বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৬১
আরহাম বেরিয়েছে সেই বিকালে। সন্ধ্যায় মালিহা খাঁন ছোট ছেলেকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে ।আনান আফনান হোস্টেলে। আশরাফ খাঁন জরুরি কাজে ঢাকার বাহিরে আছেন । বাড়ির কাজের লোকেরাও অদ্ভুত কোন কারণে সবাই ছুটিতে।সেহের আশনূহাকে একা ফেলে দিশার শাশুড়ির সাথে যাওয়া হয়নি।বাড়িতে- ই রয়ে গেছে। সারা সন্ধ্যা সেহেরের মন খারাপে কাটে। আরহামও খানিক বাদে বাদে অধৈর্য হয়ে ফোন করছে।অর্ধেক রাস্তা থেকে ফিরে আসতে চাইছে। সেহের বুঝিয়ে শুনিয়ে রাখছে।
গভীর রাত ঘড়ির কাটা বরাবর দুইটা।সেহের আশনূহা গভীর ঘুমে মগ্ন । এমন সময় মেইন গেট খুলে গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসে । শীত রাত হওয়ায় হালকা আওয়াজটাও বেশ ভারী ভাবে কানে লাগছে । সেহেরের ঘুম ভাঙে । ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বিছানা ছাড়ে এতো রাতে কে এসেছে? আরহাম নয় তো? সেহের ঢুলতে ঢুলতে বারান্দায় যায়। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে দূরে কয়েকটা গাড়ি দেখল । লাইট জ্বলতে থাকায় গাড়ি গুলো দেখতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি! আচমকা এক এক করে বাড়ির সবগুলো লাইট বন্ধ হয়ে গেল।সেহের বেশ চমকাল! জেনারেটর থাকার পরও লাইট কিভাবে নিভল? ঘরের আবছা আলো ছড়ানো ড্রিম লাইটটা বন্ধ।পুরো ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে গেছে। আশনূহা জেগে গেলে কান্নাকাটি করবে! সেহের অন্ধকারে আঁচ করে বিছানার দিকে পা বাড়ায়। বিছানায় ফোন খুঁজতে লাগে।ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে আশনূহার দিকে এগিয়ে যায়। আশনূহা গভীর ঘুম। যেই সেহের ঘুমাতে যাবে অমনি বাহির থেকে কারো চলাফেরা র আওয়াজ ভেসে আসে। সেহের সন্দিহান চোখে ভ্রু কুঁচকে নেয়।ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে যেই দরজা খুলে অমনি আঁধারে কেউ মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে । সাথে সাথে কপাল ফেটে সেহেরের রক্ত বেরিয়ে আসে। চোখ বুজে নিচে ঢুলে পরে ।
সেহেরের জ্ঞান ফিরে ঘন্টা খানেক পর। ঝাপসা ঝাপসা চোখ খুলে দেখে কারো পায়ের কাছে বসে আছে সে।পাশে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে আশনূহার মাথায় মাস্ক পরিধানকারী এক ব্যক্তি পিস্তল পয়েন্ট করে আছে। আশনূহা ভয়ে কাঁদছে। দিশা বেগমেরও একই হাল।বাম দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে এক ব্যক্তি পিস্তল ধরে আছে। হল ঘরটায় ছয় সাতজন তাদের ঘিরে আছে । তাদের সবার মুখ ঢাকা শরীরে কালো পোশাক । সেহের মাথা তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। বিস্মিত স্বরে বলল,” দাদাজান! আপনি? ”
আশরাফ খাঁন হিংস্র হেসে গম্ভীর স্বরে বলে,” স্বাগতম সেহের ”
সেহের থতমত খেয়ে যায়। আতংকিত স্বরে বলে,” এসব কি হচ্ছে! এরা কারা দাদাজান? ”
