বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৪৪
গতরাতে পার্টিতে হাতাহাতির ঘটনা পুরো শহরে তড়িৎগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে ।আরহামের এমন উদ্ভট আচরণে পার্টির অন্যসব নেতারা কানাঘুষা করছে। বিরোধী দল সুযোগের ব্যবহার করতে বিন্দু মাত্র ভুলেনি। ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাজারো অপবাদ জল্পনা কল্পনা সৃষ্টি করছে। বাড়িয়ে চড়িয়ে তিল থেকে তাল বানিয়েছে । সাংবাদিকরা সেহেরের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতে দ্বিধা বোধ করছে না।তাদের ধারণা মতে সেহের প্রিতম নামক ছেলেটার সাথে আপত্তিকর কোন সম্পর্কে জড়িত যেই ক্ষোভে আরহাম ছেলেটার উপর আক্রমণ করেছে।কেউ কেউ পরকিয়া নামক কুৎসিত নাম দিতেও বাঁধছে নাহ!
এসব ঘটনা নিয়ে বাড়ি ভর্তি লোকজন ক্লান্ত ।মন্ত্রী সাহেব রাগারাগি করে সেই সকাল সকাল বেরিয়েছেন ।মালিহা খানমও ভীষণ রেগে। আরহামের উদ্দেশ্যে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,”যদি বউকে নিয়ে এতোই দুশ্চিন্তা তবে তাকে বাহিরে বেরোতেই বা দেও কেন । ঘর বন্দি রাখলেই পারো! তালি তো আর এক হাতে বাজে না ,তাই না? “কথাটা আরহামের উদ্দেশ্যে বললেও আঘাত লাগে সেহেরের বুকে! এক সেকেন্ডের জন্য বড়ই অদ্ভুত লাগল । মালিহা খানমের কথায় অন্যরকম এক ঝাঁজের অনুভূতি হলো । তা কি? ক্রোধ নাকি অজানা কোন ক্ষোভ?
সময় তার নিজ গতিতে চলছে। সময়কে আটকানোর সাধ্যি কার।সেই রাতের পার্টির সেই ঘটনা সামাল দিতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছে।সেহেরের রিকোয়েস্টে প্রিতম সাংবাদিকের কাছে সবটা ক্লিয়ার করেছে।
যতদিন যাচ্ছে আরহাম প্রতি সেহেরের সন্দেহ বাড়ছে। আজকাল চেনা আরহামকে ভীষণ অচেনা লাগে।হুটহাট রেগে যাওয়া ,অতিরিক্ত পজেসিভ হওয়া ।যা সেহেরের কাছে বড্ড অদ্ভুত লাগে।ইদানীং আরহামের সম্পূর্ণ নজর উপর । মুহূর্তের মুহূর্তের সকল খবর পই পই হিসাব রাখে। যা সেহেরের কাছে অস্বস্তিজনক! মাঝেমাঝে মনে হয় এটা বাড়ি না , জেলখানা! যেখানে সেহের বড় কোন অপরাধ করে বন্দি!
বেশ কিছুদিন বন্ধের পড়াশোনায় বড় আকারে গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। যা সেহের দিনরাত পড়ালেখা করেও কভার করতে পারছে না।পিয়াল নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় নোট গুলোও কালেক্ট করতে পারছে না।তাই সুদিপের কাছ থেকে সাহায্যে নিতে হচ্ছে। সুদিপ ক্লাস টপার।দরিদ্রতার জন্য পড়াশোনায় খরচা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।লজ্জায় কারো থেকে হাত পাততে দ্বিধাবোধ করছে। দীর্ঘদিন সেহের তার ভাইদের জন্য প্রাইভেট টিউটর খুঁজছে । সুদিপ থেকে ভালো কোন টিউটর তাদের জন্য হতে পারেনা । তাই সেহের তার ভাইদের প্রাইভেট টিউটারের চাকুরী দিয়েছে। এতে দুজনের সমস্যার সমাধানের হাল হবে। যদিও পুরো বিষয় আরহামের চোখ ফাঁকি দিয়ে হচ্ছে। সুদিপ সেহেরের পরিচয়ে এখানে এসেছে আরহাম জানলে নিশ্চয়ই কপাল কুঁচকাবে। যা সেহেরের ভীষণ অপছন্দ।
আনান আফনানের পড়া শেষে সেহের সুদিপ থেকে অংক বিষাইত কিছু ডাউট ক্লিয়ার করছিল।এমন সময় ধুমধাম রুমের দরজা মেলার আওয়াজ কানে আসলো। সেহের সুদিপ দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। সামনে আরহাম চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে।আরহামের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি কে লক্ষ করে সেহের ভয়ার্ত মুখে উঠে দাঁড়ায়। আরহাম বড় বড় রাগী পা ফেলে সেহেরের দিকে অগ্রসর হয়। সেহের কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই আরহামের থমথমে শীতল আওয়াজ ভেসে আসে,”তোমার ফোন কোথায়? ”
“আ…আসলে ”
সেহেরকে থামিয়ে দিয়ে আগের মত শীতল স্বরে বলে,”আমি জিগ্যেস করেছি ফোন কোথায়? ”
সেহের টেবিলের উপর উল্টানো ফোনটা আরহামের হাতে ধরিয়ে দেয়। আরহাম সেহেরের মুখের সামনে ফোন ধরে ধমকের স্বরে বলে,” 30+ মিসকল! আমার ফোন রিসিভ করার প্রয়োজনবোধ করো না? ”
