বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৪১

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৪১

অনেক দিন কেটে গেছে।তফির এখন পুরোপুরি সুস্থ। এক্সিডেন্টের পর সাপ্তাহ দু তিন হসপিটালে ভর্তি ছিল। এরপর বাড়ি ফিরে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে।নিজেকে কাজে পুরোপুরিভাবে ডুবিয়ে রাখে । মানুষিক ভাবে সে ভীষণ অসুখী ।যবে থেকে জেনেছে সেহেরের বিয়ে হয়েছে সেদিন থেকে একদম ভেঙে পড়েছে। সেই ছোট থেকে সেহেরকে ভালোবাসে।কিন্তু পারিবারিক জঞ্জালের জন্য কোন দিন বলা হয়নি। অনেকবার বাড়িতে মাকে জানাতে চেয়েছে কিন্তু ফ্যামিলি স্টেটাসের বিশাল ব্যবধানের কথা চিন্তা করে আর বলেনি।কিন্তু সেহের চিরকাল তফিরের মন জুড়ে ছিল ,আছে আর থাকবে!
সেদিনের এক্সিডেন্টের পর তফিরের মনে গভীর এক চিন্তা ভার করেছে।কেন জানো মনে হচ্ছে সেটা এক্সিডেন্ট না! তফিরকে জেনে শুনে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে!
অলস সকাল। চারদিকে কুয়াশায় ঘেরা সূর্যের রশ্মি এখনো মাটি ছোঁয়নি।উষসী মত আঁধার নেমে আছে সবদিকে।তফির কম্পিউটারের সামনে বসে।এক্সিডেন্টের সেই রাস্তার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ।বার বার রিপিট ,জুম করে দেখছে! কিন্তু এখন অবধি কোন সুরাখ মিলেনি।আচমকা ভিডিও ফুটেজে কিছু একটা দেখে তফির থমকে গেল।ভিডিও ফুটেজ আবার রিপিট করল।জুম করে তফিরকে ধাক্কা দেওয়া গাড়িটা দেখল ।গাড়ির কালো কাচের জন্য ভেতরের মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।সামান্য আবছা এক ছায়া দেখা যাচ্ছে।আর স্টিয়ারিং এর উপর রাখা হাতের অনামিকা আঙুলে রিং। রিংটা দেখে তফির চমকে গেল। এর আগেও এই রিংটা কারো হাতে দেখেছে । কিন্তু কার হাতে দেখেছে ঠিক মনে পরছে না।তফির চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা হেলিয়ে ভাবতে লাগল। হাতের কলমটা টেবিলের উপর ঘুরছে। হ্ঠাৎ কিছু একটা মনে করে তফির ধপ করে চোখ খুলল ।এক অফিসারকে ডেকে পুরানো কিছু ফাইল আনতে বলল।

ছুটির দিন।আরহাম আজ বাড়িতে।আজকের পুরোটা সময় শুধুই সেহেরের।সাপ্তাহে অন্য ছয় দিন ব্যস্ত থাকলেও শুক্রবার পুরোদিন শুধু মাত্র বউয়ের জন্য বরাদ্দ।দুজনের দিন বেশ হাসিখুশি খুনসুটি পূর্ন কাটছে।ছুটির দিন থাকায় সেহের সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত ।বেশ ভোরে উঠে আরহামের জন্য তার প্রিয় ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছে। তারপর দুপুরে আরহামের পছন্দের বাঙালি খাবার ।রান্নার কাজ গুছিয়ে মাত্রই ঘরে এসে শাওয়ার নিয়েছে ।সেহের বারান্দায় দাড়িয়ে তয়লা দিয়ে অলস হাতে চুল থেকে পানি ছাড়াচ্ছে। সারাদিনের ক্লান্তি যেন মুহূর্তে মাথা্য চড়ে বসেছে।এমন সময় পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে।সেহেরের ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি ফুটে উঠে।বেশ বুঝতে পারছে আরহাম এসেছে! আরহাম সেহেরের হাত থেকে তোয়লা নিয়ে চুল মুছে দিতে থাকে। সেহেরও ক্লান্ত ভঙ্গিতে আরহামের বুকে গা এলিয়ে দেয়।বেশ আরাম লাগছে। চোখে নিদ্রা ভাব ভর করেছে।আরহাম চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে,”সেহের? ”
সেহের চোখ বুঝে গাঢ় স্বরে বলল,”হুমমম !”
“নিজেকে ক্লান্ত করে এসব করার কি দরকার? বাড়িতে এসবের জন্য লোক আছে তো! ”
আরহামের কথায় সেহের চোখ বুঝেই এক চিলতে হাসল।আগের মত প্রসুপ্ত স্বরে বলল,”আপনার জন্য এসব করতে আমার ভালো লাগে। লোক আছে তাতে কি? এই একটা কাজই তো পার্ফেক্টলি পারি।”
আরহাম তোয়ালে রেখে সেহেরকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নাক টেনে দিয়ে বলে,”তুমি সবকিছুতেই পার্ফেক্ট।বুঝলে? ”
সেহের চোখ খুলে আরহামের গলায় জুলে ফিক করে হাসে।আরহাম সেহেরের এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছনে গুছিয়ে দিতে দিতে বলে,” বিকালে তৈরি থেকো ,বের হবো! ”
আরহামের কথায় সেহের খুশিতে লাফিয়ে উঠে।উৎসাহী গলায় বলে,”সত্যি? কোথায়? ”
“উমম,সারপ্রাইজ! ”
সেহের আরহামের থেকে কথা বের করার বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে তবে প্রত্যেকবার বিফল হতাশ হয়।আরহাম চতুরতার সাথে এড়িয়ে যায়।

