#গল্প
বৃষ্টি_ভেজা_অরণ্য
পর্ব_১
-শাতিল রাফিয়া
হতাশ হয়ে বসে আছি! মাথাটা বনবন করে ঘুরছে! আমার আশেপাশে হইচই, হট্টগোল এবং বাচ্চাকাচ্চাদের ক্যাওম্যাঁও! বেবি পাউডার, লোশন এবং দুধের কৌটা ছড়ানো, ছিটানো!
হঠাৎই টের পেলাম আমার জামার পেছনের দিকে ভেজা ভেজা লাগছে আর সাথে সাথে মায়ের আনন্দিত কণ্ঠ শুনতে পেলাম- আরে আপামণি হিসু করে দিয়েছে!
আমি তড়াক করে দুইলাফে উঠে দাঁড়ালাম। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে জামাকাপড় বদলে গোসল করে বেরিয়ে এসে দেখি আরেক নতুন উপদ্রব! আমার বড়আপা, দুলাভাই এবং তাদের দুইবছরের ছোট ছেলে তিতুন এসেছে! বড়আপাকে দেখেই বিরক্ত লাগছে! কারণ সে প্রচন্ডরকম নাটকীয়তা পছন্দ করে! আমার মাঝেমধ্যেই দুলাভাইকে অ্যাওয়ার্ড দিতে ইচ্ছা করে এই মহিলার সাথে সে কী করে পাঁচ বছর যাবৎ সংসার করে যাচ্ছে! বড়আপা একটা ভার্সিটির লেকচারার। তার স্টুডেন্টরা তাকে কিভাবে সহ্য করে এবং তাকে নিয়ে কি পরিমাণ কানাঘুষো আর হাসাহাসি করে সেটা আমার জানার খুব ইচ্ছা!
এই যেমন এখন আপা আমার বড়ভাইয়ার বাবুর দিকে চোখমুখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলছে- ওরে! আমার লক্ষী সোনা মেয়ে! একদম বড়ফুপুর নাক পেয়েছিস! বল তো ফুপু! ওলে ওলে! আয় সেলফি তুলি! দেখো মা নাকটা আমার মত খাড়া হয়েছে না?
আপার ভাব দেখে মনে হচ্ছে ভাইয়ার মেয়েকে সে এইমাত্র দেখেছে। অথচ তা নয়! ভাইয়ার মেয়ের বয়স আজ পাঁচদিন! আর তার নাক যে আপার মত হয়েছে এই কথাটা এই নিয়ে সে একহাজারবার বলে ফেলেছে! এটা নিয়ে দুলাভাই একটু বিরোধিতা করায় আপা কেঁদে কেটে চোখমুখ ফুলিয়ে একাকার করেছে! আর পাঁচদিনের বাচ্চা কি করে ‘ফুপু’ ডাকবে? এই আদিখ্যেতার মানে কি? আর এই নিয়ে মনে হয় শ’খানেক সেলফি তোলা হয়েছে আর ডজনখানেক পোস্টও হয়ে গেছে!
আমার রুম থেকে এবার বড় টয়লেটের গন্ধ আসছে! ভাইয়ার মেয়ে বড়কাজ করেছে কি না বোঝার আগেই তিতুন গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করে!
আপা চেক করে বলে- তিতুন বাথরুম করে দিয়েছে! আহা! ডায়পার লিক করেছে। চাদর বদলাতে হবে! তিতুন এদিকে এসো।
তিতুন ওর মায়ের কাছে না গিয়ে ‘খালামণি’ বলে আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে!
আমার ইচ্ছা করছে চিৎকার করে বনজঙ্গলে পালিয়ে যাই! আমি এমনিতেই বাচ্চাদের একবিন্দু পছন্দ করি না। বাচ্চাকাচ্চা দেখলে মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়! কোন এক বিচিত্র কারণে তারাও আমাকে সেরকম পছন্দ করে না। আমাকে পদে পদে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে! এই যেমন তিতুন! তোর এই নোংরা প্যান্ট নিয়ে আমাকে না জড়িয়ে ধরলেই কি হত না? আমি যতই তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি সে আরও জোরে জাপটে ধরছে। কেউ না থাকলে ঝেড়ে দুই থাপ্পড় মারতাম!
