বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৫৯
এক সপ্তাহ কেটেছে সেহের আশনূহা দেশে ফিরেছে । এই এক সপ্তাহে আশনূহা সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে । সবাই আশনূহা বলতে অজ্ঞান!
এদিকে সাদাত সাহেব ফিরে এসেছেন । মেয়ে আর নাতনির সাথে দেখা করে চিটাগাং ফিরবে।অধৈর্য ভাবে অপেক্ষা করছে।মুখে স্পষ্ট চিন্তাভাব ফুটে। এখানে আসার পর সেহেরের কোন অসুবিধা হয়নি তো? আরহাম সেহেরের উপর আবার অত্যাচার করেনি তো?
এমন সময় দিশা চা- নাস্তা নিয়ে এগিয়ে আসে। দিশাকে দেখে সাদাত সাহেবের দমে থাকা রাগ জেদ উপচে আসে । বাজখাঁই গলায় বলে,” আজ আমার মেয়ের জীবন এলোমেলো হওয়ার পেছনে একমাত্র তোমার হাত! ”
হ্ঠাৎ এমন কথায় দিশা হতভম্ব মুখ করে সাদাত সাহেবের দিকে তাকিয়ে । বিস্ময় কাটছে না।খানিক বাদে নিজেকে সামলে বলে,”আমি কি করলাম? ”
“সবটা তুমি- ই তো করেছ! না তুমি সেহেরকে এখানে ডাকতে ,না আরহামের সাথে পরিচয় হতো! না সেহেরকে এসব সহ্য করতে হতো!
আমার মেয়েকে বন্দি করে রেখেছে । শান্তির শ্বাস ফেলবার মত ফুরসত নাই! ”
দিশা সাদাতের কথায় বাঁকা হাসল।তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,”আজ তোমার মেয়ে বলে তুমি সেহেরের কষ্টটা অনুভব করছো। আমাকে তো তুমি রেহাই দেওনি ,আমিও কারো মেয়ে ছিলাম । তোমার কাছে দমিয়ে রাখতে চাইছিলে! বুঝলে সাদাত পাপ বাপকেও ছাড়েনা। তোমার কর্মের ফল নিষ্পাপ সেহের পেয়েছে! ”
“তুমি সত্যি হৃদয়হীন জঘন্য মহিলা । নিজের মেয়ের কষ্ট অনুভব করতে পারছ না! ”
“অবশ্যই অনুভব করতে পারছি ,তাও তোমার থেকে অনেক বেশি! আমিও যে এই পরিস্থিতি মুখোমুখি হয়েছি।সেহেরের জন্য ভীষণ কষ্ট হয়। ”
“তোমার মুখভাব দেখে তো মনে হচ্ছেনা ”
“আমার ভেতরের যন্ত্রণা আমি জানি । সেহের আমারো মেয়ে এই পাঁচবছর মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ শুনে কতটা ভেঙে পড়েছিলাম তা কেবল আমি জানি! সেহেরের সাথে হয়েছে আমার জন্য নয় তোমার কর্মফল এসব ”
সাদাত সাহেব কিছু বলতে চাইল । সেহেরকে এদিকে আসতে দেখে চুপ করে রইল। হাজার হোক মেয়ের শ্বশুর বাড়ি তো!
সকাল সকাল বাগানের দিক থেকে হাসি ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে।আশনূহা বাবার সাথে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে। সেহেরের ঘুম ভাঙ্গল দেরী করে।নাস্তা শেষ করে বাগানে আসতে সেহের ভীষণরকম চমকাল ।আরহাম তফির মুখোমুখি বসে হাসি ঠাট্টা করছে। দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে দুজনের ভেতর খুব ভালো সখ্যতা! সেহের ফ্যালফ্যাল চোখে দুজনকে দেখছে । পাঁচবছর আগে আগে দুজন দুজনার নাম শুনতে নারাজ ছিল। কিন্তু এখন? এখন দেখে মনে হচ্ছে বহু বছরের পুরানো বন্ধুত্ব!
