বিবর্ণ জলধর পর্ব:১০

0
1022

#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১০
_____________

মিহিকের পরনে ভারী কাজের লাল লেহেঙ্গা। লাল টুকটুকে বউ সেজে আছে সে। শ্রাবণের বিবাহিতা স্ত্রী সে এখন। হুহ, বিয়েটা হয়ে গেছে শ্রাবণের সাথে। এইতো, সন্ধ্যার পরই তাদের বিয়ের কার্য সম্পন্ন হলো। বর্তমানে সে এখন শ্রাবণের রুমে অবস্থান করছে। সকাল নাগাদ মা-বাবাকে আরেক দফা বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সে, কিন্তু লাভ হয়নি। কেউ বুঝলো না তাকে। যার দরুণ বিয়েটা করে নিলো।
শ্রাবণও নিজের পরিবারকে আরেক বার বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। কবির সাহেবের এক কথা, বিয়ে না করলে বাড়ি থেকে বের করে দেবে, সেই সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করবে সারাজীবনের জন্য। রাত্র এখন এগারোটা চলছে। মিহিক বসে আছে বেডের উপর। ঘরটা তরতাজা ফুল দিয়ে সজ্জিত। রুপালি, জুন, কারিব এরা মিলে সাজিয়েছে রুমটা। বিয়েটা ঘরোয়াভাবে শুধু নিজস্ব মানুষদের নিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বাহিরের কোনো মানুষদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এক রকম চুপিসারেই হয়েছে বিয়েটা। কবির সাহেব বিয়েটা নিয়ে কোনো প্রকার ঝামেলা চাননি। আগে শ্রাবণের মাথা থেকে রুমকির ভূত নামুক, তারপর জাকজমক আয়োজন করবেন।

মিহিকের ক্রুর দৃষ্টি এখন তার সদ্য বিবাহিত স্বামীর উপর। মেজাজটা বেজায় খারাপ হয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে সামনে কোনো এক সার্কাস সিন চলছে। আহা, কী মনোরম দৃশ্য! বাসর রাতে নতুন বউয়ের সামনে স্বামী মোবাইলে তার গার্লফ্রেন্ডকে বোঝাতে ব্যস্ত!

শ্রাবণ রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করছে আর রুমকিকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে কিছুতেই চায়নি আজকে রুমকি তার বিয়ের খবরটা জেনে যাক। চেয়েছিল কালকে রুমকির সাথে দেখা করে নিজেই বিয়ের খবরটা জানাবে এবং রুমকিকে সব বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু তা আর হলো না। রুমকি কীভাবে যেন তার বিয়ের খবরটা জেনে গেছে। এখন রুমকিকে বোঝাতে সে যারপরনাই ব্যস্ত।

“রুমকি…রুমকি তুমি বিশ্বাস করো…বিশ্বাস করো আমি…”

রুমকি হুংকার করে উঠলো,
“চুপ! একটা কথা বলবি না তুই। তুই আমার বিয়ে ভেঙে দিয়ে নিজে এখন ধেই ধেই করে বিয়ে করে নিলি? বেইমানের বাচ্চা! কী করে বিয়ে করলি তুই? যখন অন্য একজনকেই বিয়ে করবি তাহলে আমার বিয়ে ভেঙেছিলি কেন? বল কেন ভেঙেছিলি?”

“রুমকি তুমি বিশ্বাস করো…বিশ্বাস করো আমাকে! আমি নিজ ইচ্ছাতে এই বিয়েটা করিনি। আমার আব্বু জোর করে আমাকে…”

“আমার বিয়ে যখন ভেঙেছিলি তখন কি তোর বাপের পারমিশন নিয়ে ভেঙেছিলি? তাহলে এখন কেন তুই তোর বাপের কথায় বিয়ে করবি? কেন করবি?”