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চারদিক কুয়াশা ভেজা আঁধারে ডেকে গেছে।সেই আঁধার কাটাতে হাজারো আয়োজন ।উঁচু দেয়াল ঘেরা ইটপাথরের শহরের হাজারো কৃত্রিম আলোয় আলোকিত।পিটপিট করে লাল সাদা হলুদ বাহারি রঙের আলো জ্বলছে।সেহের ছোট ছোট চোখ করে গাড়ির কাঁচে তাকিয়ে। আলো আঁধারের এই খেলা তার বেশ ভালো লাগছে।কথায় আছে দিনের ঢাকা শহর থেকে রাতের ঢাকাশহর বেশি জমজমাট! এই ঝকঝকে চকচকে শহরে হাজারো নামহীন গল্প গুলো বিরামহীন ভাবে চলছে ।সেহেরের এক হাত আরহামের হাতের ভাজে।আরহাম আলতো করে সেহেরের হাতে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,”এমন গভীর চোখে কি দেখছ? ”
সেহের বাহিরে দৃষ্টি রেখে আনমনে উত্তর দিল ,”আপনার শহরের আলো আঁধারের খেলা! ”
আরহাম কিঞ্চিত হাসল।সামনের দিকে চোখ রেখে বলল ,” এটা এখন তোমারও শহর! ”
আরহামের কথায় সেহের চোখ ফিরে তাকায়।সিটের ভেতর হেলান দিয়ে কিছুটা ভাবুক স্বরে উত্তর দেয়,” উহু,কেন জানো এই শহরকে আপন করতে ভীষণ ভয় হয় ।মাঝে মাঝে মনে হয় এই শহরের ঝকমকে দুনিয়ায় সাধারণ আমি কোথাও হারিয়ে যাবো! এই জমকালো দুনিয়া আমার জন্য নয়। ”
আরহাম সেহেরের হাত শক্ত করে চেপে ঠোঁটের কাছে নিয়ে আরেকবার গাঢ় চুমু খেল।সেহেরের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত স্বরে বলল, “কখনো হারাতে দেব না।আ’ম অলওয়েজ উইথ ইউ! ”
সেহের এক চিলতে হাসল।

