বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ১৭

0
5114

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ১৭
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ।বাসায় ফিরে এসেছে সবাই।বারোর ঘর ছুইছে ঘড়ির ঘন্টার কাটা।টিক টিক করে সময় চলছে তার আপন গতিতে।

জীবন বড়ই অদ্ভুত।মিনিটে বদলে যেতে পারে তার চলার পথ।নারী জীবন বৈচিত্র্যতায় ভরপুর।জন্মের পর থেকে যে মানুষগুলো কে ভালোবেসে জীবনের তিনভাগের একভাগ সময় অতিবাহিত হয় সে মানুষগুলোকেই বৈবাহিক সম্পর্ক নামে এক নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পেছনে ফেলে আসতে হয়।আপন মানুষগুলো ছেড়ে পারি দিতে হয় এক নতুন গন্তব্যে।অজানা,অচেনা মানুষগুলোকে আপন করে নিতে হয়।তখন তাদের দুটো বাড়ি হয়।বাবার বাড়ি আর স্বামীর বাড়ি।নারী আসলেই মহান সৃষ্টিকর্তার এক রহস্যময় সৃষ্টি।তারা সব পারে।তাদের কোমল হৃদয় যেমন মমতায় ভরা তেমনই ক্ষেত্র বিশেষে বজ্রকঠোর।
নারী অনেকটা পানির মত।যে পাত্রেই রাখা হয়
তার অনুরূপ ধারণ করে।

শুভ্র বিছানায় গোলাপের পাপড়ি বিছানো।হালকা গোলাপী রঙের জামদানি পড়ে বসে আছে নন্দিতা।সানায়া,নুরাইসা প্রহর ওকে ঘিরেই বসে আছে।ঘড়ির কাটায় ঢং ঢং ঘন্টা পড়তেই দরজায় কড়াঘাত পড়ে।সামান এসে দাড়িয়েছে।দরজা খুলতেই ওকে দেখে ঠোঁট চিপে হাসতে থাকে নুরাইসা আর প্রহর।ভ্রু কুচকে আদর জড়ানো কন্ঠে সানায়া বলল–

“তুমি এখানে??

সামান ভ্রু নাচিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল–

“আমি এখানে মানে!!
এটাতো আমার রুম।”

নুরাইসা ফিক করে হেসে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল–

“তা তো জানি দুলাভাই।কিন্তু আজ যে আপনার এই ঘরে থাকা হবে না।”

সামান বেগতিক হয়ে পড়ে।এমনিতেও মেয়েদের সাথে ও বেশি কথা বলতে পারে না।তার উপর ছোট বোনের সাথে একমাত্র শ্যালিকা দাড়ানো।হেমন্তের শেষ।শীতের কাপন শুরু হবে বলে।ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশেও দরদর করে ঘামছে সামান।ওর অসহায় মন আজরাহান এর পথ চেয়ে আছে।জড়ানো কন্ঠে বলল—

“আসলে,,,

“আসলে ভাইয়া বলতে চাইছে ভাবীর যদি একা ভয় করে আপনিও সাথে থাকতে পারেন।আমার ভাই যথেষ্ট সুবিবেচক।কাউকে অবশ্যই নিরাশ করবে না।কি বলো ভাইয়া!!

আজরাহান এর কথায় বুক ভরে চোখ বুঝে এক নিঃশ্বাস নিলো সামান।প্রশান্তিতে ভরে গেছে তার মন।কিন্তু আজরাহান এর কথা শুনেই চোখ মুখ বাকায় নুরাইসা।প্রদৃপ্ত কন্ঠে নুরাইসা বলল–

“আপনি,আপনি এখানে কেনো এসেছেন!! এখানে আপনার কী কাজ??

