বিবর্ণ জলধর পর্ব:২৮

0
796

#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৮
_____________

মিহিক বলতে গেলে এখন প্রায় সুস্থ। আষাঢ়ের জ্বরও যাব যাব করছে। কিন্তু একেবারে যাচ্ছে না দেখে আষাঢ় বার বার বলছে,
‘কী ঔষধ দিলো ডক্টর? এখনও সুস্থ হচ্ছি না কেন আমি?’
কারিব তাকে বোঝাচ্ছে,
‘ইনশাআল্লাহ, আপনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবেন আষাঢ় ভাই।’

মিহিক সুস্থ বোধ করার কারণে বাবার বাড়ি এসেছে সকালে। এসেই একটা খবর পেল। খবরটা শুনে মিহিক বিস্ময়ে বিমূঢ়।
ওদিকে শ্রাবণ এই খবরটা পেল বিকেল নাগাদ। তখন সে অফিসে। খবরটা দিলো কারিব। কারিব সপ্তাহে একদিন কি দুইদিন এসে অফিসে টুকটাক কাজ করে যায়। বাকি দিনগুলো আষাঢ়ের সাথে ঘুরে ঘুরে কাটায়। কেবিনের দরজায় উঁকি দিয়ে কারিব বললো,
“খবর কি শুনেছেন শ্রাবণ ভাই?”

শ্রাবণ অন্যমনস্ক ছিল। ভাবছিল মিহিককে, সাথে রুমকির ভাবনাও বাদ যায়নি। কারিবকে দেখে সে বুঝতে পারলো বড়ো কোনো খবর হবে। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী খবর?”

কারিব রুমে ঢুকলো। শ্রাবণের সম্মুখের একটা চেয়ারে বসে গলার স্বর একধাপ নিচু করে বললো,
“রুমকি পালিয়েছে বাসা থেকে।”

শ্রাবণের মুখ থেকে কৌতূহল কেটে গেল। মুখ হয়ে উঠলো বিবর্ণ।
“কী?”

“হ্যাঁ শ্রাবণ ভাই, হ্যাঁ। পালিয়েছে প্রায় কয়েকদিন হয়ে গেছে। রুমকির ফ্যামিলি সবটা গোপন রেখেছিল। কিন্তু বিষয়টা এখন আর গোপন রইল না। একজন থেকে একজন করতে করতে অনেক জনের মাঝে ছড়িয়ে গেছে কথাটা। ভেবে দেখুন এখন, আপনি কেমন মেয়ের জন্য পাগল ছিলেন।”

শ্রাবণের সবকিছু লন্ডভন্ড মনে হচ্ছে। আশপাশের যাবতীয় সব কিছু যেন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। হৃদয় ভেঙে বেঁকে যাচ্ছে যেন তার। অন্তঃকরণে অস্থির ঝঞ্ঝা। বাইরে শান্ত প্রশ্ন করলো,
“একা পালিয়েছে?”

“উহু, একা পালাবে কেন? বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়েছে।”

ব্যাপারটা খটকা লাগলো শ্রাবণের। বয়ফ্রেন্ড? রুমকির বয়ফ্রেন্ড তো সে। সে তো এখন অফিসে। তাহলে রুমকি বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়েছে কীভাবে? কারিবকে প্রশ্ন করলো,
“বয়ফ্রেন্ড মানে?”

“রুমকির বয়ফ্রেন্ডদের ভিতর একজন প্রবাসী বয়ফ্রেন্ড ছিল। এক বছর যাবৎ না কি সম্পর্ক তার সাথে। ওই বড়োলোক ইতালি প্রবাসীর সাথেই পালিয়েছে সে।”

শ্রাবণের মাঝে আক্রোশের জন্ম হচ্ছে। চোখ হয়ে উঠছে রক্তিম। সে কাঠিন্য স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি শিওর রুমকি তার প্রবাসী বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়েছে?”

“হ্যাঁ শ্রাবণ ভাই, একশ পার্সেন্ট শিওর।”

শ্রাবণের মস্তিষ্কে তোলপাড় হতে লাগলো। বসা থেকে উঠে হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

কারিব পিছন থেকে ডাকলো,
“কোথায় যাচ্ছেন?”