“এই বিয়েটা না করলে আব্বু আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতো, তেজ্যপুত্র করতো আমাকে।”

“তুই তোর নাটক থামা। আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি সব কিছু। আমার জীবনটা শেষ করে দিয়ে, ও ওর নিজের নতুন জীবন শুরু করছে! এই শোন, কান খুলে শুনে রাখ। তোকে…তোকে আমি ছাড়বো না। চৌদ্দ শিকের ভিতরে ঢোকাবো তোকে আমি। জেলের ভাত খাওয়াবো তোকে। বেইমানের বাচ্চা! একদম মেরেই ফেলবো তোকে।”

রুমকি কথা শেষ করে ফট করে কল কেটে দিলো। শ্রাবণ এই মুহূর্তে কতটা অসহায়, কতটা কষ্টে আছে সেটা শুধু সে জানে। রুমকি কল কেটে দেওয়ায় তার ভিতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। খাঁ খাঁ মরুভূমি তার বুকে। পাগল প্রায় অবস্থা তার। কোনোদিক না ভেবে আবারও কল দিলো রুমকিকে। রুমকি কল কেটে দিলো। শ্রাবণ থামলো না, কল দিয়ে গেল। পাঁচ বারের বার রুমকি ফোন রিসিভ করলো।

শ্রাবণ ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলো,
“প্লিজ রুমকি, প্লিজ কথা শোনো আমার। কল কেটে দিয়ো না দয়া করে। প্লিজ বিলিভ মি! আমি ইচ্ছা করে এই বিয়েটা করিনি। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি! বিলিভ মি প্লিজ!”

মিহিকের সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে এক ছুটে দূরে কোথাও চলে যায়। জীবনে কি ভেবেছিল এমন তামাশার সম্মুখীন হবে? ছি! বিয়ের পরেও এরকম করতে পারে কেউ? তাও আবার বউয়ের সামনে! এ বিয়ে তো টিকবে না। সত্যিই ডিভোর্স হয়ে যাবে মনে হচ্ছে! যা খুশি তাই হোক। পরিবার বুঝুক গিয়ে এখন।

রুমকি যেন একটু নরম হলো। শান্ত কণ্ঠে বললো,
“ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম। কাল সকালেই আমার সাথে একবার দেখা করবে। আর হ্যাঁ, বউয়ের ধারে কাছেও ঘেঁষবে না তুমি। তিন হাত দূরে থাকবে ওর থেকে।”

“তিন হাত কী? আমি তো তিনশ হাত দূরে থাকবো। তুমি রাগ করে থেকো না প্লিজ।”

“রাগ না করে থাকার উপায় নেই। রাগ আমি করবোই। কাল সকালে দ্রুত আসবে দেখা করতে।”

“হ্যাঁ, অবশ্যই আসবো। তুমি চাইলে তো আমি এখনই দেখা করতে পারি।”

“এখনের কোনো দরকার নেই। কাল সকালে। রাখছি। আবারও বলছি কিন্তু, মোটেই বউয়ের কাছে যাবে না, দূরে দূরে থাকবে। ঠিক আছে?”

“ও কে!”

“রাখছি।”

“হুম।”

কল কাটলো রুমকি। দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো শ্রাবণের বুক চিরে। মাথা নিচু ভঙ্গিতে সে স্বস্তির শ্বাস ত্যাগ করতে লাগলো। যাক, রুমকি বুঝলো। রুমকি যে এত দ্রুত শান্ত হবে ভাবেনি।
শ্রাবণ অনুভব করলো তার মাথা থেকে যেন রাজ্যের একটা চাপ কমে গেছে। কিছুক্ষণ নীরব সময় পার করে পিছন ফিরে বেডে মিহিকের দিকে তাকালো। মিহিক অন্যদিকে তাকানো, তাও ঢের বুঝলো শ্রাবণ তাকিয়েছে তার দিকে। বুঝতে পেরেই মিহিক মুখ ভেংচালো। শ্রাবণের ভ্রু কুঁচকে গেল তা দেখে।

“কী ব্যাপার, ভেংচি কাটলেন কেন আপনি?”

মিহিক শ্রাবণের দিকে দৃষ্টি ফেলে বললো,
“আমার ইচ্ছা আমি ভেংচি কেটেছি, আপনি না দেখলেই পারেন। চোখ বুজে থাকেননি কেন?”

শ্রাবণ রেগে গেল। মুখে রাগের প্রলেপ এঁকে খানিক ক্ষণ নীরব থেকে বললো,
“খুব তো বলেছিলেন আমাকে বিয়ে করবেন না, তাহলে আবার কেন বিয়ে করলেন আমাকে?”

“আপনিও তো বলেছিলেন বিয়ে করবেন না, আপনি কেন করলেন?”