পাশে আশফিক ও দাড়ানো।নুরাইসার কথা শুনেই একগাল হাসে আশফিক আর বলল–

“কলেজে না হয় আমরা তোমার স্যার।এখানে কিন্তু আমরা তোমার বেয়াইন।আর বড় ভাইয়ের শালির উপর ছোট ভাইদের কিন্তু একটা অধিকার আছে।”

“কথাটা কিন্তু পুরোপুরি সত্য।”

মারশিয়াদ এর স্নিগ্ধ আওয়াজ এ স্বস্তি পায় নুরাইসা।সানায়ার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠে।বুক জুড়ে এক স্নিগ্ধতা বিরাজ করে।গত তিনবছর ধরে তার সুপ্ত ভালোবাসার প্রানদেব সে।মুখ ফুটে কখনো বলতে পারে নি।মারশিয়াদ কে দেখেই সানায়ার এক অন্যরকম অনুভুতি হয়।তার ব্যাখ্যা সে জানে না।তা অবর্ননীয় এক সুখানুভব।
আশফিক এর কথায় সম্বিত ফিরে সকলের।বলল—

“তো এখন কী করা যায় বলেন বেয়াইনসাব!!!
আমাদের ভাই কে কী ভিতরে যেতে দিবেন নাকী আমাদেরই কিছু করতে হবে!!

নুরাইসা তপ্ত কন্ঠে বলল–

“এইটা কী ধরনের কথা !!আপনারা কেনো ভিতরে যাবেন!!

“তাহলে আমাদের ভাই কে যেতে দিন।”

“আশফিক ভাইয়া দিস ইজ নট ফেয়ার।তুমি ভাইয়ার পক্ষ কেনো নিচ্ছো!!

সানায়ার করা প্রশ্নে হেসে উঠে আশফিক।বলল–

“আমাকে কী তোর মেয়েপক্ষ মনে হয়!!

“তাই বলে তুমি,,

“ওই চেংরি তুই এতো কথা বলিস কেনো!!বের হ এখান থেকে।”

আজরাহান ধমকে উঠে সানায়া কে।সামান অসহায় এর মতো দাড়িয়ে আছে।ভীষন লজ্জা পাচ্ছে সে।ছোট ভাইবোনদের সামনে কী বিশ্রি ব্যাপার!!
অধর কোনে হাসি টেনে মারশিয়াদ বলল–

“আমাদের সমস্যা নেই।আপনারা বললে আমরা বর নিয়ে চলে যাই।পরে দরকার পড়লে ডাকবেন।”

শক্ত কন্ঠে নুরাইসা বলল–

“এইটা আবার কী কথা !!বর নিয়ে যাবেন কেনো??

“তো আপনারা বর কে ভিতরে যেতে দিচ্ছেন না কেনো??
জানেন তো এই রাতের ভোর খুব তাড়াতাড়ি হয়।শুধু শুধু ভাবি কে কষ্ট দিচ্ছেন।”

নুরাইসা মুখ বিকৃত করে।কি বলে এই লোকটা!!

“সময়ের এতো চিন্তা তো দেনা পাওনা তো শেষ করো।”

ইনশিরাহ এর ফিকে আওয়াজ এ আজরাহান ভ্রু কুচকে বলল–

“তো এইসব শিরনির প্ল্যান!!

“মোটেও না।এইসব ফরমালিটিস।”

“বাহ!!
তোমার তো ভালো অভিজ্ঞতা।”

ইনশিরাহ চোখের কোন ক্ষীন করে তাকায়।মুখে তার গম্ভীর ভাব।আজরাহান এর দিকে কঠোর দৃষ্টি রেখে বলল–

“তোমার তো আরও বেশি থাকা উচিত।”

আজরাহান অধর বাকিয়ে বলল–

“তা দেনা পাওনাটা কিসের শুনি।”

“এই আমাদের আপু কে আজকের জন্য ভাইয়াকে দিবো তার জন্য।”

“ঘরের শত্রু বিভীষন।ভাবী না কি শিরনীর আপু।ওই তোরা কে কোথায় আছিস আমারে ধর!!
ভাই আমাদের,ভাবী আমাদের,ঘর আমাদের,বিছানা আমাদের সবই যখন আমাদের দেনা পাওনা আবার কীসের!!পাঁচ লক্ষ টাকা কাবিন করে ভাবী কে এনেছি।ফ্রি তে না।”

“তো!!
এখন টাকা না দিলে ভিতরে যেতে দেওয়া হবে না।”

“আব আয়া উট পাহাড় কে নিচে।টাকার জন্য এতো কিছু!!!

