বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৫৮
সেহের সোফায় গা এলিয়ে বসে। লং জার্নি করে শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। ভীষণ ক্লান্ত সে।এতো বছর পর দেশে এসে নিজের বাড়ি ফিরে ভীষণ ভালো লাগছে ।নিজের দেশের মাটিতে অন্যরকম এক জাদু থাকে।মুহূর্তেই মনে অদ্ভুত এক শক্তি জোগান দেয়।রুমের দিকে একবার চোখ বুলালো।কোন কিছু পরিবর্তন হয়নি সবকিছু আগের মত পরিপাটি আছে। এই বিছানা এই ঘরের সাথে হাজারো স্মৃতি ডোরে বাঁধা।সবকিছু আগের মত থাকলেও মানুষ গুলো অনেক পরিবর্তন হয়েছে।আগের সেই আন্তরিকতা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। আজ সকালে যখন বাড়ি ফিরল মালিহা খানম আশনূহাকে কাছে টানলেও সেহেরকে এড়িয়ে গেছে। যেন তার ফিরে আসায় তিনি ভীষণরকম অসন্তুষ্ট!
ভাবনার মাঝেই সেহের মাথা থেকে তোয়ালে ছাড়ালো । চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে।মাত্রই শাওয়ার নিয়ে এসেছে । চোখে তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব। মনে হচ্ছে এখনি ঘুমের দেশে তলিয়ে যাবে।আলতো করে কপালে হাত বুলাচ্ছে।এমন সময় নিজের খুব কাছে কাউকে অনুভব করে।ধপ করে চোখ খুলল । মাথা তুলে পিটপিট করে তাকাল।আরহাম এসেছে।আরহামকে দেখে ছোট নিশ্বাস ফেলল।আরহাম ধীরে ধীরে সেহেরের কাছে আসছে । সেহের পিছাতে পিছাতে সোফার কিনারার সাথে ঠেকেছে । আরহাম শার্টলেস, আঁখি পল্লব ভারী ।ঠোঁট জোড়া লাল টকটকে। মাত্রই শাওয়ার নেওয়ায় সাদা চওড়া বুকে বিন্দু বিন্দু জলকণা লেগে। পাঁচবছরে কিছু বদলায় নি। আরহাম আগের মতই সুদর্শন ,বরং বয়সের সাথে যেন আরো বেড়েছে।আরহামকে এতো কাছে দেখে সেহেরের গলা শুকিয়ে আসছে। শরীর ঠকঠক কাঁপছে ।আরহাম সেহেরের দুপাশে হাত রেখে সেহেরকে নিজের বাহুডোরে আটকে নেয়।সেহের অনবরত পলক ঝাপটাচ্ছে। আরহাম সেহেরের ঘাড়ের কাছে মুখ এসে বড় এক শ্বাস টেনে নেয়।যেন কত জনম পর বিশুদ্ধ হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে।সেহেরের নড়চড়ে আরহামের ধ্যান ভাঙে চোখ খুলে সেহেরের মুখোমুখি হয়ে।কাঠখোট্টা স্বরে বলে ,” এতো কাঁপছ কেন? ”
সেহের কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,”আ…আপনি এতো কা…কাছে? মানে ”
আরহাম ভ্রু কুঁচকে বলল,”তো ? চার্জার নিতে এসেছি! ”
“চার্জার? ”
সেহের আরহামের দিকে তাকিয়ে ভাবনাগ্রস্ত স্বরে বলল।আরহাম সেহেরের পেছন থেকে চার্জার বের করে মুখের সামনে তুলে ধরে। সেহের দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। আমতা আমতা স্বরে বলে, “আ..আমি ভেবেছি ”
“কি ভেবেছ? তোমার কাছে এসেছি? ”
সেহের চুপ থাকল। আরহাম উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল,”ডোন্ট ওয়ারী,এখন তোমার স্নিগ্ধতা আমাকে টানে না! তোমার উপর এখন আর …”
“ইন্টারেস্টেড নাহ! তাইতো? ”
সেহের কথা কেটে বলল। আরহাম উত্তর দিলো না।সেহেরের ভীষণরকম মন খারাপ হলো।অশ্রুপূর্ণ ভারী চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে থাকল । এমন সময় আশনূহা বাহির থেকে ছুটে আসে।আরহাম গায়ে শার্ট জড়িয়ে মেয়েকে কোলে তুলে বারান্দার দিকে যায়। সেহের অভিযোগের স্বরে বলে ,”সব আদর ভালোবাসা মেয়ের জন্য ,মেয়ের মা তো বন্যার জলে ভেসে এসেছে! ”
সোফা ছেড়ে বড় বড় পা ফেলে সেহের বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরে।চোখে জমে থাকা জলকণা কয়েক ফোটা বালিশে গড়িয়ে পরে। মিনিট দুএকের ভেতর চোখে ঘুম নামে। গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায়। ঘুমের ভেতর অনুভব করে কেউ খুব কাছে এসে মুখের উপর পড়ন্ত চুল গুলো সরিয়ে দিচ্ছে।আবেশে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে! হাওয়ায় মিষ্টি মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ভাসছে । ঘ্রাণটা সেহেরের ভীষণ পরিচিত।নিশ্চয়ই আরহাম!
