বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৪৭
জ্ঞান ফিরল পরের দিন সকালে। বেলা তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই । সোনালি রোদ ধীরেধীরে কঠোর রূপ ধারণ করছে। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ পাড়ে আচড়ে পড়ছে । যার শব্দ কোন আদি মোহিত সুর তুলছে ।চারদিক জুড়ে পাখির কিচিরমিচির ডাক।সেহের ভারী ভারী মাথা তুলে উঠে বসল।মাথাটা এখনো শ’মণ ভার হয়ে আছে।সেহের বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে রইল। রাতের কথা ভাবতেই মুখে ভীতু ভাব ফুটে উঠে। পুরো ব্যাপারটা সেহেরের কাছে ভয়ানক কোন এক দুঃস্বপ্ন মনে হলো।স্বপ্ন এতোটা বাস্তব হয়কি? আনমনে নিজেকে প্রশ্ন করল।এমন সময় রুমের দরজা খুলে আরহাম ঢুকল।আরহামকে দেখে সেহের কেঁপে উঠল । এক মুহূর্তের জন্য রাতের ছবি গুলো চোখের সামনে বাস্তব চিত্ররূপে ভেসে উঠল।আরহাম ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছে ।সেহেরের পাশে বসে মিহি হেসে বলল,”গুডমর্নিং লাভ! ”
সেহের জোরপূর্বক হাসি টানল ।তারপর আবার চিন্তায় ডুবে গেল।আরহাম সূচালো চোখে সেহেরের দিকে তাকাল ,সেহের কোন কিছু সন্দেহ করছে কি? প্রশ্ন করল,”ইজ এভরিথিং ওকে! ”
সেহের একবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।কিছুকক্ষণ চুপ থেকে নিজে নিজেই বলল,”জানিনা কালরাত কি হয়েছে।ঘুম ভাঙার পর ভয়ানক এক স্বপ্ন চোখের সামনে ভাসছে।যেন সবটাই বাস্তব! স্বপ্নে আপনি কাউকে নির্দয় ভাবে হত্যা করছে ,আপনার মুখ রক্তে ভিজে! ”
সেহেরের কথায় আরহামের মুখের রঙ পাল্টাল।মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে থেমে থেমে বলল,” কি বলছ! আমি? আমি কাউকে খুন করব? ”
বলেই গা কাঁপিয়ে হাসতে লাগে।আরহামের হাসির পেছনে ভয় লুকিয়ে ,যা সেহের তেমন ভাবে বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারছে।কিন্তু কেন? সেহের ভাবুক মুখ করে বেড টি শেষ করল। আড়চোখে আরহামের দিকে তাকাতে দেখল ,আরহাম কোন গভীর চিন্তায় ডুবে ।সেহের চা শেষ করে।ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকে।আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভীষণরকম চমকায়! এ পোশাক পরে তো কাল রাতে শোয় নি তাহলে তার গায়ে এ পোশাক আসলো কি করে?
রাতের কথা মনে করতেই সেহেরের মাথায় হালকা ধাক্কা লাগে।কাঁপা কাঁপা হাত জোড়া চোখের সামনে মেলে। কই রক্ত নেই তো! সকাল থেকে আরহামের কথা কাজে সেহেরের ভীষণরকম সন্দেহ হচ্ছে নিশ্চয় গতরাতে কিছু একটা হয়েছে ,তা কি?
সেহের ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরে দেখে আরহাম নেই।আবার কোথায় গেল? এসব ভাবনা চিন্তার মাঝে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে।কেয়ারটেকার আজ আসেননি । আরহামও বাড়ি নেই ,পুরো বাড়ি ফাঁকা।সোফার রুমে আসতে সেহের কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়।চোখের সামনে আবছা প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। সেহের আতকে উঠে ছিটকে দূরে সরে যায়।ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।সামনের থেকে গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলে।দুপুরের খাবারের জন্য কিচেনে ডুকতে নাকে তীব্র এক গন্ধ বাজে। সেহের নাকমুখ ছিটকে নেয়।কোথাও কিছু নষ্ট হয়েছে কি?