আজরাহান কিছুতেই টাকা দিবে না।তার এক কথা কাবিনের টাকা শোধ করা হবে রাতেই তাই বাড়তি কোনো খরচ সে করতে পারবে না।মানে দিবে না।ইনশিরাহ নুরাইসা ওরাও ছাড়ার পাত্রী নয়।দরজা আগলে দাড়িয়ে আছে।সামান এর অস্বস্তি হচ্ছে।কিছু বলতেও পারছেনা।ঠায় রোবটের মতো দাড়িয়ে আছে।মুখে তার বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।

ঘরের ভিতর থেকে মিটিমিটি হাসছে নন্দিতা।পাশেই স্থবির হয়ে বসে আছে প্রহর।নন্দিতা মৃদু স্বরে বলল–

“কী হয়েছে প্রহর??
শরীর খারাপ লাগছে??আর তোর ঠোঁটে কি হয়েছে।ইশশ!!
কেমন কালষেটে পড়ে গেছে।ব্যথা পেলি কী করে।””

নন্দিতার করা এতো প্রশ্নের জবাব প্রহর এর একদম দিতে ইচ্ছে করছে না।বিরস কন্ঠে বলল–

“আমার ভালো লাগছে না।আমি ঘরে যাবো।”

নন্দিতারও বেশ খারাপ লাগছে।সে কখন থেকে দেখছে প্রহর ঘাপটি মেরে বসে আছে।মুখটাও একদম শুকনো।আর চোখ গুলো কেমন দেবে গেছে ভিতরে।কেমন বিবর্ন দেখাচ্ছে।হয়তো ঘুমের প্রয়োজন।নন্দিতা বিপাকে পড়ে।একে নতুন বউ।আর ওরা যা শুরু করেছে কিছু বললে হিতে বিপরীত হতে পারে।প্রহর বিছানা থেকে আলগোছে নেমে আসে।দরজার সামনে গিয়ে নরম কন্ঠে বলল–

“সানায়া আপু আমি ঘরে যাবো।”

সবার কথার স্বর এক নিমিষেই স্তব্দ।চোখ নিবদ্ধ করে প্রহর এর দিকে।কেউ কিছু না জানলেও মারশিয়াদ জানে প্রহর এর এই অস্বাভাবিকতা কারণ কী।
আজরাহান এর চোখ পড়তেই চোখ সরায় প্রহর।আজরাহান ছোট্ট করে দম ছাড়ে।পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করে তা নুরাইসার তালুতে গুঁজে দেয়।দরজা থেকে সরে দাড়ায় ওরা।প্রহর বেরিয়ে আসতেই সামান ভিতরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।হাঁফ ছেড়ে বাচে সামান।ওকে দেখেই হেসে কুটিকুটি নন্দিতা।এই লোকটা যে এতোটা ইনোসেন্ট তা সে বুঝতে পারে নি।

সিড়ি দিয়ে নেমে আসে প্রহর।আজরাহান আসতে গেলে নুরাইসা আর সানায়া আবার ওকে ধরে।যেই টাকা আজরাহান ওদের দিয়েছে তার উপরে দুইটা হাজার টাকার নোট হলেও বাকী গুলো সাদা কাগজ।বাক বিতন্ডা শুরু হয় আবার।

প্রহর এর পিছু পিছু আসে মারশিয়াদ।শান্ত কন্ঠে বলল–

“রেড চিলি!!

“হুহ।”

মারশিয়াদ ওকে একটা মেডিসিন দিয়ে হালকা কন্ঠে বলল–

“এইটা খেয়ে নিন ব্যথা কমে যাবে।”

প্রহর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল–

“লাগবে না।”

ততক্ষনে আজরাহান ওদের সামনে এসে দাড়ায়।ওকে দেখেই প্রহর নিজের ঘরে চলে যায়।গর্জে উঠে মারশিয়াদ।কঠিন কন্ঠে বলল–

“তোর সাথে আমার কথা আছে।”
,
,
বাগানের কোনে দাড়িয়ে আছে ওরা দুইজন।বিশাল থালার মতো আকাশজুড়ে আজ তারার মেলা।টিপ টিপ করে জ্বলছে তা।তারই মধ্যখানে রুপের পসরা সাজিয়ে বসে আছে চন্দ্ররানী।বিশাল আকাশের একচ্ছত্র রানী সে।
মারশিয়াদ রাশভারী কন্ঠে বলল–

“এইসব কী শুরু করেছিস তুই??

