বিবর্ণ জলধর পর্ব:৩২

0
740

#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩২
_____________

আষাঢ়ের কথায় নোয়ানা রাগে ফুঁসে বললো,
“যদি পারতাম তাহলে আপনাকে চড় মেরে আপনার গাল লাল বানিয়ে ফেলতাম।”

নোয়ানার কথার প্রতিক্রিয়ায় আষাঢ়ের মাঝে কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না। হাস্য মুখে বললো,
“চড় মেরে গাল লাল বানিয়ে ফেলো তাতে সমস্যা নেই। তবে এই লাল কাটিয়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা রেখো। শুধু একটা…”
আষাঢ়ের পরবর্তী কথা তার কণ্ঠতেই থমকে গেল। নোয়ানা আষাঢ়ের অধরে তর্জনী ঠেকিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“চুপ করুন। একদম চুপ হয়ে যান। আপনার এরকম কথা শুনতে শুনতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।”
নোয়ানা আঙুল নামিয়ে নিলো।

“আমি কি বলতে চাইছিলাম সেটা কি তুমি জানো?”

“জানি। আপনার কথাবার্তার ধরণ মুখস্থ হয়ে গেছে আমার।”

“তাই? তো বলো তো, কী বলতে চাইছিলাম আমি?”

“বড়ো হয়ে আপনি এমন অসভ্য একজন মানুষ হয়ে উঠবেন এ বিষয়ে আমি অজ্ঞ ছিলাম। সত্যিই বুঝতে পারিনি। আপনি কি জানেন আপনি একজন পাগল?”

“আমি অসভ্য? পাগল?”

“এ বিষয়ে সন্দেহ আপনার মাঝে মানায় না।”

নোয়ানা ঘুরে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। বাড়ির ভিতরে ঢুকে সশব্দে বাড়ির গেট বন্ধ করে দিলো। তার পা দুটো বন্ধ গেটের ওপাশেই স্থির দণ্ডায়মান হলো। হৃদয়ে কষ্ট হচ্ছে। আষাঢ়ের সাথে দেখা, কথা হওয়ার পরই তার অন্তঃকরণে একটা চাপা মর্মান্তিক কষ্ট অনুভব হয়। শুধু শুধু কেন এই কষ্টের আগমন? আঁখি কোটর থেকে জল গড়িয়ে পড়লো তার। ওড়না দিয়ে মুছে নিলো। ইদানিং যেন তার মনটা নরম হয়ে উঠছে, আবেগি হয়ে উঠছে। কিন্তু এমনটা তো সে চায় না। নরম, আবেগি মন সে বরাবরের মতো মাড়িয়ে আসতে চায়।

“ভাবির সাথে কী কথা হলো আপনার? উনি আপনার ঠোঁটে এরকমভাবে আঙুল ছোঁয়ালো কেন?”

“এটা মিথ্যা স্বপ্ন বলার ফল কারিব। কখনো কাউকে মিথ্যা স্বপ্ন বলেছো?”

কারিব না সূচক মাথা নাড়লো।

“ভিতরে চলো। সবাইকে মানাতে হবে।”

লিভিং রুমে এখনও হতভম্ব সবাই বসে আছে। এদের ভিতর সিনথি অনুপস্থিত। মেয়েটা যেমন সাইকো, তাতে এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তবে অন্য একজন যোগ হয়েছে, জুন। আষাঢ়কে দেখে লায়লা খানম দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“ওই মেয়েটা কে আষাঢ়?”

“কেউ না।”

“কেউ না মানে কী? এভাবে বাড়িতে এসে তোমার খোঁজ করলো কেন? তুমিই বা ওর সাথে এরকম আচরণ কেন করলে?”

“ও এর থেকে ভালো আচরণ পাওয়ার যোগ্য ছিল না।”

“শুকরিয়া করো যে তোমার আব্বু বাড়িতে ছিল না। না হলে আজ অনর্থক হয়ে যেত।”

আষাঢ় নিরুত্তর রইল।

“সিনথিয়াকে কী বলবো আমি? ও কী মনে করলো আজ এই ঘটনা থেকে?”

