বৃহন্নলার ডিভোর্স পর্ব-তিন মাহাবুবা বিথী

#ধারাবাহিকগল্প
বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-তিন
মাহাবুবা বিথী

জীবনের অনুষঙ্গ নিয়ে নাটক সিনেমা তৈরী হয়।কিন্তু কখনও জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নাটক সিনেমাকে হার মানিয়ে যায়।
পাড়াপ্রতিবেশী দুঃসম্পর্কে আত্মীয়স্বজন বউ দেখতে এসে আবীরের মাকে বলে,
—–আপা তোমার হ্যাংলা শুকনা পটকা ছেলের জন্য
নাদুস নুদুস ফর্সা বউ পেয়েছো। তোমার বুবু বউ ভাগ্য কপাল।
এই কথা শুনে আবীরের মা সগৌরবে হাসে। এরমাঝে রুমির বিবাহিত জীবনের মাসখানিক সময় পার হয়ে যায়। রুমি বুঝে ফেলে তার স্বামী আবীর শারীরিকভাবে সক্ষম পুরুষ নন। সংসার হয়তো ওর একটা হবে তবে স্বামী বলে যা বুঝায় তা ওর কপালে নেই। রুমি ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে ওর ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া উচিত। আবীর রুমির কথা মানতে চায় না। এদিকে আবীরের মা রুমির উপর দিনদিন অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। রুমিকে নিয়ে এসে আবীরের মা কৌশলে কাজের খালা বিদেয় করে দিয়ে রুমির উপর সংসারের সমস্ত কাজ চাপিয়ে দেয়। তারউপর সেদিন খাবার টেবিলে রুমিকে বলে,
—–তোমার মাতো বিয়ের দিন আমার ছেলেকে আস্ত খাসি দিতে পারেনি আর তুমিতো বহাল তবিয়তে গান্ডেপিন্ডে গিলছো। যাক তুমি তো আমার ছেলের বউ। তোমার হাতীর খোরাক তো আমার ছেলেকেই বহন করতে হবে। তবে এখন খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দাও। রুমি তোমারতো বয়সও বেশী। তারউপর তুমি বেশ মোটা। তোমার তলপেট ভারী।বাচ্চা হতে সমস্যা হবে। তাই তুমি শুধু সবজি দিয়ে ভাত খাবে। তোমার জন্য আপাতত মাছ বা মাংসের বরাদ্দ নেই। আর আবীরেরও বেশী মাছ মাংস খাওয়ার দরকার নেই। ও মোটা হয়ে যাবে।বরং সাব্বিরের দরকার। ওর অনেক পরিশ্রম হয়।
রুমি ওর শাশুড়ীকে বললো,
—-আপনার ছেলেরও খাওয়া উচিত।ও শারীরিক ভাবে দুর্বল।
অমনি আবীরের মা বলে উঠলো,
—-আমার ছেলের ভালমন্দ আমি বুঝে নিবো।তুমি আমাদের মা ছেলের মাঝখানে ঢুকবে না।
বিয়ের আগে দুর্বল ছিলো না। তোমার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে আমার ছেলে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
রুমি অপমানে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। একবার রুমির মনে হলো ওর মাকে বলে দেয়া উচিত আপনার ছেলেতো শারীরিকভাবে অক্ষম।আবার আবীরের কথা ভেবে ও নিজেকে সামলে নেয়।
রুমি অবাক হয়ে আমাকে বলে,
—-আপু আমি ভাবি ওনার ছেলের সমস্যা কি উনি জানেন না? নাকি জেনেও না জানার ভাণ করেন।হয়তো ধরেই নিয়েছেন ওনার ছেলে সুস্থ হবে না সুতরাং ওকে খাইয়ে লাভ নেই। শুধুই অন্নের ধ্বংস।