আপা এসে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন- বৃষ্টি আয় তো! ডায়পারটা বদলে দেই!
আমি কঠিন গলায় বললাম- আমার আগামীকাল পরীক্ষা! তোমার ছেলের জন্য আবার গোসল করতে হবে। আমি এখন পারব না!
এরপর রুমের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম – আমার রুমটা খালি করে দিলে আমি খুশি হব। আমি পড়তে বসব!
বলে আর না দাঁড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলাম! আর সাথে সাথেই আপার খুনখুন করে কান্নার শব্দ শুনলাম!
– শুনলে মা! এটা কি ওর একার রুম? আমি বাসায় থাকি না বলে আমাকে তোমরা পর করে দেবে?
আমি আপাকে কি করে বোঝাই যে আমি ওকে না সবাইকেই যেতে বলেছি! রুমে চাচী, মামী, খালা, ফুপু সবাই ছিল, আশেপাশের বাচ্চাকাচ্চারা ছিল! আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। আগামীকাল শেষ পরীক্ষা! এর আগে দুইদিনের একটা ছুটি ছিল। কিন্তু ভাইয়ার মেয়ে হওয়ায় আমিও ব্যস্ত ছিলাম। বাসা টু হসপিটাল দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। আজকে সে বাসায় এসেছে। নতুন বাবু বাসায় আসলে সবাই দেখতে আসবে স্বাভাবিক! কিন্তু সেই নতুন বাবুকে কেন আমার ঘরে রাখতে হবে? মাকে এই প্রশ্ন করাতে মা বলল, ভাইয়ার রুম নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে তাই কিছুক্ষণের জন্য যেন আমি সহ্য করি!
মাকে বলেছিলাম- তোমার আর বাবার রুমে নাও।
মা বললেন- ওখানে অনেক আত্মীয় স্বজন বসে আছে, বাচ্চা ঘুমাতে পারবে না! আর তোর ভাবীও আজ শান্তি করে ঘুমাচ্ছে।
‘আমার রুমে কি আত্মীয় স্বজন কম বসে আছে নাকি?’ কিন্তু এটা নিয়ে কিছু বললাম না। নাহলে এবার মা বলবেন ‘তুই কেমন ফুপু? খালা, ফুপুর স্থানও মায়ের সমান’ ইত্যাদি ইত্যাদি! এত কথা শোনার থেকে কথা না বলা ভাল।
বাথরুম থেকে আবার গোসল করে বেরিয়ে দেখি ধমকে কাজ হয়েছে। ভাবী এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল মায়ের ঘরে। সে উঠেছে আর বাবুকে তার ঘরে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে। বাকিরা সবাই সেখানেই ভীড় করেছে! আমার রুমের চাদর পাল্টে দেয়া হয়েছে! তবু রুম থেকে ডেটল এবং টয়লেটের মিশ্রিত এক উৎকট গন্ধ আসছে! আমি এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করার পর একটু কমল! বাসায় আরও কিছু বাচ্চাকাচ্চার আওয়াজ পাচ্ছি! নিশ্চয়ই চারতলার দুষ্টু ছেলেটা বন্ধুবান্ধবসহ এসেছে। এই ছেলে একবার আমার রেডি করা অ্যাসাইনমেন্টে লাল মার্কার পেন দিয়ে দাগিয়ে রেখেছিল। আমি জানতামও না! স্যার অ্যাসাইনমেন্ট ফেরত দিয়ে আমাকে যা খুশি তাই বলে বকা দিয়েছিলেন। আমি বাসায় এসে ওই ছেলেটার কান মলে দিয়েছিলাম বলে ওর মা এরপর সে কি রাগ আমাদের সাথে!
