বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ১৬

0
4868

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ১৬
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

থমথম করছে ঘর।শো শো আওয়াজ এর প্রতিধ্বনি হচ্ছে উত্তরের হাওয়ার।নুরাইসার ঘন নিঃশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসছে তারই কানে।থেমে থেমে ফুপিয়ে যাচ্ছে সে।
আজরাহান এর দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ধীর ধীরে অক্ষিপল্লব মেলে তাকায় নুরাইসা।কান্নার ফলে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।নুরাইসা দেখলো সামনে আজরাহান পা ভাজ করে চিবুক এ হাত দিয়ে ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।ওকে দেখেই আজরাহান স্মিত হাসে।নরম কন্ঠে বলল–

“ভয় পেয়েছেন মারমেইড!!
ভয় পাবেন না।আমি এতোটাও খারাপ ছেলে নই।আসলে কী হয়েছিলো বলেন তো সেদিন আপনি যা করেছেন আমি বেমালুম ভুলে যেতাম।কিন্তু পারিনি কেনো জানেন!!
আপনার জন্য সেদিন প্রথমবার আমার মা আমার গায়ে হাত তুলেছে।আমি আমার মায়ের প্রিয় সন্তান নই কিন্তু আমি তার অযোগ্য সন্তানও নই।”

আজরাহান কিছুক্ষন থামে।একাধারে হেচকি তুলে যাচ্ছে নুরাইসা।আজরাহান আবার বলল–

“সেদিন শুধুমাত্র আপনার সাথে কথা বলার জন্য আমি আপনার ঘরে গিয়েছিলাম।আপনি শাওয়ার নিচ্ছিলেন।আপনি টাওয়েল চেয়েছেন বলেই আমি সেটা আপনাকে দিতে গিয়েছিলা।বাট এলাস!!পা পিছলে আপনিই আমার হাত টেনে ভিতরে নিয়ে গিয়েছেন যেখানে আমার কোনো দোষ ছিলো না।তারপরও সবার সামনে আপনি আমাকে ব্লেইম করলেন।ভাগ্য ভালো ছিলো নাবীন স্যার আমাকে বিশ্বাস করতো।তা না হলে সেদিন কী হতো বলেন তো!!!

নুরাইসা টপাটপ আরো কয়েক ফোটা চোখের জল বিসর্জন দিলো।

আজরাহান বুক ফুলিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিলো আবার বলল–

“একটা সাদা কাগজে যদি কখনো এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পরে তাহলে তার ছাপ কোনোদিনও যায় না।যতক্ষন না পর্যন্ত তাকে পুড়িয়ে ভষ্ম করা হয়। মানুষের সম্মান ও ঠিক তেমন।একবার তাতে দাগ লেগে গেলে পৃথিবীর কোন পরিষ্কারক তা মুছে ফেলতে পারে না।
আমার মা সারাজীবন নারীদের সম্মান করতে শিখিয়েছে।হয়তো আমি একটু বেপরোয়া।কিন্তু তারমানে এই নয় আমি নিচ।”

আজরাহান ফোস করে এক দম ছাড়ল।বিরস কন্ঠে বলল–

“যান।আজকের পর আপনার আর আমার সব হিসেব বরাবর।আজকের পর আমার আর আপনার মাঝে আর কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু মনে রাখবেন কাউকে দোষ দেওয়ার আগে অন্তত একবার মানুষটার জায়গায় নিজেকে রেখে ভাববেন।
যান আপনি।”

নুরাইসা শুনতে পায় ডোর লক এ খচখচ আওয়াজ হচ্ছে।কেউ বাইরে থেকে লক খুলে দিয়েছে।আর একমিনিটও দেরি না করে নুরাইসা উঠে দরজা খুলে চলে যায়।আজরাহান ক্ষণকাল সেখানেই বসে থাকে।শার্ট থেকে বিশ্রি গন্ধ আসছে।গা গুলিয়ে উঠে আজরাহান এর।
হল এ আসার সময় এক্সট্রা শার্ট নিয়ে আসে।পাঞ্জাবী খুলে সেটাই পড়ে নেয়।গায়ে কয়েকফোটা অ্যালকোহল ছিটিয়ে কিছু অংশ মুখেও মেখে নেয়।আর অভিনয় এ আজরাহান ছোট বেলা থেকেই মাহির।

মোবাইলে কিছু একটা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে আশফিক।আজরাহান এসেই ওর ঘাড়ে হাত রেখে দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল—

“কেমন দিলাম বল!!

