বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৪২
দিন যায় ,সাপ্তাহ কাটে আরহাম সেহেরের সম্পর্কের গভীরতা সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে বাড়ে ।আরহাম আজকাল নিজের অবসর সময়ের পুরোটাই সেহেরের জন্য তুলে রাখে সময় পেলেই হুটহাট বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে দুজন একান্ত সময় কাটাতে ।দিন গুলো স্বপ্নের মত কাটছে । কিন্তু কথায় আছে না? দুনিয়ায় স্থায়ী বলতে কিছু নেই সবই খানিকের মরীচিকা।স্বপ্ন সবসময়ই সুন্দর আর মধুর হয়। কিন্তু বাস্তব! বাস্তব তিক্ত আর কঠিন ।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ।শীতের ছুটির পর আজ প্রথম ক্লাস ।শীতের প্রবণতা তখনো আকাশ চুম্বী।গায়ে ভারী চাদর টেনে সেহের গাড়ি থেকে নামে।সামনের দিকে অগ্রসর হতে নিলে আরহাম থামিয়ে দেয়।ডেকে বলে,”টেক কেয়ার! ক্লাস শেষে নিতে আসবো ।একা যাওয়ার প্রয়োজন নেই। লাভ ইউ ”
সেহের মুচকি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে।ভার্সিটি গেটের দিকে অগ্রসর হয়।আরহাম পেছন থেকে একনজরে তাকিয়ে থাকে।”লাভ ইউ” র প্রত্যুত্তর সেহের প্রত্যেকবার এড়িয়ে যায়। সেই রাতে প্রথম আর শেষবার সেহেরের মুখে ভালোবাসি কথাটা শুনেছিল। এরপর সবসময় মুচকি হেসে এড়িয়ে গেছে।যদিও এতে আরহামের কোন অভিযোগ নেই। কারণ সেহেরের লাজুক চাহনি ঠিক বলে দেয়,সে আরহামকে কতোটা চায়! থাক না! কিছু কথা না হয় না বলাই থাক,অনুভূতিতে অনুভব করা যাক!
ডিপার্টমেন্টের সামনেই পিয়ালের দেখা মিলল। হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে।সেহেরকে দেখেই গলা জড়িয়ে ধরে। সেহের মজার স্বরে বলে ,”বাহ ,শীতের ছুটিতে এতো উন্নতি? আমাকে দেখে এতো খুশি? নাকি এই খুশির পিছনে কারণ আরেক? ”
পিয়াল লজ্জায় হেলতে লাগে।প্রসন্ন স্বরে বলে ,”একটা গুড নিউজ আছে! ”
“ডোন্ট টেল মি ,ইউ আর প্রেগন্যান্ট! তাহলে নির্ঘাত হার্ট এটাক করবো । ”
“ওহ সেহের তুমিও নাহ! শুধু দুষ্টুমি ”
সেহের ফিক করে হেসে উঠে।পিয়াল আগের মত লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে ”
সেহের পিয়ালকে খুশিতে জড়িয়ে ধরে বলে ,”ওয়াও! কংগ্রেস,কবে কখন কিভাবে হলো? ”
“এইতো ক্রিসমাসে।বড় আন্টির ফ্রেন্ডের ছেলে।ছেলে ইঞ্জিনিয়ার! ”
“ভীষণ ভালো ,তো বিয়ে কবে করছো? ”
“দু সপ্তাহ পর ”
“এতো জলদি? ”
“উনি দেশে বাহিরে চলে যাবে তাই এতো তড়িঘড়ি করে আয়োজন । তোমাকে কিন্তু প্রথম থেকে শেষ অবধি সব প্রোগ্রামে থাকতে হবে! ”
“অবশ্যই কেন না! ”
দুজন ক্যান্টিনে বসে টুকটাক কথা বলছে।এমন সময় পেছন থেকে চেনা আওয়াজে ডাক পরে। সেহের ঘাড় ফিরিয়ে দেখে তফির এসেছে।তফিরকে এখানে দেখে খুশি হয় সেই সাথে ভীষণ চমকায়।প্রত্যেকবারের মত এবার তফিরকে একটু অন্যরকম লাগছে। চেহারায় হাসির বুলি রেখা নেই। চিন্তিত মুখ।সেহের বলল,”তুমি হ্ঠাৎ এখানে? ”
তফির চিন্তিত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো ,”তোর সাথে কিছু কথা ছিল। তুই কি ফ্রি? ”
“হ্যাঁ ভাইয়া ,বলো ”
তফির পিয়ালের দিকে একবার তাকিয়ে সেহেরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল,”কথা গুলো একটু ব্যক্তিগত বাহিরে কোথাও বসলে ভালো হয়! ”
পিয়াল হয়তো কিছু একটা বুঝল।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ব্যস্ত গলায় সেহেরকে বলল,”ক্লাস শুরু হলো বলে। আমি ক্লাসে যাচ্ছি তুমি।তুমি এসো! ”
সেহের হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।পিয়াল ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে গেল। পিয়াল যেতেই তফির সেহেরের সামনের খালি চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়ল।তফিরের চোখে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ। সেহের সাবধানী স্বরে জিগ্যেস করল,” ভাইয়া সিরিয়াস কিছু? ”
তফির বেশ কিছুক্ষণ সেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,”আমি জানি আমি এখন যা বলবো তা তোর জন্য বিশ্বাস করা ভীষণ কঠিন। কিন্তু প্লিজ আমার কথা গুলো মন দিয়ে শুনবি ”
