বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ৩

0
6483

#বৃস্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ৩
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

পড়ন্ত বিকেল।প্রভাকর তার তীর্যক রশ্মির তীব্রতা কমিয়ে ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে।কমলা রঙের আভায় সেজেছে তার আশপাশ।দিনের আলো গোধূলি ছুই ছুই করছে।এমন সময়টা অনেকের কাছে বিরক্তিকর হলেও নাবীন খান পরম আবেশে অনুভব করে এ সময়টা।তার বাড়ির সামনের দিকে বিশাল খোলা বারান্দা।বারান্দা জুড়ে লাগানো ফুল গাছ। সেখানেই বৈকাল বেলার খানিক বিশ্রাম আর ফুরফুরে বৈকাল বেলার সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য ছোট ব্যবস্থা।একটি টেবিলের চারপাশে চারটি চেয়ার আর বামপাশের দেয়াল ঘেষে ডিভান রাখা।কখনো কখনো এখানেই তারা চাঁদের জোৎস্নায় স্নান করে পূর্নিমা রাতের নীলাম্বরীর স্বর্গীয় সৌন্দর্য অবলোকন করে।একটা ঝাঝড়ি নিয়ে ফুলের টব গুলোতে পানি দিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়েছেন।বাড়ির সামনে দিয়ে এক হকারওয়ালা কিছু মাটির তৈরি জিনিষ নিয়ে যাচ্ছেন।গলা ফেড়ে বলছেন—-“”লাগবে মাটির থালা,কাঁসা,ফুলের টব””।নাবীন খান মৃদু হাসলেন।যে সময়টা তারা প্রিয় কিছু করার জন্য উৎফুল্লতায় ব্যয় করেন সে সময় কতিপয় মানুষ জীবন সংগ্রামের অধ্যায়ের পাঠ চয়নে ব্যস্ত।

“ব্যস্ত জীবন,ব্যস্ত শহর
মানুষ এখন বন্দি ঘর।”

পানির ঝাঝড়ি টা বারান্দার কোনায় রেখে চেয়ারে এসে আরাম করে বসলেন।নাবীন খান এক অদ্ভুত অভ্যাসে অভ্যস্ত।যেখানে সারা দুনিয়ার মানুষ দেশ ও বহির্বিশ্বের খবর জানার জন্য সকাল সকাল পত্রিকার পাতায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেখানে তিনি সেই অযাচিত খবর পড়ে সকালের স্নিগ্ধতা নষ্ট করতে চান না।আজকাল পত্রিকা পাতা খুললেই চোখ কেড়ে নেয় বড় বড় রাঘব বোয়ালদের দূর্নীতি,কালো টাকার পাহাড়,খুন,গুম,ধর্ষন,ছিনতাই ইত্যাদি।যা একদম অপ্রীতিকর ঘটনা।

চেয়ারে আরাম করে বসেই টেবিলে থাকা পেপারটা হাতে নিলেন।কিন্তু তা আর পড়া হলো না।রাগে অগ্নিশর্মা নুরাইসা হন্তদন্ত হয়ে সেখানে এসে ডিভানে হাতে থাকা ব্যাগটা ছুড়ে মেরে ধম করে বসে নাবীন খান এর সামনের চেয়ারে।নাবীন খান মুখের উপর থেকে পেপারটা সরিয়ে নিচে রাখলেন।শান্ত ভঙিতে নুরাইসার দিকে দৃষ্টিজ্ঞাপন করলেন।তিনি দেখলেন নুরাইসার চোখ দুটি লালচে বর্নের।তার সুশ্রী মেয়ের নাকের ডগায় জমে আছে একরাশ গম্ভীর ভাব যা যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হবে।স্বাভাবিক কন্ঠে তিনি বললেন–

“কিছু বলবে??

নুরাইসা দাঁতের সাথে দাঁত নিষ্পেষণ করে।গলায় কঠিন স্বরের তাল তুলে বলল—

” আপু কে বিয়ে দেওয়ার জন্য আর ছেলে পেলে না!!
ওই বেয়াদব লোকটার ভাইকেই তোমাদের পছন্দ হলো??

