বৃহন্নলার ডিভোর্স পর্ব-চার

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-চার
মাহাবুবা বিথী

রুমির ঠিক মতো খাওয়া বিশ্রাম না হওয়ায় একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। ওই দিন ছুটির দিন। আবীর বাসায় ছিলো।রুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।সেন্স আসার পর আবীরের মা আবীরকে বললো,
—ওকে বাপের বাড়ি রেখে আয়। ওর অসুখের পিছনে টাকা খরচ করার মতো সস্তা টাকা আমার নেই।
আবীরও মার কথামতো রুমিকে রেডী হতে বললো। ওদের অবহেলায় রুমির খুব কান্না পাচ্ছিলো। রুমি আবীরের দিকে তাকিয়ে ভাবলো,এই কিনা ওর স্বামী। সারাটা জীবন এর সাথে রুমি কিভাবে কাটাবে? এই ভাবনায় রুমি শিউরে উঠলো। অগত্যা
আবীরের সাথে রুমি ওর বাপের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো।
রুমি আমাকে বললো,
—আপু মানুষ যে এতটা নীচ হতে পারে তা আমার শাশুড়ীকে না দেখলে আমি বুঝতে পারতাম না। আমি সেটেল ম্যারেজে করতে চেয়েছিলাম।কারণ আমার অনেক বান্ধবীকে দেখেছি বিয়ের আগের প্রেমিক বিয়ের পরে তথাকথিত স্বামী হয়ে যায় নয়ত ভিলেন হয়। প্রেমিক আর কেউ থাকে না।তাই আমি বিয়ের পরে প্রেম করতে চেয়েছিলাম।অথচ আমার কপালে এই লেখা ছিলো।
—আপু আমি জীবনের এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে বুঝেছি,পৃথিবীতে ভালভাবে বাঁচতে গেলে স্বামীর ভালবাসা নয়, আর্থিক স্বাধীনতা বড় বেশী প্রয়োজন।কারণ বিপদে পড়লে ভালবাসা নয় টাকার দরকার সবচেয়ে বেশী হয়।
মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকে গেলে ভীষণরকম কষ্ট অনুভব হয় আর নিজেকে বোকা নির্বোধ মনে হয়।

আমি ওর কষ্টগুলিকে হালকা করার জন্য বললাম,
—-তুমি বিষয়টা এভাবে না দেখে অন্যভাবেও দেখতে পারো। ওরা আসলে তোমার যোগ্য ছিলো না তাই তোমাকে মুল্যায়ন করার মতো সামর্থ ওদের নাই।