শ্রাবণ দমে গেল। প্রশ্নের জবাব দিলো না। ক্ষণিকের মৌনতা কাটিয়ে খুব শান্ত স্বরে বললো,
“দেখুন, এতক্ষণ যা হলো…মানে আমি যে রুমকির সাথে কথা বললাম এটা প্লিজ আমার মা-বাবাকে জানাবেন না। অন্য কাউকেও জানাবেন না এটা, প্লিজ! আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন না, এই বিয়েটা আপনি করতে চাননি, তাও বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে। আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেম। আমার মা-বাবা আমার ব্যাপারটা বুঝতে চায়নি, কিন্তু আপনার তো বোঝার কথা। আমি রুমকিকে ভালোবাসি! এ ব্যাপারে তো আপনি আগে থেকেই অবগত।”

মিহিক বুক ভর্তি ঘৃণা নিয়ে স্বামী নামক ব্যক্তিটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার হঠাৎ কান্না পাচ্ছে। তার স্বামী এমন অকপটে অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসে বলছে তার সামনে? হোক শ্রাবণ রুমকিকে ভালোবাসে, হোক সে আগে থেকেই জানতো শ্রাবণের এই ব্যাপারে, তাই বলে আজকের দিনে এরকম করে কথাগুলো বলবে? ইয়া আল্লাহ! জীবনে কি ভেবেছিল স্বামীর কাছ থেকে এই কথা শুনতে হতে পারে? ভিতরটা গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কী বড়ো ভুল করে ফেললো সে!

শ্রাবণ বলে চলেছে,
“আমাদের সম্পর্কটা হয়তো বাকি সব বৈবাহিক সম্পর্কের মতো হবে না। কিন্তু আমরা এটা এখনই বাইরে প্রকাশ করতে পারবো না। হয়তো কিছুটা সিনেমাটিক লাগছে আমার কথা, তাও বলছি, আমাদের মাঝে সম্পর্কটা যেমনই থাকুক, এটা এখন সকলের সামনে প্রকাশ করা অনুচিত হবে। সকলের সামনে আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক দেখাতে হবে। তারা এত করে চাইছিল এই বিয়েটা হোক, অনেক আশা ছিল তাদের এই বিয়েটা নিয়ে। এখন যদি জানতে পারে আমরা আসলে একে অপরের সাথে স্বাভাবিক নই, তাহলে খুব কষ্ট পাবে। আম্মু তো খাওয়া-দাওয়া-ই বন্ধ করে দেবে। অসুস্থ হয়ে পড়বে সে। আমি ছেলে হয়ে এটা সহ্য করতে পারবো না।”

শ্রাবণের এত কথার প্রত্যুত্তরে মিহিক শ্লেষপূর্ণ হেসে শুধু একটা বাক্যই বললো,
“তেজ্যপুত্র হওয়ার এত ভয়?”

মিহিকের কথার ঝাপটায় শ্রাবণের মুখের বুলি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। ভীষণ অপমানে রিক্ত হলো সে। কিছু বলার আর মুখ রইল না।