নাবীন খান ঠোঁট প্রসারিত করে বিকেলের তাজা হাওয়া টেনে নিলেন।তা দেখে নুরাইসা আরো চটে যায়।ও যখনি আজরাহান এর নামে কিছু বলে ওর বাবা সমসময় মৌনতা পালন করায় ব্রতী হতে চান যা ওর দ্বেষ আরো বাড়িয়ে দিয়।
উত্তেজিত কন্ঠে নুরাইসা আবার বলে—

“বাবা!!!

নাবীন খান ধীর স্থিরভাবে একটু নড়ে বসলেন।ভদ্রলোক একদম শান্ত শিষ্ট না হলেও আজরাহান এর ব্যাপারে বিন্দুসম অযাচিত কথাবার্তা তিনি পছন্দ করেন না।সে তার মেয়েই হোক না কেনো!!
নিজেকে শান্ত রেখে আরেক দফা তাজা হাওয়া নিলেন নিজের স্বরনালিতে।আর বললেন–

“সেই প্রশ্নটা তুমি তোমার আপু কে করতে পারো।আফটার অল,সামান তার পছন্দ করা ছেলে।
আর তুমি জানো আমি তোমাদের কোনো অংশে ছেলেদের থেকে কম স্বাধীনতা দেয়নি।
নিজের লাইফ পার্টনার বেছে নেওয়ার সম্পূর্ন অধিকার তোমাদের আছে।আমাদের কাজ তোমাদের পছন্দের ব্যক্তি আসলেই তোমাদের যোগ্য কি না তা পর্যবেক্ষণ করা।আর সেই হিসেবে সামান তোমার বোনের যোগ্য লাইফ পার্টনার হওয়ার অধিকার রাখে।”

নাবীন খান এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন।নুরাইসার মনে হলো কেউ যেনো তার গায়ের আগুনে ইচ্ছাকৃতভাবে দু চামচ ঘি ঢেলে দিয়েছে।জ্বলে উঠে সে।আর বলল—

“এতো কথা বুঝি না।তুমি এই বিয়ে ক্যান্সেল করে দাও।”

“তুমি তো এমনভাবে বলছ যেনো বিয়েটা তোমার ঠিক হয়েছে!!
অবশ্য তুমি চাইলে আমি আজরাহান এর সাথে একবার কথা বলতে পারি।”

নুরাইসা গর্জে উঠে।ফোস করে এক দম ছেড়ে বলল–

“কখনই না।
পৃথিবীর সব পুরুষ মরে গিয়ে তোমার ওই আজরাহান যদি পৃথিবীর একমাত্র জীবিত পুরুষ হয় তবুও আমি ওই লোকটাকে বিয়ে করবো না।”

নুরাইসা আর থামলো না।দ্রুত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।নুরাইসা যেতেই দু কাপ ধোয়া উড়ানো চা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন নবনীতা খান।স্বামীর পাশেই বসে স্মিত হাসলেন।তার মেয়েটা ছোট বেলা থেকেই একদম শান্ত,শিষ্ট।কিন্তু যখন থেকে আজরাহান ওর জীবনে এসেছে নিজেকে কখনো কখনো ঝাছি কী রানী ভাবে।

“আজরাহান ছেলেটাকে আমার ভীষন পছন্দ।”

সহধর্মিনীর এহেন কথায় তিনি কোন প্রতিক্রিয়া করলেন না কিন্তু তার চেহারার উজ্জ্বলতা দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুশি হলেন।

“পছন্দ না করার মতো ছেলে সে নয় নব।হি ইজ আ নাইস গাই জাস্ট লাইক আ জেমস।”

বিরস কন্ঠে নবনীতা বললেন–

“কেনো যে মেয়েটা ওকে সহ্য করতে পারে না,আমি বুঝি না।”

নাবীন খান অধর চওড়া করে চোখে হাসলেন আর বললেন–

“আগুন আর পানি একসাথে থাকলে কাউকে না কাউকে তার অস্তিত্ব হারাতেই হবে।”

নবনীতা খান হাস্যোজ্জ্বল মুখে উদগ্রীব হয়ে বললেন–

“এই তুমি একবার আজরাহান কে বলে দেখো না কী বলে ও।যদি ও রাজী হয় তাহলে সামান আর নন্দিতার সাথে ওদের বিয়েটাও দিয়ে দিবো।”

“কথাটা খারাপ বলো নি।ওর মতো জামাতা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।আমি ওর সাথে এই বিষয়ে কথা বলবো।”