“সিনথিয়াকে আমি মানিয়ে নেবো। এটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না আম্মু।”

আষাঢ় কারিবকে ইশারা করলো নিজের সাথে আসতে। কাউকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে উপরে চলে গেল তারা।

রুপালি লায়লা খানমকে হুঁশিয়ার করে বললো,
“দ্রুত সিনথিয়ার সাথে আষাঢ়ের বিয়া দিয়ে দেন আপা। সবে তো একটা মেয়ে আসছে, ভবিষ্যতে যদি আরও মেয়েরা আসা যাওয়া শুরু করে তখন কী করবেন?”

রুপালির কথায় অপ্রস্তুত বোধ করেন লায়লা। এখানে মিহিক উপস্থিত আছে। বাড়ির বউয়ের সামনে তার ছেলেকে নিয়ে এমন একটা কথা বলতে পারে কী করে রুপালি? মাথায় কিছু নেই ওর? সে রুপালির কথা শুনে চুপচাপ থাকলেও, জুন ভাইয়ের সমন্ধে এমন কথা সহ্য করলো না। প্রতিবাদ করে বললো,
“আমার ভাইকে দোষ দেওয়ার চেষ্টা করো না রূপ খালা। সব দোষ ওই মেয়েটার। একশ পার্সেন্ট দোষী ওই মেয়ে।”

মিহিক ঘটনার কালচক্রে ভিতরে ভিতরে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। আজকের দিনটা বড়ো ক্লান্তিময় লাগছে তার। তবে খুশির একটা রেশও ছাপিয়ে আছে সেই ক্লান্তির মাঝে।

_________________

চোখ খুলে যদি দেখা যায় এক জোড়া চোখ তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে, তাহলে কেমন লাগে তখন? অন্য কারো কেমন লাগবে জানে না, কিন্তু শ্রাবণের কাছে ঘটনাটা বিব্রতকর ছাড়া আর কিছুই লাগলো না। শোয়া থেকে দ্রুত উঠে গেল সে। আর মিহিক তখনই বললো,
“আপনিও এত ঘুমাতে পারেন? রোজ তো আজানের সাথে সাথেই ওঠেন। তাহলে আজ এত ঘুমে পেল কেন আপনাকে?”

শ্রাবণ আড়ষ্ট গলায় বললো,
“কয়টা বাজে?”

“বাইরের রোদ দেখে কি মনে হচ্ছে এখন সকাল পাঁচটা বাজে? সাড়ে দশটা বাজে এখন।”

“সাড়ে দশটা?” শ্রাবণের কপালে ভাঁজ পড়লো। এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে? অবশ্য এটাই কি স্বাভাবিক নয়? ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমালে সেই ঘুমের রেশ কখন কাটবে সেটা কে জানে? কিন্তু এলার্ম তো বাজার কথা। না কি বেজেছিল? সে টের পায়নি? গতরাতে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমানোর কারণ, আসলে সে জানতো রাতে তার ঘুম আসবে না। পুরো রাত জুড়ে চেতনা বিলুপ্ত কাজটা তার মাথা খাবে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া। ইতস্তত কণ্ঠে বললো,
“সাড়ে দশটায় ঘুম থেকে উঠলেও তো সমস্যা নেই। আজ তো ছুটির দিন। শুধু নামাজটা কাযা গেল! আপনি ডেকে তোলেননি কেন আমাকে?”

মিহিক জবাব দিলো না। খানিকক্ষণ নীরব তাকিয়ে থেকে বললো,
“বিছানার এত পাশ ঘেঁষে কোনো মানুষ শোয়? ভেবে তো ছিলাম ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে যাবেন।”

মিহিকের কথায় শ্রাবণ একটুখানি লজ্জা পেল। মাথা নুইয়ে রাখলো।
মিহিক বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিন।”
যাওয়া দিয়ে আবার দাঁড়িয়ে বললো,
“ওহ হ্যাঁ, আপনার ভাইয়ের খোঁজে আজ একটা মেয়ে এসেছিল বাসায়।”

শ্রাবণ চমকে গিয়ে বললো,
“কোন মেয়ে?”