কেটে যায় সময়। কতটা সময় কাটলো? আধ ঘণ্টা? না কি এক ঘণ্টা? সঠিক সময়টা জানা নেই কারো। মিহিকের ওই কথার পর দুজনের মাঝে আর একবারও বাক্যলাপ হয়নি।
মিহিক ঠাঁয় এখনও বেডে বসে আছে।
শ্রাবণ বসে আছে জানালার ধারে। জানালার কাচ বন্ধ। বাইরে বৃষ্টি। যেন তেন বৃষ্টি নয়, একেবারে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রাবণ প্রত্যক্ষ করছে জানালার কাচে বৃষ্টির আছড়ে পড়া আবার গড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য। তার জীবনটাও এখন এমন আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার মতো। এক কষ্টদায়ক জীবনের মধ্যে আছে সে। রুমকির বিয়ের দিন থেকে তার জীবনটা খুব করে পাল্টে গেছে। এই পাল্টে যাওয়া জীবনে বেঁচে থাকার স্বাদ বড্ড নির্মম! আড় চোখে বার কয়েক মিহিককে দেখেছে সে। মিহিকের কোনো নড়চড় নেই, ঠিক একটা কাঠের পুতুল যেন। শ্রাবণের ভালো লাগছে না মিহিককে এরকম দেখতে। নতুন একটা বউ মুখ গোমড়া করে বসে আছে, এটা কি ভালো লাগে দেখতে? লাগে না। একদমই লাগে না। মেয়েটা হয়তো ভাবছে এই বিয়েটা তার জীবনে সবচেয়ে বড়ো ভুল। ভাবলে ভাবুক। এখানে তার কী করার আছে? নিজের জীবনেও তো এই বিয়েটা একটা ভুল ছাড়া আর কিছু না! নিজেও তো আছে বড্ড যন্ত্রণায়।
শ্রাবণের হঠাৎ ঘুমানো নিয়ে চিন্তা উদয় হলো। মিহিককে কিছুতেই নিজের বিছানায় ঘুমাতে দিতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু তাই বলে কি আর একটা মেয়েকে বলা যায়, তুমি নিচে ঘুমাও? বলা যায় এটা? যায় না। মেয়েদের প্রতি শ্রাবণের সম্মান আছে। বরাবর সে একটু বেশিই সম্মান করে মেয়েদের। এখন আবার এ মেয়ে তার বিবাহিত স্ত্রী। নতুন বউ! নতুন বউকে কি আর ফ্লোরে ঘুমাতে দেওয়া যায়? ভালো দেখায় এটা? আর মিহিক যেমন মেয়ে, মুখে কোনো লাগাম নেই। যদি নিচে ঘুমাতে বলে কী বলতে যে কী বলবে আল্লাহ মালুম! শ্রাবণের নিজেরও নিচে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। ইচ্ছে তো করছে মিহিককেই নিচে ঘুমাতে বলে, কিন্তু এটা অন্যায়। এত বড়ো অন্যায় তো সে করতে পারে না। নিজের নিচে ঘুমানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। শ্রাবণ টুল ছেড়ে উঠে ক্লোজেটের কাছে এলো। তার রুমে এক্সট্রা তোষক আছে। তোষকের উপর একটা কম্বল বিছিয়ে বিছানা তৈরি করবে নিচে। এরপর সেখানেই ঘুমাবে। ক্লোজেটের ভিতর তোষক আর কম্বল ধরে টানাটানি করলেই মিহিক বললো,
“কী করছেন আপনি?”

শ্রাবণ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে বললো,
“ঘুমাবো না আমি?”

“তো খাটে ঘুমান।”

মিহিকের কথায় শ্রাবণের অন্তঃকরণে যেন শৈতপ্রবাহ বয়ে গেল। থমকে গেল তার হৃদপিণ্ড। লজ্জায় মুখখানি লাল বর্ণ ধারণ করলো। মিহিকের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। মেয়েটা কী বললো এই মাত্র? খাটে ঘুমান? নিজের সাথে খাটে ঘুমাতে বলছে? মেয়েটার কি লজ্জা শরম নেই?
শ্রাবণ পাথর হয়ে গেল। ক্লোজেট থেকে কম্বল, তোষক টেনে বের করার খেয়ালটুকু হারিয়ে ফেললো সে।
মিহিক বিছানা থেকে নেমে শ্রাবণের কাছে এগিয়ে এলো। শ্রাবণের পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে ক্লোজেট থেকে কম্বল আর একটা বেড শীট বের করে এনে বললো,
“আপনি উপরে ঘুমান। আমি নিচে শোবো।”

শ্রাবণের ভুল ভাঙলো। ভুল ভাঙতেই সে বললো,
“কোনো দরকার নেই, আপনি খাটে ঘুমান। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।”

“আমি আপনার অসুবিধার কথা ভাবছি না, আমি নিজের অসুবিধার কথা ভাবছি। যে বিছানায় এত দিন একটা ছেলে ঘুমিয়ে এসেছে, সে বিছানায় আমি শুতে পারবো না। তাই আমি নিচে শোবো।”

মিহিকের কথায় শ্রাবণ আহত হলো। এই মেয়েটা এমন কেন? একটা ছেলে মানে? সে তো এখন তার হাসব্যান্ড। হাসব্যান্ডের বিছানায় শুতে অসুবিধা? শ্রাবণ বললো,
“ও কে! আপনার মর্জি সব।”