“এরা আমার লোক তোমাদের চিরনিদ্রায় পাঠাতে এসেছে ”
“এসব কি বলছেন? আমরা কি করেছি! কেন আমাদের এভাবে আটকে রেখেছেন! ”
সেহেরের কথায় আশরাফ খাঁন কিটকিটে হাসে। যেন ভীষণ রকম মজা পেয়েছেন তিনি। সেহেরের হাসি দেখে খুব ভয় হচ্ছে। নিজেকে গুটিসুটি মেরে গুছিয়ে নেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর আশরাফ খাঁনের হাসি থামে। চোখ মুখ গম্ভীর করে সোফা ছেড়ে সেহেরের দিকে এগিয়ে আসে। চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে রক্তিম চোখে তাকায়। সেহের ব্যথাতুর আতৎনাত করে উঠে। আশরাফ খাঁন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”সব নষ্টের মূল তো তোমরা এই তিন নারী- ই! ”
সেহের রুদ্ধস্বরে বলল,”আমরা কি করেছি? কেন আমাদের মারতে চান ”
আশরাফ খাঁন চুল ছাড়ল।আবারো সোফায় গা এলিয়ে আরাম করে বসে। শান্ত স্বরে বলে,” শুনতে চাও? তো শুনো । মৃত্যুর আগে তোমার এই আশাও পূর্ন হোক। এই জীবন এতো সহজে আমার মিলেনি। এর পেছনে অক্লান্ত কঠিন পরিশ্রম করেছি।এতো দূর আসতে সর্ব প্রথম নিজের ভালোবাসার গলা টিপে হত্যা করি। ক্ষমতার জন্য মালিহাকে বিয়ে করি। অমিদ মালিহা আমার প্রথম সন্তান ছিল অনেক স্বপ্ন ছিল তাকেঘিরে। ইচ্ছে ছিল দেশে ফিরে আমার সাথে রাজনীতিতে যোগ দিবে। কিন্তু আমার ইচ্ছে অপূর্ণ রয়ে গেল।অমিদ কানাডায় প্যামকে ভালোবেসে আমাদের ছাড়ল । অমিদের জন্য আমার ক্যারিয়ার প্রায় শেষের পথে ছিল । তাই পথের কাঁটা সরাতে দিপককে দিয়ে প্যাম আরহামকে খুন করতে পাঠাই। সব প্লান মোতাবেক হলেও আরহাম বেঁচে যায়। আরহামের যায়গায় অমিদ মারা যায়। অবশ্য আরহাম বেঁচে যাওয়ায় আমার লাভ হয়েছে।কয়েক বছর পর আরহাম দেশে ফিরে আরহামকে পুরোপুরি নিজের অধীনে করে ফেলি। আরহাম মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছে তা আমি আগের থেকে জানতাম।ইচ্ছে করে- ই কখনো ট্রিটমেন্ট করাই নি। কারণ আরহাম আমার হাতের পুতুল ছিল। ধারাল হাতিয়ার। যাকে আমি যেভাবে ইচ্ছে সে ভাবে ব্যবহার করতে পারতাম।দিপক আমারই অবৈধ সন্তান ছিল। প্যাম অমিদের সাথে কানাডায় এক সাথে পড়াশোনা করেছে। প্যামকে ভীষণ ভালোবাসতো । অমিদের সাথে বিয়ের পর ভালোবাসা ঘৃণায় পরিনত হলো। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দিপকের হাতে প্যামের খুন করাই। কিন্তু দিপক বরাবরই আমাকে হুমকির উপর রাখতো বলতো যদি আমি তাকে তার অধিকার আমার সন্তান বলে না পরিচয় নেই তাহলে সে সব সত্যি সবাইকে জানিয়ে দিবে। দিন দিন আমার গলার কাটা হয়ে গিয়েছিল।এক পার্টিতে আরহাম দিপক মুখোমুখি হয়।আরহাম দিপককে দেখেই চিনতে পারে দিপকই তার বাবা মায়ের খুনি।তাই খুন করে ।