“তুই পারিসও আজরাহান।মারমেইড তো একবারে ভয়ে শেষ।”

দুই ভাই গা দুলিয়ে হেসে উঠে।
আজরাহান ওর শার্টের বোতাম এ হিডেন ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিলো যা বাইরে থেকে পর্যবেক্ষন করছিলো আশফিক।
হাসি বন্ধ করে আশফিক বলল—

“এইসব তো হলো কিন্তু তোর ডিঙি নৌকা কে দেখতে পাচ্ছি না কোথাও!!
কোন সায়রে ভাসতে গিয়েছে সে??

আজরাহান ভ্রু কুচকে কঠিন কন্ঠে বলল—

“একদম বাজে কথা বলবি না।নিজের চিন্তা কর।শিরনির দিকে নজর রাখ।আজকাল যা শুরু করেছে আবার না তোকে ছেড়ে তোর পাখি অন্য গাছে বাসা বাধেঁ।”

আশফিক এর হৃদয় গহীনে দমাদম ঢোল বাঝতে থাকে।পুরোপুরি সত্য না হলেও আজরাহান এর বলা কথা পুরোটা মিথ্যেও নয়।ইনশিরাহ আজকালকার ব্যবহার তাকে যতটা অবাক করে তারচেয়ে বেশি তার চিত্ত কাঁপিয়ে তোলে।সে তাকে ভালোবাসে।খুব বেশিই ভালোবাসে।তাই কখনো সে তাকে জোড় করতে চায়নি।চেয়েছে সে নিজে এসে তার ভালোবাসা নীড়ে সমাহিত হোক।কিন্তু তা আর হবে না বলে মনে হচ্ছে।ইনশিরাহ আর মারশিয়াদ এর বাড়ন্ত নৈকট্য আশফিক এর স্নায়ুকে ধীরে ধীরে দূর্বল করে ফেলছে।
দিনে শত কাজে ব্যস্ত থাকার পর রাতের নিস্তব্ধতা কাটানোর জন্য হলেও একটা নিজের মানুষ সবার প্রয়োজন।আশফিকও তাই চেয়েছিলো।কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতা এখন শুধু তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।উপহাস করে বলে,,”
“রাতের মায়া,কালো ছায়া
আঁধারের ডুবোডুবি
অন্ধকার মাড়িয়ে আলো
দেখবে কী সূর্যের খনি??

—তানভি

,
,
,
দোতালার করিডোর এর একপাশে বিশাল থাই গ্লাসের জানাল।ফুরফুরে বাতাস।সেখানেই একটা বেঞ্চিতে বসে আছে ইনশিরাহ আর প্রহর।ইনশিরাহ বলল —

“একটা প্রশ্ন করি তোমাকে??

“হুহ।”

“জান কে তোমার কেমন লাগে???

“জান ভাইয়া তো খুব ভালো।”

“শুধু ভালো।আর কিছু না!!

প্রহর ভাবুক দৃষ্টিতে তাকায় ইনশিরাহ এর দিকে।প্রহর ফিক করে হেসে বলল–

“অনেক বেশিই ভালো।জান ভাইয়া কে যে মেয়ে বিয়ে করবে সে তো লাকি।”

ইনশিরাহ এর মুখ ফসকে তড়িত গতিতে বেরিয়ে আসে–

“তাহলে তুমি তাকে বিয়ে করো।”

ইনশিরাহ এর কথায় চুপসে যায় প্রহর এর মুখ।চোখের কোন ক্ষীন করে অসাড় হয়ে তাকিয়ে থাকে।ইনশিরাহ উদ্বিগ্ন হয়ে আবার বলল–

“কথা বলছো না কেনো প্রহর!!
বিয়ে করবে জান কে??