“ধারণা বলছে মেয়েটা আপনার ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড ছিল।”

“আব্বু কি মেয়েটাকে দেখেছে?”

“না, তিনি বাসায় ছিলেন না সে সময়।”

শ্রাবণ স্বস্তি অনুভব করলো।

মিহিক বললো,
“আপনার জন্য না খেয়ে বসে আছি। যান, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হন গিয়ে।”

শ্রাবণ অবাকপ্রায় হয়ে তাকালো।
মিহিক মুচকি হেসে বললো,
“বউ মানুষ তো, তাই অপেক্ষা করলাম স্বামীর জন্য।”

শ্রাবণের দু চোখে বিস্ময় তরান্বিত। মনের মাঝে খুশির একটা হাওয়া কি বইছে না? হ্যাঁ, বইছে। টের পাচ্ছে সে। বেখেয়ালে প্রকাশ্যেই হেসে ফেললো মিহিকের সামনে।

_________________

“তুমি এত কাঁচা প্লেয়ার আমি আশা করিনি আষাঢ়। তোমার গার্লফ্রেন্ড বাড়ির উপর কীভাবে চলে এলো? তুমি না একটা প্লে-বয়? প্লে বয়দের এমন হলে চলে না।”

পিছনে সিনথির তাচ্ছিল্য কণ্ঠের কথাগুলো শুনে থেমে গেল আষাঢ়। হাতের চকলেটের প্যাকেটটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে পিছন ফিরে বললো,
“তোমার মস্তিষ্ক কী দিয়ে তৈরি ভাবলে আমি মাঝে মাঝে কনফিউজড হয়ে যাই সিনথিয়া। তোমার হবু বরের গার্লফ্রেন্ড বাড়ি পর্যন্ত এসে গেছে, আর তুমি এরকম কথা বলছো? আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, তুমি আসলে কী? তুমি মেয়ে তো?”

সিনথি দুর্বোধ্য হাসলো,
“মানে কী? আমাকে ছেলে মনে হয় তোমার?”

“ছেলে নয়। তোমাকে যে আমার ঠিক কী মনে হয় আমি নিজেই সেটা বুঝে উঠতে পারি না। অক্টোপাসের চোখ!”

সিনথির ভ্রু কুণ্ঠিত হলো,
“কী? অক…অক্টোপাসের চোখ মানে?”

আষাঢ় উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো। সিনথির প্রশ্নের জবাব দিলো,
“কিছুই না। আমি মাঝে মাঝে অর্থহীন সব শব্দের ব্যবহার করি কথার মাঝে। কারিব জানে এটা। জানো না কারিব?”

সামনে চলিত কারিবকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে আষাঢ়। কারিব দু পায়ে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে বললো,
“হ্যাঁ জানি।”

সিনথি পিছনে সবার অগোচরে মিটিমিটি হাসলো। তারা এখন শপে আছে। কিছু খাদ্য, যেমন- চকলেট, চিপস, বিস্কুট, আইসক্রিম ইত্যাদি কিনতে এসেছে। বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সিনথিয়ার পরনে সিলভার রঙের একটা হিজাব গাউন। আজ শখ করে পরেছে গাউনটা। সন্ধ্যার পর যখন আষাঢ় এবং কারিব বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল, তখন একপ্রকার জোর করেই তাদের সঙ্গে এসেছে সে। আষাঢ় কিছুতেই সিনথিকে নিজেদের সঙ্গে আনতো না। কিন্তু সিনথি তাদের সাথে আসার আবদারটা করেছিল লিভিং রুমে বসে। লিভিং রুমে জানালার কাছে চেয়ারে বসে ছিলেন কবির সাহেব। আষাঢ় যখন সিনথিকে নিজের সাথে নিতে অমত করেছিল, তখন তিনি কাঠ স্বরে বলেন,
“সিনথিয়াকে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। কিছু জায়গা ঘুরিয়ে দেখাও।”

