বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৪৬
সমুদ্র পাহাড়ের মাঝবরাবর রাস্তা।এক পাশে আকাশ চুম্বী উঁচু উঁচু পাহাড় ,অপর পাশে বিশাল জলরাশি ঢেউয়ের রূপে পাড়ে আছড়ে পড়ছে।প্রকৃতির কি বৈচিত্র্য খেলা! সৃষ্টিকর্তার কি সুন্দর সৃষ্টি ,রাস্তার পাশে বড়বড় ঝাউগাছ গুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে ,যেন আকাশ ছোঁয়ার অদম্য চেষ্টা! গাড়ি মেরিন ড্রাইভের বুকে চলছে। মসৃণ স্বচ্ছন্দ রাস্তা ,দূরে অদূরে দুএকটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে।কোন যানঝট কোলাহল নেই।দূষণ মুক্ত বিশুদ্ধ হাওয়া। যা গায়ে লাগতেই ভালোলাগার ছুঁয়ে যাচ্ছে। সেহের চোখ বন্ধ করে বিশুদ্ধ হাওয়ার বিশুদ্ধ ছোঁয়া নিচ্ছে। ড্রাইভার সামনের দিকে ফিরে গাড়ি চালাচ্ছে। আরহাম পাশের সিটে থেকে শুধু সেহেরকে দেখছে।তার সব প্রকার ভালোলাগা গুলো যেন এই মেয়েটির মাঝে সীমাবদ্ধ ।বেশ মনোযোগ দিয়ে সেহেরের গতিবিধি দেখছে ,তাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে!
বিকালের শেষ প্রহর । সূর্য কমলা বর্ণ ধারণ করেছে। অস্ত যেতে আর মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধান।গাড়ী থামে হিমছড়িতে। বিশাল আকাশ চুম্বী পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে শতশত মানুষের ভিড়।কিন্তু সেহেরের কৌতূহল অন্যদিকে ।পাহাড় সমুদ্রের মাঝে ,সমুদ্রকে বেছে নেয়।রাস্তা পাড় হয়ে অপর পাশে সমুদ্রের দিকে পা বাড়ায়।দূর আকাশের সূর্যটা ধীরেধীরে সমুদ্রের দিকে নেমে আসছে। এইতো আর কিছুক্ষণ ,তারপর সমুদ্রের বুকে ডুব দিবে। বড় বড় ঊর্মিমালা পা ছুঁয়ে যাচ্ছে স্নিগ্ধতায় শরীর মনজুড়ে যাচ্ছে।ক্লান্তি অবসান সেই অনেক পূর্বেই গা ছেড়েছে । সূর্যের প্রতিচ্ছবি ভেজা বালিতে চকচক করে ফুটে উঠেছে ।সমুদ্র সোনালি রূপ নিয়েছে ।মৃদু মৃদু দুষ্টু হাওয়া গোছানো চুল গুলোকে বরাবরের মত এলোমেলো করে দিচ্ছে। সেহের আটকাল না।ছেড়ে রাখল।হোক না অবাধ্য ,একটু অবাধ্য হলে ক্ষতি কি? আরহাম একমনে সেহেরের দিকে তাকিয়ে , সেহেরের এলোমেলো চুল গুলো চোখ মুখ ছুঁচ্ছে।কখনো আবার ঠোঁট ।আরহামের বেশ হিংসে হচ্ছে! সেহেরকে কাছে টেনে খুব করে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
কখনো আঁখি পল্লব ,কখনো আবার গোলাপি মলিন ঠোঁট বা কখনো ঘাড়ে কালো কুচকুচে তিলটায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে। মেয়েটা এমন কেন? এতোটা মোহময় কেউ কি করে হয়? প্রত্যেক গতিবিধির মাঝে অদ্ভুত এক মোহ লুকিয়ে । যা আরহামকে চুম্বকের মত টানে।এখন আরহাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে কিছু একটা করে ফেললে ‘অভদ্র প্রেমিক’ নামক ট্যাগ লাগবে ।আরহাম তাতে ভয় পায় নাকি? সেহের অভদ্র বলুক আর যাই বলুক! আরহাম তো তার কাজ করবেই!
সেহেরকে কাছে টেনে বুকে মিশিয়ে নিচু হয়ে ঘাড়ের কাছে তিলটায় গাঢ় এক চুমু খেল।ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটল যে সেহের হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল।আরহাম সামনে স্ট্রিক্টলি তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। সেহের তখনো বিস্মিত!
