বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৩৬
মন্ত্রিবাড়িতে সকাল থেকে হৈ চৈ লেগে। বিষাদময় পরিস্থিতি। কিসের বিজয় উল্লাস ,কিসের পার্টি কিসের কি ,সবাই বাড়ির বউ খুঁজতে ব্যস্ত ।শহরের বুকে গার্ড ছড়িয়ে দিয়েছে।সব গার্ডদের কড়াকড়ি আদেশ সেহেরকে দেখা মাত্রই বন্দি করা।সেহেরের নিখোঁজের খবর মিলতেই বাড়ির দারোয়ানদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে!
আরহাম হিংস্র সিংহের মত রাগে গজগজ করছে ।সকল বাসস্টপ ,স্টেশন সব জায়গায় খবর নেওয়া হয়েছে। কোথাও সেহেরের খোঁজ মিলেনি।বাড়ির কেউ তার সামনে দাড়ানোর সাহস করতে পারছেনা । কে চাইবে এমন ঘায়েল সিংহের মুখোমুখি হয়ে নিজের বিপদ ঢাকতে?
এর মাঝে দিশা মালিহা একদফা আরহামের ক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছে। আরহামের স্পষ্ট ধারণা বাড়ির কেউ সেহেরকে পালাতে সাহায্য করেছে।আর সন্দেহের শীর্ষস্থানে মালিহা খানম ,দিশা।উনারাই সেহেরের একান্ত ঘনিষ্ঠ । মালিহা খানম তো এর পূর্বেও সেহেরকে বাড়ি থেকে পালাতে সাহায্য করেছে!
পুরোদিন ক্লান্তি ভরা দুশ্চিন্তায় কাটে।বেডরুমের সব কিছু চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে রক্তচক্ষু করে আরহাম বসে।এমুহূর্তে তার ইচ্ছে করে পুরো দুনিয়ায় আগুন ধরিয়ে দিতে । সবকিছু জ্বালাতে আরহামের ভেতরের আগুন যথেষ্ট! এই মুহূর্তে সেহেরকে সামনে পেলে কষে দুগালে দুই থাপ্পড় লাগাত । ফাজিল মেয়ে ,বাড়ি ছাড়ার সাহস হয় কি করে? বুকে কি ডর ভয় নাই? আরহাম আনমনে বিরবির করছে। এমন সময় ফোন বেজে উঠে।রিসিভ করে কানে তুলতে অপর পাশ থেকে কিছু একটা শুনে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।
দিন শেষ অনেকটা সময়।বিকেল থেকেই কুয়াশা জমছে । চারদিকে ঘন আঁধার নেমে এসেছে।কুয়াশা ভেদ করে গাড়ি দুরন্ত চলছে। কুয়াশায় খানিক সামনের পথও দেখা যাচ্ছেনা ।গাড়ির লাইটের আলোয় সড়ক কোনরকম দেখা যাচ্ছে ।শহুরে পথ মাড়িয়ে গাড়ি গ্রামের এলোমেলো মেঠো পথে নেমেছে ।নির্জন আঁধার কালো ভয়ানক পরিবেশ শীতল বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ।ঘন্টা খানিকের ভেতর আরহাম শান্তির নীড়ে পৌঁছায়।কোনরকম গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে ভিতরের দিকে যায়।সদর দরজায় খালা অপেক্ষা করছিল।আরহামকে দেখে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। আরহাম অস্থির স্বরে জিগ্যেস করে,”সেহের কোথায়? ”
“পুকুর পাড়ে। এখানে আহার পর লাগিস রাইখা পুকুর পাড়ে বইয়া আছে। দুপুরের খাবারো মুখে তুলেনাই । সারাদিন না খাওয়া । কড়া কইরা কইয়া দিছে কেউ যেন পুকুর পাড়ে না যায়।বউ মা একা থাকবার চায় ”
“এখানে কখন এসেছে? ”
“বারটার দিকে এক পুলিশে নামায় দিয়া গেছে ,কইলো বউমার ভাই লাগে ”
আরহাম ছোট এক নিশ্বাস ছাড়ল।বলল,”কাউকে দিয়ে সেহেরের লাগেজ গাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করুন ”
“আইচ্ছা ”
খালা ভেতরে চলে যায়।এমন সময় পানি কিছু পরার সজোরে আওয়াজ হয় । আরহাম পুকুর পাড়ের দিকে ছুটে যায়।বাঁশের সাঁকোর সামনে দাঁড়ায়। অনেকটা হাঁপিয়ে গেছে। এই গা কাঁপা শীতে আরহাম থর থর ঘামছে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। শীতকাল হওয়ায় পুকুরের পানি অনেকটাই নিচে।কুয়াশায় কালো অন্ধকারে ঢাকা। সামান্য দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছেনা।গাছপালায় ঘেরা চারিদিক। দূর অজানা থেকে বেনামী পাখির কুহু ডাক ভেসে আসছে। আরহাম সামনের দিকে ছুটে যায়। সাঁকোর মাথায় সেহেরের ওড়না মিলল।আরহামের ভয় আরো বাড়ল।তবে কি সেহের পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে? সেহের তো সাঁতার জানে না! আরহাম প্রাণহীন হয়ে থপ করে সাঁকোতে বসে পড়ে।আশেপাশের কোন শব্দ তার কান অবধি পৌঁছায় না। সেহেরের উড়না বুকে জড়িয়ে অনুভূতিহীন নিষ্প্রাণ বসে থাকে।মাথা পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।হ্ঠাৎ কিছু মনে পড়তে জোরে সেহের বলে চিৎকার দিয়ে উঠে।নির্জন শব্দহীন পুকুরপাড় হুড়মুড় কেঁপে উঠে। আরহাম চল জলদি উঠে সেহেরকে খোঁজতে পুকুরে ঝাঁপ দেয়।হিম শীতল ঠান্ডা পানিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগে। কোথাও সেহের নেই!