আজরাহান চোয়াল শক্ত করে সামনে থাকা তার বন্ধু নামের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রুর দিকে তাকায়।কন্ঠে কাঠিন্য রেখে বলল–

“তার জবাব আমি তোক দিতে বাধ্য নই।”

“তুই বাধ্য।দিতে হবে তোকে।সে তোর একার সম্পত্তি নয়।ভালোবাসার মানে এই নয় যে তুই শুধু তার ভোগ দখল করবি।তার রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও তোর।”

আজরাহান রুদ্ধ শ্বাসে বলল–

“ভোগ দখল,দায়িত্ব !!
এইসব তোর মুখে মানায় না।কী চাস তুই বলতো!!
আমি যতই চাই আমাদের সম্পর্কটা ঠিক হোক তুই ততবারই তাতে বিষ ঢেলে দিস।”

“আজরাহান!!

“একদম চুপ।আমি কিছু শুনতে চাই না।”

মারশিয়াদ কন্ঠে নম্রতা এনে বলল–

“শুনতে তোকে হবে।ভুলে যাস না রেড চিলি তোর কাছে কারো দেওয়া আমানত।যার উপর তুই জোর খাটাচ্ছিস।”

“কার আমানত,কীসের আমানত আই ডোন্ট কেয়ার।ও শুধুই আমার।”

মারশিয়াদ ঠোঁট দুটো ফাক করে এক দম ছাড়ে।শীতল কন্ঠে বলল–

“আই থিংক ভুল আমার হয়েছে।আমার তাকে ছেড়ে যাওয়া উচিত হয়নি।আসলে কী বলতো আমি ভেবেছি আমি তাকে ডিজার্ব করি না,তুই করিস।তুই ই পারবি তাকে তার হারানো সুখ ফিরিয়ে দিতে।কিন্তু আই এম রং।কাউকে ভালোবাসলে আগে তাকে ভালো রাখা শিখতে হয়।”

আজরাহান ক্ষীপ্র কন্ঠে বলল–

“ওকে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না।আমি সামলে নিবো ওকে।”

“আই নো।বাট তুই আজ যা করেছিস তার কী ব্যাখ্যা আছে তোর কাছে!!
শুধুই জেলাসি??

“কী বলতে চাস তুই।”

“আমরা যখন কোনো ফুলগাছ লাগাই তখন এইটা ভেবে লাগাই যে একদিন সে আমাদের কষ্টের ফল দিবে।ফুলের সৌরভে ভরিয়ে দিবে আমাদের প্রাঙ্গন।কিন্তু সেই সৌরভের জন্য আমাদের তার পরিচর্যা করতেই হয় না কি রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তাকে নিঃশেষ হতে দিবো!
ঠিক তেমন ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা পেতে হলে একটু বিশ্বাস করতেই হয়।বিশ্বাসবিহীন যেকোন সম্পর্ক তাসের ঘরের মতো।হালকা হাওয়াতেই তা উড়ে কোথায় গিয়ে পড়বে তা ভাবা মুশকিল।”

আজরাহান নিরুত্তাপ।সে জানে আজ যা সে করেছে তা ভুল ছিলো।কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বেও সে মারশিয়াদ কে কোনো ভাবেই প্রহর এর আশেপাশে সহ্য করতে পারে না।
মারশিয়াদ আবার বলল–

“আমি আমার হাত ঘুটিয়ে নিয়েছি তার মানে এই নয় যে আমি তার ছায়া হওয়া ছেড়ে দিয়েছি।আমি এখনো বলছি সে শুধুই তোর।প্লিজ বিলিভ হার।তোকে তার প্রয়োজন।এভাবে চলতে থাকলে তুই তাকে হারাবি।”

মারশিয়াদ হালকা হাসলো।আবার বলল–

“তুই আজ যা করেছিস তার জন্য সে তোকে ক্ষমা করলেও আমি কখনো করবো না।
সে আমার বন্ধু নয় তার চেয়ে বেশি,সে আমার প্রেয়সীও নয় তার চেয়ে কম।বাকি টা তুই বুঝে নে।
কিন্তু আজকের পর কারণে যদি তার চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি পড়ে তাহলে আই প্রমিস ইউ তুই তাকে হারাবি সারা জীবনের জন্য।
চলি আমি।তোর আর আমার মাঝখানের সেতুবন্ধন সে।এভাবে ছিড়ে যেতে দিস না।ভালো থাকিস।টাইম ইজ ইউর নাও।”
,
,
,
রাতের মায়া কাটিয়ে ভোরের স্নিগ্ধ আলো ভরে তুলছে চারপাশ।মৃদু রোদের ঝলমলে আলো চিক চিক করছে গাছের পাতা।হালকা মৃদু বাতাস বয়ে চলছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি প্রহর এর।সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ফ্রেশ হয়ে ভোরের স্নিগ্ধতায় অবগাহন করছে সে।

“প্রহর!!