বিশাল নামিদামি এক রেস্টুরেন্টের রুফটপে সেহের বসে ।চোখ ঘুরিয়ে চারদিক দেখছে।ঢাকার উঁচু উঁচু ইমারতের মাঝে এক চিলতে সবুজ প্রকৃতিক ছোঁয়া ।রেস্টুরেন্টের চারদিক বড় বাউন্ডারি ঘেরা । ভেতরে হাজারো গাছপালা মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে।রুফটপ থেকে মনে হচ্ছে যেন কোন অজানা পাহাড়ি এলাকায় বসে।পরনে সোনালি পাড়ে মেরুন রঙের পাতলা মসলিন শাড়ি।খোলা চুল। হাত ভর্তি চুড়ি।কপালে ছোট একটা টিপ।ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। আরহামকে দিশেহারা করতে আর কি চাই? হিম শীতল ঠান্ডা হাওয়ায় সেহেরের গা শিরশিরে উঠছে।আঁখিপাতা তিরতির করে কাঁপছে।মুখোমুখি বসে আরহাম সবটা দেখছে। সেহেরকে ঠকঠক কাঁপতে দেখে, বাড়ি থেকে আনা শালটা সেহেরের গায়ে জড়িয়ে দিলো ।সেহের হালকা ঘাড় ফিরিয়ে মুচকি হেসে বলল,”আপনার মনে ছিল? ”
“হুম ,বাড়ি থেকে বের হবার সময় নিয়ে বেরিয়েছিলাম । তোমাকে বললে তো শুনবে না। স্ট্রং গার্ল কিনা! ”
সেহের হেসে উত্তর দিলো ,” এতোটা ঠান্ডা পরবে আঁচ করতে পারিনি”
ডিনার শেষে দুজন টুকটাক কথা বলছে।এরই মাঝে এক নবাগত ব্যক্তির আগমন।সেহের মানুষটাকে দেখতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠে।তফির এসেছে।সেহের উল্লাসিত স্বরে বলল,” ভাইয়া ,তুমি এখানে? ”
তফির উত্তরে বলল,”কেন আমাকে দেখে খুশি না? ”
“আমি কি তা বলেছি? ভীষণ খুশি! কেমন আছো তুমি ”
“হুম ভালো! তুই কেমন আছিস? ”
“ভালো। ”
“আমি কি তোদের সাথে জয়েন করতে পারি? ”
“হ্যাঁ ,অবশ্যই কেন না ”
তফির আরহামের মুখোমুখি বসে পড়ল।তফিরকে দেখে আরহাম ভীষণ বিরক্তবোধ করল।সেহের বলল,”অর্থি থেকে শুনেছি কিছুদিন পূর্বে ভয়ানক এক্সিডেন্ট করেছ ,তো এখন কেমন আছো? ”
তফির আরহামের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো ,”এক্সিডেন্ট না এটেম টু মার্ডার বল ।খুনি খুন করতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু পেরে উঠতে পারেনি! ”
তফিরের কথায় সেহের ঘাবড়ে যায়। উৎকণ্ঠা স্বরে বলল,”বলো কি! তোমাকে কেউ কেন খুন করতে চাইবে? ”
“হয়তো আশেপাশের কেউই খুন করতে চাইছে।কিন্তু ডোন্ট ওয়ারী খুব তাড়াতাড়ি আসামি সবার সামনে আসবে! ”
তফিরের কথার তীর আরহামের দিকে। আরহাম আচমকা রহস্যময় হাসল। তফিরের উদ্দেশ্যে বলে,”আক্রমণকারীর উদ্দেশ্য অবশ্যই আপনার মৃত্যু ছিল না।যদি তাই হতো তবে আপনি এখন আমাদের সামনে উপস্থিত থাকতেন না। ”
“উদ্দেশ্য যাই হোক ,খুব তাড়াতাড়ি সে আমার হাতের মুঠোয় থাকবে ”
আরহাম বাঁকা হাসল।বলল,”তো বলুন ,আপনি এখানে কি করে ”
“যেখানে শিকার সেখানেই শিকারি।এখন কাজটাই এমন কখন কোথায় থাকতে হয় বলা মুশকিল! ”
সেহের আরহাম আর তফিরের কথোপকথন দেখে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে।তাদের চাহনি আর কথার প্রহার দেখে মনে হচ্ছে দুজন নীরবে যুদ্ধ করছে। দুজনকে থামাতে সেহের মাঝ থেকে বলে উঠে ,”আপনারা কি চোর পুলিশের আলাপ নিয়ে পড়ে আছেন । এদিকে কফি ঠান্ডা হচ্ছে! ”
সেহেরের কথা স্বরে দুজনের ঘোর কাটে।তফির কফির মগটা হাতে তুলে চুমুক দেয়।সেহের আরহামের দিকে কফির মগ এগিয়ে দিতে গেলে হাত ফসকে সামান্য কফি সেহেরের শাড়িতে পরে।সেহের কফির মগ রেখে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়।আরহামের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,
“সরি , হাত ফসকে পরে গেছে”
আরহাম বলে,”ইট’স ওকে লাভ ।”
” ক্লিন করে আসছি”
“আমিও সাথে আসছি ”
“উহু ,আমি যেতে পারবো ”
“সিউর? ”
“হুমম”
সেহের চলে গেল। তফির জেলাসিতে আরহামের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ,”আপনার এই ভালোমানুষির মুখোশ দুনিয়ার সামনে টেনে তুলবো! ”
আরহাম ফোন টিপতে টিপতে ডোন্ট কেয়ার ভাবে উত্তর দিলো ,”ট্রাই ইট! দুনিয়া কি ভাবল ,না ভাবল আই ডোন্ট কেয়ার।”
“আর সেহের? সেহের জানতে পারলে আপনার সাথে থাকবে তো? ”
তফির শয়তানি হাসি হেসে বলল।আরহাম সাথে সাথে ক্ষেপে উঠল।তফিরের শার্টের কলার টেনে দাঁত কিড়মিড়ে বলল,”এসবের মাঝে সেহেরকে টানলে জানে মেরে ফেলবো । আমার সেহেরের আশেপাশে যেন না দেখি। ”
তফির হতভম্ব ভীতু চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে । আরহামের চোখে মুখে অদ্ভুত এক হিংস্রতা।আরহাম দূরে সেহেরকে আসতে দেখে তফিরের কলার ছাড়ে।নরমাল ভাবে চেয়ারে বসে।সেহেরকে দেখে মুচকি হেসে বলে ,”ক্লিন হয়েছে? ”
তফির আরহামের দিকে ড্যাবড্যাবে তাকিয়ে এ কেমন আচরণ? এতো দ্রুত কেউ কি ভাবে পাল্টাতে পারে? আরহামের চেহারা দেখে কে বলবে খানিক পূর্বে তফিরকে খুনের হুমকি দিয়েছে? আরহামের এমন আচরণ তফিরের কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক লাগল।কিছু একটা ভেবে সেহের থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ে।তফিরের কাছে খানিকের জন্য মনে হলো আরহাম এক গভীর রহস্য । যাকে দেখতে সাধারণ হলেও গভীরতা অনেক! এর মাঝে এটাও বুঝল আরহামের একমাত্র উইক পয়েন্ট “সেহের “।

চলবে…❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টি তে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here