নাবীন খান কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঞ্চি করে আবার বললেন–

“নুরাইসা কী রাজী হবে??
ও তো আজরাহান কে একদম পছন্দই করে না।”

“তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।ওকে আমি রাজী করাবো।”

“আচ্ছা,তাহলে আমি আজরাহান এর সাথে কথা বলে দেখি।”

নবনীতা খান নাবীন খান এর কলেজ পড়াকালীন তিন বছরের জুনিয়র ছিলো।কিন্তু তাদের প্রেম টা ছিলো একদম সমানে সমান।কেউ কারো দিক থেকে ভালোবাসায় কার্পণ্য করে নি।তাদের ভালোবাসার শুভ পরিণয় ঘটে আজরাহান এর মায়ের সাহায্যে।নবনীতা খান আর কুহেলিকা আহমেদ স্কুল লাইফের সারথী।আর সেই সুবাদেই সামান এর মতো ইন্ট্রোভার্ট ছেলের জন্য নন্দিতার মতো সুযোগ্য,সুশ্রী এবং পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার মতো অসীম ক্ষমতায় পরিপূর্ন একটি মেয়েকে তারা নিজেদের পুত্রবধূ করার সৌভাগ্য লাভ করে।কিন্তু আজরাহান ছোট বেলা থেকেই ডানপিটে।পাড়াড় সকল মারামারি তে সে সবার আগে।কারো অন্যায় সে দেখতে পারে না।এলাকার বয়স্ক মানুষ অবশ্য তার এই গুনের জন্য তাকে সমীহ করে।কিন্তু মায়ের কাছে সে অবাধ্য,অপরিপক্ক,নাসামাজ এক টগবগে যুবক মাত্র।
,
,
,
ঘুটঘুটে অন্ধকারে পা টিপে টিপে চলছে প্রহর।সিড়ির পাশেই ওর ছোট্ট ঘর।সেখান থেকে আসতেই অন্ধকারে ধাক্কা লাগে একটা টুল এর সাথে।মুখে হাত দিয়েই চিৎকার করে উঠে প্রহর।কিন্তু কোনো আওয়াজ নেই।কারন রাত প্রায় পৌনে তিন।আজরাহান বাসায় ফিরেছে।বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।মারশিয়াদ এর বাসায় সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিয়ে সে ফিরেছে এখন।বাড়ির উল্টোদিকে বর্ডার দেয়ালের ওপাশ থেকে প্রহর কে ডাক দিয়ে দরজা খুলতে বলে আজরাহান।এই কাজ প্রহর প্রায়ই করে।রাত করে বাড়ি ফেরা কুহেলিকা একদম পছন্দ করেন না।সানায়া জানলে মা কে খবর টা দিতে দুই মিনিট দেরি করে না।তাই আজরাহান এর একমাত্র ভরসাস্থল ওর ডিঙি নৌকা।যে ওকে পাড়ে ভেড়াবে।

প্রহর বিড়াল পায়ে ধীরে ধীরে গিয়ে বাইরের লাইট অন করে।টর্চ লাইটের আলো জ্বেলে আস্তে করে দরজা খুলতেই এক ভোটকা গন্ধ লাগে প্রহর এর।নাক ছিটকে উঠে প্রহর।

“ছিঃ রাহান ভাইয়া,আপনি আবার এইসব খেয়েছেন???

আজরাহান গরম চোখে তাকিয়ে বলল–

“বিয়ার খেয়েছি,মদ না।এইভাবে নাক ছিটকাচ্ছিস কেনো??

প্রহর নাকে দু হাত চেপে ধরে ধরা গলায় বলল–

“আপনার শরীর থেকে কী বাজে গন্ধ বের হচ্ছে।ছিঃ”

আজরাহান কিছু না বলে ভিতরে ঢুকে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।প্রহর পিছন থেকে বলল–

“আমি আপনার জন্য খাবার দিচ্ছি।”

“আমি খেয়ে এসেছি।”

প্রহর প্রতিত্ত্যুর করে না।দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষন দাড়ায়।মুখ টা তার বিষন্ন দেখায়।আজরাহান কিছুদূর গিয়ে আবার থমকে দাড়ায়।পিছন ফিরে বলল–

“তুই খেয়েছিস??