বাবার কথার উপর কথা বলার উপায় পায় না আষাঢ়। বাধ্যতামূলক সিনথিয়াকে নিজেদের সাথে আনতে হয়েছে। এখানে কেনাকাটা করতে এসেছে ঠিকই, কিন্তু আষাঢ়ের মনোযোগ এখানে নেই। তার চিন্তায় নোয়ানা বিরাজ করছে। বিরাজ করছে সুন্দর একটা প্রোপোজ। কীভাবে নোয়ানাকে প্রোপোজ করবে? সে হঠাৎ পিছন থেকে কারিবকে ডাকলো,
“কারিব…”

কারিব থামলো। আষাঢ় গুটি গুটি পা ফেলে কারিবের কাছে এগিয়ে এসে তার সঙ্গ নিলো। কারিবের ঘাড়ের উপর থেকে একহাত ফেলে ফিসফিস করে বললো,
“তোমার টিউলিপ ভাবিকে প্রোপোজ করতে চলেছি আমি আজ।”

কারিব থেমে গেল। অকস্মাৎ পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সিনথির ধ্যান তাদের দিকে ছিল না, কিন্তু সে তাকানোতে সিনথির মনোযোগ পড়লো। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন চোখে তাকালো সে। কারিব চোখ সরিয়ে আনলো। আষাঢ়কে নিচু স্বরে বললো,
“আপনার হবু বউ আছে এখানে। তার উপস্থিতিতে এই বিষয়ে এখানে কথা বলা কি ঠিক?”

আষাঢ় চাপা স্বরে বললো,
“ঠিক নয় কেন? সে শুনলেই বা কী? তাকে পরোয়া করে কে? আর আমি তো কথাগুলো ফিসফিস করে বলছি তোমাকে।”

আষাঢ়ের কথায় যুক্তি খুঁজে পেল কারিব। আগের মতো নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কীভাবে প্রোপোজ করবেন আজকে? এখন তো রাত। টিউলিপ ভাবিকে তো বাইরে পাবেন না।”

“বাইরে পাওয়ার কী দরকার? সেদিনের মতো গেট টপকে ঢুকবো চোরের মতো। তারপর তোমার ভাবির সম্পূর্ণ মনটা চুরি করবো।”

কারিব হাসলো। সিনথি পিছনে থেকে আষাঢ় এবং কারিবের কথা বলার সারবস্তু ধরতে পারলো না। আসলে সে ধরার প্রয়োজন বোধ করলো না। তবুও হঠাৎ তার মুখটা বৃষ্টি হবার আগ ক্ষণের মতো মেঘলা রূপ ধারণ করলো।
কেনাকাটা হলো, বাড়ি ফেরা হলো।
যাবতীয় সকল কাজ সেরে ঘুমাতে যাওয়া হলো। আষাঢ়ের চোখ ঘুমহীন। কারিবও জাগ্রত আষাঢ়ের সাথে। আষাঢ় সবটা মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক করে রাত বারোটায় সে ঢুকলো ইদ্রিস খানের বাড়ির গেট টপকে। কারিবকে সাথে আনলো না। বাড়িতেই থাকতে বললো ওকে। ইদ্রিস খানের বাড়িতে ঢুকে প্রথমে সে কল করলো নোয়ানাকে। কয়েক বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো। ঘুম ঝাড়া কণ্ঠে নোয়ানা, ‘হ্যালো’ বললো।

“কলটা কি আজ বেখেয়ালে রিসিভ হলো?” প্রশ্ন করে আষাঢ়।

বিপরীতে নোয়ানার লঘু কণ্ঠ শোনা যায়,
“এত রাতে কল করে আমার ঘুম ভাঙালেন কেন?”

“অনেক রাতের ঘুম কাড়া অপরাধী তুমি! অন্য মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়ে যে অপরাধ করেছো, সে সকল অপরাধের দায়ভার নিয়ে এত নিশ্চিন্তে ঘুমাও কী করে? ঘুম ছাড়ো। এখনই উঠে এসো। তোমার বাড়ির লনে দাঁড়িয়ে আছি।”

“কী?”