আমার মাকে বললেন – চাচী। মেয়ে তো বড় হয়েছে। ওর ও তো বিয়ে হবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে। তখন দেখব।
মাও উল্টো আমাকে বকে দিলেন- এত বড় হয়েছিস জমা দেওয়ার আগে নিজের অ্যাসাইনমেন্ট চেক করে দিবি না?
একবার আমার কাজিনের এক ছেলে হয়েছে। সবাই দেখতে গেলাম। সে সুন্দর সবার কাছে গেল কিন্তু আমার কোলে এসেই আমাকে ভিজিয়ে দিল। আমাকে মানে আমার মুখ! এটা দেখে সবার কি হাসাহাসি! যেন কি এক কৌতুক হয়েছে! আর সারাদিন চ্যাওম্যাও!
এইসব কারণে আমি বাচ্চাদের ভয়াবহ রকম অপছন্দ করি! তাদের দেখলেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়! আর মেজাজও খারাপ হয়ে যায়! আর আমার ভাগ্যটাও! আমি যেখানে থাকব সেখানে বাচ্চারা আসবেই! এই তিতুনের জন্মের পরে আপা দুই-তিনমাস আমাদের বাসায় ছিলেন। এরপর আশেপাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাকাচ্চা তো আছেই। আর এখন এই ভাইয়ার মেয়ে!
আমি দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে পড়তে বসি। বসে মনে হল আমি ভেউভেউ করে কাঁদি। কারণ সিলেবাসের আগামাথা কিছুই পারি না। কিভাবে কভার করব এত বড় সিলেবাস সেটাও বুঝতে পারছি না! অসহ্য!!
সন্ধ্যার সময় খালা এসে দুইবার নক করে গেল। বাসাভর্তি মেহমান। আর এরমধ্যে আমি দরজা আটকে বসে আছি খুব নাকি খারাপ দেখা যায়! আমাকে গিয়ে হাই-হ্যালো করে আসতে বলল। অতি কষ্টে তাকে দুইবার বিদায় করলাম। এরপর আবার জানি কে নক করল! আরে যন্ত্রনা!
আমি গেট খুলে বকা দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু গেট খুলে দেখি নিশা দাঁড়িয়ে আছে। নিশা আমার খালার মেয়ে। আমার থেকে এক বছরের বড়। সে পড়া শেষ করে চাকরি করছে আর মাস্টার্স করছে। নিশার সাথে আমার খুব খাতির। আমরা সবকিছু শেয়ার করি। কিন্তু আজ তাকে দেখে আমি চমকে উঠি! তার চোখমুখ ফুলে আছে!
তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজাটা আবার বন্ধ করে জিজ্ঞেস করি – কি হয়েছে তোর?
সে কাঁদতে কাঁদতে বলে – আমার ভালবাসায় কি কোন কমতি ছিল বল বৃষ্টি? আমার সাথে শিহাব কেন এরকম করল? কেন?
– কি করেছে ভাইয়া?
– ভ্যালেন্টাইন্স ডে-এর আগে সে আমার সাথে এটা কি করে করতে পারল?
– কি করল সেটা বল!
– আজ.. আজকে দেখি সে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে!
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে বলি- তোকে কি বড়আপার রোগে ধরেছে? অতি অভিনয় কেন করছিস? সে কি তোর জন্যে মেয়েদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে?
সে হড়বড় করে বলে- না না! তুই বুঝতে পারছিস না! সে খুব ক্লোজ হয়ে কথা বলছিল! হাসাহাসি করছিল!
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম- তাকে জিজ্ঞেস কর! করেছিলি?
– না! আমি রাগ হয়ে কথা বলছি না!
এই সময় তার ফোনটা বেজে ওঠে! শিহাব ভাইয়া ফোন করেছে!
আমি বললাম – যা ধর!
– আমি ওর সাথে কথা বলব না!
– থাপ্পড় মারব কষে! যা বললাম!