প্রহর নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে থাকে।একসময় হয়তো সে এমনটা চেয়েছিলো কিন্তু আজ তা নয়।প্রহর এই বাড়িতে আসার পর টানা ছয় মাস যাতায়াত ছিলো মারশিয়াদ এর এই বাড়িতে।মিশে ছিলো প্রহর এর সাথে।ওর সব ভাবনা জুড়ে তখন ছিলো মারশিয়াদ।মারশিয়াদ প্রহর কে তার বিক্ষিপ্ত অতীত ভুলিয়ে বর্তমান নিয়ে বাচার আশা যুগিয়েছে।
অতীত ভুলে যাওয়া সহজ নয়।আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অতীত।কারো অতীত সুখকর হয় কারো দুঃখদায়ক।অতীত কে পিছনে ফেলেই সামনে এগিয়ে যেতে হয়।তবে একা সম্ভব হয় না।কেউ একজন পাশে থাকা চাই।যে হাতে হাত রেখে পায়ে পা মিলিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে নিবে।মারশিয়াদ সেই একজন হয়ে এসেছিলো প্রহর এর জীবনে।প্রহর এর কিশোর মনে এক ভালোলাগা তৈরি হয়েছিলো।কিন্তু তা ভালোবাসায় রূপ নেওয়ার আগেই মারশিয়াদ কোনো একটা কাজে আমেরিকা চলে যায়।প্রহর আবার একা হয়ে যায়।তার অতীত তাকে আবার ঝাপটে ধরে।আর তখন তার একমাত্র সাথী হয়ে আসে আজরাহান।আজরাহান এর ভালোলাগাই ওর মনে ভালোবাসার অঙ্কুরোদ্গম করে।নিশ্চলভাবে আজরাহান তার জায়গা করে নেয় প্রহর এর হৃদয়ে।যা আজ শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে তার মনে।কিন্তু দুজনই জায়গাই তার মনে স্বতন্ত্র।সে দুজনকে কখনো কারো সাথে তুলনা করতে পারে।আজরাহান এর ভালোবাসায় সে সবসময় হার মানে।তার কিশোর মনে আজরাহান এর করা পাগলামো এক অদ্ভুত ভালোলাগার আরেক নাম।

“শিরনি!!

আজরাহান এর কঠিন কন্ঠে সম্বিত ফিরে পায় প্রহর।ওকে দেখেই দুজন দাড়িয়ে পড়ে।আজরাহান আবারও জ্বলন্ত কন্ঠে বলল–

“সমস্যা কী তোমার!!

ইনশিরাহ ও তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল–

“এখানে কেনো এসেছো তুমি???
মেয়েদের মধ্যে ঠুসাঠুসি না করলে তোমার ভালো লাগে না!!!

“একদম চুপ।একটা কথাও বলবে না।আর এতো কাহিনী কিসের তোমার!!!আজ যদি ভাইয়ার বিয়ে না হতো তাহলে তোমাকে আমি,,

“কী করতে তুমি??

“ধাক্কা মেরে বের করে দিতাম।”

“মাই ফুট।কে আসতে চেয়েছে তোমার ভাইয়ের বিয়েতে।শুধুমাত্র মারশিয়াদ বলেছে বলে এসেছি।”

“তাহলে গিয়ে ওর গলায় জুলে পড়ো না। ওর চ্যালামি করছো কেনো???

“ইউ রাস্কেল!!

“শিরা!!

মারশিয়াদ এসেই খপ করে ইনশিরাহ হাত টেনে নিয়ে যায়।আজরাহান ভ্রু কুচকে তাকায় প্রহর এর দিকে।উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রহর।আজরাহান দাঁত দাঁত নিষ্পেষণ করে বলল—

“কী করছিলি এখানে??আর ওই ফালতু মেয়ের কাছে কেনো এসেছিলি??

“আপনি কেনো এসেছেন!!
আর অসভ্যের মতো কথা বলেন কেনো মেয়েদের সাথে!!

আজরাহান ওকে টান দিয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে নেয়।

“এতো প্যাঁচ প্যাচ করিস কেনো রে??

“ছাড়েন আমাকে।”

“ছাড়বো না।
বউ আমার রাগ করেছে।”

“ইশশ
কে আপনার বউ??

“কেনো তুই।আমার বাচ্ছা বউ।”

বলেই টুপ করে এক চুমু খেয়ে নেয় প্রহর এর ঠোঁটে।প্রহর কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলল–

“আপনি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন।কোথায় কী করতে হয় কিছু খেয়াল রাখেন না।ছাড়েন আমাকে।”

“এই তোর ঠোঁট এতো মিষ্টি কেনো রে!!
মধু মাখিয়েছিস!!

