শ্যামলা হয়েও দারুণ সুদর্শন।

আষাঢ় কাছে এসে হাগ করলো কারিবকে। জড়িয়ে রেখে বললো,
“ওহ মাই ডিয়ার! আমি দীর্ঘ সময় ধরে মিস করেছি তোমাকে।”

“আমিও আপনাকে অনেক মিস করেছি আষাঢ় ভাই।”

আষাঢ় কারিবকে ছেড়ে দিয়ে নিজের হাসি মুখখানা আরেকবার দেখালো। আষাঢ়ের হাসির জুড়ি নেই। হাসতেই যেন বেশি ভালোবাসে সে।

আষাঢ় আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,
“তুমি একা? আমি তো আশা করেছিলাম আমাকে নিতে আরও মানুষজন আসবে।”

“এবার আসতে পারলো না তারা। ব্যস্ত তো তাই। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি তো আছি। আপনার সেবায় সর্বক্ষণ নিয়োজিত আমি।”

আষাঢ় মুচকি হেসে দু আঙুলে আলতো করে কারিবের গাল টেনে দিয়ে বললো,
“তুমি আমার সাথে থাকলেই হয় সবসময়। কিন্তু আমার বাড়ির লোকের এত ব্যস্ততা কীসের বলো তো? বিয়ের দিনই না কি ধার্য হয়নি এখনও। এখনই সব আয়োজন শুরু করে দিয়েছে না কি?”

আষাঢ়ের বাংলাদেশ আসার বন্দোবস্ত সব আগে থেকেই করাছিল। গ্রাজুয়েট শেষ। এমনিতেই বাড়িতে বেড়াতে আসবে ভাবছিল, এর উপর দশ পনেরো দিন আগে খবর পেল তার ভাই কার বিয়েতে যেন গেঞ্জাম করেছে। এখন ভাইয়ের বিয়ে দেওয়া হবে তাড়াতাড়ি। ভাইয়ের বিয়ে খেতে আসাটাই মূলত মুখ্য বিষয় এখন। এছাড়াও বাংলাদেশ আসার আরেকটা কারণ আছে। সেটা এখন উহ্য থাক।

কথা বলতে বলতে আষাঢ় এবং কারিব এয়ারপোর্ট থেকে বের হলো। কারিব আষাঢ়ের লাগেজটা পিছনে রেখে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। আষাঢ় তখন সিটবেল্ট বাঁধছিল। মাথাটা সিটের সাথে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বললো,
“কাল তুমি এবং আমি দুজন মিলে কক্সবাজার যাব।”

“কেন আষাঢ় ভাই? কক্সবাজারে কী কাজ আমাদের?

আষাঢ় হাসলো। হাসিটা ঠোঁটের এক কোণে বেশি প্রশস্ত হলো। এটাকে কিছুটা মুখ বাঁকিয়ে হাসা বলা চলে। সে কেমন গলা ছেড়ে দিয়ে বললো,
“যেখানে সুন্দরী রমণীদের ভিড়, সেখানেই তো প্রেমিক পুরুষের যাতায়াত থাকবে কারিব।”

কারিবের বুঝতে অসুবিধা হলো না। সেও একটু হেসে গাড়ি স্টার্ট করলো। আষাঢ়ের সাথে থাকাকালীন সময়ে সে কেমন যেন হয়ে যায়। নিজের মতো থাকে না। অন্য মানুষ বনে যায়। আষাঢ়ের সব কাজে তার সঙ্গ থাকে। কাজটা ঠিক না বেঠিক, তা নিয়ে সে ভাবে না। তার ধারণা তার আষাঢ় ভাই আর যাই করুক খারাপ কিছু করে না। তার এ ধারণা শুধু আষাঢ়ের বেলায়। আষাঢ়ের মতো যদি অন্য কেউ করতো তাহলে হয়তো সে তা সহ্য করতো না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here