নিশা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে যায়। রুমে আবার কে যেন এসে নক করে। ইশশ! আমার দিনটাই খারাপ! আবার নিশ্চয়ই ডাকতে এসেছে।
বাইরে থেকে দুলাভাইয়ের গলা পেলাম – ভেতরে আসতে পারি?
এতগুলো মানুষের মধ্যে একমাত্র দুলাভাইকে আমার সেন্সিবল মনে হয়। দরজা খুলে দিলাম।
দুলাভাই তিন কাপ চা নিয়ে এসেছেন।
আমি বললাম – আমাকে বলতে। আমি নিয়ে আসতাম।
– আপনার যা মেজাজ দেখছি আজকে! সপ্তমে চড়ে আছে! বাইরে যাসনি ভাল করেছিস। বাইরে বাবুর নাম ঠিক করা হচ্ছে! তোর বড়আপা টুনটুনি, ঝুনঝুনি টাইপের নাম সাজেস্ট করছে!
আমি হেসে ফেললাম!
– তা মানিকজোড়ের আরেকজন কই?
– আরে! ও আরেক পাগল!
নিশা বারান্দা থেকে কথা বলে ফিরে এল! তার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে!
– এই জানিস! ওইটা তো ওর কাজিন ছিল!
– দেখেছিস? খামোখা হাউকাউ করে মন খারাপ করে থাকলি!
নিশা বলে- খামোখা না রে! আগে প্রেম কর! তারপর বুঝবি!
– আমার অত বোঝার দরকার নেই বাবা! যেটা এত বছরে করিনি সেটা আর এখন করতেও চাই না!
দুলাভাই হেসে জিজ্ঞেস করলেন- তুই কিভাবে জানিস? হয়তো এই ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তেই তোর প্রেম হয়ে গেল!
– মাফ চাই! নিজের টেনশনেই বাঁচি না! প্রেমটা নাহয় বিয়ের পরেই হোক!
নিশা জিজ্ঞেস করে – ভেবে বলছিস তো? বিয়ের পর প্রেম, তারপর বাচ্চাকাচ্চা.. আর ভাইয়া কে যেন বাচ্চাদের খুব ভালবাসে?
দুলাভাই হেসে দিলেন!
আমি আঁতকে উঠে বললাম – কি সর্বনাশ! থাক বাবা! আমি বিয়েই করব না!
এরপর ঘড়ি দেখে আরেকবার চমকে উঠে বললাম – সেরেছে! এই তোমরা এখন যাও! আটটা বাজে! আমার এখনো অর্ধেকও শেষ হয়নি! আগামীকাল বাকি কথা হবে!
যদি শান্তি মত সব করতেই পারতাম তাহলে তো এইটা আর আমাদের বাসা হত না। একঘন্টা পড়তে না পড়তেই বাইরে প্রচন্ডরকম চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল! কে যেন হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছে। এটা যে বড়আপা সেটা আমি না দেখেই বলে দিতে পারছি! সে ছাড়া কেউ এখন নাটক করবে না। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় বাসায় কখনো পানি না থাকলে আপাকে মাঝেমধ্যে কাঁদিয়ে দিলেই হয়! অগত্যা বের হতেই হল!
মাকে দেখলাম মুখ শক্ত করে কোথায় যেন যাচ্ছেন।
জিজ্ঞেস করলাম- কি হয়েছে মা?
মা বললেন – মহারাণী এতক্ষণে বের হয়ে আমাকে ধন্য করেছেন! এবারে দয়া করে গিয়ে দেখুন কি হয়েছে!
শব্দের উৎস অনুসরণ করে ভাইয়ার রুমে উপস্থিত হলাম! আপা হাপুস নয়নে কাঁদছে। দুলাভাই অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবীর মা-বাবা আর ভাইকেও দেখলাম লজ্জিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে! বাবাকে একপাশে নিরস মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম!
এগিয়ে গিয়ে তাকেই জিজ্ঞেস করলাম- কি হয়েছে বাবা?