তারপর আবীর রুমিকে মায়ের কাছে নিয়ে যায়। রুমির মা রুমিকে দেখে চমকে উঠে বলে,
—-তোর শরীর এতো শুকিয়ে গেছে কেন?
রুমি কিছু বলার আগেই আবীর বলে,
—-আম্মা রুমি ইদানিং ডায়েট শুরু করেছে
রুমি মাকে আর কিছু বলেনি। কারণ মাকে ওর জীবনের কষ্টের কথাগুলো জানাতে চায়নি।
সেদিন দুপুরে মায়ের কাছে রুমি আর আবীর লাঞ্চ করে। হঠাৎ যাওয়াতে আয়োজনটা সাদামাটা ছিলো। ওর মা বাজার করার সময় পায়নি। মুরগীর মাংস সবজি ডাল ইলিশ মাছ ভাজি এই দিয়ে রুমি আর আবীর দুপুরের লাঞ্চটা করে নেয়। রুমির মা এতোদিন পর মেয়ে জামাইকে কাছে পেয়ে খুব খুশী হয়ে ছিলো।রুমির মা আবীরকে বলে,
—বাবা আবীর, আজকের রাতটা থেকে যাও। তুমি এতোদিন পরে আসলে রাতে একটু পোলাও রান্না করবো।
আবীর বললো,
—-মার কাছে অনুমতি নেওয়া হয়নি।
রুমির মা বললো,
—-ফোন করে বলে দাও যে তুমি আজ রাতটা এখানেই থাকবে।
আবীর বললো,
—-সেটা সম্ভব নয়।
রুমি ওর মাকে বললো,
—ও যখন থাকতে চাইছে না তুমি ওকে জোর করো না। কেন আমি আসলাম এতে তুমি খুশী না।
আবীর সেদিন চলে গেলো। রুমিকে পেয়ে ওর মা বোন অনেক খুশী। রুমির মা ওকে বললো,
—-হ্যারে রুমি, তোকে কে বেশী আদর করে। তোর শ্বশুর না শাশুড়ী।
রুমিও মনের দুঃখ মনে চেপে বলে,
—-দুজনেই আমাকে খুব আদর করে।
মা রুমিকে বলে,
—-আর আবীর তোকে যত্ন নেয়।
রুমিও মাকে বলে
—-ও একটু মা ভক্ত ছেলে। তবে আমার খুব খেয়াল রাখে। ডায়েট করি বলে আমার উপর মাঝে মাঝে রেগে যায়।
রুম্মান রুমিকে বলে,
—-আপু তুই আমাদের কাছে কোনকিছু লুকোচ্ছিস নাতো?
রুমির মা রেগে গিয়ে বলে,
—-দেখ রুম্মান, কোন অলুক্ষণে কথা বলিস না।
ওতো নিজ মুখেই বলছে ও খুব ভাল আছে।
রুমির মা রুমিকে আবারো জিজ্ঞাসা করলো,
—–হ্যারে রুমি তোর ব্যাকপেইনের সমস্যাটা আছে। তোর শাশুড়ী তো বেশ শক্ত সামর্থ। তোকে মনে হয় খুব বেশী কাজ করতে হয় না।
রুমি বলে,
—-হ্যা,শাশুড়ী আমাকে খুব বেশী কাজ করতে দেন না।
আসলে সত্যিটা রুমি মাকে বলতে পারলো না। শ্বশুর বাড়িতে ঘর মোছা বাথরুম ধোয়া থেকে শুরু করে সবকাজই ওকে করতে হয়। আর রাতে সারাশরীরে ব্যাথায় ছটফট করে কেটে যায়। ওর বিয়ে নিয়ে ওর মায়ের এখনও আত্মীয় স্বজনের কাছে লোন রয়েছে। কবে যে শোধ হবে ও জানে না। আর এক বিয়ে নিয়ে মিডিয়া সেন্টার থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজন সবার কাছে এতো কথা শুনতে হয়েছে, নানা রকম অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে যে ও নিজেই চাচ্ছিলো একটু মানিয়ে নিতে। আর পাশাপাশি চাকরির চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছিলো।
মিরপুর এক নাম্বারে একটু গলির ভিতরে জোনাকী রোডে তিনকাঠা জমির উপরে রুমিদের একতলা বাড়ি। বিয়ের আগে রুমি আর রুম্মান একরুমেই থাকতো। আজ তিনমাস পর দুইবোন একসাথে শুয়েছে। রুম্মানের রুমিকে দেখে কেমন সন্দেহ হয়।
রুম্মান রুমিকে জিজ্ঞাসা করে,
—-আপু তুই সুখীতো?
রুমিও কথা ঘুরিয়ে উত্তর দেয়,
—-রুম্মান সুখ কাকে বলে জানিস? জানিস না। কারণ সুখ আপেক্ষিক।কোটি টাকার মাঝেও সুখের সন্ধান পাওয়া যায় না আবার অভাবের সংসারে সুখের নিবাস গড়ে তোলা যায়। অনেকে বলে ত্যাগের মাঝে কোন সুখ নেই। কেউ আবার ত্যাগের মাঝে পরিপূর্ণ সুখ খুঁজে পায় যদি ভালবাসার সঠিক মানুষটাকে সঙ্গে পায়। আমার কথা থাক। এখন তোর কথা বল। খুব ভালকরে লেখাপড়া কর। তুই তো এখন থার্ডইয়ারে। ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে বের হতে আর এক বছর লাগবে। চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিয়ে করবি।
রুমি একসময় বুঝতে পারে রুম্মান ঘুমিয়ে পড়েছে। বিয়ের পর থেকেই রুমির চোখের ঘুম হারিয়ে গেছে।

রুমি ভাবছে যে জায়গাটা নিজের নয় সেখানে জোর করে থাকতে গেলে নিজেকেই ছোটো করতে হয়। ওর এই জীবন থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাবে ও কোনকিছু বুঝে উঠতে পারছে না। এই কয়দিনে ও এইটুকু বুঝে গেছে আবীরের ভালবাসা ওর কপালে জুটবে না। ভালবাসা এমন একটা অনুভব সবসময় ওর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। আবীর আসলে একটা মেরুদন্ডহীন প্রাণী।