সেহের বিস্মিত চেহারায় তাকিয়ে। সেহেরকে দেখে তফির আওয়াজ করে বলে ,”আরে সেহের যে? কেমন আছিস? ”
তফিরের কথায় আরহাম ঘাড় ফিরিয়ে সেহেরের দিকে তাকায়। সেহের দুজনের দিকে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বলল,” আগুন বারুদ এক সাথে কি করে? জোরদার বিস্ফারণ হবে কি? ”
সেহেরের কথায় তফির গা কাঁপিয়ে হাসল বলল,”বিস্ফারণ হবে কেন? আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড! ”
‘বেস্ট ফ্রেন্ড ‘শুনা মাত্র সেহের বড়সড় বিষম খেল। পিটপিট চোখে তাকিয়ে বলল,বেস্ট ফ্রেন্ড আর তোমারা দুজন? এটাও বিশ্বাস করতে বলছ? ”
সেহের জোরে জোরে হাসতে থাকল। আবার বলল,” আমি বোকা এতোটাও নয় যে তোমার আজগুবি কথা বিশ্বাস করবো! ”
আরহাম গম্ভীর মুখ করে ফিসফিস করে বলল,”ফাইনালি ,স্বীকার তো করলে! ”
সেহের ভ্রু কুঁচকে আরহামের দিকে তাকাল। বলল,”আবারো অপমান? ওয়েট! আপনার সাথে পরে ডিল করছি! ”
তফিরের দিকে তাকিয়ে বলল,”তোমরা তো চির শত্রু ছিলে ,এতো ভালো বন্ধুত্ব হলো কি করে? ”
“আমাদের শত্রুতা ছিল তোকে নিয়ে। রাইট? ”
সেহের হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল । তফির আবার বলল ,”তুই ছিলি না আমারদের শত্রুতাও মিটে গেছে। আমরা ভালো বন্ধু হয়ে গেছি! ”
সবকিছু সেহেরের মাথার উপর দিয়ে গেল।বেখেয়ালি স্বরে বলল,”আমি ফিরে এসেছি ,এখন? ”
আরহাম সেহেরের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস স্বরে বলল,” স্টুপিড! ”
সেহের তা শুনে সরু দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকাল । আরহাম চেয়ার ছেড়ে আশনূহার দিকে পা বাড়ায়। তফির বলল,”
এখন তোকে না আমার চাই ,না আরহামের। তো শত্রুতার প্রশ্ন- ই আসে না! ”
সেহের তখনো কিছু বুঝল না। শুধু এতোটুকু বুঝল আরহামের এখন আর তাকে চাইনা!
সেহের অনেকক্ষণ তফিরের সাথে গল্প করল।তফির থেকে জানতে পারল। তফির- ই সেহেরের ঠিকানা আরহামকে জোগাড় করে দিয়েছে। চিটাগাং সেহেরের বাবার ড্রাইভার থেকে খোঁজ নিয়ে নানা ভাবে কথা বের করেছে।সেখান থেকে জানতে পারে সেহের নিউইয়র্কে আছে। প্রতিবছর সাদাত সাহেব সেহেরের সাথে- ই দেখা করতে যায়। সেহের সবশুনে হতভম্ব!
তফির আরহাম কথা বলছে। সেহের নাস্তা আনতে ভিতরে গেছে। আরহাম চিন্তিত স্বরে বলল,”সেহেরের উপর কড়া নজর রাখতে হবে! কেই আবারো চাইছে সেহেরের ক্ষতি করতে ”
তফির চমকাল।বলল,”এমন টা কে চাইবে? সেহের কারো কি ক্ষতি করেছে? ”
“জানিনা ,কিন্তু কেউ তো আছে যে সেহেরকে মারতে চায়। এর আগেও দুবার হামলা হয়েছে। আমাদের আগে নিউইয়র্কে কেউ সেহেরের খোঁজ করেছে! ”
তফির কিছু একটা ভেবে বলল,”ডোন্ট ওয়ারী । আমি বাড়ির চার পাশে কড়া গার্ড পাঠাবো ।চব্বিশ ঘন্টা তারা বাড়ি আর সেহেরের উপর নজর রাখবে! ”
আরহাম গম্ভীর স্বরে বলল,” আই ট্রাস্ট ইউ! তোমাকেও সাবধান হতে হবে। আমি কাল বিকালে পার্টির কাজে ঢাকার বাহিরে যাচ্ছি দুদিনের জন্য ।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসার চেষ্টা করবো! এই দুদিন আমার হয়ে তোমাকে সেহের আশনূহার খেয়াল রাখতে হবে ।”
“,চিন্তার কারণ নেই,আমি আছি । ”
আরহাম আরো কিছু বলতে চাইল সেহেরকে দেখে থেমে গেল। তফির সেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,” তোর ভালোর জন্য শুধু আরহাম কেন, মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করতে পারি!