আরহাম দূরে কাউকে লক্ষ করল।তাদের দিকে তাকিয়ে ,আরহামের চিনতে ভুল হলোনা।লোকটার নাম বাদশা, সিরিয়াল কিলার।এয়ারপোর্টের বাহিরে গেস্টহাউসের সামনেও দেখেছে! হ্ঠাৎ দেখায় তখন না চিনতে পারলেও।এখন পরিচয়টা স্পষ্ট হয়েছে। আরহামের বুঝতে বাকি রইল না ওদের ফলো করার কারণ কি! নিশ্চয় ব্লাকমেইলার লোকটাকে সেহেরকে মারতে পাঠিয়েছে । আরহাম কিছুটা দূরে সরে কাউকে ফোন করল।
সন্ধ্যায় সেহেরের ফোনে কারো কল আসলো। নাম্বারটা অপরিচিত।সেহের রিসিভ করবে না করবেনা বলেও করল। অপর পাশ থেকে তফিরের অস্থির আওয়াজ ভেসে আসে।বলল,”কোথায় তুই? ”
সেহের শক্ত গলায় উত্তর দিলো ,”তা জেনে তোমার কি? ”
“উফফ সেহের এখন তর্কবিতর্কের সময় না।কোথায় তুই? ”
“কক্সবাজার ,আমার তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই।রাখছি! ”
“ওয়েট ওয়েট সেহের! তোর চারপাশে বিপদ ঘুরছে। জানি আমার কথা তোর বিশ্বাস হবে না।
আরহাম তোকে খুন করতে কিলার সেট করেছে।
আমার কথা মন দিয়ে শুন ,লোক পাঠিয়েছি তুই যেখানে আছিস সাবধানে থাক আমি এখনি তোর কাছে রওনা হচ্ছি । ”
তফিরের কথায় সেহের কান দিলো না। পুরো বিষয়টা তার কাছে বানোয়াট মনে হলো।সেহেরকে ভালোবাসে আরহামের প্রতি জেলাসি নিয়েই হয়তো তফির এসব মিছে কথা রটাচ্ছে ।
আরহাম একটু বেরিয়েছে । বলে গেছে মিনিট দশেকের ভেতর ফিরে আসবে ।আধঘণ্টা হয়েছে এখনো ফেরার নাম নেই।কোথায় আছে কে জানে?
গাছপালা ঘেরা বাড়িটা সন্ধ্যা নামতেই আঁধার ঘনিয়ে আসে।সুন্দর কল্পনাপ্রি় বাড়িটা ভূতের বাড়িতে পরিনত হয়। ঝিঝি পোকা অজানা পাখির কুহুধ্বনিতে বুকটা ভীষণ কু ডাকে।তফিরের কথাগুলোও মনে ভীষণরকম ভয়ের ছাপ ফেলেছে ।ভয়টা আরহামকে নিয়ে নয়, চোর ডাকাতকে নিয়ে। এমন নিরিবিলি দ্বিপের মত জায়গায় একা থাকা সাহসের ব্যাপার বটে! কেউ খুন করে ফেলে গেলে বছরের পর বছর কাটবে কেউ টের পাবে না।যদি নিজ থেকে সন্ধান না করে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেহেরের আরহামের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তাও ভীষণ ভাবে।এমন ভুতুড়ে বাড়িতে কেউ একা ফেলে যায় না কি?
আরহাম রাত করে ফিরল।চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট । কন এক গভীর চিন্তায় মগ্ন।সেহের খুব করে রাগ দেখাল আরহাম প্রত্যুত্তরের সরি বলে এড়িয়ে গেল। সেহেরও আর কথা বাড়াল না।চুপচাপ যারযার মত ডিনার করে রুমে চলে এলো ।আরহাম কিচেনে দাঁড়িয়ে।হাত ভীষণরকম কাঁপছে ।হাতে স্লিপিং পিল সামনে দুধের গ্লাস । মেশাতে হাত কাঁপছে।বেশ কয়েকবার হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নেয়।বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে ।কিছু একটা ভেবে চিন্তে সামনের গ্লাসটায় স্লিপিং পিল মিশিয়ে সেহেরের কাছে নিয়ে যায়।দুধের গ্লাস দেখতেই সেহের নাকমুখ ছিটকে নেয়।যেন পৃথিবী সবচেয়ে স্বাদহীন বস্তু তার সামনে।নাক টিপে বলল,” আমি এটা খাবো না ,একদম খাবো না! ”
আরহাম চোখ মুখ শক্ত করে শীতল স্বরে বলে,”কোন বাহানা না, এখনি সবটা শেষ করো।কুইক! ”
সেহের চোখ মুখ খিঁচে বলে,” এটা না খেলে হয় না? ”
“উহু ”
সেহের মুখের সামনে গ্লাস ধরল।এমন সময়ই আরহামের ফোনটা বেজে উঠল । ফোন এটেন্ড করতে আরহাম কিছুটা দূরে সরে গেল।এই সুযোগে সেহের বিছানার পেছনের জানালা দিয়ে গ্লাসে দুধটুকু ফেলে দিলো । আরহাম আসার আগেই দ্রুত আগের মত বিছানায় বসে রইল।বেশ কিছুক্ষণ পর আরহাম ফিরে। সেহেরের হাতে খালি গ্লাস দেখে কপাল কুঁচকায়। সন্দিহান স্বরে বলে,” এতো তাড়াতাড়ি শেষ? ”
সেহের হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।আরহাম আবার বলল,”সবটা? ”
সেহের আবারো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।আরহামকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেহের চটজলদি শুয়ে পড়ল । কন্ঠে ঘুম ঘুম ভাব টেনে বলল,” খুব ঘুম পাচ্ছে ,একটু বিলি কেটে দিন না! ”
আরহাম সেহেরের মাথার পাশে বসল।সেহের বাচ্চাদের মত আরহামের বুকে মাথা রেখে এক হাত গায়ের উপর উঠিয়ে দেয়।চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিশ্বাস ছাড়ে।আরহাম সেহেরের মুখ পানে অপলক তাকিয়ে । নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে।সেহের তার পবিত্র প্রেম । তার প্রতি কোন প্রকার ছলনার আশ্রয় নিতে চায় না। কিন্তু ….