শ্রাবণ আগে ফ্রেশ হয়ে নিলো। মিহিক তার পরে। মা সব প্যাকিং করে দিয়েছিল ব্যাগের ভিতর। থ্রি পিস, টপস, স্লিপিং স্যুট ইত্যাদি সব কিছুই আছে। মিহিক থ্রি পিস পরলো। ভারি লেহেঙ্গা ছেড়ে এখন যেন একটু শান্তি। কথা মতন শ্রাবণ উপরে খাটে শুলো, আর মিহিক নিচে। রুমে এখন শুধু ক্ষীণ আলোয় একটা ড্রিম লাইট জ্বলছে। মিহিকের চোখ ভরে উঠছে অশ্রুতে। কোণ বেয়ে টুপ করে অশ্রু ধারা নামতে লাগলো। ভিজে যেতে লাগলো বালিশ। শ্রাবণকে বিয়ে করা কতটা ভুল হয়েছে এখন বুঝতে পারছে। জেদ ধরে বিয়েটা করা একেবারে উচিত হয়নি। শুধু শুধু একটা সম্পর্কের নাম সৃষ্টি হলো তাদের মাঝে। এই সম্পর্কের তো কোনো গতি নেই। শ্রাবণ যেসব করছে তাতে এই সম্পর্কে ভাঙন ধরবে খুব শীঘ্রই!

শ্রাবণের ঘুম আসছে না, শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না। একটু পর পর ফ্লোরের উপর বিছানা পেতে শুয়ে থাকা মিহিকের দিকে তাকাচ্ছে। একটা মেয়ের দিকে চুপিসারে তাকিয়ে থাকা কি ঠিক? শ্রাবণের মন বাধা দিচ্ছে। তারপরও চোখ বার বার কেন যেন চলে যাচ্ছে মিহিকের উপর। তবে মিহিকের দিকে তাকালেও এখন অন্যায় হবে না, কারণ মিহিক এখন তার স্ত্রী।
একটা মেয়ে তার রুমে ফ্লোরে শুয়ে আছে এটা শ্রাবণের ঠিক ভালো লাগছে না। তার অপরাধী মন বার বার প্রতিবাদ জানাচ্ছে, এটা অন্যায়। হলে হোক অন্যায়। তার সাথেও তো অন্যায় করা হয়েছে। এ বিয়ে সে করতে চায়নি, তারপরও করতে হয়েছে। শ্রাবণ মিহিকের দিকে তাকালো আবার। ড্রিম লাইটের আলোয় মিহিকের অবয়ব দেখতে পাচ্ছে সে। মেয়েটার জন্য কেন যেন তার কষ্ট অনুভব হচ্ছে। নিজের কষ্ট বোঝার কেউ নেই, অথচ সে অন্যের জন্য কষ্ট অনুভব করছে! শ্রাবণ চোখ ফিরিয়ে নিলো। অন্য পাশ ফিরে শুলো। ভাবতে লাগলো কাল রুমকিকে কী কী বলে বুঝ দেবে? এ মুখ নিয়ে রুমকির সামনে দাঁড়াতেও যে লজ্জা করবে। জীবন এত কঠিন, নির্মম হয়ে উঠলো কেন? শ্রাবণের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। চোখের পাতা এক করে আবার খুললো। ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও একবার মিহিককে দেখলো। মেয়েটার জন্য সত্যিই তার খারাপ লাগছে। মিহিকের দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। বড়ো করে শ্বাস ত্যাগ করে চোখ বুজলো। না, ঘুম বোধহয় আজ আর ধরা দেবে না চোখে।

__________________

আষাঢ়ের ঘুম আজ একটু দেরিতে ভাঙলো। তখন ঘড়ি সাতটা পনেরো ছুঁই ছুঁই। ঘুম থেকে উঠেই সে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো। এটা তার নিত্য দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সকালে একবার এখান থেকে পাশের বাড়ির ব্যালকনিতে না তাকালেই নয়। নোয়ানাকে দেখতে পাচ্ছে। আরও ভালো করে দেখার জন্য বাইনোকুলার ধরলো চোখে। আজ নোয়ানার হাতে কোনো বই নেই। আনমনা বসে আছে। আষাঢ় ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফোঁটালো। বেড সাইড টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে এসে কল করলো নোয়ানার নাম্বারে।

হাতে থাকা ফোন মৃদু সুরে বেজে উঠে নোয়ানার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো। মোবাইলে দৃষ্টিপাত করতেই ইংলিশে লেখা ‘Himel’ নামটা ভেসে উঠলো। আষাঢ়ের কল আসায় সে কিঞ্চিৎ বিরক্ত, আবার কিঞ্চিৎ খুশিও হলো। চারদিন ধরে রোজ সকালেই আষাঢ় এমন সময়ে একবার কল দেবে। প্রথম যে বার কল দিয়েছিল, সে বার কল রিসিভ করেছিল। পরের দুই দিন আর রিসিভ করেনি। কিন্তু আজকে বিনা আপোষেই রিসিভ করে ফেললো। ও প্রান্ত থেকে আষাঢ়ের গলা শোনা গেল,
“ও মা! প্রিয়তমা আজ কল রিসিভ করেছে দেখছি!”