প্রহর নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।আজরাহান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল–

“তুই খাবার নিয়ে বস আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

প্রহর উদ্দীপ্ত হয়।চট জলদি গিয়ে খাবার নিয়ে বসে রান্নাঘরের লাইট জ্বেলে।দরজা চাপিয়ে রাখে যেনো বাইরে আলো না যায়।

আজরাহান ফ্রেশ হয়ে আসে।প্রহর খাচ্ছে আর ও বসে দেখছে।প্রহর ভেবেছিলো আজরাহান না খেয়ে আসবে আর ও একা একা খাবে তাই নিজেও না খেয়ে ছিলো।আজরাহান শান্তভাবে বলল–

“একটা কথা বলি তোকে??

প্রহর মুখে খাবার দিয়ে অস্ফুটভাবে বলল–

“হুম।”

“তোর বাড়ীর ঠিকানা কী সত্যিই তুই জানিস না??

প্রহর নির্লিপ্তভাবে আজরাহান এর দিকে তাকিয়ে দুটো ফাঁকা ঢোক গিলে।আজরাহান এর কথায় প্রহর এর মুখে অমাবস্যার কালো অন্ধকার ছেয়ে যায়।শক্ত কন্ঠে বলল—

“আমার এখানে থাকায় কী আপনার সমস্যা!!
তাহলে বলেন আমি চলে যাই।”

“আমি কী তোকে চলে যেতে বলেছি!!!

“তাহলে কেনো বললেন??

” আমি তো শুধু জানতে চেয়েছি তোর বাড়ীর কেউ,,

আজরাহান এর কথা শেষ না হতেই তার রেশ ধরে প্রহর বলল—

“কেউ নেই আমার।”

আজরাহান এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।প্রহর কে যতবারই ওর বাড়ীর ঠিকানা জিঙ্গেস করা হয়েছে ও সবসময় এড়িয়ে যায়।আদৌ কী সে ঠিকানা জানে নাকি ইচ্ছে করে বলে না তা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।কিন্তু এই বাড়ীতে সবাই ওকে আপনজন এর মতোই ভালোবাসে।
,
,
,
সকালেই সকলের খাবার খাওয়া শেষ।দুপুরের খাবার তৈরি করছে কুহেলিকা।মুরগির মাংস টা রান্না হলে তা তুলে দেয় প্রহর এর হাতে রাখার জন্য।প্রহর কিচেন র্্যাকের উপর বসে পা দুলিয়ে যাচ্ছে।মাংসের বাটি থেকে একপিস মুখে পুরে দেয়।তা খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে।হাসি হাসি মুখে বলল–

“ছোট মা,তোমাকে এতো ভালো রান্না কে শিখিয়েছে??

কুহেলিকা স্মিত হাসি উপহার দিয়ে বলল–

“তোর ভালো লাগে??

“ভালো লাগবে না কেনো!!
ইউ আর দ্যা বেস্ট।বলো না কে শিখিয়েছে??

“আমার মা।”

“নানুমনি!!!!!
বাহ!!তিনি থাকলে তো আমিও শিখে নিতাম।”

“রান্না শিখবি??

“হুম।তোমার মতো ভালো ভালো রান্না করবো।”

“আচ্ছা আমি শিখিয়ে দিবো।”

প্রহর উচ্ছলিত কন্ঠে বলল–

“সত্যিই !!!!
কবে শিখাবে??

“যখন থেকে তুই শিখবি।”

“আচ্ছা।
এই জন্যই বুঝি ছোট আব্বু তোমাকে এতো ভালোবাসে!!
তুমি এতো মজার মজার জিনিস রান্না করে খাওয়াও।”

“হয়তো।জানিস তো পুরুষদের রাগ ওদের পেট হয়ে যায়।তাই পুরুষদের রাগ ভাঙানোর অন্যতম উপায় হলো তাদের প্রিয় খাবার রান্না করে খাওয়ানো।”

প্রহর অধর চড়িয়ে হাসে।আর বলল—

“তাই!!!!
তাহলে আমিও আমার বর কে ভালো ভালো রান্না করে খাওয়াবো।”

কুহেলিকা হালকা হাসলেন।মেয়েটা এতো প্রানবন্ত।কখনো কিছু ভেবে বলে কি না কে জানে!!!
প্রহর আবারও বলতে থাকে—

