বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৬০

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৬০

নভোমণ্ডলে বিশাল আকারের চাঁদ । রাতের আঁধার কাটাতে অদম্য চেষ্টা তার। তবুও শীতের প্রবণতা কুয়াশা ঘেরা গোঁয়ার আঁধার কোন ভাবে- ই মিটছে না। চাঁদও নাছোড়বান্দা দুর্জয় ভাবে লড়ছে।সেহের উদাসীন চোখে আঁধার ঘেরা নভোমণ্ডলে তাকিয়ে ।আশনূহা অনেক আগেই ঘুমিয়েছে ,সেহের বিছানা ছেড়ে বারান্দার মেঝেতে বসে। মনে জমে থাকা এক রাশ মন খারাপের মেঘ উপচে আসতে চাইছে।শীতল ঠান্ডা হাওয়া গায়ে বারবার বাড়ি খাচ্ছে । সেহেরের ভেতরের একরোখা জেদ সেই হাওয়াটাকে হার মানাচ্ছে । খানিক বাদে রুমে কারো অস্তিত্ব টের পেল। আরহাম এসেছে কি? হয়তো! সেহের নড়ল না অনড় হয়ে বারান্দায় বসে রইল।পদ আওয়াজ এদিকে এগিয়ে আসছে। সেহের স্পষ্ট টের পেল তবুও নড়ল না শক্ত হয়ে বসে রইল।খানিকক্ষণ পর পেছন থেকে পরিচিত আওয়াজ আসলো,”অনেক রাত হয়েছে ,এখানে কি করছ? ”
সেহের উত্তর দিলো না। আরহাম সেহেরের হাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে নিলো ,”হাতে মেডিসিন লাগাও নি কেন? রাতে খাওয়া হয়েছে? ”
সেহের এবারো নিরুত্তর! আরহাম বিরক্ত ভারী নিশ্বাস ফেলল।বড় বড় পা ফেলে রুমে দিকে গেল। মিনিট দুএক পর ফাস্টএইড বক্স নিয়ে ফিরে আসলো। সেহেরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল।কণ্ঠে কাঠিন্য মিশিয়ে বলল,” চোট খোলা রেখেছ কেন? ইনফেকশন হবে! ”
সেহের অভিমানে রাশভারী চোখে আরহামের দিকে তাকাল । কাঁদো কাঁদো ভাঙা স্বরে বলল,” হলে হবে তাতে কি! আমি কষ্ট পেলে আপনার কি! ”
আরহাম আড়চোখে তেজি দৃষ্টিতে সেহেরের দিকে তাকাল। কাঁদো কাঁদো মুখখানা দেখে বুকে এক ধাক্কা লাগে। তবুও মন গললো না।মুখশ্রীর শক্ত কাঠিন্য ভাব বজায় রাখল । সটান হয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতে সেহের বাচ্চাদের মত আরহামের হাত আটকাল ।দুহাতের মুঠোতে আরহামের এক হাত জড়িয়ে রেখেছে! হাতের বাঁধন খুব একটা মজবুত নয়। তবুও আরহাম ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।তেজি গলায় বলল,” কিছু বলবে? ”
সেহেরের ফিসফিস আওয়াজ করে কান্না ভেজা স্বরে বলল,” এভাবে এড়িয়ে চলবেন না প্লিজ! আমি আপনার মত স্ট্রং নই! আমার বুকের বাঁ পাশে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। খুব কষ্ট হয়! ”
আরহাম চোয়াল শক্ত করে আগের মত ঠায় দাঁড়িয়ে।সেহের এবার কান্না চেপে রাখতে পারল না। কেঁদেই দিলো । বলল,” আমি আপনার ঐ রূপ দেখে ভয় পেয়েছিলাম । তাই আমার থেকে দূরে সরে গেছি। আমি জানি আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি। আপনাকে ঐ অবস্থায় ফেলে যাওয়া একদম উচিত হয়নি। আশনূহাকে আপনার থেকে দূরে রাখা ঠিক হয়নি! এর জন্য আমার শাস্তি পাওয়া উচিত। কঠিন শাস্তি!