আষাঢ়ের কথা কেমন ঢংপূর্ণ লাগলো নোয়ানার। কিছু বললো না সে। চুপচাপ শুনলো।

“তোমার ওই সুন্দর মুখখানিতে রোদের আনাগোনা কিন্তু একদম ভালো লাগছে না আমার। তবে লাল থ্রি পিসে তোমাকে দেখতে দারুণ লাগছে।”

আষাঢ়ের কথায় নোয়ানা সচকিত চোখ বুলিয়ে নিলো আশেপাশে। কোথায় কাউকে না দেখতে পেয়ে বললো,
“আপনি কি আমায় দেখছেন? জানেন কী করে আমার পরনে লাল থ্রি পিস না কি? কোথায় বসে দেখছেন?”

আষাঢ় হাসলো। দোতলার এক জানলা দিয়ে সে যে নোয়ানাকে দেখছে, এটা নোয়ানার জানার কথাও না। বললো,
“হুম দেখছি তো। তুমি খুব কাছে আমার। হাত বাড়ালেই আমি ছুঁয়ে দেখতে পারি তোমাকে।”

“তাই?”

“হ্যাঁ।”

নোয়ানা হেসে ফেললো। তার হাসিও যে আষাঢ় খুব ভালো করে দেখতে পাচ্ছে বাইনোকুলারের সাহায্যে এটা হয়তো তার অজানা। সে বললো,
“আপনি ঠিক কে বলুন তো?”

“তোমাকে তো আগেই বলেছি প্রিয়তমা, আমি কে সেটা জানার প্রয়োজন নেই তোমার। তুমি কে সেটাই হলো ইম্পরট্যান্ট।”

“আপনি কি আষাঢ়?”

“ওপস! ধরা খেয়ে গেলাম কী করে?”

“তাহলে এটা সত্যিই আপনি? পরিচয় গোপন রেখেছিলেন কেন?”

“আমি পরিচয় গোপন রাখিনি প্রিয়তমা, আমার পরিচয় প্রকাশ্যেই ছিল। তুমিই না চেনার ভাণ করেছিলে।”

আষাঢ়ের মুখের প্রিয়তমা ডাকটি একবারও শুনতে ভালো লাগেনি নোয়ানার। ডাকটি তার কাছে বিরক্তির কারণ বৈ কিছুই না। সে রাশভারী কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আমি কেন আপনাকে না চেনার ভাণ করবো? কী কারণ আমার?”

“সেটা তো তুমিই ভালো জানো। তুমি চিনেও কেন আমাকে না চেনার ভাণ করছো নোনা?” শেষের কথাটা কেমন আকুল পূর্ণ আষাঢ়ের।

‘নোনা’ ডাকটি শুনে নোয়ানার হৃদয় কম্পিত হয়ে ওঠে। আজ অনেক বছর পর কেউ তাকে আবার ‘নোনা’ বলে ডাকলো। কিছু স্মৃতি হুড়মুড় করে জেগে উঠলো মনে। নিজেকে কাঠিন্য করলো নোয়ানা। শক্ত কণ্ঠে বললো,
“আমি ‘নোনা’ নই, আমার নাম ‘নোয়ানা’!”

“নোয়ানা নামটা কঠিন লাগছে আমার কাছে, তাই ছোট করে নোনা ডাকলাম। ভেবেছিলাম নোনা ডাকলে তুমি মাইন্ড করবে না। কিন্তু তুমি তো মাইন্ড করলে। তোমাকে নোনা বলে ডাকাটা কি এতটাই দোষের?”