সেহের ঘুমকাতুরে স্বরে বলল,”প্রথমে রাগ দেখিয়ে এখন আদর করা হচ্ছে? আপনি পঁচা ,খুব বেশি পঁচা …
আরো কিছু বলল।যা আরহামের কান অবধি পৌঁছায় না। তার আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়!
আরহাম মুচকি হেসে ফিসফিসে বলে ,” এই বাচ্চা মেয়ে কিনা এক বাচ্চার মা! ”
সেহেরের ঘুম ভাঙল বিকেলে।দুপুরে খাওয়া হয়নি। কয়েকবার আশনূহা ডেকে গেছে । সেহেরে বেহুশ হয়ে পড়ে ঘুমিয়েছে।বাহিরে কালো হয়ে এসেছে শীতের বিকেল পাঁচটা বাজতে- ই অন্ধকার নামে।সেহের বড় হাই তুলে বিছানা ছাড়ে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে লিয়াকে দেখে।মুহূর্তে চোখ মুখ চমক দিয়ে উঠে। দ্রুত সিরি বেয়ে লিয়ার কাছে এগিয়ে যায়। লিয়া আশনূহার সাথে কথা বলছে।পাশেই তিন সাড়ে তিনবছরের এক বাচ্চা ছেলে দেখল । আশনূহার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয় লিয়ার ছেলে। চেহারার গঠন বলে দিচ্ছে।সেহের লিয়াকে ডাকতে লিয়া মুখ ঘুরিয়ে নেয়।অভিমানী স্বরে বলল, “তোমার সাথে আড়ি কথা নেই! ”
“কেন? আমি আবার কি করলাম? ”
“কিছু করোনি? পাঁচবছর আমাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছ । আশনূহাকে আমাদের থেকে দূরে রেখেছ! রাগ তো ভাইয়ার সাথে ছিল আমাদের কেন কষ্ট দিলে! জানো কত চিন্তা হতো? ভীষণ মিস করেছি তোমাকে! ”
সেহের অপরাধী স্বরে উত্তর দিলো ,”সরি একটা ভুল বুঝাবুঝি থেকে এতোকিছু হয়ে গেছে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার ভুলের জন্য আমার কাছে মানুষ গুলো কতটা ভুগেছে! ”
“হয়েছে হয়েছে এখন মন খারাপ করতে হবে না। তোমাকে মানায় না!
এখন আমাকে এটা বলো তো ভাইয়ের কার্বনকপি কোথা থেকে আনলে? পুরো ভাইয়ের মত চলনবলন! যে কেউ দেখলে বলবে আশনূহা তোমার আর ভাইয়ের মেয়ে! ”
সেহের মুচকি হাসল।বলল,” এটা তোমার ছেলে বুঝি ”
লিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।সেহের বাচ্চাটার গাল ছুঁয়ে বলল । বাচ্চাটার শান্ত দৃষ্টি তখনো অপলক ভাবে আশনূহার দিকে। সেহেরের কথায় চেতনা ফিরল খুব ডিসেন্ট ভাবে উত্তর দিলো ,”আমার নাম লিয়ান ,মামি মণি! ”
সেহের আদর করে বলল, ” বাহ ,কি সুন্দর নাম! আমাকে মামি মণি ডাকতে কে বলেছে। আম্মু? ”
“না আমি নিজের থেকেই ডেকেছি ”
সেহের লিয়ানের কথা বলার ধরণ দেখে ভীষণ চমকায়।এতো টুকু বাচ্চা ছেলে কি সুন্দর শালীন ভাবে বড়দের মত কথা বলে।শান্ত দৃষ্টি!