শ্রাবণের থেকে প্রত্যুত্তর পাওয়া গেল না। অফিস থেকে বের হয়ে সোজা চলে এলো সে এক লেকের পাড়ে। পাড় ঘেঁষে থাকা ওয়াক ওয়ে দিয়ে হাঁটছে কিছু মানুষ। ফোন বের করে রুমকিকে কল করলো সে। রুমকির ফোন আগেকার মতো বন্ধ। যে পালিয়ে গেছে সে কি আর ফোন অন রাখবে? তাও শ্রাবণ পাগলপ্রায় হয়ে কিছুক্ষণ ধরে কল করে গেল। এই তাহলে কারণ রুমকির এতদিন ফোন বন্ধ রাখার? রুমকি এভাবে ধোঁকা দিলো? রুমকির যখন প্রবাসী বয়ফ্রেন্ড ছিল, ও যখন ওই বয়ফ্রেন্ডের সাথেই পালিয়ে যাবে, তাহলে তার সাথে রিলেশনশিপে আসার মানে কী ছিল?
রাগে শ্রাবণের সর্বাঙ্গ কাঁপছে। রুমকি ফ্লার্ট করেছে তার সাথে। এটা কীভাবে করলো রুমকি? রাগে-দুঃখে শ্রাবণের কান্না পাচ্ছে। নিজের চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।

সন্ধ্যার ঝাপসা আঁধার যখন রাতের কালো আঁধারে পদার্পন করেছে, তখন শ্রাবণ বাড়ি ফিরলো। মাগরিবের নামাজও কাযা গেছে তার। লিভিং রুমে রুপালি রুমকিকে নিয়ে নানান কথা বলায় ব্যস্ত ছিল জুন আর লায়লা খানমের সাথে। শ্রাবণের আগমনে তাদের কথার ইতি ঘটলো। শ্রাবণ একটুর জন্য লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে বেড রুমে চলে এলো।
মিহিক বেডে হেলান দিয়ে মোবাইল টিপছিল। শ্রাবণকে দেখে বললো,
“এত দেরি করে বাসায় ফিরলেন কেন?”

শ্রাবণ উত্তর দেয় না। গম্ভীর মুখ নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়।
মিহিক বুঝতে পারলো রুমকির বিষয়টা শ্রাবণের কান অবধি পৌঁছেছে। সে বললো,
“আপনার গার্লফ্রেন্ড যে তার বয়ফ্রেন্ডের কাছে চলে গেছে সে খবর কি পেয়েছেন?”

শ্রাবণের মস্তিষ্ক গরম হয়ে গেল। পিছনে তাকিয়ে ক্রোধ সঙ্গতায় বলে উঠলো,
“আপনার সাথে আমার একদম কথা বলার মুড নেই মিহিক। অতএব আর একটা কথাও না বলে আমাকে বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকুন।”

আলনা থেকে তোয়ালে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল শ্রাবণ।
মিহিক তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলো,
“রুমকির রাগ কি উনি আমার উপর ঝাড়ছেন?”

______________

গুণে গুণে দুইটা দিন পার হলো। শ্রাবণের কোনো কিছুতে মন বসে না। না কাজে, না ঘুমানোয়, না খাওয়ায়। রুমকির ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়েছে সে। রুমকির সত্যি একজন প্রবাসী বয়ফ্রেন্ড ছিল। আর রুমকি তার কাছেই গিয়েছে। রুমকি পালিয়েছে বলে যে তার খুব কষ্ট হচ্ছে সেটা না। তার প্রশ্ন, রুমকি এটা কেন করলো? যখন ওই ছেলের সাথে ওর দুই বছর ধরে রিলেশন, তখন তার সাথে মাঝখান থেকে কেন রিলেশনশিপে জড়িয়েছিল?
প্রশ্নের উত্তরটা রুমকির কাছ থেকেই মিললো। বিকেল পাঁচটার দিকে শ্রাবণের মোবাইলে আননোন নাম্বার থেকে একটা বড়ো-সড়ো ম্যাসেজ আসলো। ম্যাসেজের প্রথম লাইন দেখেই শ্রাবণ বুঝতে পারে এটা রুমকি। ম্যাসেজে লেখা–

