বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :২১
সেহের ক্লাস থেকে ফিরেছে অনেকক্ষণ।বিকাল মাড়িয়ে সন্ধ্যা হলো বলে।খানিক পূর্বে দিশা বাড়ি ফিরেছে।সেহের তখন দোতালার বারান্দায়।গাড়ীর শব্দ পেয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকাল।দিশাকে নামতে দেখে এক চিলতে হেসে নিচ তালার সিড়ির দিকে পা বাড়ায়।এতোটা সময় মায়ের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। আজ অনেকদিন মায়ের সাথে ঠিকঠাক কথা হয়না।বিয়ের কথা চলাকালীন সময় থেকে সম্পর্কে একটা গ্যাপ চলে এসেছে। মাও আগের মত তেমন কথাবার্তা বলেন না।যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেন। হয়তো সেহেরের উপর রেগে আছেন।হওয়াটাই স্বাভাবিক ।সেহের না বুঝে না জেনে মাকে অনেক আজেবাজে বলে দিয়েছে।সব কিছুর জন্য উনাকে দায়ী করে গেছে।নিজের ভুল গুলোর জন্য সেহের ভেতরে ভেতরে ভীষণ অনুতপ্ত।তাই আজ মায়ের কাছে সেদিনের করা খারাপ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইবে।এসব ভাবতে ভাবতে সেহেরের দিশার রুমের সামনে যেয়ে দাড়ায়।দরজা ভিড়ানো ।দুবার নক করে ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসছে না।সেহের ছয়নয় না ভেবে ভেতরে ডুকে পড়ে।বারান্দায় দিশার ছায়া দেখা যাচ্ছে।সেহের ভাবল মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চমকে দিবে।আলতো পায়ে চুপিসারে বারান্দার দিকে পা বাড়ায় ।বারান্দার চৌকাঠে পা রাখতে সেহের থমকে যায়।
“হ্যাঁ ,হ্যাঁ আমি মানছি আমিই তোমাকে আরহাম আর সেহেরের ভিডিও ভাইরাল করতে বলেছি।এর বিনিময়ে যত টাকা চেয়েছ, দিয়েছি। এরপরও কেন বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করছ?
প্রাণের ভয় কি তোমার নেই? ভুলে যাচ্ছ কার সাথে কথা বলছ? ”
…………………………………
“মূর্খ, তুই আমাকে আরহামের ভয় দেখাচ্ছিস? আরহাম বিয়ের আগেই সব জেনে গেছে।এর পর আমাকে ফোন করলে সোজা জেলে ঢুকাব। এমন অবস্থা করবো প্রাণ ভিক্ষা চাইবি! ”
দিশা ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে বলল।অপর পাশে ব্যক্তিটা হয়তো ভয় পেল।দিশা ফোন কেটে রাগে গরগর করতে করতে পিছন ফিরে চাইল।সেহেরকে দেখে ছিটকে গেল।সেহের দিশার দিকে ঘৃণা মিশ্রিত অশ্রু ভেজা চোখে তাকিয়ে।দিশা সেহেরের দিকে কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে ভীতু স্বরে বলল ,
“সেহের মা ,আমার কথাটা শুনো …আ..আমি ….