“বাংলা তো স্পষ্টই বোঝো। তাহলে দুবার বলে বোঝাতে হবে কেন? তোমার বাড়ির লনে দাঁড়িয়ে আছি। এখনই ঘর ছেড়ে বের হয়ে দেখা করো আমার সাথে। হারি আপ!”

“আপনি আবার চোরের মতো গেট টপকে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছেন?”

“ঢুকতে হলো। কী করবো আর? তুমি তো আমার জন্য গেট খুলে দেবে না। সুতরাং বাধ্য হয়ে চোরের মতোই ঢুকতে হলো।”

“যেমন চোরের মতো এসেছেন, তেমন চোরের মতোই বেরিয়ে যান।”

“বেরিয়ে যেতে তো আসিনি। তোমার সাথে দেখা করবো বলে এসেছি। দেখা করো আমার সাথে।”

“আমি কি পাগল? না কি বোকা? রাত বারোটায় কেউ একজন আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘আমার সাথে দেখা করো’ আর আমিও পাগলের মতো তার সাথে দেখা করবো? আপনি এক্ষুণি চলে যান।”

“তার মানে দেখা করবে না?”

“পাগল আপনি হতে পারেন, আমি নই।”

“যদি দেখা না করো তাহলে সেটা ভালো হবে না কিন্তু। তোমার বাড়ির সামনে সিনক্রিয়েট করবো আমি। তুমি বেশ ভালো করেই জানো এটা আমার কাছে কঠিন কিছু নয়।”

“হুমকি দিয়ে লাভ নেই, চলে যান।”

“যদি এখনই ঘর থেকে বের না হও, তবে জোরে একটা চিৎকার করে তোমার বাড়ির লোকদের ঘুম থেকে জাগ্রত করবো। এমনকি তাদের এটাও বলে দেবো, আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। আর শুধু এটুকুই বলবো না। আপনার মেয়ে আমাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসে এটাও বলবো। ভালো কি হবে সেটা?”

নোয়ানা বিভ্রান্ত অবস্থায় পড়লো। আষাঢ় যে একটা পাগল জানে সে। পাগলের ডাকে সাড়া দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু পাগলের পাগলামিরও কোনো সীমা নেই। পাগলরা সবই পারে।

“কি আসবে?” প্রশ্ন করলো আষাঢ়। গলায় এমন ভাব যেন সে নিশ্চিত নোয়ানা আসবে।

নোয়ানা কিছু না বলে কল কাটলো। আষাঢ় মুচকি হেসে বললো,
“তুমি কিন্তু বোকাই টিউলিপ!”

নোয়ানাকে দেখা গেল কিছুক্ষণ বাদে। তিন্নি হঠাৎ জেগে যাবে কি না সেই নিয়ে সে সংশয়ে ছিল। কথা বলার শব্দে তিন্নির ঘুম হালকা হয়েছে কি না যাচাই করছিল। মনে হয়নি কথা বলা, বা কল আসার শব্দ তিন্নির ঘুমে কোনো প্রভাব ফেলেছে। মেয়েটা ঘুমিয়ে গেলে দুনিয়ার হুঁশ খেয়াল থাকে না। আষাঢ়কে দেখতে পেল উঠোনের চেয়ারে বসে আছে। কী নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে তাকে।
নোয়ানা নিকটে এসে গেলে আষাঢ় বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললো,
“দেখা করতে আসার জন্য ধন্যবাদ।”

নোয়ানা আগুন চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আজকে আবার কেন চোরের মতো আমাদের বাড়িতে এসেছেন? সমস্যা কী আপনার?”

“আমার সমস্যার শেষ নেই নোনা। হৃদয়ে সারাক্ষণ সমস্যা লেগেই থাকে। এই সমস্যার প্রতিকার চাই আমি।”

“চলে যান।”

“দেখতে এসেছি তোমায়। এটুকু দেখায় মন ভরেনি। আরও কিছুক্ষণ দেখতে চাই।”

আষাঢ় কাছে এগিয়ে এলো। নোয়ানার বুক ধুকপুক করছে ভয়ে। কী দরকার ছিল আষাঢ়ের কথা মতো এত রাতে এখানে আসার? ভুল হয়ে গিয়েছে, চরম ভুল।

“হাত দাও।”

নোয়ানা ভিতরে ভিতরে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। কাঠিন্যতা হারিয়ে যাচ্ছিল তার মাঝ থেকে। কিন্তু সে হারাতে দিলো না। কণ্ঠে কাঠিন্য বিরাজ রেখে বললো,
“কেন?”