‘কেমন আছিস গাধার বাচ্চা? চিনতে পেরেছিস আমায়? হুম, এটা আমি। ইওর ফার্স্ট লাভ। কী ভেবেছিলি তুই? তোর মতো একটা বলদের সাথে সত্যি সত্যি প্রেম করছি আমি? ওহ নো, ইউ আর রং। তুই আমার বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলি। তাতে লাভ-লস দুটোই হয়েছিল আমার। তবে লাভের থেকে দশ গুণ বেশি লস হয়েছে। বিয়ে ভাঙার কারণে আমি খুশিও হয়েছিলাম একটু, আবার আফসোসেও শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। আফসোসটা বলতে গেলে একটু বেশিই হয়। যা লস করলি আমার!
এখন লাভের গল্পটা শোন– বিয়ে ভাঙায় লাভ হয়েছিল এটা যে, বিয়ে হলেও পরে সম্পর্কটা ভেঙে যেত। বিয়ের পরে যেটা ভেঙে যেত, সেই ঝামেলা বিয়ের আগেই ভেঙে গেছে।
আর লসের গল্পটা খুব করুণ। এই গল্পটা একটু ধীরে সুস্থে শোন।
বিয়ে ভাঙার কারণে তোর উপর রাগ ছিলাম। এই রাগ তো তোর উপর কিছুতেই মিটছিল না আমার। চিন্তা করলাম কঠিন আকারে একটা ছ্যাঁকা দেবো তোকে। ভালোবাসার সাধ মিটিয়ে দেবো। সব ভালোই চলছিল, কিন্তু মাঝখান থেকে তোর বিয়েটা হয়ে গেল।
বিশ্বাস কর, তোর বিয়েতে এতটুকু খারাপ লাগেনি আমার। তোর বিয়ের দিন যেসব চিল্লাপাল্লা করেছি, ওগুলো ছিল ফেইক। তোর বিয়ে এ খবরটা আমি তোর বিয়ের দিন না, আরও অনেক আগে থেকেই পেয়েছিলাম। খবরটা শুনে হাসি পাচ্ছিল। তোর মতো বলদকে বিয়ে করে বেচারি ডাইনিটার জীবন পুড়লো। তুই তো কোনো দিক থেকেই পারফেক্ট না। শুধু দেখতে একটু সুদর্শন তুই, আর কিছু না। আস্ত একটা আহাম্মক! আমার বয়ফ্রেন্ডের ধারে কাছেও নেই তুই। শুধু এ বয়ফ্রেন্ডের কথা কেন বলছি? তুই আমার এ যাবৎ কোনো বয়ফ্রেন্ডেরই ধারে কাছে নেই। প্রথম দিক থেকেই ধারণা করেছিলাম তুই একটা আহাম্মক। আর এই জন্যই তুই আমার টার্গেট থেকে বাদ পড়েছিলি। আমার আবার আহাম্মক টাইপ ছেলে একদমই পছন্দ নয়। তোর ছোট ভাই হলে একটা কথা ছিল। তোর ভাইকে অবশ্য আমি টার্গেট করেছিলাম। কিন্তু কী জানি, তোর ভাই আমার ইশারায় সাড়া দিলো না। আমি এক বছরের সিনিয়র বলে বোকাটা পটেনি এমন তো নয়, শুনেছি ওর একটা গার্লফ্রেন্ড আছে ওর থেকে দুই বছরের সিনিয়র। আচ্ছা বাদ দিই ওর কথা, তোর কথা বলি এখন। তোর মতো আহাম্মককে ম্যাসেজ পাঠাতেও আমার রুচিতে বাধছিল। কিন্তু কিছুদিন ভুয়া প্রেম তো করেছি তোর সাথে, একটা দায়িত্ববোধ আছে না?
আমার বয়ফ্রেন্ডের দেশে ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। অনেক বাছাইয়ের পর আমি ওকে সুনির্দিষ্ট করেছি। মা-বাবাকেও বলেছিলাম ওর কথা। রাজিও ছিল তারা। কিন্তু হঠাৎ করে মা-বাবার কী হলো জানি না। তাদের ধারণা ছিল ওর থেকেও আমার জন্য অন্য কেউ ভালো হবে। ভালো এক ছেলের সাথে বিয়েও ঠিক করে ফেললো আমার। এক ইশারায় ছেলেটাকে বিয়ে করতে সম্মতি দিয়েছিলাম। কারণ, আমার প্ল্যান তো আগে থেকেই সাজিয়ে রাখা। বিয়ের পর ওই বড়োলোক ছেলের টাকা-পয়সা নিয়ে চলে আসবো আরশাদের কাছে। এলাম তো চলে। কিন্তু বড়োলোক স্বামীর টাকা আনতে পারলাম না, আফসোস! এর পিছনে তো তুই দায়ী।
কথায় কথায় অনেক কিছুই বলে ফেললাম তোকে। বলদ তো তুই, যা খুশি বলা যায় তোকে। আচ্ছা শোন, আরশাদকে বিয়ে তো করে ফেলেছি আমি, কয়েক মাস পর বাড়িতেও চলে আসবো স্বামী নিয়ে। তোকে অগ্রিম আমন্ত্রণ জানালাম, আমার বরকে দেখতে আসবি। চেয়েছিলাম কঠিন একটা ছ্যাঁকা দেবো তোকে, কিন্তু মনে হচ্ছে ছ্যাঁকার পরিমাণটা কম হয়েছে। বউয়ের প্রতি এত দ্রুত পিরিত জন্মালো কেন তোর? আরও পরে জন্মালে ছ্যাঁকাটা বেশি কঠিন হতো।
আচ্ছা বাদ দিলাম এসব। তোর সাথে আর কিছু বলার ইচ্ছা নেই আমার। শেষে একটা প্রশ্ন করতে চাই, আমি আরশাদের কাছে চলে আসার কারণে কতটা কষ্ট পেয়েছিস তুই? প্রশ্নটা আমাকে ম্যাসেজ অথবা কল করে জানাবি সেই সুযোগ তো আমি রাখবো না। উত্তরটা জমিয়ে রাখিস। পরে যখন তোর সাথে দেখা হবে সামনা-সামনি উত্তরটা জেনে নেবো। বাই ডার্লিং!’