“আজরাহান!!!

কুহেলিকার শীতল আওয়াজ এ হীম হয়ে উঠে আজরাহান এর শরীর।প্রহর কে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ায়।কুহেলিকা কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল–

“কী করছো এখানে তুমি??

আজরাহান থতমত খেয়ে যায়।আমতা আমতা করে বলল—

“কিইকিছু না।”

কুহেলিকা স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন–

“তোমার ভাইয়ের আজ বিয়ে।কোথায় তাকে সময় দিবে তা না করে বাউন্ডলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছো কেনো??

“সরি মা।যাচ্ছি।”

“আর প্রহর তুই নন্দিতার কাছে যা।মেয়েটা অনেকক্ষন ধরে একা বসে আছে।”

“আচ্ছা ছোট মা।”

,
,
“কী শুরু করলে এইসব তুমি??

“যা করেছি বেশ করেছি।ওই ছেলে কখনই প্রহর কে ডিজার্ব করে না।”

“কে কাকে ডিজার্ব করলো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।এই নিয়ে আর কোনো কথা হবে না।”

“কেনো হবে না।কেনো তুমি তাকে যেতে দিলে!

“তোমাকে আমি কী করে বুঝায় শিরা।আই ডোন্ট লাভ হার।”

“অস্বীকার করতে পারবে,প্রহর ই সেই মেয়ে নয় যাকে জীবনে তোমার প্রথম ভালো লেগেছে???

মারশিয়াদ সুপ্ত কন্ঠে বলল–

“করছি না।কিন্তু তুমি যেমনটা ভাবছো তা নয়।তার প্রয়োজন নেই আমার। আমার তোমাকে প্রয়োজন।আমি চাই আমার পুরো পরিবার আমার সাথে থাকুক।”

“প্রহর কী তোমার পরিবার এর কেউ নয়??

“নাহ।”

“আই ডোন্ট বিলিভ দিস।”

কথা শেষ করেই হনহন করে পা বাড়ায় ইনশিরাহ।মারশিয়াদ ওকে বার কয়েক ডাকলেও ওর কর্ণকুহর হয় না।

দরজা খুরে ভিতরে আসতেই নন্দিতাকে দেখে মিষ্টি হাসে প্রহর।হাসি হাসি কন্ঠে বলল–

“বাহ!!
ভাবি তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে।বড় ভাইয়া তো আজ তোমাকে দেখেই শেষ।”

“হয়েছে।আর পাকা পাকা কথা বলতে হবে না।কোথায় ছিলে তুমি??

“তুমি আমাকে তুমি করে কেনো বলছো!!নুরাইসা আপুকে যেমন বলো তেমন বলবে।”

“ওকে লিটল প্রিন্সেস।”

নুরাইসা আসে এক আকাশ ঘন মেঘ নিয়ে।চোখ দুটো কেমন লালচে।মুখটাও রঙ হীন।প্রহর ওর হাত ধরে জিঙ্গাসু কন্ঠে বলল–

“কী হয়েছে নুরাইসা আপু!!!

“কিছু না।তুই যা।”

সানায়া হালকা হেসে ওকে শুনিয়ে বলল–

“আরে বুঝলিনা
ওর বোনের এতো হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বেচারী এখনও একটা বয়ফ্রেন্ড জুটাতে পারলো না।”

সানায়া নিজের হাত টা কপালে উল্টো করে ধরে ব্যাঙ্গাত্নক ভাবে বলল–

“হায় মেরি ফুটি কিসমাত।”

নুরাইসা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো।আজরাহান এর সাথে হওয়া ঘটনার রেশ সে এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি।মোবাইলের মেসেজ টিউন বাজতেই হুড়হুড়িয়ে বের হয় নুরাইসা।
,
,
ছাদের বাউন্ডারি দেয়ালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে মারশিয়াদ।নুরাইসা এসেই ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।মারশিয়াদ ওর হাত সরিয়ে ঘুরে দাড়ায়।ভেজা চোখ মুখ দেখে বলল–

“মন খারাপ মিষ্টি??