তফিরের কথায় সেহেরের ভয় বাড়ল।ভীতু চোখে তফিরের দিকে তাকিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তফির মুলহ খুলল ,”জানি আর পাঁচটা মেয়ের মত তোর জীবন স্বাভাবিক ছিল না। ছোট থেকে হাজারো উথালপাতাল দেখে বড় হয়েছিস। আমি চাই না, তুই কোন মিথ্যা স্বপ্ন নিয়ে মরীচিকার দুনিয়ায় বেঁচে থাক! ”
সেহের ভীতু নত স্বরে বলল,”ভাইয়া হেয়ালি করোনা প্লিজ,তোমার এসব কথা আমার ভয় বাড়াচ্ছে । ”
তফির খানিকক্ষণ চুপ থেকে ভারী গলায় বলে,”সেহের আমার উপর আক্রমণকারী অন্যকেউ না আরহাম খাঁন”
কথাটা শুনা মাত্র সেহেরের কুঁচকানো ভ্রু সটান হলো।থমথমে চোখে তফিরের দিকে তাকিয়ে রইল।তফির সেহেরকে থমথমে দেখে।সেহেরের হাতের উপর হাত রেখে অস্থির স্বরে বলল,”আমি জানি তোর জন্য মানতে খুব কষ্ট হবে।কিন্তু এটাই সত্যি! সেদিন ডিউটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।সিসি ক্যামেরার ফুটেজে গাড়িতে আরহাম খাঁন কে দেখা গেছে ।”
তফির থামল । সেহের কাঠকাঠ স্বরে বলল,”গাড়িতে স্পষ্ট আরহামকেই দেখেছ? ”
“নাহ ,আরহামের হাত দেখা গেছে।”
“চেহারা না দেখে কি করে বুঝলে সেটা আরহামই ছিলো? ”
“হাতের আঙটি দেখে ”
সেহের ঝাড়ি দিয়ে তফিরের হাত সরিয়ে তেতে বলল,”একটা আঙটির উপর ভিত্তি করে আপনি আমার স্বামী কে খুনি প্রমাণ করতে চাইছেন? আর আমাকেও তা বিশ্বাস করতে বলছেন? আপনাকে খুন করে আরহামের কি লাভ? এমন আঙটি শহরে অগণিত আছে।আপনার উপর আক্রমণকারী যে কেউ হতে পারে।”
তফির সেহেরকে বোঝানো চেষ্টা করে বলল,”ট্রাই টু বি আন্ডারস্ট্যান্ড! আরহাম- ই এমনটা করেছে। সে সরাসরি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে! ”
“আচ্ছা! তাই? আরহাম এমন কেন করবে? ”
“কারণ আমি তোকে পছন্দ করি “তফির রাগের বসে জোর গলায় বলল।সেহের কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলল,”এর জন্যই বুঝি আমার স্বামীকে ফাঁসাতে চাইছেন? আমি অনেক আগেই অর্থি থেকে জেনেছি আপনি আমাকে পছন্দ করেন।সেদিন রেস্টুরেন্টে আপনার কথার প্রহার যে আরহামের দিকে ছিল তাও আঁচ করতে পেরেছি । ছিঃ এতো জঘন্য আপনি? নিজ স্বার্থে আরহামকে ফাঁসাতে চাইছেন? ”
“সেহের আমার কথাটা একবার শুন । সেহের ক্রুদ্ধ গলায় উত্তর দিলো ,”কি শুনবো আমি? আমি আপনার কোন কথা শুনতে চাই না।আপনার মত জঘন্য লোকের সাথে কথা তো দূর চেহারাও দেখতে চাইনা ।আজ থেকে আমাদের মাঝে কোন প্রকার সম্পর্ক নেই! ”
বলেই সেহের তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।যেই বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়াবে এমন সময় তফির পেছন থেকে বলে ,”তুই আমার কথা বিশ্বাস কর আর না কর । আরহামের মুখোশের আড়ালের চেহারা তোর সামনে একদিন ঠিক আনবো । ”
সেহের ভারী স্বরে বলল,”সেদিন কোনদিন- ই আসবে না”
সেহের ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়। তফির ব্যথিত চোখে সেহেরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বর্তমান….
গাড়ির হর্ণের শব্দে সেহের বাস্তবে ফিরে। ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি থেমে। হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরছে। পেছন থেকে বেশ জোরে হর্ণের শব্দ ভেসে আসছে। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। আরহাম ড্রাইভিং সিটে বসে।সেহের ভাষাহীন চোখে বাহিরে তাকিয়ে ।আচমকা পাশের গাড়িতে চোখ আটকায়।এক বাচ্চা মেয়ে গাড়ি থেকে সেহেরের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে।বয়স কত হবে দুই কি বা আড়াই! তুলতুলে হাত দুটো সেহেরকে ডাকছে । নিষ্পাপ চোখ জোড়ার পিটপিট চাহনিতে সেহেরের মন ছুঁয়ে যাচ্ছে।সেহেরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।সেহেরের হাসিতে যেন বাচ্চাটা আরো উৎসাহী হলো।খিল খিল করে হেসে উঠে।হাসির গুঞ্জন সেহেরের মন অবধি ঠেকেছে! আনমনেই সেহেরের হাত পেট অবধি চলে গেল। নিজের মধ্যে বেড়ে উঠা নতুন প্রাণটাকে অনুভব করতে চাইল । সে জানে অনুভব করার জন্য সে এখনো অনেক ছোট কিন্তু এতে কোথাও যেন মনের শান্তি মিলল!
সেহের পেটে হাত রেখে চোখ বুজে সিটে গা এলিয়ে দিলো । চোখের কোণ বেয়ে দু ফোটা অশ্রু বেয়ে পড়ল । সুখের না দুঃখের তা তার নিজেরও অজানা!
স্মৃতির পাতার গভীরে সেহের আবারো ডুব দিলো। চোখের সামনে স্বপ্ন হয়ে সবটা ঝলঝল করে ভেসে উঠল ।
অতীত …..
চলবে…..❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