পুরো ম্যাসেজ পড়ে শ্রাবণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। রাগে ফুঁসে উঠতে লাগলো তার ভিতর। সেই সাথে মন পড়ে গেল অসহায়ত্বের দুর্বিপাকে। ঘৃণারাও পাক খেয়ে উঠলো। বাম হাত দিয়ে চুল খামচে ধরলো সে। যে নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে সেই নাম্বারে কল করলো। কিন্তু সংযোগ পেল না। রুমকি এমন করলো তার সাথে? রাগে মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেললো শ্রাবণ। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
বিছানায় মিহিক বসেছিল। অনেকক্ষণ ধরে শ্রাবণকে খেয়াল করেছে সে। কিছু বলেনি। হঠাৎ করে লোকটা পাগলের মতো হয়ে গেল কেন? ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটালো মিহিক। তারপর শ্রাবণের মোবাইলটা কাছে টেনে নিলো।

________________

প্রকৃতি ঢেকে গেছে তিমিরে। গুড়ুম গুড়ুম মেঘ ডাকার শব্দ আসছে কানে। আজকেও বোধহয় বৃষ্টি হবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস পর্যবেক্ষণ করা হয়নি মিহিকের। ছাদে উঠে শ্রাবণকে দেখলো ছাদের কর্ণারে বেঞ্চিতে বসে আছে। লোকটা সেই যে বিকেলে রুমকির ম্যাসেজ পাওয়ার পর রুম থেকে বের হয়েছে, আর রুমে ফেরেনি। মাগরিবের নামাজও পড়েনি বোধহয়। মিহিকের নামাজ আদায় করা হয়েছে। মাথার হিজাব এখনও অবধি পরা সে। এগিয়ে এসে শ্রাবণের পাশে বসলো।
পাশে কেউ বসেছে টের পেয়ে তাকালো শ্রাবণ।
খয়েরি হিজাব পরিহিত অপূর্ব সৌন্দর্যে আবৃত মেয়ে মুখটা নজরে পড়লো তার। এক দণ্ড তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলো।
মিহিক নিবিড় গলায় বললো,
“গার্লফ্রেন্ড পালিয়েছে বলে কি খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার?”