নুরাইসা ফুপিয়ে উঠে।আর্দ্র কন্ঠে বলল–

“জানেন আজরাহান কি করেছে!!

“উহু।আমি জানতে চাই না।”

“জানেন ওই লোকটা কতো অসভ্য!!আমার সাথে,,

“শিসসসসসস!!
চুপ।আমি শুনতে চাই না সে সব।ভুলে যান যা হয়েছে।দোষ আপনারও ছিলো।
কিন্তু এখন এইসব মনে করে লাভ নেই।তাই ভুলে যাওয়ায় শ্রেয়।”

নুরাইসা মারশিয়াদ এর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।আধো আধো কন্ঠে বলল–

“আপনি খুব ভালো।একদম আমার বাবার মতো।”

মারশিয়াদ হালকা শব্দ করে হেসে বলল–

“আমাকে বুড়ো বানিয়ে দিলেন!!!

“সরেন।আপনি কেনো বুড়ো হতে যাবেন।”

সরেন শব্দটা শুনতেই মারশিয়াদ মুচকি হাসে।আর বলল—

“একটা কথা বলবো??

“বলেন।”

“আজকের পর আর কখনো আপনি আজরাহান এর আশেপাশে যাবেন না।”

নুরাইসা মারশিয়াদ এর বুক থেকে হালকা মাথা উঠিয়ে বলল–

“কেনো??

মারশিয়াদ থমথমে গলায় বলল–

“আমি বলেছি তাই।কেনো,,
আমাকে আপনার পছন্দ নয়??

নুরাইসা এক গাল হেসে আবার মারশিয়াদ এর বুকে আছড়ে পড়ে।শান্ত কন্ঠে বলল–

“ইউ আর দ্যা বেস্ট।”

মারশিয়াদ আলতো করে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নুরাইসা কে।এক অদ্ভুত শিরশির অনুভুতি হচ্ছে তার।মনে মনে বলল–“আপনি আমার শূন্যতার ঘরে পূর্নতা হয়ে এসেছেন।জানি না আপনাকে আপনার মতো করে ভালো বাসতে পারবো কি না!!
কিন্তু কথা দিচ্ছি আপনাকে আমি আমার হৃদয়ের রাণী করে রাখবো”
,
,
,
বিয়ে পড়ানো শেষ।বিকেলের সূর্য তার উজ্জ্বল রশ্মির পাট চুকিয়েছে।কমলা আভায় সজ্জিত নীলাম্বরী।দূরের আত্নীয় রা অলরেডী যেতে শুরু করেছে যেহেতু বৌ ভাত দু দিন পর।
নিরণ ক্র কোলে নিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়েছে প্রহর।ঘুমিয়ে গিয়েছে নিরণ।ওকে নির্ধার কাছে দিয়ে আসে।মাথার খোপার সাথে ওড়না আটকে যায় প্রহর এর।দু হাত দিয়ে ছাড়ানো চেষ্টা করছে।সামনে মারশিয়াদ কে দাড়ানো দেখে প্রহর ওর কাছে গিয়ে দাড়ায় আর বলল —

“জান ভাইয়া একটু আমার চুলটা খুলে দিন না।”

মারশিয়াদ হালকা হেসে ওর খোপায় হাত দেয়।খোপায় লাগানো ক্লিপ এর সাথে ওড়নার সুতো পেচিয়ে যায়।সেটাই খুলে দেয়।
দুর থেকেই দেখে আক্রোশে ফেটে পরে আজরাহান।ত্রস্ত পায়ে এসে প্রহর এর হাত ধরে ওকে নিয়ে যায়।নিচ
তলায় কর্নারে খালি জায়গা।সেখানে নিয়ে প্রহর কে চেপে ধরে দেয়ালের সাথে।ক্রোশানলে জ্বলন্ত আজরাহান বজ্র কন্ঠে বলল—

“কী সমস্যা তোর!
এতো বার বলি কানে কথা যায় না!!কেনো যাস বারবার ওর কাছে??

প্রহর সিক্ত কন্ঠে বলল—

“রাহান ভাইয়া,,
কী পাগলামো করছেন।ছাড়েন আমাকে।”

আজরাহান এর অগ্নি চোখ দেখে শুকনো ঢোক গিলে প্রহর।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।দম দম করতে থাকে ওর হৃৎপিন্ড।ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে থাকে ।আজরাহান আবারো তেতে উঠে বলল—

“তোকে অন্য কারো সাথে দেখলে আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে।আমি পারি না নিজেকে কন্ট্রোল করতে।তাহলে কেনো যাস তুই বারবার!!