আধোঘুম আধো জাগরণে কোনরকমে রাতটা পার করে রুমি। রুমির মা ও রুম্মান দুজনেই খেয়াল করে রুমি কেন যেন সারাদিন আনমনা হয়ে থাকে। গভীর ভাবনায় ডুবে থাকে। তাই রুম্মান মাকে বলে,
—-আম্মু জারার আম্মু বলছিলো আপুকে নিয়ে ওদের বাসায় বেড়াতে যেতে। জারা মেসেজ পাঠিয়েছে।
রুমির মা অমত করে না। রুম্মান রুমিকে নিয়ে বিকালে জারাদের বাসায় বেড়াতে যায়।
জারা হচ্ছে রুম্মানের স্কুল ফ্রেন্ড।ওদের দুই পরিবারের বেশ আসা যাওয়া ছিলো। জারার আম্মুর ইচ্ছা ছিলো ওনার ছেলের বউ করে রুমিকে ঘরে তুলবে। জারার ভাই ইন্টার কমপ্লিট করে জার্মানিতে পড়তে চলে যায়। জারাদের আর্থিক অবস্থা রুমিদের থেকে অনেক ভাল। এই কারনে রুমির মার একটু অমত ছিলো। ওদিকে জারার ভাই এক বিদেশীনিকে বিয়ে করে। যার ফলে দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠল না।
রুম্মান রুমিকে নিয়ে জারাদের বাসায় পৌঁছে যায়। জারার মা রুমিকে দেখে অনেক খুশী হয়। অবাক হয়ে রুমিকে জিজ্ঞাসা করে,
—–তুমি এতো শুকিয়েছ কেন?
রুমি বলে,
—ডায়েট করছি তো তাই একটু শুকিয়েছি।
জারার মা বলে,
—-বেশী ডায়েট করোনা অসুস্থ হয়ে যাবে। সাংসারিক কিছু কথা বলে জারার মা ওদের গল্প করতে বলে কিচেনে চলে যায়।
জারার ভাই রায়হান ও কদিন আগে আমেরিকা থেকে ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছে। ওদের দুই পরিবারের আগেই জানাশোনা ছিলো। এতোদিন পর রুমিকে দেখে রায়হান চোখ ফেরাতে পারে না। রায়হান ভাবে মেয়েটার এতো সৌন্দর্যের মাঝেও কোথায় যেন বেদনার ছায়া লুকিয়ে আছে। রুমিরও রায়হানকে আগেও ভাল লাগতো এখনও ভাল লাগে। ওরা দুজনে বেশ আড্ডা দেয়। তারপর খাবার টেবিলে জারাদের বাসায় পাস্তা খেতে গিয়ে রুমি হঠাৎ বিষম খায়। রায়হান চটজলদি গ্লাসে পানি এগিয়ে দেয়। রুমির খুব ভাল লাগে। অথচ আবীরের কাছ থেকে এই সামান্য কেয়ারিং টুকু ও কখনও পায়নি। যাক অনেকদিন পর রুমি খুব সুন্দর একটা সময় পার করে।
ওদিকে আবীরের মা সাতদিন ধরে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে। বিনা বেতনে পাওয়া কাজের মেয়ে হাতছাড়া করতে উনারও মন চায় না। বসে থেকে কুটকচাল করে সময় কাটাতে উনার ভালই লাগে। অতঃপর রুমির মাকে ফোন দেয়।
—–হ্যালো বেয়াইন কেমন আছেন। আমার রুমি মা কেমন আছে। আপনার বেয়াইতো ওকে চোখে হারায়। আমারও ঘর খালি খালি লাগে। ওকে এখন পাঠিয়ে দিলে হয় না।
রুমির মা আনন্দে গদগদ হয়। মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে এতো আদর পায়। খুশীতে আবীরের মাকে বলে,
—-ওতো এখন আপনাদের বাড়ির মেয়ে। আপনি যখন বলছেন দুএকদিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দিবো।

রুমি আর রুম্মান আনন্দের আতিশয্যে বাড়ি ফিরে আসে। এমন সময় রুমির মা রুমিকে বলে,
—-তোর শাশুড়ী ফোন দিয়েছিল। মারে তোকে ওরা খুব ভালবাসে। তাই আর থাকতে পারছে না। তোকে যেতে বলেছে।
মায়ের কথা শুনে রুমির পূর্নিমার আলোর মতো ঝলকানো চেহারাটা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here