শ্রাবণের তিরিক্ষি, ঝাঁঝালো গলা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল মিহিক। কিন্তু শ্রাবণ তাকে শান্ত কণ্ঠে বললো,
“আমি কষ্ট পেলে কি আপনি খুশি হবেন? না কি কষ্ট না পেলে?”

“আপনার ধারণা কী বলে? কোনটাতে খুশি হবো আমি?”

শ্রাবণ হৃদয় চেরা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। আগের মতো শান্ত কণ্ঠে বললো,
“হুম, আমার গার্লফ্রেন্ড পালিয়েছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, আমার তেমন কষ্ট হচ্ছে না এতে।”
বলতে বলতে মিহিকের দিকে তাকায় শ্রাবণ।
মিহিক হকচকিয়ে যায়। আঁখি জোড়ায় বিস্ময় প্রলুব্ধ। শ্রাবণের এরকম জবাবে সে অপ্রস্তুত। বুকের ভিতর অদৃশ্য স্থল হতে নির্গত অনুভূতি জানান দেয় শ্রাবণের এ জবাবে সে খুশি। দৈবাৎ অকারণে লজ্জা দেখা দিলো তার মাঝে। শ্রাবণের দৃষ্টিতে অটল থাকতে পারলো না। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। শ্রাবণও চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“গার্লফ্রেন্ড তো, পালিয়ে যাওয়াতে একটু খারাপ লাগছে। এটা লাগার কথা। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার যতটা খারাপ লাগছে এটা পরিমাণে অতি অল্প। এর থেকে আরও অনেক বেশি খারাপ লাগার কথা ছিল আমার। কিন্তু লাগলো না কেন বলুন তো? হঠাৎ এমন অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে কেন আমার সাথে?”

মিহিকের হৃদয় ধুকপুক করছে। শ্রাবণের প্রশ্নের সম্মুখে সে একেবার নড়বড়ে। শ্রাবণের পাশে বসে থাকার মতো পরিস্থিতি অনুভব করলো না আর। দাঁড়িয়ে গিয়ে খাপছাড়া কণ্ঠে বললো,
“সারা রা…সারা রাত কি এখানেই বসে থাকার প্ল্যান আছে আপনার? গার্লফ্রেন্ডের শোকে কি পাগল হয়ে যেতে হবে একেবারে? নিচে যাচ্ছি আমি, আপনিও দ্রুত চলে আসবেন।”

মিহিক দরজার দিকে এগোতে লাগলো ক্রমশ। এই শ্রাবণ তার হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক করে দিয়েছে। এ সমস্ত কথা শ্রাবণের বলার কী দরকার ছিল তার কাছে? দরজার কাছাকাছি চলে এলে পিছন থেকে শ্রাবণের কণ্ঠ ভেসে আসে বাতাসের সাথে,
“রুমকির বিয়ে ভাঙার কারণে আমাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। যদি ওর বিয়েটা না ভাঙতাম, তাহলে আমাদের বিয়েটা কি হতো মিহিক?”

মিহিক স্থির দাঁড়িয়ে গেল। শ্রাবণের প্রশ্ন তার হৃদয়ে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে সেটা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। এই মনে হচ্ছে হৃদয় থমকে গেছে তার। আবার পরক্ষণেই মনে হলো উথাল-পাথাল এক পরিস্থিতি তার হৃদয়ে। হঠাৎ করে এ কেমন প্রশ্ন করলো শ্রাবণ? মিহিকের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। প্রশ্ন যেমনই হোক, সে মিহিক উত্তর দিলো,
“হয়তো না। রুমকির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর হয়তো আপনি অন্য কারো প্রেমে পড়তেন, সে মেয়ে ভালো হলে নিশ্চয়ই আপনার মা-বাবা তার সাথেই বিয়ে দিতো আপনার।”

“রুমকির বিয়ে ভেঙে একদম ঠিক কাজ করিনি আমি। বিয়ে ভাঙাটা চরম ভুল ছিল। রুমকির বিয়েতে ঝামেলা না করলে সব কিছু এখন অন্য রকম থাকতো। আমার মতো একটা অসুন্দর মানুষের স্ত্রী পরিচয়ে থাকতে হতো না আপনার। আপনার কি খুব বেশি কষ্ট হয় এই অসুন্দর মানুষটার স্ত্রী হয়ে থাকতে?”