আরহাম সেহেরের মুখের উপর পড়ন্ত চুল সরিয়ে বলে,”শেষবারের মত! …এরপর আর কোন লুকোচুরি নয়।তোমার যেমন আমিকে পছন্দ তেমনটাই হয়ে রবো এবারের মত ক্ষমা করো!”
আরহাম কপালে গাঢ় এক চুমু এঁকে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখে সেহেরের ঘুম ভাঙল।বিছানায় তড়াক করে উঠে বসে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে।গা ঘামে একাকার।কপাল গলা ভিজে।সেহের বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে ।শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দু তড়িৎ বেগে ছুটছে।বুকের ধুকধুকানি এখনো কমেনি।পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাস্টা তুলে নিমিষে ঢকঢক করে শেষ করে।পাশে ফিরে আরহামের দিকে চাইল। আরহাম নেই । বিছানা খালি। অন্ধকার ঘরটায় সাদা পর্দাগুলো বসন্ত হাওয়ায় এলোমেলো ভাবে উড়ছে।ড্রিমলাইটের মিটিমিটি আলো জ্বলছে।পুরো ঘর জুরে আলো ছায়ার খেলা। আঁধারটা যেন রূপকথার দৈত্যের রূপ নিয়েছে ।আলো আঁধারের খেলায় যেন কাল্পনিক ভূত গুলো তার দিকটায়ই এগিয়ে আসছে। সেহের ভীষণ ভয় পেল।তফিরের কথা গুলো মনে করে ভয় আরো বাড়ল । বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। আরহাম নেই , বারান্দায় ও নেই। এতো রাতে কোথায় যেতে পারে? সেহের ভীতু গলায় আরহামকে ডাকতে থাকে । কিন্তু কোন প্রত্যুত্তর মিলল না। এমন সময় নিচ থেকে পুরুষালি চিৎকার ভেসে আসে। সেহের ভয়ে কেঁপে উঠে। দ্রুত পায়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
শেষ সিঁড়িতে পা রাখতেই সেহের আতকে উঠে।জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়।গা থরথর কাঁপছে তার।দু তিনজন একটা লোককে ঘিরে।মধ্যমণি সোফায় আরহাম বসে।কালো হুডি ,হাতে গ্লাবস ভয়ংকর রূপ।মায়াদয়াহীন চোখ মুখ ।চেহারায় স্পষ্ট খুনের নেশা। রক্তাক্ত লোকটা প্রাণের ভিক্ষা চাইছে । জায়গা জায়গায় গা থেকে রক্ত ঝোরছে।সেহের স্থির চোখে তাকিয়ে ,শরীরের সবরকম অনুভূতি কোথাও হারিয়ে গেছে।শরীর ছেড়ে দিতে চাইছে সেহের সিড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে যায়।শরীর মৃত শরীরে পরিণত হয়েছে।
সেহেরকে দেখে আরহাম ঠিক ততটাই অবাক । রাগে গরগর করছে। মাথা চেপে ফোঁসফোঁস শব্দ করে বলে,”এখানে এসে ঠিক করনি,একদম ঠিক করোনি ।”
হুংকার দিয়ে সামনের টেবিলটায় লাথি মারে।সেহের ভয়ে কেঁপে উঠে।আরহাম বিরবির করে আস্তে আস্তে সেহেরের দিকে এগিয়ে আসছে সেহের ধীরেধীরে পিছনের দিকে যাচ্ছে।চোখ থেকে অনবরত জল ঝোরছে।বাদশা সুযোগ বুঝে আরহামের উপর হামলা করতে চাইলে আরহাম আটকে ফেলে। সামনে এনে ঘাড়ের উপর একের পর এক ছুরিকাঘাত করে। আরহামের শক্ত দৃষ্টি তখনো সেহেরের দিকে। চোখে মুখে হিংস্রতার ধারাল ছাপ। মানুষ রূপি দানব । আরহাম অনবরত একের পর এক প্রহার চালাচ্ছে । রক্তে আরহামের মুখ ভিজে । রক্তের ছিটাফোঁটা সেহেরের গা ছুঁয়েছে।সেহের হাতের দিকে তাকিয়ে থরথর কাঁপতে থাকে। হাত রক্তে মাখামাখি । নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চারদিক গোল গোল ঘুরছে। সেহের সজোরে চিৎকারে মাটিতে ঢলে পরে।জ্ঞান হারায়।
চলবে….❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।