সেহের কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,”ফোন সাইলেন্ট ছিল ,তাই টের পাইনি”
“কি এমন ইম্পরট্যান্ট ডিসকাশন চলছিল? যে তুমি দুনিয়া ভুলে তাতেই মগ্ন ছিলে! এই ছেলের সাথে তোমার কিসের পরিচয়? কে এই ছেলেটা”
সেহের নিরুত্তর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এতে আরহামের রাগ বাড়ে। হাতের ফোনটা ফ্লোরে আঁচড়ে ফেলে হুংকার ভারী চিৎকার স্বরে বলল,”আমি জিগ্যেস করেছি কে ও? ”
সেহের ভয়ে কেঁদে উঠে। কান্নারত স্বরে বলে,”আমার ক্লাসমেট ”
আরহাম ছেলেটার কলার টেনে গাল চেপে ধরে।দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”এই বাড়ি আর সেহেরের ত্রিসীমানায় যেন না দেখি! প্রথমবার ওয়ার্নিং দিলাম এরপরের বার সোজা লাশ পড়বে । ”
আরহামের কথায় ছেলেটা কেঁপে উঠে।ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে পরে। আরহাম রাগ দমাতে টেবিলের উপর সজোরে দুইতিনটা লাথি মারে।সেহের আতকে উঠে।এই মুহূর্তে আরহামকে তার ভীষণ ভয় করছে।কোনভাবেই কান্নার বেগ কমাতে পারছেনা ।আরহাম চোখ বুঝে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।সেহেরের দিকে পা বাড়াতেই সেহের দ্রুত পায়ে ভীতু মুখ নিয়ে রুম থেকে ছুটে বেড় হয় আরহাম সেহেরের যাওয়ার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে।
পুরো রুম জুরে ডুকরে কান্নার আওয়াজ ভাসছে।আরহাম বিছানার দিকে ব্যথাতুর চোখে তাকিয়ে ।মিহির চিকিৎসায় আরহাম এখন আগে থেকে অনেকটা সুস্থ। নিজের রাগটা কন্ট্রোল করতে শিখছে । নিজের মধ্যে বসবাসরত অন্য সত্তাটার উপর নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করছে। যতবার সবটা গুছিয়ে অতীত ভুলে নতুন করে শুরু করতে চাইছে ততবারই সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।এখন সেহেরকে কি করে বুঝাবে? তার চারপাশে বিপদ ঘুরপাক করছে! কেউ বারবার সেহেরকে মারার হুমকি দিচ্ছে । হারানোর ভয় আরহামকে ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ।কেউ একজন আছে যে সেহেরের উপর সারাক্ষণ নজর রাখছে।আরহামকে ব্লাকমেইল করছে! সেহেরের এক মুহূর্তের নিখোঁজ আরহামকে দিশেহারা করে দিচ্ছে!
আরহাম ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে।সেহেরের মাথার কাছে বসে আলতো হাতে হাত বুলিয়ে বলে,”এখনো রেগে আছো? আ’ম সরি । আ’ম রিয়েলি রিয়েকি সরি! ”
সেহের কোন প্রত্যুত্তর করল না।আরহাম সেহেরকে কাছে টানতে চাইলে সেহের হাত ছিটকে দূরে সরিয়ে চিৎকার করে বলে ,
“কি চাই আপনার? কেন এমন করেন? আমার আপনার এসব পাগলামো ব্যবহারে ভয় হয়। ভীষণ ভয়!
আপনার ভালোবাসা আমার কাছে পাগলামো মনে।আপনার হিংস্রতায় আমি বিরক্ত ভীত! স্বাধীনতা চাই আমার, আই নিড আ ব্রেক! ”
শেষের কথা গুলো বলার সময় সেহের কান্নায় ভেঙে পড়ে। আরহাম শীতল দৃষ্টিতে সেহেরের দিকে তাকিয়ে ।কোন কিছু ব্যাখ্যা দেওয়ার মত তার কাছে শব্দ নেই। কি বলবে সে? তাকে কেউ জানে মারতে চাইছে? আরহাম নিজেকে নিয়ে ভীতু? তার মাঝে দ্বিতীয় সত্তার বসবাস? সব কিছু শুনে সেহের মানবে! থাকবে আরহামের সাথে?
অসহায় চোখে আরহাম তাকিয়ে থাকে।সেহের থেকে দূরে থাকার কথা আরহাম ভাবতেও চায়না! সেহেরের ব্রেক নেওয়ার কথাটা আরহামের বুকে ছুরিকাঘাত করছে।আরহাম সেহেরের পায়ের কাছে বসে কোলে মাথা রেখে অসহায় স্বরে বলে,”তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত ভাবতে পারিনা! আর তুমি ব্রেক নিতে চাইছ? ব্রেক চাইনা আমার তোমাকে চাই।এই ইটপাথরের শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলো ,কোন সমুদ্রের পাড়ে তরঙ্গদের দেশে! যেখানে শুধু তুমি আমি আর আমাদের ভালোবাসা থাকবে। ”
আরহামের অসহায় ভারী আর্তনাদ সেহেরের মনকে খুব টানছে সেই হিংস্র মানবকে এই মুহূর্তে ভয়ংকর প্রেমিক লাগছে।চেহারায় নিষ্পাপতার ছোঁয়া! একজনের এতো রূপ কেন? মাঝেমাঝে এই মানুষটা এমন হিংস্র হয় কেন?
চলবে…❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।