“দূরে যাও ,তোমার এই নোংরা হাতে আমাকে ছুঁবে নাহ! ”
সেহের একপা একপা করে পিছনের দিকে পিছচ্ছে।দিশা কান্নারত স্বরে বলল,
“প্লিজ শান্ত হও! আমার কথাটা একবার শুনো।আমাকে বলার সুযোগ দেও ”
সেহের দিশার হাত ঝাড়ি দিয়ে চিৎকার করে বলে ,
“কি শুনবো আমি? কি? তোমাকে দেখলে আমার ঘৃণা হয় ,জাস্ট ঘৃণা! নিজের লাভের উদ্দেশ্য সবার সামনে নিজের মেয়ের মান ইজ্জত এভাবে টেনে খুললে! এসব করার আগে একবার তোমার বুক কাঁপল না? ছিঃ এতো নিকৃষ্ট তুমি।”
এতোটুকু বলেই সেহের কান্নায় ভেঙে পড়ে।অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে বলল,
“ছোট থেকে তোমার অবহেলা পেয়ে বড় হয়েছি। জন্মের পর বাবা হাতে তুলে চলে এসেছ।তোমার নতুন জীবন গুছিয়েছ ।অবহেলা অনাদরে বড় হয়েছি।মায়ের একটু খানি ভালোবাসা পাওয়ার লোভে বেহায়ার মত তোমাকে ফোন করেছি। বহুবার কান্নায় ভেঙেছি ,কিন্তু আমার কান্না শোনার মত তোমার সময় হয়নি।বরাবরের মতই আমাকে ইগনোর করে গেছ।কেন আমার প্রতি তোমার এতো ঘৃণা । কি দোষ ছিল আমার? কেন আমার জীবনটা এমন রংহীন হলো! বলতে পারো? …….তোমার জন্য।সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। ক্লাস এইটে যখন তোমার কাছে আসলাম নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল আমি তোমার সাজানো গোছানো সংসারে বেহায়ার মত চলে এসেছি । লিয়াকে দেখে প্রচণ্ড হিংসে হত।কারণ বাবা মায়ের শতভাগ ভালোবাসা ও পাচ্ছিল।কিন্তু আমি? আমি সর্বদা একা ছিলাম।না আমার সাথে বাবা, ছিল না মা।
কারো কোন আদর আহ্লাদ ছাড়া একা বেড়ে উঠেছি।জীবনের কঠিন সময় পাড় করেছি।যখন বিপদে পরে তোমার কাছে ঠাই নিলাম ,তুমি আমার সাথে এই করলে? আমার জীবনটা এভাবে শেষ করে দিলে? নিজ স্বর্থে আমাকে ব্যাবহার করলে! ছিঃ পুরো শহরের সামনে এভাবে আমার মান ইজ্জত নষ্ট করলে! এর বরং আমাকে মেরে ফেলতে।”
সেহের মাটিতে হাঁটু গেড়ে কান্না করছে।দিশা সেহেরের সামনে বসে কান্না করতে করতে বলে,”হ্যা আমি তোমাকে একা ছেড়ে এসেছি।তোমাকে এড়িয়ে চলেছি এর কারণ শুধুমাত্র তোমার বাবা। তোমাকে দেখলে বুকের গাঁ গুলো জেগে উঠত। আমাকে তিলেতিলে শেষ করত।তাই বলে আমি তোমাকে কখনো ঘৃণা করিনি।শুধু মানুষিক প্রশান্তির জন্য তোমার থেকে পালিয়ে বেঁচেছি ।কিন্তু ভেতরে ক্ষণে ক্ষণে আমিও অনুতাপের আগুনে পুড়েছি ।আমি যা করেছি তোমার ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য করেছি। চাকচিক্য সুন্দর জীবন তুমি ডিজার্ভ করো।সীমাহীন সুখ ডিজার্ভ করো।আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না।প্লিজ আমাকে বুঝার চেষ্টা করো । ”
সেহের অশ্রুঝরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল।বলল,”কেন এমন মিথ্যা বাহানা দিচ্ছ? আমি জানি তুমি এসব কেন করেছ।আমার এসব চাকচিক্য কৃত্রিম সুখ চাই না।শুধু ভালোবাসা চাই।যা তুমি কোন দিন বুঝবে না। তুমি আমার মা নও।একজন ক্ষমতা লোভী নেত্রী মাত্র । ক্ষমতার লোভে তুমি সব সীমানা ভাঙতে পারো ।প্রথমে নিজেকে বিক্রি করেছ এবার আমাকে করলে। হেইট ইউ ।…. আই হেইট হউ! ”
সেহের কান্না করতে করতে দিশার রুম ছেড়ে বের হয়ে যায়।সেহেরের যাওয়ার দিকে দিশা নিরাশ পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল।সন্তানের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখার মত বেদনা দায়ক অন্যকিছুতে নেই ।