“বলছি তাই।”

“আপনি বললেই সেটা কেন করতে হবে আমাকে? কেন দেবো হাত?”

“তোমার পালানোর রাস্তায় দ্বিগুণ সিকিউরিটি লাগাবো তাই।”
বলে হেসে হাতের মুঠোয় থাকা রিংটা দুই আঙুল দিয়ে সামনে তুলে দেখালো।

আষাঢ়ের হাতে আংটি দেখে নোয়ানার বুক ধক করে উঠলো। বিস্ময় অবান্তর চোখ জোড়া আষাঢ়ের হাত থেকে মুখে গিয়ে ঠেকলো। আষাঢ়ের ঠোঁটে মৃদু হাসি। আষাঢ়কে অবলোকন করতে লাগলো সে। আষাঢ়ের মাঝে এই মুহূর্তে পাগলামির ছাপ দেখতে পাচ্ছে না। আষাঢ়ের মাঝে নমনীয়তা।
হৃদস্পন্দন তড়িৎ গতি সম্পন্ন হয়ে এলো নোয়ানার। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করে উঠলো সূক্ষ্ম ব্যথাদ্বয়। নিঃশ্বাস হয়ে এলো এলোমেলো। কোনো দিক বিবেচনা না করেই সে বিপরীতে ঘুরে ঘরের দিকে ছুটে এলো। কিন্তু বেশিদূর আসতে পারলো না। একটা হাত পিছন থেকে তার হাতকে কব্জা করে নিলো। অসহায়ের মতো থেমে যেতে হলো তাকে।
আষাঢ় খানিক অবাক সুরে প্রশ্ন করলো,
“হোয়াট’স ইওর প্রবলেম টিউলিপ? এরকম করলে কেন তুমি?”

নোয়ানার দু চোখ লাল হয়ে উঠেছে। লাল চোখ আবার অশ্রুসিক্ত। আষাঢ়ের হাত থেকে নিজের হাতকে মুক্ত করে নিতে ব্যস্ত হয়ে বললো,
“ছাড়ুন আমায়।”

আষাঢ় তো হাত ছাড়লোই না, বরং আরও শক্ত করে হাতটা চেপে ধরে নিজের দিকে ফেরালো নোয়ানাকে। আষাঢ় এই মুহূর্তে রাগান্বিত। নোয়ানার কাছ থেকে এমনটা আশা করেনি সে। শক্ত কণ্ঠে বললো,
“তুমি আমার। তোমাকে ধরে রাখবো, কি ছেড়ে দেবো সেটা একান্ত আমার ব্যাপার।”

নোয়ানার মুখমন্ডল কাঁপছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো জলধারা। বললো,
“আমি আপনার নই।”

“অবশ্যই তুমি আমার। সব সময়ের জন্যই আমার। মৃত্যু পর্যন্ত আমারই থাকবে।”

“আপনি যেটা করতে চাইছেন সেটা ভুল।”

“আমি নিশ্চিত, এই ভুল করে কখনও আফসোস করতে হবে না আমার। সুতরাং আমি এই ভুল করবো।”

আষাঢ় নোয়ানার হাতে রিং পরিয়ে দিতে উদ্যত হলো। নোয়ানা হাত ছাড়িয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু সে ব্যর্থ। আষাঢ় শক্ত বাঁধনে তার হাত আঁকড়ে ধরে আছে। নোয়ানা গলায় জোর দিয়ে বললো,
“হাত ছাড়ুন আষাঢ়।”