আমি সবজেনে মনে মনে খুশি হলেও আরহামের সামনে তা প্রকাশ করি না। আরহামের খুনকে খুব সুন্দর ভাবে ধামাচাপা দিয়ে দেই। এতে আরহামের আনুগত্য আমার প্রতি বেড়ে যায়। আরহামের ভিতরের সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে তাকে পুরানো ছাইরঙা বাড়িতে বন্দি রাখি । সব কিছু ঠিক- ই চলছিল। এর মাঝেই কিন্তু হয়ে তুমি আসলে। আরহামের তোমার প্রতি তীব্রভাবে আসক্তি আমার প্রতি আনুগত্য হারাল। তোমার জন্য করা খুন গুলো হ্যান্ডেল করতে গিয়ে আমি বিপদে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম । এক সময় আরহাম তার দুনিয়া তোমাকে মানতে শুরু করে যা আমার বিন্দু মাত্র সহ্য নয় । আমার হাতের পুতুল ধীরেধীরে হাত ছাড়া হচ্ছিল।সে শুধু তোমার ট্রিটমেন্ট করতে কানাডা যেতে চাচ্ছিল । তাই আমিও আরহামকে আটকালাম না। আরহাম কানাডা যেতেই তোমার উপর হামলা করলাম। কিন্তু ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেলে। তারপর দ্বিতীয় হামলা চিটাগাং গেস্ট হাউসে করলাম সে বারও বেঁচে গেলে। কিন্তু এতে আমার- ই ভালো হয়েছে তোমার আরহামের ভেতর দূরত্ব বাড়ল । সেদিন অগ্নিকাণ্ডের দিন আমি সেখানে- ই ছিলাম । তোমাকে পালিয়ে যেতে দেখেছি আটকাইনি। ভেবেছিলাম আর ফিরবে না কিন্তু সেই ফিরে আসলে। সেদন তোমাকে মেরে ফেলা উচিত ছিল। তাহলে এদিন দেখতে হতো না।
আর দিশাকে কেন মারতে চাই শুনবে? দিশা সব নষ্টের মূল। ও প্রথম আমার ছোট ছেলের মাথা বিগড়েছে । তারপর তোমাকে এখানে এনে সবচেয়ে বড় ভুল করেছে। তোমার আর আরহামের সম্পর্ক গড়ে উঠার পেছনে দিশার পুরোপুরি হাত আছে । তা আমি জানি। দিশাকে অনেক আগেই প্যামের মত মেরে ফেলতাম। কিন্তু শুধু মাত্র ক্ষমতার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছি।এখন দিশা কোন পদে নেই ওকে বাঁচিয়ে রেখে কোন লাভ নেই । ওর শাস্তি ওকে পেতে হবে। ”
সেহের সব শুনে থম মেরে আছে।বিস্ময় কোন ভাবে- ই কাটছে না। কেউ এতোটা জঘণ্য কি করে হয়? ক্ষমতার লোভে নিজের সন্তানকেও খুন করতে হাত কাঁপেনি তার?
পাশ থেকে দিশা কান্ন জড়িত স্বরে বলে ,” সব নষ্টের মূল আমি । আমাকে শাস্তি দিন । সেহের আশনূহাকে ছেড়ে দিন। ওরা এই শহর ছেড়ে দেশ ছেড়ে অনেক দূর চলে যাবে। ”
আশরাফ খাঁন আবারো শব্দ করে বিচ্ছিরি ভাবে হেসে মুলহ শক্ত করে বলে ,” এতোটা বোকা আমি নই দিশা!এমন কাঁচা কাজ আমি করব না। কোন প্রমাণ রাখবো না । সবাই মরবে! ”
সেহের চোখ মুখ শক্ত করে বলে,”আমার দোষ আমাকে শাস্তি দিন আমার নিষ্পাপ বাচ্চার কি দোষ? ওকে ছেড়ে দিন! ”
“ওহ সেহের! তুমি বড্ড বোকা । আশনূহা ছেলে হলে না হয় ছেড়ে দিতাম কিন্তু ও মেয়ে। আমার কি কাজের? তাছাড়া ও আরহামের পিছুটান আরহামের প্রতিচ্ছবি । ওকে বাঁচিয়ে রাখা আমার জন্য বিপদ । তুমি কি মনে করো আরহাম বোকা? ও কখনো জানতে পারবেনা এসব আমি করেছি! ও আমার প্রতিচ্ছবি আমার প্রতিকাজ সে খুব সুক্ষ্ম সে ধরে ফেলে। সে আমার নিজ হাতে গড়ে তোলা ।সবচেয়ে ভয়ংকর সে। ঐ যে কথায় আছে না লোহা লোহাকে কাটে আমাকে শেষ করতে কেবল আরহাম পারবে। তফিরের সাথে মিলে অলরেডি তদন্ত শুরু করে দিয়েছে সে আজ নয় কাল ঠিক আমাকে ধরে ফেলবে । আমি চাই সে সব হারিয়ে পুরোপুরি নিস্ব হোক। ওর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওকে হারাবো। তোমাদের হারিয়ে সে প্রাণ হীন কাঠেরপুতুল হয়ে থাকবে!