কিন্তু সেই শাস্তি এতোটা ভয়ানক হবে আনার জানা ছিল না। আপনার আমাকে এড়িয়ে চলা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। প্রতি মুহূর্ত মৃত্যু সমান অনুভব করাচ্ছে।আমি পারছিনা আপনার নীরবতা মেনে নিতে। এই পাঁচ বছর আপনার থেকে দূরে থেকে এতো কষ্ট হয়নি যতটা আপনার কাছে এসে আপনার এড়িয়ে চলা দিচ্ছে! সত্যি কি এখন আর ভালোবাসেন না? আমার জন্য কোন অনুভূতি নেই ? ”
আরহামচোখ মুখ শক্ত করে তীব্র আওয়াজে বলল,” নাহ! নেই! ”
সেহের থমকে হাত ছেড়ে দিলো।বলল,”আমার চোট দেখে আপনি এতো বিচলিত কেন? ”
আরহাম ভড়কে গেল।থতমত স্বরে উত্তর দিলো ,” আমি চাইনি তোমার চোট থেকে নূহার ইনফেকশন হোক !”
সেহের ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো।বলল,” বাহানা অন্তত ঠিকঠাক বিশ্বাসযোগ্য দিন! ”
আরহাম মুখ ফিরিয়ে আদেশ স্বরূপ স্বরে বলল, “রাত বাড়ছে ঘুমাতে চলো । ”
সেহের অভিমানী স্বরে নাকচ করল। বলল,” উহু ,যাবো না । এখানেই থাকবো । এখানে বসে ঠান্ডায় মরে যাবো! তাতে আপনার কি?”
আরহাম হাত টেনে দাঁড় করায়।রুমের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,” বাচ্চামো জেদ ছাড়ো ,অসুস্থ হয়ে যাবে! ”
সেহের হাত ঝাড়ি দিয়ে দাঁড়াল।হাত পা ছড়িয়ে বারান্দার চৌকাঠে মুখ ফুলিয়ে বসে রইল।আরহাম গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল,” ঘরে যাবে না? ”
সেহের ‘না ‘সূচক মাথা নাড়াল। আরহাম থেমে থেমে নিশ্বাস ফেলে রুমে চলে যায়। আরহামের যাওয়ার দিকে সেহের একপলক তাকিয়ে কান্না জুড়ে দিলো । বুক ভেঙে কান্না আসছে । আরহাম তাকে ভালোবাসে না? তার মনে এখন আর কোন অনুভূতি নেই? আরহামের কাছে এতোটা পঁচে গেছে সে!
কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়ছে । ডুকরে সেহের কাঁদছে । কারো কানে কি সেহেরের কান্নার গুঞ্জন যাচ্ছে? কি জানি!
বুকে শ’মণ ভারী কিছু অনুভব করল। নিশ্বাস থেমে যাচ্ছে । প্রাণ পাখি বেরিয়ে আসতে চাইছে ।বেরিয়ে আসুক তাতে কি? এমন যন্ত্রণা দায়ক জীবন থেকে মৃত্যু শ্রেয়!
এমন সময় পিছন থেকে কেউ তার বক্ষপঞ্জরে সেহেরকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে।খানিক বাদে কাঁধে উষ্ণ স্পর্শের ছোঁয়া মিলল।শীতল হাওয়ায় উষ্ণ ছোঁয়ায় সেহের কেঁপে উঠে। কান্না অটোমেটিক থেমে গেছে । চোখেমুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ।পেছন থেকে আরহামের ফিসফিসে আওয়াজ ,”ভালোবাসি সেহের! প্রচণ্ড ভালোবাসি ”
সেহের তৃপ্ত হেসে পেছনে ফিরে আরহামের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। চোখ থেকে অনবরত অশ্রুকণা বেয়ে পরছে ।এই কয়েকটা শব্দতে বিশেষ কোন এক জাদু আছে যা খানিকের ভেতর সেহেরের ভেতর জ্বলতে থাকা অগ্নিকুণ্ডকে শান্ত করে দিয়েছে।শীতল এক আবেশে মন প্রাণ শান্ত।
আরহামের গলা সেহেরের চোখের জলে ভিজে আছে। সেহের মুখ ঠেকিয়ে বিরামহীন কেঁদে যাচ্ছে।আরহাম সেহেরের দু গালে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে ,