আষাঢ় শুনলো না। নোয়ানা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকায় রিং পরাতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। শেষ পর্যন্ত সে সকল বেগ কাটিয়ে জোর করে রিং পরিয়েই দিলো। দেওয়ার পর নোয়ানার হাতটাও ছেড়ে দিলো।
নোয়ানা স্থবির হয়ে গেল। তার দৃষ্টি এখন নিজ হাতের অনামিকায়। যেখানে একটি রিং উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ রিংটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে আষাঢ়ের দিকে দৃষ্টি দিলো। দৃষ্টিতে কোনো আনন্দ নেই। গাঢ় কালো রং ছুঁয়ে আছে আঁখিতে। অভিমানের আঁচড় টানা। টপটপ করে জল পড়ছে শব্দহীন। বহু কষ্টে ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বললো,
“আপনি পাগল, বদ্ধ উন্মাদ হিমেল!”

“কোনো সমস্যা নেই। আমার মতো পাগল, বদ্ধ উন্মাদের সাথে থাকতে পারবে তুমি।”

“আপনার পাগলামি বাস্তব জগতের সাথে মানানসই নয়। আপনি পাগলামি করতে পারেন, কিন্তু এটা মানুষ মানতে পারে না। যেখানে আপনার ঘরে আপনার হবু বউ আছে, সেখানে আপনি অন্য একজনকে কীভাবে আংটি পরিয়ে দিলেন?”

“যেভাবে দেখেছো, সেভাবেই। তবে আমি জোরপূর্বক আংটি পরাতে চাইনি। আমি শান্তভাবে আংটি পরাতে চেয়েছিলাম।”

নোয়ানা চোখ বুজে ফেললো। নিজেকে ধাতস্থ করে ক্ষণিকের ভিতর আবার চোখ খুলে বললো,
“দেখুন, আপনার পাগলামি থামান। আপনার মা-বাবা পছন্দ করে সিনথিয়াকে নির্বাচন করেছে। সুষ্ঠুভাবে বিয়েটা করে নিন।”

“সম্ভব নয়। আমি যে পণ করে ফেলেছি, বিয়ে করলে তোমাকেই করবো।”

নোয়ানা অতিষ্ঠ হয়ে বলে উঠলো,
“আপনি কি বুঝতে পারছেন না? আপনি যেটা করছেন সেটা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়! আমাকে বিয়ে করবেন বলছেন এটাও আপনার পাগলামি। দয়া করে এটা বন্ধ করুন। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন বলছেন। কিন্তু আপনার একার কথায় তো কিছু যায় আসে না। আপনার মা-বাবা কেন আপনার পাগলামিতে সামিল হবে? কেন আমার মতো অনাথ, আশ্রিতা একটা মেয়েকে ছেলের বউ করবে তারা? যেখানে তারা সিনথিয়ার মতো সুন্দর একটা মেয়েকে আপনার জন্য পছন্দ করে রেখেছে!”

“সিনথিয়া কোনো ব্যাপার নয়, সে খুব দ্রুত ইন্ডিয়া ব্যাক করবে, আর আমার হবু বউ সিলটাও উঠে যাবে তার থেকে। আর বাকি রইল আমার মা-বাবা। তুমি তো অনাথ, আশ্রিতা নও। সবকিছুই আছে তোমার। মা-বাবা না থাক, মা-বাবার মতো চাচা-চাচি আছে তোমার। বলতে গেলে মেয়ের মতোই আছো তাদের কাছে। তুমি অনাথ এটা কোনো ফ্যাক্ট নয়। আমার মা-বাবা এমন মানসিকতার নয় যে একটা অনাথ মেয়েকে ছোট করে দেখবে তারা। আমি যদি বলি তোমাকে বিয়ে করবো তাহলে তোমার সাথেই বিয়ে দেবে।”

নোয়ানা তাচ্ছিল্য হাসলো,
“আপনি অনেক কিছুই জানেন না আষাঢ়। ভাবছেন আপনার মা-বাবা আপনার পাগলামি মেনে নেবে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা মানবে না। কারণ, এটাই বাস্তবতা। আপনি বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। আপনার বসবাস পাগলামির রাজ্যে। যেখানে শুধু পাগলামি করে বেড়ান আপনি। যদি বাস্তব জগতে পা রাখেন তাহলে দুরূহ অবস্থায় পড়বেন। সুতরাং এই পাগলামির এখানেই ইতি ঘটান।”

“এটা পাগলামি নয়।”

“আমি পাগলামি ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”

“ঠিক আছে ধরে নিলাম আমি পাগলামি করছি। আমি একটা বদ্ধ উন্মাদ। তো এখন তোমার খবর কী? তুমি কি বিয়ে করতে চাও না এই উন্মাদকে? ভালোও কি বাসো না?”