– কি আবার হবে? তোমার আপু তিতুনের সাথে মিলিয়ে বাবুর ডাকনাম রাখতে চেয়েছে টুনটুন। বৌমার ভাই বলেছে এটা আবার কেমন আজব নাম! সেই থেকে নাটক শুরু হয়েছে!
ভাবী বলল- না ঠিক আছে! আপা যেটা বলেছেন ডাকনাম সেটাই হোক! অসুবিধা কি?
ভাবীর মা তাড়াতাড়ি বললেন- না আমাদেরও কোন অসুবিধা নেই!
আমার ভাইয়া বলল- আচ্ছা থাক আমরা নাম পরে নির্বাচন করব! ভোট করব! ওকে?
এদিকে আপা কেঁদেই যাচ্ছে।
দুলাভাই এবার কঠিন কন্ঠে বলে- রূপরেখা বাসায় চল! অনেক হয়েছে!
আপা বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে- নাম ঠিক করে কি ডাকতে হবে আমাকে জানিয়ে দিও তোমরা!
ভাবী পেছন থেকে ডাক দিলেন- আপা প্লিজ রাগ করে যাবেন না!
– রাগ আর কি? তোমাদের বাচ্চা! তোমরাই বোঝ!
আমি অসহ্য হয়ে বেরিয়ে এলাম!
নিশা এসে বলে- বৃষ্টি তোর ঘরে না কিসের যেন উটকা গন্ধ! তখনও পেয়েছি!
– হ্যাঁ তিতুন আর বাবু আমার রুমকে নিজেদের টয়লেট বানিয়ে ফেলেছে!
– সে তো অনেকক্ষণ আগে! আর তুই ফ্রেশনার দিসনি?
– দিয়েছি!
– তাহলে গন্ধ থাকবে কি করে?
আমার কাছে গন্ধ লাগছিল না। মনে হয় আমি অনেকক্ষণ থাকায় সয়ে গিয়েছে! রুমে ঢুকেই নিশা নাক কুঁচকাল! আমি আর নিশা খুঁজে দেখি তিতুনের ডায়পার আপা আমার খাটের পাশে বাস্কেটে ফেলে রেখেছে! হায় আমার কপাল!
জীবনটা কোন রূপকথা নয় যে আধাখ্যাঁচড়া পড়েই আমি ভাল পরীক্ষা দিয়ে দিব! আমার পরীক্ষা ভয়াবহ রকম খারাপ হল। টেনেটুনে পাশ করতে পারি! তাও একটা প্রশ্নের উত্তর যেটা লিখেছি সেটা যদি সঠিক হয় তাহলে পাশ। নাহলে ওটাতে দশ মার্কস কাটা। ওই প্রশ্নটায় অংকের মতো নাম্বার সঠিক হলে দশ মার্কস। ভুল হলে আমি ফেল! পরীক্ষা শেষ করে প্রচন্ড মন খারাপ করে বাসায় এসেছি। অনেক টেনশন হচ্ছে। একপর্যায়ে মনে হল উত্তরটা মিলিয়ে ফেলি। কি আছে আর? অন্তত রেজাল্ট পর্যন্ত তো আর টেনশনে থাকতে হবে না। বইতে উত্তরটা সরাসরি পেলাম না। ভাবছি সুমিকে ফোন দেব। সুমি আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। সুমির নাম্বারে ফোন দিলাম। সুমি কয়দিন আগেই নতুন নাম্বার নিয়েছে। এই নাম্বারে সুমির সাথে আগে কথা হয়নি!