“আমি বরকে বেশি বেশি রান্না করে খাওয়াবো তো বর আমাকে বেশিই ভালোবাসবে।যেমন ছোট আব্বু তোমাকে ভালোবাসে।”

“হুম।”

কুহেলিকা নিজ চিন্তে নিজের কাজে ব্যস্ত।কিন্তু প্রহর এর কথা শেষ হতেই ওর চোখ যায় রান্না ঘরের দরজায়।আজরাহান মূর্তিমান হয়ে দাড়িয়ে আছে।সাদা রঙের শার্টের সাথে কালো প্যান্ট।সাথে কালো টাই।ফোল্ড করা হাতাই ব্ল্যাক কালারের ওয়াচ।সিল্কি চুল গুলো পুরো সেট করা।ফর্সা দ্যুতি ছড়ানো চেহারায় গাঢ় জাম রঙের ঠোঁট।তার উপর কাজল কালো ভ্রু।প্রহর ওকে দেখেই সম্মোহিনী চোখে তাকিয়ে থাকে।অক্ষিপল্লব যেনো তার পলক ফেলতেই ভুলে গেছে।প্রহর এর শ্বাস ওর স্বরনালীতেই আটকে আছে।ওর মাথায় যেনো একশ ভ্রমর এসে গুনগুন করছে।কিন্তু ওর চাহনি ওর রাহান ভাইয়া তেই আবদ্ধ।পকেটে হাত ঘুজে এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে আসছে আজরাহান।আর ওর এগিয়ে আসার প্রতিটি পদক্ষেপ যেনো তীরের মতো বিঁধে যাচ্ছে প্রহর এর হৃদপিন্ডে।আজরাহান এর চোখে তাকাতেই দেখে রক্তদৃষ্টি দিয়ে ও তাকিয়ে আছে প্রহর এর দিকে।ওর সামনে আসতেই প্রহর নিচে নেমে দাড়ায়।আজরাহান কে মাথা হেলিয়ে এপাশ ওপাশ দেখে আর শান্তভাবে বলল–

“রাহান ভাইয়া,আপনার লেজে কী কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে,এমন লাল হয়ে যাচ্ছেন কেনো??

আজরাহান নিজের রাগ পুরোটা সংবরন করতে চাইলেও পারে না।কঠিন কন্ঠে বলল—

“বিয়ে করার অনেক স্বাদ জেগেছে তোর না??

আজরাহান এর কথায় নিজের শ্বাস আটকে নেয় প্রহর।কুহলিকা কোনো প্রতিক্রিয়া না করে নিজের কাজের ফাকেই স্বাভাবিক ভাবে বললেন—

“মেয়ে হয়ে জন্মেছে একদিন তো স্বামীর বাড়ী যেতেই হবে।এখানে স্বাদ জাগার কিছু নেই।”

আজরাহান ক্ষীণকায় উত্তেজিত হয়ে বলল–

“এই বয়সে এতো কিসের চিন্তা বিয়ে নিয়ে!!!

কুহেলিকা সবজি কাটা রেখে আজরাহান এর দিকে তাকায়।আজরাহান এর চোখ নিবদ্ধ প্রহর এর চোখে।কুহেলিকা এক শ্বাস ছাড়লেন।তার ছেলেকে সুদর্শন বললে ভুল হবে বলতে হবে ভয়ংকর সুদর্শন।এক দেখায় যে কোনো মেয়েকে সম্মোহন করতে ওর চোখের এক নিগূঢ় দৃষ্টিই যথেষ্ট।
কিন্তু একটাই অনুতাপের বিষয় সৌন্দর্যের সাথে যদি একটু ব্যক্তিত্বপূর্ন মানুষের গুনাবলি তার মাঝে বিদ্যমান থাকতো তাহলে তাকে লাখে এক বললেও ভুল হতো না।

কুহেলিকা নিজের ভাবনার অবসান ঘটিয়ে বিরস কন্ঠে বললেন—

“ফুলবাবু সেজে কোথায় যাওয়া হচ্ছে??