নোয়ানা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো এই প্রশ্নের সামনে। হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে। পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হচ্ছে। অতি কষ্টে নিজেকে কঠিন রাখার চেষ্টা করে ধীর কণ্ঠে বললো,
“পাগল আপনি হতে পারেন, আমি না। আপনার পাগলামির সাথে সামিল হলে জীবন চলবে না আমার।”

বলে হাতের আংটিটা খুলে ছুঁড়ে ফেললো ঘাসের উপর।
এই মুহূর্তে আষাঢ়ের নিঃশ্বাস আটকে এলো। হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হলো। রক্ত ক্ষরণ হয়ে যেন তলিয়ে যাচ্ছে তার বুক। অতলস্পর্শে কী এক নিদারুণ কষ্ট! মুহূর্তেই চোখ ফেঁটে জল এলো তার। রক্তলাল চোখে এমন জলের আগমন শেষ কবে ঘটেছিল? হৃদয় হাহাকার করে উঠলো। ঘাসের উপরে পড়ে থাকা আংটির উপর থেকে চোখ সরিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্ঠুর মেয়েটার দিকে তাকালো। চারটি অশ্রুপূর্ণ চোখ একসাথে মিলিত হলো। ক্ষণকাল একসাথে মিলিত হয়ে রইল। প্রথমে চোখের এই মেলবন্ধন ভাঙলো নোয়ানা। ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালো ঘরের দিকে। আর তখনই আষাঢ় পিছন থেকে বলে উঠলো,
“তোমার ব্যবহারে আজ আমি খুব কষ্ট অনুভব করলাম টিউলিপ। বিশ্বাস করো, একদম হৃদয়ে এসে লেগেছে। এত সুন্দরভাবে হৃদয়ে আঘাত করতে কীভাবে শিখলে?”

আষাঢ়ের কণ্ঠ কানে আসায় দাঁড়িয়ে গেল নোয়ানা। তার হৃদয়ে কি কষ্ট হচ্ছে না? হু, হচ্ছে। কিন্তু এই কষ্টকে তোয়াক্কা করলে হবে না। কষ্টকে চাপা দিয়ে শীতল গলায় বললো,
“এখন শুধু আপনি একা কষ্ট পাচ্ছেন, কিন্তু আপনার এই পাগলামিতে সবাই কষ্ট পেতো। একা কষ্ট পেয়ে অন্যদের কষ্ট না পেতে দেওয়াই ঠিক কাজ।”

আষাঢ়ের হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে। এই ভীতু মেয়েটা এভাবে কষ্ট দেবে সত্যি জানতো না সে। এই রাত্রি হাওয়াও যেন আজ বিক্ষিপ্ত। পরতে পরতে করুণ সুর তুলছে। হৃদয়ের হাহাকার পূর্ণ কষ্ট মুখ ফুঁটে শুধু একটা বাক্য স্বরূপই বেরিয়ে এলো,
“তোমার মতো এত হার্টলেস মেয়ে আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি টিউলিপ!”

বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না আষাঢ়। ঘাসের উপর থেকে রিংটা তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল গেটের দিকে।
নোয়ানা পিছন ফিরে তাকালো না। আজকের এই অভিমানী আষাঢ়কে পিছন ফিরে দেখলো না একবার। কষ্টকে তোয়াক্কা না করে পারছে না সে। হৃদয় ভার হয়ে আছে কষ্টে। কষ্ট করে হলেও পা দুটো টেনে এগিয়ে যেতে লাগলো ঘরের দিকে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here