দিনের আলো ফুরিয়ে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসছে।চারদিকে অন্ধকার নেমে।আরহাম বাড়ী ফিরল বরাবর নয়টায়।চেহারায় একরাশ ক্লান্তি আর রাগ নিয়ে।আজ সারাদিন কাজের চাপ ছিল প্রচুর।এতো ব্যস্ততার মাঝে সেহেরকে ফোন করেছে কিন্তু সেহের একবারের জন্য রিসিভ করেনি।উল্টো সন্ধ্যার পর থেকে ফোন সুইচঅফ।আরহামের মাথা পুরোপুরি ভাবে বিগড়ে । মেয়েটা এতো কেয়ারলেস কেন? কেন এমন অবুঝের মত আচরণ করে! আরহাম দাদীমা মায়ের সাথে দেখা করে নিজের রুমের দিকে বড় বড় পা ফেলে।ঘরে ঢুকতে আরহাম চমকে যায়। পুরো রুম অন্ধকারে ঘিরে আছে। আরহাম সেহেরকে কয়েকবার ডাকে কিন্তু প্রত্যুত্তরে কোন সাড়াশব্দ নেই।সেহেরের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আরহাম ঘাবড়ায়। তড়বড়ে সুইচ অন করে। পুরো রুমে চোখ বুলায় কোথাও সেহের নেই।আরহামের ভয় বাড়ে।রুমে ডিভানের পাশে যেতে নিভৃত কান্নার স্বর ভেসে আসে।আরহাম দ্রুত পায়ে ডিভানের পিছনে যেতেই থমকে যায়।সেহের মাটিতে বসে হাঁটুতে মাথা গুজে ডুকরে কাঁদছে।আরহাম কাঁপা কাঁপা হাত সেহেরের কাঁধে রাখতে সেহের ভয়ে ছিটকে উঠে।চোখ মুখ ফুলে রক্তিম হয়ে আছে।গাল এখনো অশ্রজলে ভিজে।আরহাম কিছু জিগ্যেস করবে তার পূর্বেই সেহের আরহামের বুকে আঁচড়ে পড়ে।বুক ফাটা চিৎকারে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আরহাম শক্ত ভাবে সেহেরকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,”কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে? এভাবে কান্না করছ কেন! ”
সেহের ধ্যান ফিরতেই আরহাম থেকে হুট করে দূরে সরে যায়। কান্না জড়িত গলায় বলে,”আপনিও আমাকে ছুঁবেন না। আপনারা সবাই এক । ঠক মিথ্যুক মুখোশ ধারী! ”
আরহাম বিস্মিত স্বরে জিগ্যেস করে,”আমি কি জানতাম? তুমি এসব কি বলছ? ”
“আর কত অভিনয় করবেন? আর কত? কেন আপনি জানতেন না ভিডিও দিশা খানম ভাইরাল করেছে? সব জেনে শুনে আমার জীবন কেন নষ্ট করলেন??আমি আপনাদের কি ক্ষতি করেছি! কেন এমনটা করলেন! ”
“সেহের তুমি ভুল বুঝচ্ছ।আমি এসব কিছু….”
আরহামকে থামিয়ে সেহের ভারী গলায় বলল,”আর কত মিথ্যা বলবেন? এবার অন্তত এসব বন্ধ করুন।আমি আপনাদের এই মরিচীকাপূর্ণ চাকচিক্যময় পরিবারের অংশ হতে চাইনি।আমাকে কেন ব্যবহার করলেন? আমার এসব থেকে রেহাই চাই। প্লিজ আমাকে মুক্তি দিন। প্লিজ! ”
সেহের মাটি থেকে উঠে ব্যাগ গোছাচ্ছে । পাগলের মত আচরণ করছে। এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর পড়ছে। যেন সে নিজের মাঝে নেই।আরহাম সেহেরকে বোঝানো চেষ্টা করে । কিন্তু সেহের কোন কথা শুনতে নারাজ।আরহাম সেহেরের হাত ধরে আটকায়। সেহের হাত ছাড়িয়ে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বিরবির করে বলে ,”যেখানে মিথ্যা,বেইমানীর বসবাস সেখানে আমি এক মুহূর্ত থাকব না।আমার হাত ছাড়ুন ।ছাড়ুন বলছি! ”
আরহাম সেহেরের কথায় ভীষণ রেগে যায়। শক্ত করে হাত টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে ভারী স্বরে বলে,”আই কান্ট! আই কান্ট লিভ উইথ আউট ইউ । ”
সেহের মাথা তুলে ড্যাবড্যাব চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে থাকে।আরহামের ক্রুদ্ধতায় ভরা রক্তিম চোখ।সেহের বিরবির করে বলে ,”আই হেইট ইউ ,হেইট ইউ”
আরহাম সেহেরের কথায় তোয়াক্কা না করে। শক্তভাবে বুকের সাথে জড়িয়ে চোখ বুঝে মাথায় চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,”বাট আই লাভ ইউ ”
কথাটা কি সেহেরের কান অবধি পৌঁছায়? হয়তো শুনেছে ! হয়তো না ।
চলবে…❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।