“আশফিক এর কাছে।”

“ভালো।ওকে আজ বাসায় নিয়ে এসো।অনেকদিন হলো ছেলেটাকে দেখি না।”

আজরাহান মায়ের দিকে তাকালেন।বিক্ষিপ্তচিত্তে শুধালেন—

“নিজের ছেলে কে তো একবার তাকিয়ে দেখো না।অন্যের ছেলে কে দেখার এতো আগ্রহ কেনো??

“তোমাকে দেখার কী আছে!!!ওই মাথায় ক গাছি চুল আর শ্বেত রোগীর মতো গায়ের রঙ।এছাড়া তো তোমার মাঝে দেখার কিছু নেই।”

কুহেলিকার কথায় প্রহর ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে।
আজরাহান ভারী কন্ঠে বলল–

“আমার গায়ের রঙ মোটেই শ্বেত রোগীর মতো নয়।”

“গিয়ে খাবার টেবিলে বসো।”

আজরাহান দাঁত,মুখ খিচে বের হয় রান্নাঘর থেকে।আজ কলেজ ছুটি তাই আজরাহান লেট করে উঠেছে।
প্রহর এর হাতে নাস্তার ট্রে ধরিয়ে দেয় কুহেলিকা।

ডাইনিং এ ঝিম মেরে বসে আছে আজরাহান।মস্তিষ্কের দু পাশের শিরা দপদপ করছে।মুষ্টিবদ্ধ হাতের মোটা শিরাগুলো যেনো এখনই ফেটে যাবে।প্রহর ট্রে নিয়ে এসে আজরাহান এর সামনেই রাখে।আর বলল–

“তাড়াতাড়ি খেয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।”

প্রহর এর কথা শেষ হতেই আজরাহান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়।কালক্ষেপন না করেই এক হাত দিয়ে প্রহর এর কোমড় চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে।আরেক হাত দিয়ে প্রহর এর এক হাত ধরে পিছন দিকে উল্টিয়ে ধরে।ক্ষীপ্র কন্ঠে বলল—

“অনেক বিয়ে করার স্বাদ জেগেছে তোর না!!!!
আরেকবার বিয়ের কথা বললে একদম জানে মেরে ফেলবো।”

প্রহর ওর হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।কিন্তু আজরাহান এর বিশাল দেহের বলিষ্ঠ হাতের সাথে পেড়ে উঠে না।প্রহর হকচকিয়ে বলল–

“ছাড়েন আমাকে।ছাড়েন বলছি।রাহান ভাইয়া!!!
লাগছে আমার।”

আজরাহান দাঁত কিড়মিড় করে বলল—

“আর আমার যে লাগে!!

“ছাড়েন বলছি।আমি ছোট মা কে ডাকবো।”

প্রহর সত্যিই ডেকে উঠে—

“ছোট মা!!!!

আজরাহান ওকে ছেড়ে দাড়ায়।প্রহর ঝাড়ি মেরে উঠে বলল—

“আপনি কী পাগল।তাহলে ছোট আব্বুকে বলবো আপনাকে এসাইলাম এ দিয়ে আসতে।যত্তসব!!!

আজরাহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই দেখে কুহেলিকা রান্নাঘরের চৌকাঠ এ দাড়িয়ে আছে।আজরাহান ওর যাওয়ার পথ ধরে।

বাইরে এসে বাইকের কী হোলে কী দিতে দিতে আনমনে বলে উঠে—-

“তোকে আমি কোথাও যেতে দিবো না ডিঙি নৌকা।
কেনো বুঝিস না তুই আমাকে!!!
সব তো বুঝিস।তাহলে আমাকে কেনো বুঝিস না।”

আজরাহান ওর পাশেই কারো ছায়া দেখতে পায়।মাথা উচু করে ছাদে তাকাতেই কেউ একজন সড়ে পড়ে।

ছাদের উপর বসে বসে হাপাচ্ছে প্রহর।আজরাহান আবারো ওকে ছুইয়ে দিয়েছে।ও জানে না কেনো আজরাহান এর স্পর্শে ওর এমন মনে হয়।ওর দুনিয়া কেনো কেপে উঠে।সবকিছু যেনো শুন্যে মিলিয়ে যায়।না চাইতেও এক অদৃশ্য বলয় ওকে আষ্টেপৃষ্টে জেঁকে বসে।যা থেকে ও বেরোতে পারে না।কিছুতেই না।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here