বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৩৫
পরদিন মিহির বের হবার পর সেহের তার রুমে ঢুলে।পুরো রুম জুড়ে নিখুঁত তদন্ত করে কিন্তু কোন প্রকার প্রমাণ মিলে না। হতাশ হয়ে বড় এক নিশ্বাস ছাড়ে,আরহামকে তাদের অ্যাফেয়ারের কথা জিগ্যেস করে জোরগলায় না করবে। উল্টো বাড়ির সবার সামনে সেহেরের অভার থিংকিং বলে উড়িয়ে দেবে।এখান থেকে যেতে হলে সেহেরের শক্ত প্রমাণ চাই। তখনি সেহেরের চোখ আটকায় সামনের কাবার্ডের দিকে।সেহের দ্রুত পায়ে সেদিকে অগ্রসর হয়।কাবার্ড খুলে তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি করে। হ্ঠাৎ- ই চোখ আটকায় নীল ফাইলে।উপরের কালো কলমে গোটাগোটা অক্ষরে ‘আর্বিন্দ’ লিখা ।নামটা সেহেরের খুব পরিচিত।এর আগেও কোথাও শুনেছে । কিন্তু কোথা শুনেছে তা মনে পড়ছে না। দূর থেকে এক অস্পষ্ট আওয়াজ মাথায় বাড়ি খাচ্ছে । চোখের সামনে কিছু আবছা আবছা ভেসে উঠছে। মাথার পেছন দিকে এক অসহ্য যন্ত্রণা কিলবিল করছে। সেহের মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠল।দ্রুত হাতে ফাইল খুলল।কোন এক বিষয়ের উপর ডকুমেন্টারি। উপরে গাঢ় কালিতে লিখা ‘multiple personality disorder’।রোগীর নাম আর্বিন্দ ।রোগীর লক্ষণ সমূহ :
1/ ব্যক্তিগত তথ্য ভুলে যাওয়া।
2/:-স্বাভাবিক বিষয়গুলো ভুলে যাবার প্রবণতা বেড়ে যায়। সম্পর্ক, মানসিক বা পেশাদারি চাপ সামলাতে অক্ষম হয়ে পড়া।তার মাঝে প্রচুর পরিমাণে হতাশা দেখা দেয় এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া।
3/বার বার হ্যালুসিনেশন হতে থাকে । ভয়ানক স্মৃতি গুলো তাড়িয়ে বেড়ায়। ঘুমের সমস্যা হয় প্রায়শই দুঃস্বপ্ন , ইনসমনিয়া , দেখা দেওয়া।
4/ অস্থিরতা প্যানিক এটাক বিভিন্ন রকম ফোবিয়া ।
সেহেরের বিষয় গুলো পড়ে ভীষণরকম অদ্ভুত লাগল।ভ্রু কুঁচকিয়ে নিলো। এমন অদ্ভুত রোগও হয় কি? মিহি কি আর্বিন্দ নামক রোগী উপর রিসার্চ করছে? নাকি তার ট্রিটমেন্ট করছে? এসব ভাবতে ভাবতে সেহের পেজ উল্টায় এমন সময় বাহির থেকে লিয়ার ডাক পড়ে। বাকি পৃষ্ঠা গুলো আর পড়া হয় না। তড়িঘড়ি করে ফাইলটা কাবার্ডে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
আরহামের ঘুম ভাঙার আগেই সেহের ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।সেদিন থেকে আরহামকে কড়াকড়ি ভাবে এড়িয়ে চলতে শুরু করে।দুজনের মধ্যে হাসবেন্ড ওয়াইফের সম্পর্ক না থাকলেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিলো।কিন্তু আজকাল সেই সম্পর্কটাও ফাটল ধরেছে। দুজনের মাঝে তেমন কথাবার্তা হয় না।বেশ সকালে আরহাম জাগার আগেই সেহের ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়।ক্লাসের শেষে দুটো টিউশন নিচ্ছে। আজকাল নিজেকে যথাসাধ্য ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে।এর মাঝেই এক্সামের টেনশন সব মিলিয়ে সেহেরের দিনও বেশ ব্যস্ত কাটছে। অল্পস্বল্প যেই সময় পায় সেই সময়টা বারান্দায় দাড়িয়ে দূর আকাশে তাকিয়ে পাড় করে ।সেহেরের এমন হ্ঠাৎ পরিবর্তন আরহামের চোখে পড়ে। বেশ কয়েকবার এ নিয়ে সেহেরের সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু সেহের প্রত্যেবারই ব্যস্ততার বাহানা দিয়ে এড়িয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে আরো কিছুদিন কেটে যায়।