কারো নির্নিমেষ নরম কন্ঠে পিছন ফিরে তাকায় প্রহর।আজরাহান দাড়িয়ে আছে।চোখ দুটো ফুলে ফেপে উঠেছে।চুলগুলোও আলুথালু।চোখের নিচটাতেও কেমন ডার্ক সার্কেল পড়ে আছে।আজরাহান কে দেখেই ওকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে প্রহর।আজরাহান আবারো শান্ত কন্ঠে বলল–

“প্লিজ দাড়া ডিঙি নৌকা।একবার আমার কথা শোন।”

প্রহর ঘুড়ে দাড়ায়।বিরস দৃষ্টিতে আজরাহান এর দিকে তাকায়।কোনো প্রতিক্রিয়া সে করে না।আজরাহান দীপ্ত পায়ে ওর সামনে গিয়ে প্রহর এর হাত দুটো ধরে বলল–

“প্লিজ আই এম সরি।রাগের মাথায় তোর সাথে আমি,,,

প্রহর এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয়।দাঁত মুখ খিচে রুদ্ধ কন্ঠে বলল—

“কীসের এতো রাগ আপনার!!কেনো এমন করেন আপনি আমার সাথে!!!
যখন যাই ইচ্ছে তাই করেন।কেনো,আমি কী আপনার খেলার পুতুল??

আজরাহান ভেজা কন্ঠে বলল–

“আমি তোকে ভালোবাসি প্রহর।”

প্রহর দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে উত্তেজিত হয়ে বলল—

“চুপ করেন আপনি।চুপ করেন।আপনি কখনই আমাকে ভালোবাসেন নি।শুধু চেয়েছেন আমার উপর অধিকার খাটাতে।”

আজরাহান প্রহর এর কাছে ওর দুই হাত দিয়ে প্রহর এর ঘাড়ের কাছে হাত রেখে বলল–

“আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে।প্লিজ একবার আমার সিচুয়েশেনটা বোঝ।”

“কিছু বুঝতে চাই না আমি।কিচ্ছু না।আপনি আর কখনো আমার কাছে আসবেন না।”

প্রহর থামে।চিৎকার করে কথা বলায় ওর বুকের উপরিঅংশ উঠানামা করছে।ফোস ফোস করতে থাকে প্রহর।তারপর ধীরে ধীরে শান্ত,নিশ্চল হয়ে পড়ে।নেত্রনীড় উপচে পড়ছে।কপোলের দুই ধারে যেনো মুষলধারে বাদল ঝড়ছে।আজরাহান প্রগঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ওর বুকের ভেতরে ভীষন যন্ত্রণা হচ্ছে।এক নাম না জানা যন্ত্রণা।পিষে যাচ্ছে আজরাহান তার রাগের যাতাকলে।কেনো সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না।বুক ভারী হয়ে আসে আজরাহান এর।তার প্রেয়সীর চোখের জলে যে তার হৃদয় পুড়ে তা কী করে তাকে বোঝায়।প্রহর নরম,শান্ত ও আর্দ্রতা জড়ানো কন্ঠে বলল–

“কেনো এমন করেন আপনি আমার সাথে!!
আমি আপনাদের আশ্রিতা বলে!!তাহলে বলেন আমি চলে যাই।”

“প্লিজ একবার আমার কথা শোন।”

আজরাহান ওকে ধরতে গেলেই প্রহর ছিটকে সরে পড়ে।রুদ্ধ কন্ঠে বলল–

“আপনি আমাকে ছোবেন না।একদম না।জান ভাইয়া বলেছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন!!
মিথ্যে বলেছে জান ভাইয়া।আপনি শুধু আমাকে দয়া করেছেন।চাই না আপনার দয়া আমার।চলে যাবো আমি এখান থেকে।চলে যাবো।আর কখনো আসবো না।”