দুইটা রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ বলে- হ্যালো। আসসালামু আলাইকুম।
কণ্ঠটা শুনে আমি আমার চারপাশ ভুলে গেলাম! এত সুন্দর কণ্ঠ কোন মানুষের কি করে হতে পারে! তার উচ্চারণ করা তিনটি শব্দে যেন এক একটি মোহ জড়িয়ে আছে! আমি এত গান শুনেছি, আবৃত্তি শুনেছি কিন্তু এত সুন্দর গভীর, ভরাট কণ্ঠস্বর কোনটি মনে হয়নি! আমি যেন স্বপ্ন দেখছি! এক ঘোরের জগতে আমি চলে গিয়েছি, মোহাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছি! শুধুমাত্র তিনটি কথা আমার ভেতরটা ওলট-পালট করে দিল! সেটা শুধুমাত্র কণ্ঠটার জন্যই! মনে হল আমি সারাটা জীবন এই কণ্ঠস্বর শুনে কাটিয়ে দিতে পারব! ঘোরটা কাটল সেই কণ্ঠের ডাকেই!
– হ্যালো!
আমি কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম- সুমি আছে?
– স্যরি! সুমি নামের কাউকে তো চিনি না!
আহা! কি সুন্দর কণ্ঠ! কি সুন্দর করে কথা বলছে! আমি জানি সুমিরা দুইবোন। আর তাছাড়া সে বলছে সুমি নামের কাউকে সে চিনে না।
আমি তবুও একবার জিজ্ঞেস করলাম- শিওর?
ওপাশের কণ্ঠস্বরটা এবার হেসে দেয়!
ইশশ! এত্ত সুন্দর হাসি! মনে হল সমুদ্রের একরাশ জলরাশি যেন তীরে এসে আছড়ে পড়েছে!
হেসে সে বলে- জি শিওর। এইটা আমার নাম্বার। আপনি রং নাম্বারে ডায়াল করেছেন।
– স্যরি!
– নো ইট’স ওকে। রাখছি!
ফোনটা কেটে গেলেও আমি ভাল লাগা নিয়ে একইভাবে বসে থাকি!
হঠাৎ করেই আমার বান্ধবী জয়া ফোন করে।
আমি ফোনটা ধরেই বললাম – আমাকে সুমির নাম্বারটা দিবি একটু?
জয়া বলে – দিচ্ছি! কিন্তু তুই জানিস? চার নম্বর প্রশ্নটা এসেছিল না? যেটাতে দশ মার্কস ছিল?
আরে এটাই তো সেই প্রশ্ন যেটা আমি সুমিকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম!
আমি দুশ্চিন্তা নিয়ে বললাম – হুমম…
– ওইটা আমার ভুল গেছে। স্যারকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম!
উত্তরটা শুনে বুঝলাম আমি যেটা লিখেছি সেটা ঠিক হয়েছে! যাক ফেলটা অন্তত আটকানো গেল!
জয়া সুমির নাম্বার দিলে আমি মিলিয়ে দেখলাম! কি আশ্চর্য! শুধু সিমটা এক কোম্পানির! এছাড়া একটা ডিজিটও জয়া যে নাম্বারটা দিয়েছে তার সাথে মিলে না! কি আজব! আমি তাহলে এই ভদ্রলোকের নাম্বার কোথায় পেলাম? আর কেনই বা সেটা সুমি নামে সেভ করে রাখলাম? চিন্তা করে আমি কোন কূলকিনারা পেলাম না! বিরক্ত হয়ে চিন্তা করা বাদ দিলাম! হয়েছে হয়তো কোনভাবে!
কিন্তু আমি শান্ত হতে পারলাম না। সারাদিন আমার অশান্তি লাগতে থাকে, কেন জানি আমি ছটফট করতে লাগলাম! কণ্ঠটা আরেকবার শোনার জন্য, আবার কথা বলার জন্য আর তাকে চেনার জন্য আমার ভেতরটা ওলট-পালট হয়ে যায়! রাতেরবেলা শুয়ে শুয়ে একা একা অনেকক্ষণ কাঁদলাম! কেন তা আমি নিজেও জানি না! হঠাৎই আমি উঠে বসলাম। চোখ মুছে ঠিক করলাম এই কণ্ঠস্বরের অধিকারীকে আমার খুঁজে বের করতে হবে। করতেই হবে!
[চলবে]