আজ নির্বাচনের দিন। পুরো শহরবাসীর মনে এক অদম্য উত্তেজনা ।সকাল থেকে পুরো পরিবার টেনশনে হাতপা কচলাচ্ছে ।আরহাম ও তার পার্টির লোক জায়গা জায়গায় প্রতিটা কেন্দ্রে রাউন্ড দিচ্ছে ।গোপন তথ্য জানা গেছে বিরোধী দল ভয়ানক কোন ষড়যন্ত্র করছে।জোরদার লড়াইয়ের পর জনগণের অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ে বিপুল ভোটে আরহামের দাদাজান আবারো জয় লাভ করেন।তৃতীয় বারের মত মন্ত্রী হন।পুরো শহর জুড়ে বিজয়ের উৎসব ।বাড়িতে খুশির আমেজ । শুধু মাত্র সেহের গোমড়া মুখে।মন থেকে খুশি হলেও এই খুশি তার কঠিন সিদ্ধান্তের উপর কোন প্রভাব ফেলছে । এই তো আর একটা রাত তারপর এ বাড়ি এশহর সব ছেড়ে অনেক দূর পাড়ি জমাবে!
বিজয়ের উৎসব,বিজয় মিছিল শেষ করে আরহাম দাদাজানের সাথে বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে। আগামীকাল পার্টির সকল আয়োজন শেষ ।বাড়িতে খুশিখুশি মুখ নিয়ে প্রবেশ করতে দেখে পরিবারের সবাই হল ঘরে উপস্থিত।সবাই অভিনন্দন জানানোর জন্য আরহাম আর দাদাজানের অপেক্ষা করছিল।আরহাম সেহেরের দিকে তাকাল ।উদাসীন দাঁড়িয়ে । দুজনের চোখাচোখি হল।সেহের বেশিক্ষণ আরহামের দিকে তাকাল না চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।আরহামের খটকা লাগল কিন্তু পরিবারের সবাই সাথে থাকায় কিছু বলল না।কিছুক্ষণ পর অসুস্থতার বাহানা করে সেহের উপরে চলে যায়।আরহামও তার পিছু পিছু যায়।সেহের ওয়াশরুমে ।আরহাম চেঞ্জ করে বিছানায় সেহেরের অপেক্ষা করে। অনেকটা সময় নিয়ে সেহের বের হয় ।চোখ মুখ ফুলে টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে ।সেহেরকে দেখে আরহাম বলল,”শরীর কি খুব বেশি অসুস্থ? চলো ডক্টরের কাছে যাই”
সেহের মুখ মুছতে মুছতে না সূচক মাথা নাড়াল।ভারী স্বরে বলল,”আপনার সব দরকারী জিনিসপত্র কাবার্ডে রাখা।কাবার্ডের নিচের পার্ট গুলোর চাবি বিছানার পাশের টেবিলটায় রাখা।”
সেহেরের হঠাৎ এমন কথায় আরহাম চমকাল।তখনি চোখ পড়ল লাগেজ গুলোর উপর।আরহাম ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,”কোথাও যাচ্ছ? ”
“হ্যাঁ ,বাবার কাছে চিটাগাং । ”
“আগে বললে না যে! ”
“এইযে এখন বললাম আগে প্রয়োজনবোধ করিনি তাই বলিনি ।”
সেহেরের এমন নিরস উত্তরে আরহাম কিছু মনে করল না। আজকাল সেহের আরহামের সাথে টোনেই কথা বলে।প্রত্যুত্তরে বলল,”পুরো সাপ্তাহ একটু ব্যস্ত আছি । আগামী সাপ্তাহে আমি নিজে সাথে গিয়ে তিনচারদিন থাকবো কেমন? ”
“এখানে আপনার যাওয়ার কথা কোথা থেকে আসছে? আমি একা যাচ্ছি তাও সারাজীবনের জন্য। ”
সেহেরের বাজখাঁই গলায় এমন কথা শুনে আরহাম বেশ চমকাল।বিছানা ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে বলল,”সারাজীবনের জন্য মানে? কি বলতে চাইছ? ”
“এই নামমাত্র সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই আমার! ডিভোর্স পেপার সাইন করা আছে ।আপনি সাইন করে দিবেন প্লিজ ”
সেহেরের কথায় আরহামের রাগ আকাশ চুম্বী।সেহেরের বাহু চেপে ক্রুদ্ধ গলায় বলল,”হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড? তোমার ডিভোর্স চাই?