আজরাহার গলার স্বর আরোও বাড়িয়ে দেয়।প্রহর বিবশ হয়ে যায়।না কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না একটু নড়ার।আজরাহান তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরেছে প্রহর কে।দাঁতে দাঁত চেপে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।কর্কশ কন্ঠে বলল–

“কেনো যাস তুই মারশিয়াদ এর কাছে!!!তোর সর্বাঙ্গে শুধু আমার অধিকার।সেখানে অন্য কারো অস্তিত্ব আমি কখনো হতে দিবো না।”

প্রহর অস্ফুট ভাবে কিছু বলতে গেলেই আজরাহান প্রহর এর নিচের ঠোঁটে এক সজোড়ে কামড় বসিয়ে দেয়।কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া করার সময় প্রহর পায় নি।ঠোঁট কেটে বেরিয়ে আসে রক্ত।কোনো রকম আওয়াজ নয়।আজরাহান এর হিংস্রতায় ওর দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে নদীর উপচে পড়া ঢেউ এর জল।আজরাহান হিসহিসিয়ে বলল—

“কষ্ট হচ্ছে !!
আমারও হয়।তোকে যখন মারশিয়াদ এর সাথে দেখি তখন আমার এই বুকটা শূন্য হয়ে যায়।আমাকে ছাড়া অন্য কারো কথা যদি স্বপ্নেও ভাবিস আমি তোকে ছাড়বো না।মেরে ফেলবো তোকে।ঠিক যতটা কষ্ট দিয়ে তোকে শেষ করবো তার চেয়ে দশগুন কষ্ট দিয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলবো।তুই আমার আমারই থাকবি।এই জীবনে আর আগামী সাত জনমেও।আমি ছাড়া তুই অন্য কারো হতে পারবি না।”

আজরাহান ওকে ছেড়ে যেতেই প্রহর নিচে বসে পরে।ডুকরে কেঁদে উঠে প্রহর।ঠোঁটে তার প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।
এক শান্ত,স্নিগ্ধ পুরুষালী কন্ঠ বলল–

“ঠোঁট টা মুছে নিন রেড চিলি।”

মারশিয়াদ একটা রুমাল এগিয়ে দেয় প্রহর এর দিকে।অশ্রুসজল চোখে মাথা তুলে তাকায় প্রহর।কম্পনরত হাতে মারশিয়াদ এর হাত থেকে রুমাল নেয় প্রহর।মারশিয়াদ ওর পাশেই বসে।সামনের দেয়ালে অক্ষি স্থাপন করে বলল–

“পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ ভালোবাসে।এক.
কেউ ভালোবেসে মরতে পারে।দুই.কেউ ভালোবেসে মারতে পারে।আপনার রাহান ভাইয়া কোন ক্যাটাগরির বলেন তো??

প্রহর আর্দ্র চোখে উৎসুক হয়ে তাকায় মারশিয়াদ এর দিকে।মারশিয়াদ বলল–

“আপনার রাহান ভাইয়া ভালোবেসে মরতে জানে।”

প্রহর জড়ানো কন্ঠে বলল–

“রাহান ভাইয়া আমাকেও মেরে ফেলবে।”

“নাহ।আপনার রাহান ভাইয়া কখনো আপনাকে মারতে পারবে না।ভালোবাসার মানুষ কে কেউ মারতে পারে না।এই যে আপনাকে কষ্ট দিলো কেনো জানেন??
কারণ এর চেয়ে বেশি কষ্টে আছে সে।আপনাকে শুধু উপলব্ধি করাতে চেয়েছে তার হৃদয়ে জ্বলা আগুন কতোটা তাকে দগ্ধ করছে।”

প্রহর চোখ নামিয়ে নির্বিকার হয়ে বসে থাকে।মারশিয়াদ হালকা নিচু হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল–

“খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন???

“আপনাকে দিয়ে দেখাবো!!