শ্রাবণের মাথা খারাপই হয়ে গেছে বলে ধারণা মিহিকের। শ্রাবণের এবারের প্রশ্ন তার বক্ষে সূক্ষ্ম ব্যথার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। রুদ্ধ প্রায় গলায় বলে উঠলো,
“হয় কষ্ট। তবে যদি অসুন্দর মানুষটা সুন্দর হয়ে যেতে পারে তাহলে কষ্টটা ঘুচে যাবে আশা করি।”

মিহিক দ্রুত পা ফেললো। অক্ষি দৃশ্যপট থেকে মিহিক অদৃশ্য হয়ে গেলে অদূর আকাশে দৃষ্টি মেলে তাকালো শ্রাবণ। নিকষ কালো আকাশ। শ্রাবণ বিড়বিড় করলো,
“বৃষ্টি কি আজ হবে? মনের সাথে পাল্লা দিয়ে?”

_________________

বর্ষণমুখর দিন। বাইরে বারি ধারার উপচে পড়া ভিড়। ঝুপঝাপ শব্দ হয়ে যাচ্ছে এক নাগাড়ে। লাইব্রেরি রুমের দরজা জানালা সব বন্ধ। বাইরের বৃষ্টির শব্দ তাই ভিতরে ক্ষীণ। আষাঢ় চেয়ারে বসা। কানে তার ফোন লাগানো। কথা হচ্ছে স্থায়ী গার্লফ্রেন্ড জেনির সাথে।

“তোমার ড্যাড আবারও মেরেছে তোমাকে?”
আষাঢ়ের কণ্ঠ ক্ষিপ্র।

জেনির কণ্ঠ আবেগি,
“এটা সামান্য। ড্যাড ড্রিঙ্কস করেছিল তাই…”

“কিছু দিনের জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে যাও। কোনো ফ্রেন্ডসের বাসায় থাকো, না হয় একটি ভ্যান ভাড়া করো। কিছু দিন মেয়ের কাছ থেকে দূরে থাকলেই মি. গিভসন বুঝবেন স্ত্রী হারানোর পর মেয়ে হারানো কতটা কষ্টের।”

“আমি সবটা সামলে নেবো ডার্লিং। তুমি এ নিয়ে বেশি চিন্তা করো না। আচ্ছা, এখন আমার লাইন কাটতে হবে। রান্না করবো।”

“ও কে। ডিনারের জন্য অভিনন্দন।”

আষাঢ় মোবাইলটা কান থেকে সরিয়ে টেবিলের উপর রেখে, চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো। কারিব বুক শেলফে একটা বই খুঁজছিল। পিছন থেকে আষাঢ়ের তাচ্ছিল্য কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ঘাড় ঘুরালো।

“হুহ্, আমি জানি তো তুমি কোথায় থাকবে। বয়ফ্রেন্ড মার্কের সাথে থাকবে তার বাসায়।
কী ভেবেছো? আমি জানি না?”

আষাঢ়কে একা একা কথা বলতে দেখে কারিব ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
“কী বলছেন আপনি আষাঢ় ভাই?”

আষাঢ় হেলিয়ে দেওয়া মাথা সোজা করে বসে বললো,
“আমি জেনির কথা বলছি। তুমি কি আমাদের কথপোকথন শোনোনি? মি. গিভসন ড্রিঙ্ক করার পর ওকে মেরেছে। আমি ওকে কদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে ফ্রেন্ডসদের বাসায় অথবা একটা ভ্যান কিনে থাকার এডভাইস দিয়েছি। কিন্তু ও তো আমার কথা শুনবে না। বাড়ি ছেড়ে গেলেও, মার্কের কাছে গিয়ে থাকবে।”

“মার্ক মানে, তার বয়ফ্রেন্ড?”

“হুহ।”

“আপনার কি দুঃখ লাগছে উনি মার্কের কাছে গিয়ে থাকবেন বলে?”