আমার ভালো থাকাটা তোর ভালো থাকায় সীমাবদ্ধ। ”
কাল আরহাম বের হবে।তাই আশনূহা জিদ ধরেছে বাবাইয়ের সাথে বাহিরে আইসক্রিম খেতে যাবে ।আরহামও মেয়ের কথা ফেলতে পারেনি । সন্ধ্যার পর পর সেহের আশনূহাকে নিয়ে বেরিয়েছে । শীতের সন্ধ্যা বরাবরই সেহেরের ভীষণ পছন্দ।হুটহাট আরহামের সাথে বেরিয়ে পড়া ,ঢাকার আবছা আলোছায়ার খেলা দেখা সেহেরের ভীষণ পছন্দ!
আজ কতবছর পর আবারো আরহামের সাথে বেরিয়েছে ।
আরহাম ড্রাইভ করছে সেহের পাশের সিটে আশনূহা মায়ের কোলে বসে প্রশ্নের জুড়ি খুলেছে । মাম্মাম এটা কি ,ওটা কি! সেহের উত্তর দিচ্ছে। আরহাম মা মেয়ের কথোপকথন শুনে মুচকি হাসছে।গাড়ি আইসক্রিম পার্লারের সামনে থামল।গাড়িতে হেলান দিয়ে সেহের আশনূহা একের পর এক আইসক্রিম খাচ্ছে ।একজন আরেকজনকে নাকে লেগে থাকা আইসক্রিম দেখে খিলখিল হাসছে। আরহাম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ।আনমনে ফিসফিস স্বরে বলে ,”মাই হ্যাপিনেস! ”
আরহামের ফোন বাজতে টনক নড়ল।সেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,”এখানে অপেক্ষা করো! আমি আসছি । ”
আরহাম কল রিসিভ করতে খানিক দূরে সরে গেল। আশনূহা পানি খাবে।সেহের পানি আনতে রাস্তার অপর পাড়ে যেতে নেয় এমন সময় দ্রুত এক গাড়ি এগিয়ে আসে। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটল যে কি রকম প্রতিক্রিয়া করবে সেহের ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। বিস্ময়ের চোখে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল।এমন সময় পেছন থেকে টান পরে । সেহের তাল সামাল দিতে না পেরে মাটিতে পরে খন্ড ইটে লাগায় হাত সামান্য কাটে ।সেহের হাত চেপে বসে আছে আরহাম দ্রুত সেহেরের কাছে আসে । রাগী স্বরে বলে, “কথা শুনলে কি বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেত? অপেক্ষা করতে বলেছিলাম!”
“আশনূহা পানি খাবে,পানি আনতে গিয়েছিলাম! ”
“আমি মরে গেছি? আমাকে বলা যায়নি । ”
“আপনি ফোনে কথা বলছিলেন ”
“তো? ”
“এভাবে বকছেন কেন? আপনার জন্য- ই তো ব্যথা পেলাম! ”
“আমার জন্য?”
“আপনি- ই তো ধাক্কা দিলেন,তাই তো ব্যথা পেলাম ”
আরহামের এ মুহূর্তে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে ।সে এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচাল আর তাকেই দোষারোপ করা হচ্ছে! রাগ দমিয়ে ছোট এক নিশ্বাস ফেলল।বলল ,” উঠো বাড়ি যাবো! ”
সেহের পা ধরে ব্যথা পাবার নাটক করে বলল,” পায়ে ব্যথা লেগেছে , কোলে তুলেন ”
আরহাম সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ,”লাগল হাতে ,ব্যথা পায়ে? ”
সেহের মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,” থাক লাগবেনা ,আমি একাই যেতে পারবো! ”
সেহের উঠতে নিলে আরহাম কোলে তুলে নিলো ।সেহের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটিয়ে মনে মনে নিজেকে সাবাস দিচ্ছে। আরহাম সেহেরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,” এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই! তুমি যে নাটক করছ আমি জানি। এসব বাচ্চামো ট্রিক্স আমার উপর কাজ করে না। ”
সেহের ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে।বুঝে গেল কি করে? ম্যাজিক ট্যাজিক জানে নাকি?
চলবে….❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।