“অনেক হয়েছে ,আর নাহ! ”
সেহের থামছে না।আরহাম আলতো করে নাকে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলল,”এভাবে কাঁদলে নূহা উঠে যাবে যে! ”
সেহের আরহামের কথার তোয়াক্কা না করে। নিজের মত অনবরত বলতে থাকে,”আ’ম সরি আরহাম! আ’ম রিয়ালি রিয়ালি সরি। সেই প্রথম থেকে আপনি আমার খেয়াল রেখে এসেছেন আর আমি কিনা আপনাকে ভুল বুঝেছি ।প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন । আপনি যেভাবে বলবেন সবটা সে ভাবে- ই হবে। শুধু আগের মত একটু ভালোবাসেন আমাকে। ”
আরহাম গভীর দৃষ্টিতে সেহেরকে দেখছে । কি গভীর আকুতি ওর। কান্না ভেজা চোখ জোড়া আরহামের বুক দাউদাউ করে পোড়াচ্ছে ।খুব করে চেয়েছিল সেহের তার ভালোবাসা বুঝুক । তাকে বুঝুক! তাইতো এই এড়িয়ে চলা । কিন্তু তা আর হলো কই? প্রিয়তমার চোখের জল তাসেরঘরের ন্যায় আরহামকে ও ভেঙে দিয়েছে ।আরহাম যতই শক্ত কাঠিন্য খোলস পরিধান করুক না কেন ,সেহেরের সামনে সর্বদাই হেরে যাওয়া যোদ্ধা ।সেহেরের কান্ন ভেজা স্বর আরহামের সকল দৃঢ়তা ভেঙে চুরচুর করে দেয়।
আরহাম চোখ বুজে সেহেরের ললাটে গাঢ় এক চুমু খেল । নাকের সাথে নাক ঘষতে ঘষতে উত্তর দিলো ,”তুমি মন্ত্রমুগ্ধের মত । তোমার উপর কেন জানি শক্ত অভিমান হয় না।যতই চেষ্টা করি প্রতিবার আমি- ই আঘাত প্রাপ্ত হই! তোমার চোখের সরলতা আমায় ভীষণ টানে ,খুব করে বলে তোমাতে হারাতে! কেন এমন হয় বলতো? ”
সেহের চোখ নামিয়ে লাজুক হাসলো।যা আরহামের বুকে তীরের মত বিঁধল।মুহূর্ত অপেক্ষা না করে অস্থির হয়ে সেহেরের ওষ্ঠদ্বয় নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের ভাজে মিলিয়ে নেয়। বেশ খানিকক্ষণ পর ছাড়ে।চোখ বুজে দুজন হাঁপাচ্ছে । বুক অনবরত ধুকধুক করছে।আরহাম চোখ খুলে সেহেরের মুখপানে তাকায়। সেহের তখনো চোখ বুজে ঠকঠক কাঁপছে । আরহাম সেহেরের মুখশ্রীর উপর পড়ন্ত চুল সরিয়ে উতলা স্বরে বলে,”ভালোবাসি প্রেয়সী ”
সেহের এক পলক আরহামের চোখে তাকাল ।প্রেম নেশায় ভারী আঁখিপল্লব। কি মায়া! এই চোখে বেশিক্ষণ চোখ রাখা সেহেরের পক্ষে অসম্ভব । মাথা নুইয়ে নিলো । চোখ মুখ খিঁচে থেমে থেমে বলল,” ভালোবাসি আরহাম ”
আরহাম সেকেন্ড অপেক্ষা না করে সেহেরকে নিজের বুকে আগলে ধরে। দূর আকাশের চাঁদটাও মিটমিট হাসছে। জমিনের ফুল গুলো লজ্জায় মাথা নুইয়েছে ।

পরদিন বিকালে আরহাম রওনা হলো।যাওয়ার আগে নানান কৌশল করে না যাওয়ার বাহানা আঁটল। কিন্তু কাজ হলো না। শেষমেশ যেতেই হলো। যাওয়ার সময় আরহামের মুখ দেখার মত। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে গাল ফুলিয়ে বেরিয়েছে । যেন তাকে কোন যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে।সেহের বারান্দা থেকে আরহামের যাওয়ার পথে ক্লান্তিহীন তাকিয়ে রইল। যতক্ষণ না গাড়ি মেইন গেট পাড় হয়েছে।মনে অদ্ভুত এক ভয় জমেছে।বিপদের ভারী আবাস। ” আবার দেখা হবে তো দুজনের? ”

চলবে … ❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here