“কেন শুনে খুশি হননি? এমনটাই তো চেয়েছিলেন।আমার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলেই আপনি মুক্ত লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রেন্ডশিপের নাম করে অ্যাফেয়ার চালাতে হবে না।মিহিকে নিজের করতে পারবেন ।শুধু নির্বাচন শেষ হবার অপেক্ষায় ছিলাম। আমি চাইনা আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে শহর জুড়ে মাতামাতি হোক। এই বাড়ির সম্মান নষ্ট হোক!
“সেহের আমি এর আগেও বহু বার তোমাকে বলেছি আমাদের মাঝে ফ্রেন্ডশিপ ছাড়া অন্যকোন সম্পর্ক নেই ।তুমি কেন বুঝো না? ”
সেহের তাচ্ছিল্য হেসে বলে ,”আচ্ছা তাই ,রাতবিরাতে রিফ্রেশমেন্টের নাম করে তার সাথে সময় কাটানো এটা এমন ফ্রেন্ডশিপ? আমি এতোটাও বোকা নই যে আপনি যা বলবেনামি তা মানবো। আপনি চরিত্রহীন! ”
সেহের বেয়াদবিতে আরহাম চুপ থাকতে পারল না । থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত উঁচু করতে গিয়ে থেমে গেল।সেহের আরহামের এমন ব্যবহারে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল।টলটল চোখ থেকে ঝরঝর করে গাল বেয়ে পানি পড়ল।আরহাম দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে নিজের রাগকে দমিয়ে শন্ত স্বরে বলল,”এসব চিন্তাভাবনা কবে থেকে তোমার মাথায় ঘুরছে? ”
“যেদিন রাতে আপনি মিহির সাথে ড্রাংক হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন! ”
আরহামেত বুঝতে বাকি রইল না সেহের কোন দিনের কথা বলছে।আরহাম সেহের কাছে এগিয়ে তাকে সবটা বুঝাতে চেষ্টা করল।কিন্তু সেহের নাছোড়বান্দা শুনতে নারাজ । আরহামকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,”ব্যস ,অনেক হয়েছে। আমার আপনার থেকে মুক্তি চাই! ”
আরহামের মাথা বিগড়ে গেল। সেহেত পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে । আরহাম আটকে নেয়।কোলে তুলে বিছানায় ফেলে শক্ত গলায় বলে,”তুমি চাও আর না চাও ,তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে! ”
সেহের বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইল। কিন্তু পাড়ল না পেছন থেকে আরহাম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ।
গভীর রাতে আরহাম ঘুমিয়ে পড়তেই বিছানার পাশে ডিভোর্স পেপার রেখে। সেহের আলতো পায়ে লাগেজ নিয়ে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ে।
চলবে….❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমাত দৃষ্টি মতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।