“আপনি আর ফোন করবেন না আমাকে।”

“কিন্তু ফোন না করে যে আমি থাকতে পারবো না।”

“আপনি ফোন করলে আমি বিরক্ত বোধ করি।”

“আনন্দ বোধও তো করো।”

“ভুল ধারণা আপনার।”

“শুধু একবার চিনতে পারো আমায়, সকল ভুল কাটিয়ে সঠিক করে নেবো আমি।”

“আমি চিনি না আপনাকে। আপনি আষাঢ়, আপনি কবির আঙ্কলের ছেলে এটাই জানি আমি।”

নোয়ানার অকপটে মিথ্যা বলায় হাসলো আষাঢ়।
“তাই? ঠিক আছে, চিনতে হবে না আমায়। নতুন করে আবার চেনা জানার শুরু হোক তাহলে।”

কথাটা শেষ করে কল কেটে দিলো আষাঢ়। নোয়ানার থমথমে মুখটা দেখতে পাচ্ছে সে। ফিচেল হেসে বললো,
“তুমি এখনও একই রকম আছো লাভলি বার্ড!”

আষাঢ় ভালো করে খেয়াল করে দেখলো, স্বভাব একই থাকলেও চেহারায় হালকা পরিবর্তন এসেছে নোয়ানার। গায়ের রংও আগের থেকে একটু কালো পূর্ণ হয়েছে। এটার কারণ কী? তার প্রিয়তমার গায়ের রং কালচে হয়েছে কেন তার মতো? বাংলাদেশের ওয়েদার এর পিছনে দায়ী না কি? আষাঢ়ের রাগ হলো। আবহাওয়াও আজকাল মানুষের রূপ পরিবর্তন করে দিচ্ছে?

_________________

জগিংএ যাওয়ার সময় মিহিককে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছিল শ্রাবণ। আর জগিং থেকে ফিরে মিহিককে একদম পরিপাটি অবস্থায় দেখলো। পরনে থ্রি পিস নেই, একটা সবুজ কাতান শাড়ি পরে আছে। ফ্লোরে থাকা বিছানাপত্রও নেই। সবকিছু একেবারে গোছগাছ। শ্রাবণের মনে হলো মিহিক মেয়েটা গোছানো স্বভাবের। শ্রাবণ সে নিয়ে অহেতুক না ভেবে নিজ কাজে মন দিলো। তার রেডি হয়ে দ্রুত রুমকির সাথে দেখা করতে যেতে হবে। জানে রুমকি আটটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না, তাও সে আগে ভাগেই রেডি হচ্ছে। গিয়ে অপেক্ষা করবে। রুমকির ঘুমে ডিস্টার্ব হোক সেটা সে চায় না।
মিহিক নিচে চলে গেছে ততক্ষণে। মিহিকের সাথে কোনো কথা হয়নি তার। অনেক বার ভেবেছে মিহিককে ‘গুড মর্নিং’ জানাবে, কিন্তু জানাতে পারেনি। জড়তা কাজ করছিল। মিহিক এখন তার বউ, তার বউ পরিচয়ে এ বাড়িতে ঘুরে বেড়াবে, ব্যাপারটা ভাবতে কেমন যেন লাগছে শ্রাবণের। যেখানে রুমকির তার বউ পরিচয়ে থাকার কথা, সেখানে মিহিক তার বউ পরিচয়ে আছে, এ সবটাই বাবার দোষ। রুমকির সাথে তার বিয়েটা দিলে কী এমন ক্ষতি হতো? শ্রাবণ এরকম নানান চিন্তা ভাবনা করতে করতে রেডি হয়ে নিচে নামলো। সোজা বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইছিল, মা ডাইনিং থেকে ডাকলেন,
“কোথায় যাচ্ছ শ্রাবণ?”

শ্রাবণ ঘাবড়ালো না। আগে থেকে উত্তর তৈরি করে রেখেছে সে। মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের পাশেই আবিষ্কার করলো মিহিককে। আর কেউ না জানলেও মিহিক জানে সে কোথায় যাচ্ছে। মিহিকের সামনে মিথ্যা বলতে বাধলো শ্রাবণের। তাও বললো,
“আমার খুব জরুরি একটা কাজ আছে আম্মু।”

“কী এমন জরুরি কাজ? নাস্তা করে যাও।”

“সময় হবে না।” শ্রাবণ আর দাঁড়ালো না। মিহিকের উপর শেষ বার দৃষ্টি বুলিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল।

মিহিকের নিজের কপাল নিজের চাপড়াতে ইচ্ছা করছে। ভুল! বড্ড ভুল হয়ে গেল শ্রাবণকে বিয়ে করা। ইচ্ছা করছে এ বাড়ি থেকে এক্ষুণি চলে যেতে। কিন্তু যাবে কোথায়? নিজের বাড়ি? না, ওখানে তো যাবে না আর। একটা বার পা দেবে না ও বাড়িতে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here