সেহের পুরো কিচেনে তল্লাসি করতে লাগে।কোথাও কিছু নেই।এমন সময় কিছুতে পা পিছলে নিচে পড়ল।হাত পায়ে খুব লেগেছে ।উঠে বসে যেই চেক করতে লাগল অমনেই চিৎকার দিয়ে উঠল।হাতে পায়ে রক্ত লেগে।চুলার নিচের বক্স থেকে ফোটা ফোট রক্ত ঝোরছে।শব্দহীন বাড়িটায় রক্ত বিন্দুর টপটপ আওয়াজ বাজছে ।সেহের বক্সটা খুলতে বেশ চেষ্টা করল ,পারল না।তালা লাগানো ।বাহির থেকে লাঠি এনে বেশ কয়েকবার আঘাত করতেই তালা ভেঙে খুলে গেল।সামনে দেখতেই সেহের চিৎকার করে দূরে সরে গেল। সামনে কারো অর্ধগলিত লাশ। যার থেকে চুঁইচুঁই করে রক্ত ঝোরছে। সেহের মুখ চেপে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল । তারমানে সেটা স্বপ্ন ছিলোনা ,গতরাতে সত্যি ছিলো! আরহাম সত্যি খুন করেছে,সে খুনি!
পাথর হয়ে বসে রইল।
সত্যের এক বিশেষ গুন আছে হাজার চাইলেও তা লুকানো যায়না । কোন না কোন সূত্র ধরে তা ঠিক সামনে আসে। যত দেরীতে তা সামনে আসে তত বেশি ভয়ংকর হয়।
সেহের বেশ কিছুক্ষণ পাথর হয়ে বসে রইল।কিছু একটা মনে করে তড়িঘড়ি করে মোবাইল খুঁজতে লাগল।চোখ থেকে তখনো অনবরত পানি ঝোরছে। মোবাইল টেবিলের উপর মিলল ।মোবাইল হাতে নিয়ে তফিরের নাম্বারে ফোন করল। ফোন রিং হচ্ছে। ধরছে না। দুবার বাজতেই পেছন থেকে কেউ ফোন কেড়ে নিলো।সেহের ঘাড় ফিরিয়ে চাপা চিৎকার করে উঠে। আরহাম গাঢ় স্বরে বলে,” কাকে ফোন করছ! তফিরকে? সে এখন ব্যাগপত্র গোছাতে ব্যস্ত ।নারায়ণগঞ্জ ট্রান্সফার হচ্ছে! ”
সেহের ধপ করে আরহামের পায়ের কাছে বসে পড়ে। পা চেপে বলতে লাগে,” আমাকে ছেড়ে দিন ,কাউকে কিছু বলব না।আমাকে যেতে দিন!”
আরহাম অনুভূতিহীন শক্ত চোখে তাকিয়ে।সেহের পা জড়িয়ে অনবরত কাঁদতে লাগে।আরহাম নিচু হয়ে সেহেরের থুতনি ধরে দাঁড় করিয়ে ।শক্ত করে মুখ চেপে বলে,”কেন যেতে চাইছ? আমার যে তোমাকে চাই! ”
সেহের কান্না ভরা আকুতি করতে করতে বলে,”প্লিজ আমাকে যেতে দিন ,প্লিজ! ”
আরহাম শুনল না। রেগে চিৎকার করে বলল,” কেন যেতে চাইছ তুমি? কেন? সবাই আমাকে ফেলে চলে যায় কেন! ”
আরহাম অস্বাভাবিক আচরণ করছে।সেহের আরহামের আচরণে ভয়ে গুটিসুটি মেরে আছে। ভীষণ ভয় করছে। ক্লান্তিহীন ভাবে কেঁদেই যাচ্ছে।আরহাম নিজে নিজেই বিরবির করে কিছু বলে চলছে ।আরহামের বেখেয়ালির সুযোগ নিয়ে সতর্কতার সাথে যেই সেহের পালাতে যাবে অমনি পেছন থেকে আরহাম চুল টেনে ধরে।সদর দরজার দেয়ালে মিশিয়ে মুখ চেপে শক্ত গলায় চিৎকার করে বলে,”কেন যেতে চাইছ? আমার ভালোবাসায় কমতি কিসের? কি চাই তোমার? এক্ষুনি পায়ের কাছে হাজির করব ! বলো কি চাই? বলো ”
আরহাম কাতর চোখে সেহেরের দিকে তাকিয়ে । সেহের আরহামের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিৎকার স্বরে বলে,” মুক্তি চাই আমার! শুনেছেন? মুক্তি চাই! খুনি অমানুষ জানোয়ারের সাথে এক মুহূর্ত থাকতে চাই না। আমাকে মুক্তি দিন! ”