আশনূহা লিয়ানকে তার মায়ের এতো কাছে আসতে দেখে কপাল কুঁচকে নিয়েছে।রাগী দৃষ্টিতে লিয়নের দিকে তাকিয়ে আছে।
সেহের লিয়া কথা বলছে।আশনূহা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। লিয়ান শান্ত ভাবে বসে puzzle ফিক্সড করছে।এর মাঝেই আরহাম আসে । আশনূহার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে আমার নূহা মার? ”
আশনূহা উত্তর দিলো না। বিরক্তি ভারী চোখ করে লিয়ানের দিকে তাকাল।নূহার দৃষ্টি অনুসরণ করে লিয়ানের দিকে তাকাল ,বলল, “লিয়ানকে তোমার পছন্দ না? ”
নূহা না সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল,” নাহ একদম পছন্দ না! ও আশুর মাম্মামের আদর নিয়েছে।ও আশুর মাম্মামকে মামি মণি বলেছে! ”
“তাতে কি হয়েছে? ”
“নাহ কেউ আশুর মাম্মামের আদর নিতে পারবেনা । মাম্মাম শুধু আশুকে আর বাবাইকে আদর করবে! ”
আশনূহার কথা শুনে সেহের বিষম খেলো।এতো টুকু মেয়ে কতকিছু বুঝে! ধমকে স্বরে বলে,” আশু! এগুলো কেমন কথা? স্যে সরি ,”
আশনূহা না সূচক মাথা নাড়াল।সে লিয়ানকে সরি বলবে না। মায়ের কথায় মান করে উপরে চলে যায়। সেহের বিরবির করে বলে,” একদম বাপের মত নাকউঁচু হিংসুটে হয়েছে! ”
কথাটা আরহামের কান এড়ায় না।আরহাম সরু চোখে তাকাতে সেহের সাথে সাথে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আরহাম ধমকি সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেয়ের মান ভাঙাতে পিছু পিছু যায়।
রাতে ঘুমাতে যেয়ে বিছানায় সেহেরকে দেখে আরহাম ভ্রু কুঁচকে নেয়। গম্ভীর আওয়াজ করে বলে ,” তুমি এখানে? ”
“হ্যাঁ তো! এতো অবাক হওয়ার কি আছে? রাত হয়েছে ঘুমাবো না! ”
“এখানে কেন? ”
“তো কোথায় ঘুমাবো”
“তোমার রুমে ”
“এটাই তো আমার রুম ”
“উহু ,সামনের রুমের তালা খুলে দেওয়া হয়েছে । সেখানে যাও! ”
সেহের আরহামের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আধ শোয়া থেকে পুরোপুরি শুয়ে আশনূহাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে চেঁচিয়ে বলে ,”এটা আমার রুম আমি এখানে- ই ঘুমাবো। এই দেখেন আমি ঘুমিয়ে গেছি! ”
বলেই সেহের ঘুমের ভান করল। আরহাম বড়বড় পা ফেলে বিছানায় উঠে। সেহেরকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।সেহেরের শ্বাসবন্ধ হওয়ার উপক্রম! ঘাড় ঘুরিয়ে বড়বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে ,” কি করছেন। মরে যাবো তো! ”
আরহাম বাঁকা হেসে বলে,” এখানে ঘুমালে এভাবে- ই ঘুমাতে হবে। সব কিছুর একটা মূল্য আছে না! ”
সেহের বিরবির করে বলে ,”এতো ভঙ্গিমা না করে সরাসরি বললেই পারেন আমাকে জড়িয়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে! ”
আরহাম হতভম্ব হয়ে সাথে সাথে ছেড়ে দেয় । অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ে। সেহের কিটকিটে হেসে বলে,”চুরি ধরা পড়লে সবাই এভাবে- ই মুখ লুকায়। ”
অপর পাশ থেকে আরহামের উত্তর,” বাহ, চালাক হয়েছো দেখছি! মিষ্টি বিলি করবো? ”
সেহেরের হাসি উড়ে গেল।লোকটা আবারো অপমান করল?
চলবে…..❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।