মারশিয়াদ ওর ব্লেজার এর হাতা টা কিঞ্চিৎ উপরের দিকে টেনে বলল–

“দিন তাহলে।তাতে যদি আপনার ব্যথা একটু কমে।”
,
,
আশফিক এর পাশে বসেই ফোস ফোস করছে আজরাহান।রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।আশফিক বলল–

“কী পাগলামো শুরু করেছিস এইসব??

“জানি না আমি।ওকে আমি এতো সহজে ছাড়বো না।”

“তাই বলে,,,

“ভালোবাসা জোর করে পাওয়া যায় না কিন্ডার গার্টেন।”

মারশিয়াদ এর কথায় ফুসলে উঠে আজরাহান।ওর পাশেই গেড়ে বসে মারশিয়াদ।
আজরাহান বিরক্তি ও রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলল–

“তুই এখানে কেনো এসেছিস!!যা এখান থেকে।”

“এতো রাগ ভালো নয়।কুল ম্যান।”

মারশিয়াদ এর হাতের দিকে নজর যায় আশফিক এর।বলল–

“তোর হাতে কী হয়েছে??

মারশিয়াদ হাতা টা টেনে স্বাভাবিক ভাবে বলল–

“কিছু না।”

আশফিক সন্দিহান কন্ঠে বলল–

“মনে হলো কামড়ের দাগ!!!

“কীসের কামড়ের কথা চলছে??

শিহরণ এর করা প্রশ্নে মৃদু হাসে মারশিয়াদ।হাসি হাসি কন্ঠে বলল–

“কামড়ের প্র্যাক্টিস চলছে।বিয়ের পর কাজে লাগবে রে ভাই।”

“বিয়ের আগেই কামড়া কামড়ি শুরু করলি!!তোদের কাছে তো কোনো বাবা মেয়েও দিবে না।”

মারশিয়াদ খলখলিয়ে হেসে বলল–

“আরে দেওয়ার কী দরকার!!!সব ঠিক করা আছে।”

হাস্যোজ্জ্বল মুখে সেখানে এসে দাড়ায় নির্ধা।আর বলল–

“জান ভাইয়া তা বিয়ে টা কবে করছেন??

” ওয়েট ভাবি।টোপ ফেলেছি এখন গিললেই হলো।”

মারশিয়াদ এর কথা শেষ হতেই নির্ধা শিহরণ হা হা করে হেসে উঠে।আশফিক আর আজরাহান একে অন্যের দিকে তাকায়।আজরাহান চোখ মুখ কুচকে উঠে দাড়ায়।আর দীপ্ত কন্ঠে বলল–

“শালা সবগুলো নাজায়েজ ওলাদ।”

আজরাহান এর আবুল কথায় আরেকদফা হেসে উঠে সবাই।বিপত্তি বাধলো মাইক্রোফোনে বলা ইনশিরাহ এর বিদ্রুপ করার অভিপ্রায়ে বলা আজরাহান কে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করায়।আজরাহান এর গা রি রি করে উঠে।এমনিতেই সবকিছু অসহ্য লাগছে তার কাছে।কিন্তু সে হেরে যাওয়ার পাত্র নয়।তাই বাধ্য হয়ে গান গাইতে যায়।মাইক্রোফোন হাতে নিতেই দেখে কিছুটা দুরে ভীড়ের মধ্যেই প্রহর দাড়িয়ে আছে।নির্লিপ্ত দৃষ্টি তার ঠোঁটে রুমাল চেপে রেখেছে।আজরাহান এর বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়।অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে তার ডিঙি নৌকা কে।নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছে।কন্ঠ স্বাভাবিক করে গান শুরু করে আজরাহান।তার অক্ষিযুগল নিবদ্ধ তার ডিঙি নৌকার চোখে।

“আমারে দিয়া দিলাম তোমারে….
তুমি কী দিবা তোমায় আমারে…।।

পারিনা বলতে মুখে..
দেখো না বলছি চোখে..
লাগে খুব লাগে ভালো তোমারে…
তুমি কী দিবা তোমায় আমারে..।।

নজরে নজরে তুমি,তোমার বাস
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে তুমি,তুমি যে শ্বাস।।

পারিনা বলতে মুখে..
দেখো না বলছি চোখে..
লাগে খুব লাগে ভালো তোমারে…
তুমি কী দিবা তোমায় আমারে..।।

—সাব্বির নাসির

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here