আজরাহান এর উত্তরের অপেক্ষা প্রহর করেনি।চলে যায় সেখান থেকে।অস্ফুট ভাবেই আজরাহান বলল–

“তুই আমাকে ছেড়ে গেলে তোর রাহান ভাইয়া বাচবে না ডিঙি নৌকা।এতো বড় সাজা তুই আমাকে দিস না।পারবো না আমি তোকে ছাড়া থাকত।একদম পারবো না।”

ছাদের একপাশে থাকা ফুলের টব গুলোতে একের পর এক লাথি মারতে থাকে আজরাহান।দু একটা উঠিয়ে আছড়ে ভেঙে ফেলে।টেনে ধরে নিজের চুল।হাত দিয়ে মুখ কচলাতে থাকে।কি করবে সে এখন???
,
,
,
দুই দিন ধরে আজরাহান নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে।একবেলা খেলে অন্যবেলা ঘুমিয়ে কাটায়।প্রহর এর মুখোমুখি হয়নি এই দুইদিন একবারও।প্রহরও আজরাহান এর ঘরের দিকে পা বাড়ায় নি।কুহেলিকা ছেলের এমন অস্বাভাবিক আচরণে ঘাবড়ে যান।তার যেই ছেলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে আজ সে এতো শান্ত!!
আজরাহান কে জিঙ্গেস করলে সে জানায় সামনে তার মাষ্টার্স ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম তাই নিজেকে সময় দিতে চায়।কুহেলিকা দিরূক্তি করে না।আজরাহান বরাবরই ভালো রেজাল্ট করে।

রাতের সবার খাওয়া শেষ।এই দুদিনে বেশ মানিয়ে নিয়েছে নন্দিতা নিজেকে এই পরিবারের সাথে।কাল ওদের বৌ ভাত।নানা আয়োজন।তাই সকাল সকাল উঠতে হবে বলে রাত জাগলো না কেউ।আজরাহান আজোও খায় নি।কুহেলিকা ছেলের এমন আচরণ শুধু ভাবাচ্ছে না বরং অসুস্থ করে তুলছে।কিন্তু সামান এর বিয়ের ঝামেলা মিটার আগে সে এইসব নিয়ে ভাবার সময় পাচ্ছে না।

আজরাহান এর জন্য খাবার বেড়ে তা টেবিলের উপর রাখে নন্দিতা।প্রহর রান্না ঘরেই ছিলো।নন্দিতা ওর কাছে গিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলল–

” একটা কাজ করবি প্রহর!!

“বলো না।”

“আজরাহান এর খাবার টা ওর ঘরে দিয়ে আসবি??

প্রহর বিস্ময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নন্দিতার দিকে।গাঢ় কন্ঠে বলল–

“আমি!!

“হ্যাঁ তুই।তোর ভাইয়া সে কখন থেকে আমাকে ডাকছে।তুই একটু যা না।জানিস তো খাবার না দিয়ে এলে না খেয়েই সারারাত পড়ে থাকবে আজরাহান।”

প্রহর নির্বিকার কন্ঠে বলল–

“আচ্ছা।তুমি যাও আমি দিয়ে আসছি।”

নন্দিতা ওর হাতে থাকা প্লেট গুলো নিয়ে বলল–

“এগুলো আমি দেখছি তুই যা।”

প্রহর ভোলা চোখে তাকিয়ে থাকে নন্দিতার দিকে।
সেদিন ছাদের ঘটনা সম্পূর্ন অবলোকন করেছে নন্দিতা।সকালে গোসল সেরেই বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখে আজরাহান উপরে যাচ্ছে।নিচে এসে প্রহর এর ঘরের দরজা খোলা পেয়ে ঘরে গিয়ে দেখে প্রহর নেই।ওকে খুজতে খুজতে উপরে আসে নন্দিতা।
,
,
দরজা ঠেলে খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে প্রহর।আজরাহান বিছানায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে।প্রহর কে দেখেই অধর কোনে হাসির রেখা টানে আজরাহান।প্রহর নিশ্চল ভাবে বলল–

“আপনার খাবার রেখে যাচ্ছি।খেয়ে নিবেন।”

আজরাহান উঠে গিয়ে প্রহর কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল–

” এখনো রেগে আছিস আমার উপর!!একটুও কমেনি রাগ??