সবার আগে আশনূহাকে মারবো । তোমার ছটফটানি দেখতে হবে তাই না? নিজ চোখে তোমাদের মৃত্যু দেখবো । ”
সেহের যন্ত্রণায় কেঁদে উঠে।ছুটে যেয়ে আশরাফ খানের পা চেপে ধরে।কান্না করতে করতে বলে,” আমার আশনূহাকে ছেড়ে দিন । আমার প্রাণ নিন আমার মেয়েকে ছাড়েন ।”
কান্না ভরা আকুতি করছে। আশরাফ খাঁন সেহেরের আকুতি দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। জোরে জোরে হাসছে। আশরাফ খাঁন সামান্য অন্যমনস্ক হতেই সেহের টেবিলের উপর রাখা কাঁচের ফুলদানি ভেঙে হাতে তুলে নেয়।আশরাফ খানের গলায় চেপে ধরে।রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলে,”আশনূহা আর মাকে যেতে দিন ”
আশরাফ খাঁন হেসে বলে “এই নরম হাতে খুনে রঞ্জিত হওয়ার জন্য নয়। তোমার দ্বারা হত্যা হবে নাহ! ”
সেহের ফুলদানির ভাঙা টুকরো আরো শক্ত ভাবে গলায় চেপে ধরে । আশরাফ খানের গলায় সামান্য কেটেছে । সেহের দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” মা সন্তানের জন্য সব পারে । সব! খুনও ।
মা আর আশনূহাকে যেতে দিন ”
আশরাখ খাঁন চোখে ইশারা করে ছাড়তে। দিশা আশনূহাকে কোলে তুলে নেয়। সেহের বলে,”মা এখনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও। ”
দিশা কান্না করতে করতে বলে ,”তোকে এখানে রেখে আমি যাবো না ”
“মা জেদ ধরোনা ,আমার কিছু হলে হোক । আশনূহা মাঝে আমি থাকবো। তুমি আশনূহাকে নিয়ে এখান অনেক দূরে চলে যাও ।তোমাকে আমার কসম ,যাও! ”
দিশা বাধ্য হয়ে আশনূহাকে নিয়ে সদর দরজার দিকে আগায়। সেহের মেয়েকে শেষবারের মত দেখছে। চোখ জলে ভরে আসছে। দিশা যেই সদর দরজা পাড় হবে অমনি আশরাফ খাঁন তার লোকেদের ইশারা করে । পেছন থেকে গুলি চালাতে। গুলি যেয়ে দিশার পিঠে লাগে। দিশা একবারে জন্য থামে না। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। সেহের তখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ।কিছু বুঝে উঠার আগেই আশরাফ খান সেহেরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। হাতের কাঁচের টুকরা নিচে পরে । আশরাফ খাঁন সেই কাচের টুকরা তুলে সেহের গলায় আঘাত করে । রক্ত দিয়ে গলা ভিজে যায়।চোখ ঘোলা হয়ে আসে ,শ্বাস থেমে থেমে আসছে। বাহিরে পুলিশের গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। আশরাফ খাঁন সহ বাকিরা সবাই দৌঁড়াদৌড়ি করে পালাচ্ছে। সেহের আস্তে আস্তে চোখ বুজে নেয়। ফিসফিস স্বরে বলে,” ভালোবাসি আরহাম ,অন্তিম বিদায় !”
চলবে ….❣️
প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন । ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন😊😊😊।