আরহাম নিজে মধ্যে নেই। পাগল পাগল হয়ে সেহেরকে খোঁজছে । জোর গলায় চিৎকার করছে আর সেহেরকে ঢাকছে।
“এই রাতে গোসল করতে পুকুরে নেমেছেন? পানি প্রচণ্ড ঠান্ডা সর্দি লেগে যাবে। ”
হ্ঠাৎ- ই পেছন থেকে আলতো মিষ্টি স্বর ভেসে আসে।চিরচেনা সেই আওয়াজে আরহাম তড়িৎ বেগে ঘাড় ফিরে তাকায়। সেহের সাঁকোর মাথায় দাঁড়িয়ে ।আরহাম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে।ঘোর কাটতেই দেরী না করে উপরে উঠে আসে।হুট করে সেহেরকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়।বুকের ভেতর জ্বলন্ত আগুন নিভল ।এক চিলতে হিম শীতল হাওয়া ছুঁয়ে গেল।অনেকটা সময় ভেজা শরীরে আরহাম সেহেরকে বুকে জড়িয়ে রাখল।সেহের নড়চড় করল না।চুপ থাকল।হ্ঠাৎ আরহামের কিছু একটা মনে পড়তে সেহেরের বাহু ধরে সামনে দাঁড় করাল। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,”এইসব কি ঢং শুরু করেছ বাড়ি ছাড়ছ ,ডিভোর্স নিচ্ছ! কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরোনোর সাহস পাও কি করে ?পাখা গজিয়েছে? উড়তে চাও? সকাল থেকে কুকুরের মত শহতের এক কোণা থেকে অন্যকোনা অবধি ছুটে বেড়াচ্ছি।তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছি ।এসব গায়ে লাগে না? সবাইকে এমন হয়রানি করে বেশ আনন্দ লাগছে? ”
সেহের চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাথা নত করে ঠক ঠক কাঁপছে।আরহাম হাত টেনে সামনের দিকে এগোতে এগোতে ভারী স্বরে বলে,”বাড়ি চলো ”
সেহের থেমে যায়।হাত ছাড়িয়ে আগের মত মাথা নত করে আমতা স্বরে উত্তর দেয়,” আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল । ঐ বাড়িতে যাবো না ,আপনার সাথে থাকবো না। আজই চিটাগাং ফিরে যেতাম কিন্তু সকালে জানতে পারি বাবা দেশের বাহিরে ফিরতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে তাই যাওয়া হয়নি! ”
সেহেরের কথায় আরহামের আবার মাথা বিগড়ে গেল।সব কিছু শান্ত ভাবে সামলাতে চেয়েছে । কিন্তু সেহের মাটি কামড়ে জিদ ধরেছে সে আরহামের কোন কথাই মানবে না। আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”ভালোয় ভালোয় বলছি বাড়ি চলো”
সেহের দু কদম পিছিয়ে ঝাঁড়ি দিয়ে বলে,”বলেছি ত যাবো না।কেন যাবো আপনাদের প্রেমলীলা দেখতে? আমাকে আমার মত থাকতে দিন এখান থেকে যান প্লিজ! ”
কথা শেষ করে আরহামের দিকে তাকাতে সেহের কেঁপে উঠে।অদ্ভুত হিংস্র চাহনি।এমন হিংস্র চাহনি সেহের বিয়ের পরদিন বিকালে দেখেছিল ।তবে কি আরহামের মাঝে দ্বিতীয় সত্তা জেগেছে? সেহের আরহামের এমন ভয়ংকর রূপ দেখে কেঁপে উঠে। ভয়ে ঢোক গিলে।আস্তে আস্তে পিছনের দিকে পিছাতে লাগে। আরহামও সেহেরের দিকে হিংস্র চাহনি নিয়ে এগিয়ে আসছে।পিছতে পিছাতে সেহের সাঁকোর মাথায় দাঁড়িয়ে। আরহামও তার মুখোমুখি আরেক কদম পিছনে বাড়ায় ঝোঁক সামলাতে না পেরে পিছনের দিকে পরে যেতে নেয় ।সাপোর্টের জন্য আরহামের কুর্তি ধরে ফলস্বরুপ আরহাম সহ পুকুরে পরে।হিম শীতল বরফ ঠান্ডা পানিতে সেহের হাবুডুবু খাচ্ছে আরহাম স্থির চোখে তাকিয়ে । সেহের সাহায্যের জন্য সজোরে আরহামের নাম ধরে ডাকে। মুহূর্তে আরহামের জ্ঞান ফিরে দ্রুত সেহেরের দিকে এগিয়ে যায়।
চলবে….❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।