প্রহর পেটের উপর থেকে আজরাহান এর হাত দুটো সরিয়ে ঘুড়ে দাড়িয়ে আজরাহান এর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল–

“খেয়ে নিন।খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

“আগে বল রাগ কমেছে তোর??

প্রহর শান্তভাবে দু বার মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বোধক সম্মতি দেয়।আর বলল–

“খেয়ে নিন।”

আজরাহান চট করে বলল–

“আমার এক্সাম শেষ হলেই মা কে তোর আর আমার বিয়ের কথা বলবো।”

প্রহর দৃঢ় কন্ঠে বলল–

“আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।”

আজরাহান হালকা তপ্ত কন্ঠে বলল–

“প্রহর!!!
তুই আবার শুরু করলি!!সমস্যা কী তোর!!

“সমস্যা আপনি।কেনো বিয়ে করতে চান আপনি আমাকে!!
শুধুমাত্র আমার শরীরটার জন্য??

আজরাহান ক্ষেপে উঠে।রুষ্ট কন্ঠে বলল–

” এইসব কী বলছিস তুই??

“আমি ঠিকই বলছি।আপনার শুধু আমার শরীরটাই প্রয়োজন।আপনারা সব পুরুষরাই এক।
এই যে আপনি আমাকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছেন কিন্তু বিয়ে হলে আর ভালো লাগবেনা আপনার আমাকে।”

আজরাহান প্রদৃপ্ত কন্ঠে বলল–

“কী আজে বাজে কথা বলছিস এইসব!!
আমি তোকে ভালোবাসি।”

“জানি।এখন আপনি এই কথাই বলবেন।কিন্তু বিয়ের পর সবাই বদলে যায়।ভালোবাসার মানুষ গুলো তখন পুরোনো হয়ে যায়।তখন আর তাদের ভালো লাগে না।নতুন কাউকে লাগে তাদের।নিঃশেষ হয়ে যায় ভালোবাসা।বেচে থাকে শুধু চাহিদা।”

আজরাহান ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়ে।বিগলিত কন্ঠে বলল–

“ভালোবাসা কখনো নিঃশেষ হয় না।ভালোবাসা রঙ বদলায়।তুই যত ভালবাসবি ভালোবাসার রঙ তত গাঢ় হবে।রাঙিয়ে দিবে তোর জীবন।
আমি তোকে সেভাবেই ভালোবাসবো প্রহর।আমার ভালোবাসা কখনো নিঃশেষ হবে না।তা ধ্রুভ তারার মতো সত্য।তার রঙ আকাশের রঙধনুকেও হার মানাবে।”

“নাহ।আমি বিশ্বাস করি না।একবার বিয়ে হয়ে গেলে আপনিও আমাকে ছুড়ে ফেলে দিবেন।আমাকে আপনার আর ভাললাগবে না।আমি করবো না আপনাকে বিয়ে।কাউকে করবো না।কাউকে না।”

আজরাহান আর কিছু বলতে পারেনি।প্রহর এর কথায় যে কষ্ট প্রকাশ পেয়েছে তা তীরের মতো বিধে যায় আজরাহান এর বুকে।কেনো এতো সংশয়??
কেনো ওর মনে হয় বিয়ের পর ভালোবাসা থাকে না??

নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে বসে পড়ে প্রহর।ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে।আজরাহান এর সামনে যতটা নিজেকে শক্ত করে রেখে কথা বলেছে বন্ধ দরজার ভেতর নিজেকে অসহায় পথিক মনে হচ্ছে।যে তার জীবনের সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে।কাদত কাদতে বলল–

“সবাই বদলে যায়।সবাই।ভালোবাসা রঙ বদলায় রাহান ভাইয়া।আমি আপনাকে কখনো কখনো বিয়ে করতে পারবো না।কাউকে না।”

প্রহর নিজের কম্পনরত হাতটি নিজের পেটের উপর আলতো করে রেখে বলল–

“আমার মেয়ে কে তার বাবা কখনো ভালোবাসবে না।মেয়ে হয়ে জন্মানো পাপ।আমি আর পাপ করতে পারবো না।আর পারবো না।”

চলবে,,,

বিঃদ্রঃ
প্রহর সম্পর্কে কী ধারনা🙂🙂🙂)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here