“দুঃখ কেন লাগবে? হ্যাঁ, সে আমার স্থায়ী গার্লফ্রেন্ড। আমার গার্লফ্রেন্ড হয়ে সে তার অন্য বয়ফ্রেন্ডের কাছে থাকবে এটা ভেবে একটু খারাপ লাগছে আমার। কিন্তু ওটা ব্যাপার না। আমার ভাইয়ের কথা বলো। তার গার্লফ্রেন্ড তো অন্য বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে। আমার ভাই কি এখনও খুব দুঃখী?”

“মনে হচ্ছে না উনি খুব দুঃখী। গত দুই দিন যেরকম ছিল এখন আর তেমন দেখতে পাচ্ছি না। মুখটা দেখে দুঃখী লাগে না। আজকে সকালে জিমেও গেলেন। ব্রেকফাস্টও করলেন মন দিয়ে, অফিসেও গেলেন স্বাভাবিক চেহারা নিয়ে।”

“তার এই স্বাভাবিকতার মূলে কে আছে জানো?”

“কে আছে?”

“ভাবি। ব্রো হয়তো বুঝতে পারছে না সে ভাবিকে ভালোবাসে। কিন্তু মনে আসলে ভাবির জন্য অনুভূতি আছে। রুমকি তো এখন নেই, তাই একটু দ্রুতই বুঝে যাবে নিজের অনুভূতি। এখন আমার টিউলিপের কথায় আসা যাক। আমার টিউলিপ কবে বুঝবে আমাকে, বলো তো?”

“শীঘ্রই বুঝবে আশা করি।”

আষাঢ়ের মুখটা দুঃখী। দু চোখে করুণতা। হৃদয়ে হাহাকার। নিভে যাওয়া গলায় বললো,
“সে কি বোঝে না তার এরকম আচরণে আমি কষ্ট পাই? সে কি সত্যিই বোঝে না? হৃদয় পোড়ে আমার। আমার হৃদয় পোড়ার জ্বালা কি ভীতু মেয়েটার হৃদয়ে কষ্ট দেয় না? ওই বিষণ্ন মুখখানিতে আমার জন্য চাপা ভালোবাসা দেখতে চাই না আমি, প্রকাশিত ভালোবাসা দেখতে চাই। চাপা ভালোবাসা খুব বাজে কারিব। আর যারা চাপা ভালোবাসা শুধু হৃদয়ে পুষে রাখে তারা আরও বেশি বাজে। তোমার টিউলিপ ভাবিও ওই বাজে দলের একজন। চাপা ভালোবাসা পুষে রাখা মানুষগুলো অনেক কিছু পারে। তাদের হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও তারা ভালোবাসার কথাটা মুখে প্রকাশ করে না। এত বাজে হয় কীভাবে মানুষ? এত বাজে ভাবে বিক্ষত করতে পারছে কী করে আমায়? করুক সে। তবে আমি তার মতো নই। সে কষ্ট সইতে পারে, সে ধৈর্যশীল। আমি তার উল্টো।”

কারিব মনোযোগ সহকারে শুনলো আষাঢ়ের সব কথা। মাঝে মাঝে আষাঢ়ের এমন কথা শুনলে তার কষ্ট লাগে খুব। আষাঢ় পকেট থেকে ক্ষুদ্র একটি বক্স বের করলো। বক্সটা খুলে সেখান থেকে বের করলো একটা রিং। রিংটা দেখে কারিব বললো,
“আংটিটা কীসের আষাঢ় ভাই?”

আষাঢ় মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
“এনগেজমেন্ট রিং।”

“আপনার হবু বউয়ের জন্য?”

“না। সে তো এনগেজমেন্ট ছাড়াই আমার হবু বউ হয়ে বসে আছে। ভাবছি এনগেজমেন্টের পালা সেরে এবার অন্য কাউকে হবু বউ বানাবো।”

কারিবের কিছু বুঝতে আর বাকি থাকে না। নিঃশব্দে হাসে সে। আষাঢ় রিংটা পলকহীন দেখতে দেখতে বললো,
“আমি বড্ড ধৈর্যহীন টিউলিপ ফুল!”

(চলবে)
______________

(অসুস্থ আমি! সাথে আবার লেখাপড়ার চাপ। দুদিন বসে খুব কষ্টে পর্বটা লিখেছি। মাথায় কোনো শব্দই আসছিল না। অগোছালো ভাবনায় লিখলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here