আবীরের মা ওকে খাওয়ার খোঁটা দিলো অথচ এই একমাসে রুমির ওজন পাঁচ কেজি কমে গেছে। ও আমাকে বললো,
—–আপু সকালে আমাকে দুটো রুটি সাথে সবজি আর এককাপ লাল চা, দুপুরে সবজি ডাল আর ভাতও ওনার মেপে দেওয়া। মোটার উছিলায় রাতেও দুটো রুটি আর অল্প একটু সবজি। এ বাড়িতে এটাই আমার বরাদ্দ।
আমি রুমিকে জিজ্ঞাসা করি,
—-আবীর জানতো না ওর মা যে তোমার উপর টর্চার করে।
রুমি বললো,
—-ও কেমন যেন রোবটের মতো ছিলো। সময় মতো খাওয়া অফিসে যাওয়া আর ঘুমানো এই ওর কাজ ছিলো। সংসারের কোনদিকে ওর খেয়াল ছিলো না।
আমি রুমিকে বললাম,
—-তোমার স্বামী যে শারীরিকভাবে সক্ষম নয় এটা তুমি তোমার মাকে জানাওনি?
রুমি বললো,
—-আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।মা আমাকে চারভরি গয়না ছেলের পোশাক আংটি ঘড়ি খাওয়া দাওয়া সব মিলিয়ে আমার বিয়েতে দশলক্ষ টাকা খরচ করেছেন। অনেক ধার দেনা করে মা টাকাটা যোগাড় করেছেন। এখন এই বিষয়টা মাকে জানালে মা অনেক আপসেট হয়ে পড়বে। মার প্রেসার ও কিডনির সমস্যা আছে। কিছুদিন আগে বাবাকে হারিয়েছি। মা ছাড়া আমাদের কেউ নাই। এসব কারনে মাকে জানানো হয়নি। মা জানত, আমি অনেক সুখে আছি। আমিও মুখ বুজে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
আমি রুমিকে বললাম,
—-তোমার শাশুড়ীর এসব আচরণে তোমার স্বামী শ্বশুর কেউ প্রতিবাদ করতো না?
রুমি বললো,
—-আবীরতো আমাকে আগেই বলেছে ও কোনদিন ওর মার মুখের উপর কথা বলতে পারবে না। আর শ্বশুরও কিছু বলতে পারতো না কারণ এই ফ্লাটটা আমার নানা শ্বশুর আমার শাশুড়ীকে দিয়েছে। তাই শ্বশুর কিছু বললে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিতো। আমার শাশুড়ী কোনদিন ওনার ছেলেদের দিয়ে কোন কাজ করাননি। বাজার করা,বিল দেওয়া,কাপড় ইস্ত্রি সংসারের এ ধরনের কাজগুলো আমার শ্বশুর করতো। আমি ঘরের যাবতীয় কাজগুলো করতাম। এমনকি ওনার হুকুম ছাড়া আমি ফ্যানও ছাড়তে পারতাম না।
আমি মনে মনে ভাবি,
এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ সমাজে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে বেড়ায়।কিন্তু সময়ের আবর্তে তাদের বিকৃত মানসিকতার চেহারা উম্মোচিত হয়।এই ঘুণে ধরা সমাজে নারীর উপর অত্যাচার আজও হয়ে যাচ্ছে। যতই আমরা নারী জাগরণ কিংবা নারী স্বাধীনতা বলে চিৎকার করিনা কেন প্রতিটি ঘরে কান পাতলে নারীর অত্যাচারের হাহাকার শোনা যায়। এক্ষেত্রে অনেক সময় নারীরাই নারীদেরকে অত্যাচার করে।
কোন কোন ক্ষেত্রে হয়ত কিছু মেয়ে উশৃঙ্খল জীবন যাপন করে তাদের সংখ্যা নেহায়েৎ খুব কম।

এই উপমহাদেশে মেয়েরা বিয়ে করে না তাদেরকে বিয়ে দেওয়া হয়।অনেক বাবা মাই মেয়ে স্বাবলম্বী করতে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত তার থেকে বিয়ে দেওয়াটা বেশী গুরুত্ব মনে করে।
রুমিকে দেখে আমার খুব মায়া হয়।সারাদিন সংসারে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে আবার শারীরিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে রাতটুকু পার হয়ে যায়।প্রকৃতিগত ভাবে নারী পুরুষ উভয়ের শারীরিক চাহিদা থাকে। সেক্ষেত্রে নারীরা তার ভরা যৌবনের লাগাম টেনে রাখতে পারে।
আমি রুমিকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-তুমি কখনও আবীরের এই সমস্যার কথা তোমার শাশুড়ীকে জানাওনি?
রুমি বললো,
—-না আমার ওনাকে বলার সাহস হয়নি।তবে আকার ইঙ্গিতে আবীরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি।আমার ধারণা ছিলো আবীর যদি ডাক্তার দেখাতে রাজি হয় তাহলে শাশুড়ীকে জানানোর দরকার নাই। শাশুড়ী জানলে এতে শুধু অশান্তি বাড়বে বই কমবে না। এর মাঝে আমার পিরিয়ড হলো। আমার পিরিয়ডের কথা শুনে শাশুড়ী আমার মাকে ফোন দিয়ে বললেন,
—–আপনার মেয়ের মনে হয় কোন সমস্যা আছে। ওতো কনসিভ করলো না।
আমার মা বললো,
—-কেবলতো ওদের বিয়ের একমাস হয়েছে।বাচ্চা হওয়ার সময়তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।
শাশুড়ী বললো,
—-আপনার মেয়ের তলপেট বেশ ভারী। বিচার বিবেচনা না করে আমার ছেলেকে চটজলদি বিয়ে দেওয়াটা ঠিক হলো না। যাক যা হবার তাতো হয়ে গেছে।দেখি নাতির মুখ দেখার ভাগ্য আমার কপালে আছে কিনা কে জানে।বেয়াইন ফোনটা রাখলাম।
আমি রুমিকে বললাম,
—-উনি যদি উনার ছেলের ত্রুটি গোপন করে তোমার সাথে বিয়ে দেয় তাহলে উনি তো একটা ক্রাইম করেছেন। তুমি যদি মেডিকেল রিপোর্ট যোগাড় করতে পারতে তাহলে উনার বিরুদ্ধে মামলা করা যেতো।
রুমি বললো,
—-আপু আমার অত কিছুর দরকার ছিলো না।শুধু আবীরের কাছে ভালবাসা চেয়েছিলাম। যে ভালবাসা শুধু শরীর ছোঁয় সে ভালবাসা নয়। সেই ভালবাসাই চেয়েছিলাম যা শরীরকে ছাড়িয়ে আত্মাকে ছুঁয়ে দেয়। আমাদের যদি বাচ্চা না হতো একটা বাচ্চা দত্তক নিতাম। সাব্বিরের বিয়ে দিলেই তো ওর বাচ্চা হতো। ওই বাচ্চাই এদের নাতির সাধ মিটাতো। শুধু একটু ভালবাসার জন্য মুখ বুঝে সবটা সহ্য করতে চেয়েছি কিন্তু শেষটা আর রক্ষা করতে পারলাম না।উগড়ে দিলাম।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here