সেহের কান্নায় ভেঙে পড়ে। আরহাম স্থির চোখে তাকিয়ে । শীতল চোখ মুখে ভাবমূর্তির কোন প্রকার পরিবর্তন হয়নি।আরহামের স্থির চাহনি বড় কোন ঝড়ের আবাস।আরহাম ঠান্ডা স্বরে বলল,”জানতাম একদিন ঠিক আমার সত্যিটা তোমার সামনে আসবে! কিন্তু তা এতো দ্রুত আসবে জানা ছিলো না। ”
সেহের ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। আরহাম দু কদম সরে টি- টেবিলের উপর থেকে ক্লোরোফর্মের শিশিটা হাতে নিলো।পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বের করে খানিকটা ভিজিয়ে সেহেরের নাকে চেপে ধরে কানের কাছে মুখ এনে ধীর স্বরে বলল ,”সরি লাভ! তোমাকে কাছে রাখতে সব করতে পারি। সব! ”
সেহেরের সামনে সব ঘোলাটে হয়ে আসে। মাথা অসহ্য যন্ত্রণা ।ধীরেধীরে আরহামের বুকে ঢুলে পরে।চোখ বুঝে উঠার আগে দেখল আরহামের ঠোঁটে অদ্ভুত রহস্যময় হাসি ফুটে ।
এরপর যখন চোখ খুলল নিজেকে অন্যকোথাও এক বাড়িতে বন্ধী পেলো ।বেশ কয়েকবার পালাতে চেষ্টা করছে।কিন্তু প্রত্যেকবার বিফল হলো।ফলস্বরূপ হাতে পায়ে শিকল লাগল । এই বিশাল নিরিবিলি বাড়িতে মাসের পর মাস আসামিদের মত আটকা থেকে গেল।বাবা মা আত্মীয়স্বজন সবার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন।বাড়ির সব দরজা জানালা সাউন্ড প্রুফ পাসওয়ার্ড লাগানো ।সেহেরের কান্না আকুতি কোনটাই এই চার দেয়ালের বাহিরে পৌঁছয় না। এক জানালার ফটক দিয়ে দিন রাত মাসের আন্দাজ লাগিয়ে কাটাতে লাগল।দিনের পর দিন আরহামের জোরপূর্বক ভালোবাসা বিষাক্ত প্রেমের শিকার হলো।
বর্তমান……..
গাড়ির হর্নে সেহেরে ঘোর কাটল।চোখ খুলে দেখল বাড়িতে পৌঁছে গেছে।এতো মাসে এই প্রথম বাহির থেকে বাড়ি দেখল।সেহের পুরোপুরি হতভম্ব এতো মাস তিলোত্তমা বাড়িটার পাশে ছাইরঙা সেই ভূতুরে বাড়িটায় বন্ধী ছিলো?
সেহেরের ভাবনা জগতে টোকা পড়ল।মুখ উঠিয়ে দেখে আরহাম গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে।সেহের চুপচাপ উঠে সামনের দিকে পা বাড়াল।আরহাম সাহায্য করতে চাইলে সেহের হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয়।ছোট ছোট পা ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। শরীর এখনো ভীষণ দুর্বল । এক কদম চলার মত শক্তি নেই। অনেকটা মনের জোর দিয়েই পা বাড়াচ্ছে।আরহাম পেছন থেকে তা লক্ষ করে কোলে তুলে নেয়।সেহের রক্তচক্ষু করে তাকাল।আরহাম সেদিকে খেয়াল না করে বলল,”সব সময় খামাখা জিদ দেখানোর প্রয়োজন নেই।এখন তুমি একা নও তোমার গর্ভে আমাদের সন্তান। ….আমার ছোঁয়ায় তুমি ভস্ম হয়ে যাবে না। ”
“আমাদের না শুধু আপনার! ”
সেহের রাগী স্বরে বলল।আরহাম গাঢ় দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে ভিতরে চলল।
চলবে…❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।